(আমাদের টেকো বুড়ো ডাক্তার বড্ড বকবক করেন – রোগীরা সাক্ষী – সুতরাং ধৈর্য ধরুন।)
সেদিন সন্ধ্যায় যখন সূয্যি ডোবার পরে আকাশ কালো আর কমলা রংএ চমৎকার সেজে উঠেছে – তখন ডাক্তার চেম্বারে চা পান করতে করতে ভাবছিলেন ওনার চায়ের পেয়ালায় যে মাছিটা পড়ে মরেছে অথবা মরে পড়েছে সেটা সমেত চা পান করাটা উচিত হবে কিনা? তখন বাইরে ওনার রূপসী রিসেপশনিস্ট, যাকে উনি পিসিমা বলে ডাকেন, তিনি একটা কান খুঁচুনী দিয়ে চোখ বন্ধ করে পরম আহ্লাদে কান খোঁচাচ্ছিলেন। এমন সময় একজন শীর্ণ পাকানো চেহারার প্রবল সাজসজ্জা করা মধ্যবয়সিনী সুন্দরী ডাক্তারের খুপড়িতে প্রবেশ করলেন। ডাক্তার চায়ের পেয়ালা সরিয়ে করজোড়ে ওনাকে বসতে বললেন।
ভদ্রমহিলা বসে বললেন”আসলে দীপা আমাকে পাঠালো।”
ডাক্তার ভুরু নাচালেন “চিনলাম না।”
“মানে দীপা আমাদের ফ্ল্যাটেই ওপর তলায় থাকে।”
ডাক্তার একটুক্ষণ গোল গোল চোখে ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন “বটে? তা আপনার অসুবিধেটা কি – মানে কি জন্যে আমার কাছে এসেছেন?”
ভদ্রমহিলা অনেকক্ষণ ব্যাগ ট্যাগ হাতড়ে একটা সুগার রিপোর্ট বার করে ডাক্তারের সামনে রাখলেন। চারশো আটাত্তর। পিপি। বীরেন্দ্র সহবাগ এই রানটা করতে পারলে খুশী হতো। কিন্তু ভদ্রমহোদয়া মোটেই খুশী নন।
ডাক্তার বললেন “হুমমমমমমমমমমমমমম।”
“ডাক্তারবাবু আমি অনেকগুলো ওষুধ খাচ্ছি ….খাওয়া দাওয়া তো একদমই বাদ বলতে পারেন…. কতো ডাক্তার বদ্যি তো দেখালাম ….আমি কিন্তু ইনসুলিন নেবো না…. যা লাগে ওষুধ লিখে দিন…. নবার বড়ো জামাইয়ের ইনসুলিনের পরেই কিডনিতে ইয়ে হয়ে গেল ওটা বাদ দিয়ে যা হয় দিয়ে দিন …”
“আপনার অসুবিধেটা কি?”
“ঐ যে ডাক্তারবাবু সুগার কমছে না …ওষুধ খেলেও যা না খেলেও ঐ”
“আর কোনও অসুবিধে আছে?”
“না না আমি এমনিতেই প্রচুর কাজ হাঁটাহাঁটি সবই করি.. ইয়োগাও করি .. না আর কোনও কিছু তো বুঝতেই পারি না”
ইয়োগা শব্দটা শুনে ডাক্তার একটা ছোট্ট হেঁচকি তুলে বললেন “তা হলে ওষুধটা খাচ্ছেন ক্যানো?”
ধরে নিলাম ওনার নাম সুরঞ্জনাদেবী। প্রশ্নটা শুনে সুরঞ্জনাদেবী খাবি খেলেন “খাবো না? ওষুধ খাবো না?” ওনার বিস্ময় থৈ পায় না।
“কি মুশকিল … ওষুধ না খেলেও আপনার চারশো শুগার থাকে খেলেও তাই ….তাতে আপনার কোনও অসুবিধেও নেই তাই তো? তাহলে ওষুধ খেয়ে লাভটা কি?”
সুরঞ্জনাদেবী বোধহয় ভাবছেন দীপা এ কার কাছে পাঠালো রে বাবা আর আপাততঃ ভালোয় ভালোয় উঠে পালাবেন কিনা এইসব ..এমন সময় আমাদের বুড়ো ডাক্তার গোঁফ চুমড়ে চশমার ফাঁক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন “সুগার রোগটা কি মশাই? রোগটা যে কী সেটা জানেন?”
“ঐ ইয়ে রক্তে সুগারটা বেড়ে যায়”
“বটে? কিন্তু ক্যানো সেটা জানেন কি? আসুন না আমরা দুজনে তাহলে একটু ইয়ে করি… মানে গল্প করি … পিসিমা দুটো চা বলে দে আর দেখিস চায়ে য্যানো মাছি টাছি না মিশিয়ে দ্যায়।”
পিসিমা মুখ বেঁকিয়ে গটগট করে চা আনতে চলে গেলো।
চায়ের গেলাসে চুমুক দিয়ে গুঁফো ডাক্তার বললেন
“আমরা খুব সহজবোধ্য বাংলায় এইসব নিয়ে একটু আলোচনা করি?”
সুরঞ্জনাদেবী সোৎসাহে ঘটাঘট ঘাড় নেড়ে সহমত জ্ঞাপন করলেন।
“ম্যাডাম আপনি যেটা খাচ্ছেন সেটা পেটে গিয়ে কী হয়?”
সুরঞ্জনাদেবী বেশ কনফি নিয়ে মানে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললেন “হজম হয় আর কি হবে?”
ডাক্তার বেশ খানিক জুলজুল করে তাকিয়ে থেকে বললেন “তারপর? হজমের পরে কি হয়?”
সুরঞ্জনাদেবী কণে দেখা সন্ধ্যায় লাজে রাঙা হয়ে একটু ইতস্ততঃ করে বললেন “ইয়ে মানে পটি হয়ে বেরিয়ে যায়”
গুঁফো ডাক্তার গোঁফের ফাঁকে দুষ্ট হাসি হেসে বললেন “তাহলে ম্যাডাম খাবারটা সরাসরি প্যান বা কমোডে ঢেলে দিলেই হয়? খামাকা চেবানো গেলা আর হজম করার দরকারটা কি?”
সুরঞ্জনাদেবী অসহায় ভাবে আত্মসমর্পণ করেন
“তাহলে কি করবো? রান্না করেই সব কমোডে ঢেলে দেবো?”
ডাক্তার ধূর্ত শেয়ালের মতো করে হাসেন “নিন চা’টা জুড়িয়ে শরবত হয়ে গেছে …. আসলে কি জানেন ম্যাডাম খাবারের ভেতরের প্রায় সমস্ত পুষ্টিকর জিনিসগুলোই হজমের পরে গ্লুকোজ মানে চিনি মানে আপনার সুগারে পরিণত হয় । তারপর রক্ত সেই সুগারটা টেনে নিয়ে শরীরের …”
সুরঞ্জনাদেবী ডাক্তারের বাক্যে ধরতাই দ্যান “বুজিছি রক্ত সেটা নিয়ে আমাদের কিডনি হার্ট সব জায়গায় পৌঁছে দ্যায়”
ডাক্তার মোচে তা দ্যান “উঁহু হলো না ঠিকঠাক হলো না… ফেইল”
“তাইলে কি হয়?” সুরঞ্জনাদেবী অবাক।
“রক্ত ওটা নিয়ে গিয়ে একজন পোস্টম্যানকে দিয়ে দ্যায় তারপর ঐ পোস্টম্যান ঘরে ঘরে ঢুকে স্যরি প্রতিটি কোষের ভেতর ঢুকে সুগারটা পৌঁছে দ্যায়, সেখানে এনার্জি তৈরি হয় তাতেই আমাদের শরীরের যন্ত্রপাতি চলতে থাকে। এবার হতে পারে লোকাল সিন্ডিকেটের লোকজন ঐ পোস্টম্যানকে কাজ করতে দিচ্ছে না অথবা পোস্টম্যান নিজেই অক্ষম হয়ে পড়েছে তাই ঠিকঠাক কাজ করতেই পারছে না। যদি হয় যে সিন্ডিকেটের গুন্ডাগিরির জন্যে পোস্টম্যান কাজ করতে পারছে না তাহলে বাইরে থেকে দমদম দাওয়াই … ইয়ে ওষুধের প্রয়োজন সেক্ষেত্রে ইনসুলিন নাও লাগতে পারে।”
“ঐ পোস্টম্যানটা কে ডাক্তারবাবু?”
“ওর নাম হলো ইনসুলিন আর স্থানীয় গুন্ডারা হলো ‘এন্ড অর্গ্যান রেজিস্ট্যান্স’। ‘এন্ড অর্গ্যান রেজিস্ট্যান্স’ই যদি হাই সুগারের জন্য দায়ী হয় তাহলে সাধারণতঃ ওষুধেই কাজ হয় আর ইনসুলিন কমে গেলে বাইরে থেকে ইনসুলিন দিতে হবে।” ডাক্তারের মুখে এখন একফালি চাঁদের মতো ছোট্ট একটা সবজান্তামার্কা হাসি।
সুরঞ্জনাদেবী নাছোড়বান্দা “আর যদি ইনসুলিন না নিই তাইলে?”
ডাক্তার একটা প্রবল দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রশ্ন করলেন
“ভাই শ্বসন কাকে বলে?”
“যাহ্ ব্বাবা এরমধ্যে আবার শ্বসন কোত্থেকে এলো?”
“আহা বলুন না দেখি …”
সুরঞ্জনাদেবী এতোক্ষণে সুযোগ পেয়ে বললেন
“আরে ঐ যে যে প্রক্রিয়ায় আমরা বাইরে থেকে অক্সিজেন নিয়ে কার্বনডাইঅক্সাইড পরিবেশের মধ্যে ছেড়ে দিই ঐ প্রক্রিয়া …ওটাই তো শ্বসন প্রক্রিয়া।”
“ঠিক কিন্তু সেই অক্সিজেনটা শরীরের ভেতরে ঢুকে তারপর কি করে?”
সুরঞ্জনাদেবী হতাশ হয়ে বলেন “এরও আবার পর আছে নাকি?”
“অবশ্যি অতি অবশ্যি। তারপর রক্ত অক্সিজেনটা নিয়ে গিয়ে কোষের ভেতরে ছেড়ে দ্যায়”
রোগিনী এখন ব্যাপারটায় মজার গন্ধ পেয়েছেন।
“তারপর?”
“তারপর সেই অক্সিজেন কোষের ভেতরের গ্লুকোজকে পুড়িয়ে কার্বনডাইঅক্সাইড শক্তি আর জল করে এটাই আসল শ্বসন।”
“এইটুকু মাত্তর?” সুরঞ্জনাদেবী ভারি আশাহত হলেন।
“নো মাই ফেয়ার লেডি পিকচার আভি বাকি হ্যে”
“তাই? তাই? তারপর কি হবে?”
“যখন ব্লাড সুগার বেড়ে গিয়ে কোষের মধ্যে সুগার থাকবে না – তখন অক্সিজেন কোষের ভেতরে গিয়ে চর্বি পুড়িয়ে শক্তি তৈরি করবে, তাতে কিন্তু শরীরের রক্ত অ্যাসিডিক হয়ে উঠবে – সেও ভারী মারাত্মক ব্যাপার ….সোজা পটলডাঙার বাস ধরতে হবে হেহেহে”
সুরঞ্জনাদেবী আঁৎকে ওঠেন “বলেন কি মশয় পটলডাঙা?”
“শুধু তাই নয়, আপনার শরীরের সব চর্বি গলে যাবে চামড়ার জেল্লা চলে যাবে” ডাক্তার হাত বাড়িয়ে সুরঞ্জনাদেবীর গালের চামড়া দুআঙ্গুলে চেপে ধরেন – ঐ যেমন বাচ্চাদের ও আমার তোনাটা মোনাটা করে সেই রকম এবং সুরঞ্জনাদেবী ফের লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠেন।
“নো সাবকিউটেনিয়াস ফ্যাট বুঝলেন কিছু? দেখুন সামান্যতম চর্বিও নেই। গাল ঝুলে গেছে …. সহস্র বলিরেখা”
“বলিরেখা এ্যাঁ? সেটা কি?”
“কুঁচকানো চামড়া” ডাক্তার নাক সিঁটকান।
সুরঞ্জনাদেবী স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন। অগ্নিবর্ষী চোখে বুড়োর দিকে তাকিয়ে থাকেন “আর ইনসুলিন নিলে?”
“ইয়ে মানে সঙ্গে ডায়েট আর…..” ডাক্তার বলতে চান।
সুরঞ্জনাদেবী ক্রুর চোখে চেয়ে বাধা দ্যান “চামড়া চকচক করবে কি না বলুন?” ভদ্রমহিলার চোখ চকচক করতে থাকে। “গালের ভাঁজ মিলিয়ে যাবে? নৈলে আবার আসবো কিন্তু …..”
সুরঞ্জনাদেবীর রুদ্রমূর্তি দেখে ডাক্তারের গোঁফ ভয়ে ঝুলে পড়েছে। “মানে গ্যারান্টিতো আর ….. বুঝলেন কিনা…. বিফলে মূল্য ফেরৎ… ওসব তো মানে ..”
“একি তোৎলাচ্ছেন ক্যানো? চটপট ইনসুলিন লিখে দিন…. ফটাফট …এখুনি ঘরে দাঙ্গা লাগবে …”
“দাঙ্গা?” ডাক্তার রীতিমতো ভীত।
“আহা তিন পিস রাক্ষস ফিরবে -কত্তা ,বড় মেয়ে আর ছোটছেলে, ওরা ক্ষিদের সময়ে খাবার না পেলে তুলকালাম কান্ড করবে। এখন চটপট আমার কি কি খাওয়া বারণ বলে দিন”
“বারণ? মানে বারণ? কিছুই বারণ নয় প্রতিটা খাবারের ক্যালরি জেনে নিতে হবে তারপর সারাদিনে কতো ক্যালরি খাওয়া চলবে সেটা জেনে নিজেই হিসেব করে নেবেন”
রণংদেহী দেবী একটু থমকে গেলেন “ক্যালরি? ক্যালরি মানে ত গাজর তাই না? মরুগ্গে যাক ইনসুলিনের ডোজটা ঠিক করে লিখে দিন। যদি গাল ঠিক না হয়েছে তো দেখবেন ….. আর হ্যাঁ কতো দিন পরপর টেস্ট করাবো?”
“ওরম নয় নিজে গ্লুকোমিটারে নিয়মিত পরীক্ষা করে প্রথম প্রথম আমায় জানাবেন আমি ডোজ বাড়িয়ে কমিয়ে দেবো পরে নিজেই বুঝতে পারবেন।”
সুরঞ্জনাদেবী বোধহয় রাক্ষসদের দাঙ্গা থামাতে ওষুধের ফর্দ নিয়েই দৌড় লাগালেন। বিধ্বস্ত ডাক্তার একলা বসে চুলহীন মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন।
দারুণ, দুর্দান্ত, অসাধারণ একটা লেখা ।
আপ্লুত
অসাধারণ
অনবদ্য??
কিন্তু ডাঃ বাবুরাতো কত সুগারে কতটা ক্যালরি দরকার সেটা তো বলেননা। আমার মায়ের ফাসটিং 121,পিপি 244,(29,11,2019)।Apidra 15,15,9, এবং Lantus 32,(রাতে)। মায়ের বয়স্ 75। অতঃপর।
এটা তো ওনার বয়স আর ওজন কতোটা পরিশ্রম করেন সেটা হিসেব করে ওনার ডাক্তার বাবু বলবেন ।
মুল্যবান কথাগুলো সহজ সরল ভাষায় লিখেছে। ধন্যবাদ,doctors dialogue চলুক।
ধন্যবাদ
খুব সহজ প্রাঞ্জল ভাষায়, শুগার প্রক্রিয়া টা গল্পের আকারে মেলে ধরেছেন পাঠককুলের সামনে।
একটা প্রশ্ন : সবাইকে যে বলে, রক্তে শুগার এর পরিমান বৃদ্ধি হওয়া টা বংশনুক্রমে হয়. এটা কি সত্যি.
যদি সত্যি হয় তাহলে, তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা গল্পের আকারে মেলে ধরলে বাধিত হবো.
ধন্যবাদ….
অসীম কুমার দাস…