একটা বৈশাখী সন্ধ্যায় মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে। একটা চিল্ড বিয়ার আর কাজু বাদাম-সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ–এই আমাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু-একজন বড়লোকবাবুর সন্ধ্যাযাপন।
ওরে পচা একটু থাম না-এর মধ্যে চিকিৎসা–সোনার পাথরবাটি এসব কথা ভালো লাগে?
দাদা একটু শুনুন কোনও কোটেশন নয় তত্ত্ব কথা নয়–সহজ সরল দুটো কথা বলে নিই। তারপর আপনি নেশা করুন, আমি আপনাকে তালপাতার পাখা দিয়ে হাওয়া করি।
আপনি আপনার চিকিৎসা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত নন, তাই তো? কেননা আপনার বোধহয় কয়েক কোটি টাকার স্বাস্থ্য বীমা আছে–এছাড়া যা যা আছে ওসব বললে আপনি লজ্জা পাবেন। লজ্জা পেয়ে কাজ নেই তাই ওসব কথা থাক।
আমরা যাঁরা স্বচ্ছল তাঁদের কথাই বলি। গরীবের কথা শুনে শুনে কান ভোঁ ভোঁ করছে। আমাদের মধ্যবিত্তদের কথা কেউ বলে না ।
ঠিক ঠিক ঠিক।
এঁরা না পারেন সরকারি হাসপাতালে যেতে – ঘেন্না লাগে – তাই বেসরকারি ছাড়া গতি নেই। সুতরাং উদাহরণ হিসেবে যাঁরা আয়কর দ্যান তাঁদের নিয়েই আলোচনাটা হোক।
আমাদের দেশে ইনকাম ট্যাক্স ফাইল আছে আট দশমিক চার কোটি লোকের অর্থাৎ কিনা শতকরা পাঁচ দশমিক শূণ্য চার ভাগ লোকের আয়কর ফাইল আছে । এদের অনেকেরই বার্ষিক আয় পাঁচ লাখের নিচে। এবার ট্যাক্স দ্যায় এ্যামন লোকের সংখ্যা তিন দশমিক পাঁচ কোটি -অর্থাৎ শতকরা দুই দশমিক এক আট জন লোক আয়কর দ্যায়- অর্থাৎ এদের ইনকাম বছরে পাঁচ লাখের বেশী। এই সব হাই প্রোফাইল করদাতাদের কথা ভেবেই সমস্ত প্রাইভেট হাসপাতাল গড়ে ওঠে।
আপনি একটু ভাবলেন তারপর সহমত হলেন–তাই তো?
আমি তাতেই খুশী।অধৈর্য হবেন না। পিকচার আভি বাকি হ্যে।
আপনি কি ভাবছেন আমাদের দেশের প্রাইভেট হাসপাতালে মোট আট কোটি চল্লিশ লক্ষ বেড আছে?
দ্ধুর বাদ দিন ।
যে তিন কোটি পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ আয়কর দ্যায় তাদের সবাইকার জন্যেই কি বেড আছে?
এজ্ঞে না।
আমাদের দেশে প্রাইভেট হাসপাতালের সংখ্যা তেতাল্লিশ হাজার চারশো ছিয়াশি। মোট বেডের সংখ্যা এগারো লক্ষ আশি হাজার। আইসিইউ?
নিশ্চয়ই জানবেন। ঊনষাঠ হাজার দুশো চৌষট্টি। সব শেষে ভেন্টিলেটরের সংখ্যা জানাই ঊনত্রিশ হাজার ছশো একত্রিশ (তথ্য তেসরা নভেম্বর দু হাজার কুড়ি)।
এই রে মাত্র ঊনত্রিশ হাজার? এতে তো সকলের হবে না!
হয়তো আপনি ভাবছেন কোঈ পরোটা নেই– প্রাইভেটে টাকার অভাব নেই – ওরা ঠিক বেড বাড়িয়ে নেবে।
ভুল।
কেন ভুল একটু বোঝাই? ও এবার উৎসাহ পাচ্ছেন?
চমৎকার আপনার প্লেট থেকে একটা কাজুবাদাম নেবো?
ধন্যবাদ। এবার শুনুন।
এই সব প্রাইভেট হাসপাতালগুলো একেবারেই আপনার কথা ভেবে তৈরি হয়নি। এরা প্রত্যেকেই ব্যবসার জন্য- সঠিক অর্থে ব্যক্তিগত লাভের জন্য হাসপাতাল খুলেছেন। দেখবেন একটা বড়ো শহরের বড়ো হাসপাতালের বিজ্ঞাপন চারশো কিলোমিটার দূরের প্রত্যন্ত গ্রামেও দেখতে পাওয়া যায়। কেন?
যাতে এদের বিজ্ঞাপনের জৌলুসে গ্রামের দুঃস্থ অসুস্থ মানুষও সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অভাবে আরও নিঃশেষ হতে ঐ হাসপাতালে পৌঁছয় অথবা গ্রামের মফস্বলের উচ্চবিত্ত মানুষেরা এখানে এসে ওদের ব্যবসা বাড়াতে পারে। সব বিজ্ঞাপনেই প্যাকেজের বা চিকিৎসার আনুমানিক খরচের কথা লেখা থাকে(এর ফলে কিন্তু আপনার স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় গরীবে এসে ভাগ বসাচ্ছে)।
এরা সমস্ত ইনভেস্টমেন্ট করে ভবিষ্যতে লাভের কথা ভেবে। সুতরাং যে মহামারী দু বছর পর আর নাও থাকতে পারে তার জন্য আগাম বিনিয়োগ করা ওদের কাছে যুক্তিযুক্ত নয়। এবং মহামারী বাড়লে হয়তো সরকার ঐ সব হাসপাতাল অধিগ্রহণ করবে সেক্ষেত্রে কিছুতেই ঐ সব হাসপাতাল বাড়তি চিকিৎসার জন্য বিরাট কিছু করবে না। যতটুকুতে ওদের লভ্যাংশ ঠিক থাকবে ততটুকুই ওরা করবে এবং করবে একমাত্র তাদের জন্য যারা সমাজের বিত্তশালী মানুষ তাদের জন্য। তাতে আপনিও আপনার থেকে বেশী বিত্তশালী মানুষের জন্য হাসপাতালে ভর্তি পারলেন না-এটাও হতে পারে।
বিত্তশালী খবরের হেডলাইন হওয়ার জন্য একদিন গরীবকে রাস্তায় বসিয়ে খাওয়াতে পারে বা একবার মোটা টাকা খয়রাতি দিতে পারে। আজীবনের রেকারিং খরচা টেনে আনবে না।
সুতরাং হে উচ্চবিত্ত বন্ধু আপনার জন্য পড়ে রইলো সেই নোংরা স্যাঁৎলাপড়া, গন্ধাকামিজ মানুষের ভীড়ে ভীড়াক্কার সরকারি হাসপাতালের ছুঁচোয় চাটা বেড়ালমাখা কুকুর দৌড়োনো মেঝে।
আচ্ছা আপনি জানতে চাইছেন এরকমটা ক্যানো হচ্ছে?
এক কথায় বলতে গেলে আমাদের দেশনায়কদের চিন্তার দৈন্য । সংবিধান গঠনের ক্ষেত্রে মূল প্রভাব পড়েছে ব্রিটেন আর আয়ারল্যান্ডের। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আমেরিকার ধরণে। আর সমাজবাদী চিন্তা রাশিয়া থেকে নিয়ে। (এ বিষয়ে আম্বেদকর সাহেবের একটা চমৎকার স্বীকারোক্তি আছে
“ As to the accusation that the Draft Constitution has reproduced a good part of the provisions of the Government of India Act, 1935, I make no apologies. There is nothing to be ashamed of in borrowing. It involves no plagiarism. Nobody holds any patent rights in the fundamental ideas of a Constitution….” . এইখানে দিই দাঁড়ি)।
অর্থনীতি আর স্বাস্থ্যনীতি দুজনে হাত ধরে চলে। প্রাথমিক ভাবে অর্থনীতি হলো সমাজতান্ত্রিক। ধারদেনার দায়ে প্রধানমন্ত্রী শ্রী পি ভি নরসিমারাও সই করলেন ‘ডাবলুটিও’ চুক্তিতে। এটা উন্নয়নশীল দেশগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতা চুক্তি, যে দেশ এই সংস্থার কান ধরে আছে আমেরিকা(কর্ণধার হলো আমেরিকা) ফলতঃ আমেরিকার নীতি এই সব দেশ মানতে বাধ্য হয়।
এই রে আবার ঐসব বস্তাপচা কথাবার্তা চলে আসছে তো! ব্যস ব্যস তবে ক্ষ্যান্ত দিলাম।
শুধু বলি আমেরিকার জাতীয় আয়ের প্রায় সতেরো শতাংশ আসে স্বাস্থ্য থেকে। অর্থাৎ স্বাস্থ্যও ঐ দেশের একটা উপার্জনের রাস্তা। আর আমাদের দেশের জনসংখ্যা (শতকরা তেরো দশমিক দুই পাঁচ হারে বাড়লে) এখন হওয়া উচিত একশো ষাঠ কোটি। কিন্তু আয়কর দ্যায় ঐ সাড়ে তিন কোটি মানুষ । তাহলে বাকি একশো পঞ্চান্ন কোটি মানুষের যা হবে আপনারও তাই হবে।
সুতরাং আপনাকেও সবার জন্য স্বাস্থ্যের দাবীতে রাস্তায় নামতে হবে। এবার বিয়ার খান বা আফিহেন সেবন করুন। আমার কিছু আসে যায় না।
টাটা
সুন্দর লেখা!
ধন্যবাদ