এত লোকে সিগারেট খায়, তাদের কই ক্যানসার হয়না! কিন্তু আমার বড় মেসোর হয়েছিল। খুব বেশি সিগারেট খেতেন তা নয় কিন্তু! তবু হয়েছিল। নন স্মল সেল কারসিনোমা অফ লাং পাতি বাংলায় ফুসফুসে ক্যান্সার। ধরা যখন পড়লো, স্টেজ ফোর। লিভার থেকে শুরু করে মেরুদণ্ড, সব জায়গায় ছড়িয়ে গেছিল। তারপর শুধু দিন গোনা বাকি ছিল। মাস না পেরোতেই কষ্ট ফুরিয়েছিল চিরতরে।
এত লোক ড্রিংক করে সবার কই লিভার খারাপ হয় না। কিন্তু আমার বন্ধুর দাদার হয়েছিল। মাত্র ত্রিশের কোঠায় জীবন থেমে গিয়ে, গোটা পরিবারটাকে অনিশ্চয়তার মুখে ফেলে দিয়েছিল।
হ্যাঁ এইসব কার্য-কারণগুলোর সম্পর্কগুলো বহুল প্রমাণিত এবং প্রচারিত। কিন্তু যেহেতু মানুষের শরীরটা পাটিগণিতের অংক নয়, তাই এখানে দুই এর সাথে দুই যোগ করলে চার হবেই তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
আপনার রোগ হবে কিনা তা শুধু রোগের কারণের উপরে নয়, বরং আরো অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আপনার শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা, কিংবা ইমুনিটি। এই ইমুনিটি আবার তরকাতে নুনের মত। আলুনি হলে বিস্বাদ, নুন বেশী হলে মুখে তোলা দায়। বাচ্চা এবং বয়স্কদের এমনিতে ইমুনিটি কম থাকে, তার ওপর শরীরে অন্য কোনো ক্রনিক রোগ যেমন ডায়াবেটিস থাকলে কথাই নেই। সেসব ছাড়াও ইমুনিটি তাৎক্ষণিক সময় এবং ব্যক্তি বিশেষ কম বেশি হয়। স্কুলের ক্লাসে আমি আমার সহপাঠীদের থেকে বেশি অসুস্থ হতাম, অতিরিক্ত সাবধানে থাকার পরও!
এতো গেল ইমুনিটি কম থাকার কথা। কিন্তু শরীরের এই নিজস্ব অতি শক্তিশালী সেনাবাহিনীই যদি কোনো কারণে বিভ্রান্ত হয়ে যায়! তখন এদের অতিউৎসাহে জীবাণু বিজানুর যা হবে সে তো হবে, কিন্তু সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমাদের নিজের শরীর। এ অনেকটা ‘রক্ষকই ভক্ষক’ হয়ে ওঠার গল্প। আমাদের পরিচিত বহু অটো ইমিউন ডিসঅর্ডার আছে, যেখানে শরীরের এই নিজস্ব সেনাবাহিনী, আমাদের নিজেদের সুস্থ কোষদেরই মারতে শুরু করে। তাছাড়া আছে ‘সাইটোকাইন স্টর্ম’। যা এই গত কয়েকমাসে আমরা সবাই অনেকবার শুনেছি।
ব্যাপারটা সহজ ভাষায় এরকম, আপনার ডেরায় জঙ্গী অনুপ্রবেশ ঘটেছে। প্রথমে চেষ্টা করেছিল বটে আপনার সেনাবাহিনী, বন্দুক নিয়ে যুদ্ধ করার। কিন্তু অচিরেই বোঝা গেল, সংখ্যায় জঙ্গীরা অনেক। বন্দুকে পেরে ওঠা দায়। অগত্যা এবার মিসাইল ছোড়া হলো। কিন্তু জঙ্গি তো আপনার ডেরায় মানে আপনার শরীরের ভেতরে। মিসাইলের আঘাতে জঙ্গীর সাথে সাথে আপনার নিজের লোকেরাও তো মরবে। তাই মরে। শরীরের সুস্থ কোষ গুলো ইমিউন সেলের তৈরি মিসাইল তথা সাইটোকাইন নামের কেমিক্যালে মারা যেতে থাকে। শিগগির এই সাইটোকাইন স্টর্ম না থামানো গেলে, অদূর ভবিষ্যতে জীবাণু আপনার কি পরিণতি করত কে জানে, আপনি নিজের সেনার এই মিসাইলেই পটল তুলবেন সেটা নিশ্চিত!
ইমুনিটি ছাড়াও আছে আরো বেশ কিছু পারিপার্শ্বিক বিষয় যা নির্ধারণ করে আপনার রোগ হবে কিনা, হলে সেটা কতটা ভয়ানক হবে। যেমন আপনার জেনেটিক গঠন। যেমন আপনার শরীরের ভাইরাল লোড, মানে অনুপ্রবেশকারী জঙ্গীর সংখ্যা। যে ভাইরাস আপনার শরীরে ঢুকেছে তার স্ট্রেইন, মানে ওদের আর্মির কোন রেজিমেন্ট আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে; এক এক রেজিমেন্টের শক্তি অবশ্যই একেকরকম। ইত্যাদি, প্রভৃতি।
কি হলো?! ভাবছেন এত কিছু আপনি কি করে কন্ট্রোল করবেন! সবই তো তাহলে ভাগ্যের ব্যাপার, নিয়তি! হমম…অনেক কিছুই আপনার হাতের বাইরে, সত্যি কথা বলতে গেলে একবার অনুপ্রবেশ ঘটে গেলে আপনার আর খুব বেশী কিছু করার নেই। তখন যা হবে সেটা আপনার ইমিউন বাহিনীর কর্মক্ষমতা আর অনুপ্রবেশকারীর শক্তি এই দুইয়ের ওপর নির্ভর করবে। আপনার চিকিৎসক বাইরে থেকে যুদ্ধের জন্য কিছু রসদের যোগান দিতে পারে খুব বেশি হলে! তাহলে আপনার ভূমিকাটা কি?!
আরে মশাই, মূল ফটকে তালা দেওয়ার ব্যবস্থা করাটাই যে আপনার হাতে। সেই তালাটা কত মজবুত হবে, তার চাবি কত সুরক্ষিত জায়গায় থাকবে সেটা আপনার হাতে। যদি অনুপ্রবেশ ঘটতেই না পারে, তাহলে যুদ্ধ শুরুই হবে না।
তাহলে যা যা নিয়ম মানতে বলা হচ্ছে তাতে কি কোভিড নামের এই নতুন জঙ্গীকে আটকানো সম্ভব!? উত্তর, হ্যাঁ সম্ভব।
প্রমাণ, আমি এবং আমরা। গত সাতমাসে সবচেয়ে বেশী এই ভাইরাসের সামনাসামনি আমরা হয়েছি। আমাদের পেশাটাই সামনে দাঁড়িয়ে রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। কিছুদিন আগে আমাদের হাসপাতালে সব ডক্টর এবং মেডিক্যাল স্টাফদের এন্টিবডি টেস্ট হয়েছিল। এতে ধরা পড়ে অজান্তেই এই রোগ হয়ে গিয়ে আবার সেরেও গেছে কিনা। আশার কথা আমাদের 99% এর এন্টিবডি নেগেটিভ এসেছিল।
মানে, এতদিনে এটুকু নিশ্চিত যে নাক, মুখের মোট তিনটি ফুটো ঢাকা থাকলে (আজ্ঞে না, কিছু বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া N95 কিংবা N99 এর কোনো দরকার নেই, সাধারণ থ্রী লেয়ার সার্জিক্যাল মাস্ক যথেষ্ট।), বার বার আলকোহল যুক্ত স্যানিটাইজার কিংবা পাতি সাবান জল দিয়ে হাত পরিষ্কার করলে, কোনো অজুহাতেই অপরিষ্কার হাত নাকে মুখে চোখে না লাগলে, পাশের লোকের হাঁচি কাশির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ড্রপলেটের আওতার বাইরে থাকলে…ফটকের তালা ভেঙে এই ভাইরাস আপনার শরীরে ঢুকতে পারবে না।
এত ডাক্তার তাহলে কি করে আক্রান্ত হচ্ছে!? এতজন মারা গেলেন কি করে!? কারণ, আগেই বলেছি এটা আমাদের পেশা। আমরা এই ভাইরাসের আওতায় দিনে গড় দশ থেকে বারো ঘণ্টা থাকি। সপ্তাহে অন্তত ছয়দিন। মাসের পর মাস। বেঁচে থাকার তাগিদে তার মাঝখানে আমরা জল খাই, খাবার খাই, ওয়াশরুমে যাই। মুহূর্তের অসাবধানতায় হয়ত কখনো নাক চুলকে ফেলি। রুগীর থেকে দূরত্ব বজায় রাখা কোনোভাবেই আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তারপরও যতজন ডাক্তার এবং স্বাস্থ্য কর্মী এত গুলো মাস ধরে এই ভাইরাসের চোখে চোখ রেখে, দাঁতে দাঁত চিপে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন; অনুপাত হিসেবে তাদের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা কিন্তু সাধারণ মানুষের থেকে খুব বেশী নয়। কারণ সাবধানতা।
শেষে বলতেই হয় যদি কিছু হারায় তা আপনার হারাবে। যারা আপনাকে বিভিন্ন স্বঘোষিত থিওরি এবং তথ্য শোনাচ্ছে তারা ধাপার মাঠে আপনার সঙ্গী হতে আসবে না। আপনার সুরক্ষা শুধুমাত্র আপনারই দায়িত্ব। পালন করবেন কিনা সেটা আপনার ব্যাপার।
শুভ শারদীয়া সব্বাইকে। পরের বছরও যাতে শুভেচ্ছা জানানোর সুযোগ পাওয়া যায় সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের সবার???।