সাপের কামড় নিয়ে গত এগারো বছরে অসংখ্য আলোচনা সভা, প্রশিক্ষণের ক্লাসে বলা, জন-সচেতনতা ইত্যাদি করতে গিয়ে দেখেছি, এই বিষয়টি প্রায় সর্বস্তরের মানুষজনের কাছে এখনও পরিষ্কার নয়| এই স্বচ্ছ ধারণার অভাবটা কিন্তু মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক, নতুন পাশকরা ডাক্তারবাবু, উচ্চ পদাধিকারী কর্মচারি, শিক্ষক, ছাত্র, আপামর জনগণ– সবার ভেতরেই দেখেছি, এমনকি বিজ্ঞান আন্দোলন করা লোকজনও এর মধ্যে পড়েন|
কদিন আগেই একটা ক্লাসে স্কুলের শিক্ষক আর কয়েকজন বিদ্যালয় পরিদর্শককে এই সাপের কামড় নিয়ে বলছিলাম। একজন শিক্ষক বলছিলেন যে, ওনারা অনেক বছর ধরে
বিজ্ঞান আন্দোলন করছেন, সাপের কামড়ের বিষয়ে সচেতনতার কাজও তার মধ্যে আছে৷ উনি এক ঘন্টার এ ক্লাসের শেষে নিজেই বললেন যে, এতদিন অনেক ভ্রান্ত ধারণা ছিল।
আমরাও গত বেশ কয়েক বছর এই সাপের কামড়ের চিকিৎসা করতে গিয়ে দেখেছি, সাধারণ তো বটেই, শিক্ষিত লোকজনের বহুযুগ ধরে জেনে আসা ভ্রান্ত ধারণা কাটিয়ে চিকিৎসা করাটাই মুশকিল হয়ে দাড়াচ্ছে। এজন্যই সাপে কামড়ালে কি করব আর কি করব না, এ নিয়ে বলতে হলে, প্রথমেই বলি যে, যুগ যুগ ধরে প্রচলিত ধারণাগুলি নিয়ে বসে থাকবেন না৷
যেটা করতে হবে, তার প্রথম পদক্ষেপটিই হল, হাসপাতালের ডাক্তারবাবু যে চিকিৎসাটা করতে চাইছেন, সেটা করতে দিন৷ আপনার রুগীকে সুস্থ করে তোলাটাই যে কোন চিকিৎসকের প্রথম লক্ষ্য। আপনার রুগীর ক্ষতি করার জন্য কোন ডাক্তার বাবু কোন পুরস্কারও পাবেন না৷
এবার এক এক করে বলি কাউকে সাপে কামড়ালে কি করবেন, আর কি করা যাবেনা।
- কাউকে বা আপনাকে নিজেকেই যদি সাপ বা অজানা কিছু কামড়েছে মনে হয়:
আশেপাশের কাউকে ডেকে ব্যাপারটা জানান৷ - অন্ধকারে থাকলে, তাড়াতাড়ি একটা টর্চ আনতে বলুন।
- যাকে কামড়েছে, উনি স্থির হয়ে বসে থাকবেন৷
- অন্যরা এক দু মিনিট আশেপাশের জায়গায় কোন সাপ আছে কিনা দেখার চেষ্টা করবেন। সাপ খোঁজা বা মেরে ধরে আনার জন্য সময় নষ্ট করবেন না৷ এখানে বলে রাখি, এখনকার চিকিৎসাপদ্ধতিতে, সাপের কামড়ের চিকিৎসার জন্য সাপ চেনার কোন দরকার নেই৷ যে সাপেই কামড়াক, চিকিৎসা হয়, রোগ লক্ষণ দেখে এজন্য সাপটিকে খোঁজাখুঁজি করে সময় নষ্ট না করাই ভালো। সাপ যদি দেখতে পান, যদি কোন সর্পবিদ উপস্থিত থাকেন, তাঁর কাছে জেনেনিন সাপটির সঠিক পরিচয়| সাপ মেরে বা ধরে, কখনই হাসপাতালে আনবেন না। অনেক সময়ই তাতে হিতে বিপরীত হয়েছে।
- যুগ যুগ ধরে চলে আসা, “বাঁধন দেওয়ার” কোন দরকার নেই। বাঁধনে বিষ আটকায় না। এতেও হিতে বিপরীত হয়েছে অনেক সময়।
- কামড়ের জায়গায় কোন রকম ধোওয়া বা ওষুধপত্র দিয়ে পরিষ্কার করার দরকার নেই। কুকুরের কামড়ে জায়গাটা ভালোকরে সাবান দিয়ে ধুতে বলা হয়। তার থেকেই ভ্রান্ত ধারণা তৈরী হয়েছে যে, সাপ কামড়েও বোধহয় ধুয়ে দিতে হয়; এটা একেবারে ভুল ধারণা| ধোওয়া বা ঘসাঘসি করলে বিষ আরও দ্রুত ছড়িয়ে যায়।
- হাতে কামড় হলে, তাড়াতাড়ি এ হাতের আংটি, চুড়ি, বালা ইত্যাদিকে খুলে ফেলুন। একটু পরেই হাত বা আঙুল ফুলে উঠলে এ সব গয়না কেটে বসতে পারে|
- যদি সম্ভব হয়; (আমরা স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে উচ্চতর হাসপাতালে পাঠানোর সময় এটা করে ভালো ফল পেয়েছি), হাসপাতালের কাউকে ফোনে জানিয়ে রাখুন যে, একজন সাপকামড়ের রুগী ওখানে যাচ্ছে।
- যদি খুব কাছাকাছি আম্মুলেন্স থাকে, ডেকে নিন। বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকলে আম্মুলেন্সের জন্য দেরী না করে, মোটর বাইকে আহতকে বসিয়ে নিকটবর্তী প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দিকে রওনা দিন।
এই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ব্যাপারটি সম্বন্ধে অধিকাংশ মানুষের ধারণা পরিষ্কার নয়। প্রথম কথা হল, এ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চবিবশ ঘন্টা ডাক্তার থাকতে হবে| দ্বিতীয়ত ওখানে রুগী ভর্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের যে কোন প্রাথমিক স্তরের স্বাস্থ্যকেন্দ্র, যেখানে এ দুটি ব্যাপারে নিশ্চয়তা আছে, সাপের কামড়ের চিকিৎসা সেখানে হবেই| অন্য যে কোন রোগের ক্ষেত্রে, শহরের বড় হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা ভালো থাকতে পারে| কিন্তু এই একটি মাত্র ক্ষেত্রে গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসাই সব সময় ভালো| কারণ, সাপের কামড়ের ক্ষেত্রে প্রতিটা মিনিট গুরুত্বপূর্ণ| শহরের বড় হাসপাতালে যেতে যদি পনের মিনিটবে শী লাগে, সেটাই প্রাণঘাতী হতেপারে| অবশ্য যদি, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া বা বর্ধমানের মত গ্রামীণ মেডিক্যাল কলেজের দু চার কিমির মধ্যে সাপে কামড়ায়, সেক্ষেত্রে এসব হাসপাতালেই তাড়াতাড়ি পৌছন সম্ভব|
চমৎকার পরিস্কার বক্তব্য ।