আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।
এই তো জানু পেতে বসেছি, পশ্চিম
আজ বসন্তের শূন্য হাত—
ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক। ( বাবরের প্রার্থনা, শঙ্খ ঘোষ)
সাল টা ১৯৯২ বা ৯৩। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, গান্ধীভবনের উল্টোদিকের মাঠে এক পড়ন্ত বেলায় হাঁটু গেড়ে আজানের ভঙ্গিতে বসে আছেন প্রতুলদা, দুটো হাত অস্তগামী সূর্যের দিকে প্রসারিত, মৃত্যুপথযাত্রী সন্তানের জন্য আর্তি আর নিজের জীবনের বিনিময়ে সন্তানের আরোগ্যকামনার সুর ধ্বনিত হচ্ছে আকাশে বাতাসে, বুকের ভিতর এক অবর্ণনীয় যন্ত্রণা, অথচ হৃদয়মথিত এক স্বপ্নাবেশ ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সুখদুঃখের ছোট গণ্ডি টা ভেঙ্গে ফেলে অন্তহীন এক যাত্রায়। যাদবপুরের যে সব ছাত্রছাত্রী সেদিন গান্ধীভবনের মাঠে উপস্থিত ছিলেন, তারা কোনদিনই এই আশ্চর্য বিকেলটা ভুলতে পারেন নি …
এর আগে প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান শুনেছি। মিং পাহাড় লাফিয়ে পার লাল ফৌজের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেয়ে উঠেছি ‘কিসের ভয় সাহসী মন’, ‘আমার আমি’ কে খুঁজে পেতে ‘এই বাংলার মায়াভরা পথে’ তাঁরই সঙ্গে হেঁটেছি ‘এতটা দূর’, মরা সময়ে চমকে জাগিয়ে দিয়েছে তাঁর দৃপ্ত উচ্চারণ ‘জন্মিলে মরিতে হবে জানিত সবাই তবু মরণে মরণে আনেক ফারাক আছে ভাই রে সব মরণ নয় সমান ‘। এ গান তো শুধু শোনার নয়, দেখার ও। কোন বাদ্যযন্ত্র ছাড়া শুধু শরীরের ভঙ্গী আর অভিব্যক্তিতে তাল-ছন্দ, কণ্ঠে কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি আবার কখনো বজ্রবিষাণ – বাংলা গানের জগতে উপস্থাপনা নির্ভর এক সম্পূর্ণ নতুন ধারার জন্ম দিয়েছিলেন প্রতুল।
যাদবপুরের ওই মায়াবী বিকেলে পড়ন্ত সূর্যের আলোয়, পরবর্তী প্রজন্মের স্বপ্ন বাঁচানোর প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রতুল মুখোপাধ্যায় আমাদের প্রতুলদা হয়ে গেলেন। হ্যাঁ, নব্বইয়ের দশকের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ারাও প্রতুল মুখোপাধ্যায়কে প্রতুলদাই বলত, ব্যক্তিগত আলাপ থাক বা না থাক।
তারপর গঙ্গা যমুনা রাইনে নাইলে বয়ে গেছে অনেক জল। একদিন ভাষাহীন যন্ত্রণা আর বিস্ময় নিয়ে জানলাম প্রতুলদা আর আমাদের পাশে নেই, পক্ষবদল করেছেন। আর অনুষ্ঠান হত না, হলেও যেতাম না। যে প্রত্যয় নিয়ে ওই গান একদিন গাইতেন, সেই বিশ্বাসে ঘুণ ধরলে গান আর সেই গান হয়না কখনো। তবু রয়ে গেছে প্রতুলদার গান, সুর, স্বপ্ন, বিশ্বাস আর ভালবাসা।
প্রতুলদার প্রয়াণ এমন এক সময়ে, যখন এক নারকীয় মৃত্যু নাড়িয়ে দিয়ে গেছে একটা সমাজ কে, দুর্নীতি ভয় আর সন্ত্রাস কে উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমেছেন- ‘
এ ব্যথা আমার নয় শুধু একার
বিপ্লবী তিলোত্তমা করেছে অঙ্গীকার
লুটিয়েছে প্রাণ তাই ধরেছি গান
করেছি প্রার্থনা বিফল না যায় সে বলিদান
আজ উঠুক জেগে সুপ্ত চেতনা
অন্ধকার হতে আলোকে হোক না পথ চেনা
এই প্রার্থনায় কোথাও মিশে যায় সেই আশ্চর্য বিকেলে প্রতুলদার কণ্ঠে ‘ধুসর শূন্যের আজান গান’। ‘আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক’- নিজেকে নিঃশেষ করে দিন বদলের লড়াইয়ে প্রতুলদা আছেন, থাকবেন। প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের জন্য সরকারি শোকের সমারোহে আমরা নেই, আমরা আছি প্রতুলদার সঙ্গে, যে প্রতুলদা একদিন মৃত্যুঞ্জয়ী সাহসে সঞ্জীবিত করেছেন আমাদের-
ডিঙ্গা ভাসাও সাগরে, সাথী রে
ডিঙ্গা ভাসাও সাগরে
পুবের আকাশ রাঙা হলো, সাথী
ঘুমায়ো না আর, জাগো রে ।।
 
								 
											 
				








গোপাকে অভিনন্দন সুন্দর লেখাটির জন্য।
আমাদের একটা স্মৃতি আছে। 1990s এর কোনো বছরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের এম.এ ক্লাস এ চীন বিপ্লবের Long March পড়ানোর সময় আমার ছাত্র সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায় প্রস্তাব দেয় প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে মাও সে তুং–এর লং মার্চের গানের record বাজাবার। পরের class এই শোনা হল সেই অমর সংগীত– “থাকনা হাজার অযুত বাধা, দীর্ঘ দূর যাত্রায কিসের এ ভয কিসের এ ভয় সাহসী মন লাল ফৌজের, লাফিযে হই পার”।
প্রতুল বাবু পরে ঘটনাটা জেনে খুব অবাক আর খুশি হয়েছিলেন।
খুব ঠিক কথা লিখেছ। আমরা সেই ডিঙ্গা ভাসানর আহ্বান জানিয়ে যাওয়া প্রতুলদাকেই স্মৃতিতে ধরে রাখি। ওই গানগুলোর মাধ্যমেই উনি বেঁচে থাকুক আমাদের জীবনে, আমাদের সংগ্রামে।।
একেবারে যথার্থ স্মরণ। কাল থেকে প্রতুলদাকে নিয়ে যত লেখা পড়েছি, এইটে সেরা।
প্রতুলবাবু তাঁর সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে আমাদের মননে থেকে যাবেন… বাদ্যযন্ত্র ছাড়া তাঁর পরিবেশনা প্রকৃত অর্থেই এক অন্য মাত্রা এনে দিত..
প্রণাম…
খুব ভাল লেখা। লেখিকাকে অভিনন্দন। প্রতুলবাবু শুধু কন্ঠ, সুর দিয়ে গাইতেন না; শরীর দিয়েও গাইতেন। এই ধরনের গান গাওযা খুব কম গায়কের পক্ষে সম্ভব।
মনে আছে, নকশালপনথী নেতা সুনীতি কুমার ঘোষ তার গান শুনতে চেয়েছিলেন। আমি tape recorder আর cassette নিয়ে উত্তর কোলকাতার তার আবাসনে গিয়ে শুনিয়ে এসেছিলাম।
নকশালবাডী আন্দোলনের প্রভাব তার গান এ ভীষণ ভাবে ছিল।
প্রতুলবাবু আমার স্মৃতি উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন।
লেখাটির সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত। প্রতুলদার গান আমাদের যৌবনের স্পর্ধার নদীর এক সহজাত উৎস ছিল। আজও “স্লোগান দিতে গিয়ে(ই) চিনতে শিখি কে ভাই কে দুশমন” আজও এই মধ্য বয়েসের ভাঙতে থাকা শরীরে “ক্ষেপা মোষের ঘাড়” ভাঙার সাহস এনে দেয়। উনি শিবির বদলেছিলেন, ব্যক্তি প্রতুলদার সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছিল, কিন্তু তাতে বোধহয় ব্যক্তির ভাব কে অতিক্রম করে নির্মোহ ভাবে বস্তু (ওনার গান ) নিষ্ঠ হয়ে অর্থাৎ ওনার গান কে গ্রহণ করেতে পেরেছি, ভালোবেসেছি। আর হয়তো প্রতুলদার শিবির যাই থাকুক যে কোনো কারণেই থাকুক উনি মনে মনে উপলব্ধি করতেন ক্ষেপা মোষ কে চ্যালেঞ্জ জানাতে লাল নিশান তাই প্রয়োজন। তাই আমরা গাইতে থাকবো ওনার গান তার অন্তর্নিহিত স্বপটুকু বয়ে নিয়ে যাবো এক প্রজন্মে থেকে আরেক প্রজন্মের হাতে তুলে দেব ব্যাটন, শ্রেণীহীন সমাজ গঠনের লড়াইয়ের আগুন টুকু , তুলে দেব প্রততুলদার গান.…
অনেকসময় অনেকের ক্ষেত্রে এই কষ্ট পেয়েছি। তাই তিনি যতবড়ো স্রষ্টাই হোন, সৃষ্টিতে মুগ্ধ হই, প্রত্যাশা রাখি নি আর।