করোনায় আক্রান্ত হয়ে বৃহস্পতিবার হাওড়া জেলা হাসপাতালের সুপার নারায়ণ চ্যাটার্জী ভর্তি হলেন এম আর বাঙ্গুর হাসপাতালে। প্রথমে তাঁকে বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও তাঁর অসুস্থতা গুরুতর না হওয়ায় তাঁকে আপাতত এম আর বাঙুরেই ভর্তি করা হয়েছে। হাওড়া জেলা হাসপাতালের শুধু সুপার নয়, ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী মিলিয়ে মোট ৬৮ জনকে কোয়ারান্টাইন এ রাখা হয়েছে। অন্যান্যদের পরীক্ষার রিপোর্ট এখনো আসেনি। পাশাপাশি সুপারের সঙ্গে হোম কোয়ারেন্টাইন এ থাকা তাঁর পরিবারের প্রতিটি সদস্যকেও কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে পাঠানো হয়েছে।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত 31 শে মার্চ দেবী পাল নামে বছর 58 এক মহিলার মৃত্যু হয় হাওড়া জেলা হাসপাতলে। তাঁর সংস্পর্শে এসেই হাওড়া হাসপাতালের সুপার নারায়ন চ্যাটার্জী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। শুধু তিনি নন হাওড়া হাসপাতালে ভর্তি করার আগে সালকিয়ার বাসিন্দা ওই বৃদ্ধা মহিলাকে হাওড়ার আইএলএস, জেসওয়াল, সত্যবালা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ভর্তি করার জন্য। সেখানকার চিকিৎসকসহ যেসব স্বাস্থ্যকর্মীরা তার সংস্পর্শে এসেছিলেন এমন 200 জনকে কোয়ারান্টাইন এ পাঠানো হয়েছে।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই এত স্বাস্থ্যকর্মী কোয়ারান্টিনে থাকার ফলে ভেঙে পড়েছে ওই হাসপাতালের স্বাস্থ্য পরিষেবা।এই প্রথম নয় চারদিন আগেই এন আর এস-এ একদিনে ৮১ জন স্বাস্থ্যকর্মীকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানোর ফলে ওই হাসপাতালের চিকিৎসা পরিষেবা চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে। যদিও ওই ৮১ জনের মধ্যে বেশিরভাগেরই রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। ইতিমধ্যেই করোনা সংক্রান্ত খবর নিয়ে প্রতিদিনের হেলথ বুলেটিন বন্ধ করেছে রাজ্য সরকার। বিশেষজ্ঞদের মতে কোভিড ১৯ সংক্রমণ নিয়ে অতিরিক্ত কড়াকড়ি বা খবর চাপাচাপির জেরেই এই ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হতে হচ্ছে রাজ্যকে। কারণ সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে সংক্রামিত ব্যক্তির তথ্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রোগী কার কার সংস্পর্শে এসেছেন বা কোথায় ছিলেন সেই স্থানগুলি নির্দিষ্ট করে অন্যান্যদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনাকে খতিয়ে দেখতে হয় এই ক্ষেত্রে।
মৃত দেবী পাল কে হাসপাতালে ভর্তি করতেই আপত্তি তুলেছিলেন হাওড়া জেলা হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীরা। হাসপাতাল সূত্রের খবর, ওই সময় তাঁর শারীরিক পরিস্থিতি দেখে অনেক চিকিৎসকই করোনা হয়েছে এমন আশংকা করেছিলেন এবং আই ডি হাসপাতালে রেফার করতেও বলেছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক চাপে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ ওই রোগীকে ভর্তি নিতে বাধ্য হন। পরে স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসকেরা বিষয়টি নিয়ে আপত্তি জানালেও হাসপাতালের সুপার কোনো কর্ণপাত করেননি। পরে ওই দিন রাতে রোগীর মৃত্যুর কিছুক্ষণ পরে জানা যায় রোগীর কোভিড ১৯ সংক্রমণ ছিল । ফলে হাসপাতালের সুপার সহ ওই রোগীর সংস্পর্শে এসেছেন এমন সব স্বাস্থ্যকর্মীকেই কোয়ারেন্টাইনে যেতে হয়।
রাজ্য সরকারের নির্দেশিকা অনুযায়ী কোন ব্যক্তির বিদেশ ভ্রমণের ইতিহাস থাকলে বা বিদেশ ভ্রমণ করেছেন এমন কোনো ব্যক্তির সংস্পর্শে যাঁরা এসেছেন শুধুমাত্র তাঁদেরই কোভিড ১৯ টেস্ট করা হবে। রাজ্যে সংক্রমণ শুরু হওয়ার সময় এই নির্দেশিকা জারি করেছিল স্বাস্থ্য ভবন। কিন্তু প্যানডেমিক বা এপিডেমিকের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি অনুযায়ী নির্দেশিকার পরিবর্তন করা প্রয়োজন। সরকার এখনো তা করেনি।
পুরোনো নির্দেশ অনুযায়ী হাসপাতালগুলিতে প্রাথমিকভাবে সর্দি কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট থাকলেও তার টেস্ট করা হচ্ছে না। অনেক সময় দায়িত্বরত চিকিৎসক তাঁর অভিজ্ঞতায় হয়তো বুঝতে পারছেন যে সংশ্লিষ্ট রোগী কোভিড সংক্রামিত হতে পারেন, কিন্তু উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে টেস্টের অনুমতি চাইলেও তা মিলছেনা। এর জেরে অনেকাংশেই স্বাস্থ্যকর্মীদের সংক্রমণের আশঙ্কাও বাড়ছে।
।প্রসঙ্গত এ দেশে কোভিড ১৯ প্যানডেমিক লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে । ইতিমধ্যে আইসিএমআর হটস্পট চিহ্নিত করে রেনডম টেস্ট করানোর নির্দেশ জারি করেছে। কিন্ত প্রয়োজনীয় কিটের অপ্রতুলতার জন্য এ রাজ্যে এখনো রেনডম টেস্ট শুরু করতে পারেনি সরকার। স্বাস্থ্য ভবন সূত্রে খবর কেন্দ্রের কাছ থেকে ১০ লাখ কিট চেয়েও এখনো পর্যন্ত প্রথমে ৬০.০০০ পরে এক লাখের মতো কিট পেয়েছে । শুধু কিটের অপ্রতুলতা নয়, সমস্যা আরো গভীরে।
করোনা সংক্রমণ চিকিৎসার ন্যূনতম পরিকাঠামো নেই এমন হাসপাতালকেও করোনা আইসোলেশন সেন্টার বানানো হয়েছে। সংক্রমণ ঠেকাতে নির্দিষ্ট হাসপাতলে হেপা ফিল্টার ব্যবস্থা ও নেগেটিভ প্রেসারের প্রয়োজন। সেন্ট্রাল এসি ব্যবস্থায় যা করা সম্ভব নয়। কিন্তু এম আর বাঙুর সহ অন্যান্য করোনা হাসপাতাল এই ব্যবস্থা এখনো পর্যন্ত করে উঠতে পারেনি।
অথচ এই জটিল পরিস্থিতিতে হাসপাতালে নির্দিষ্ট চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক নেতাদের চাপে অনেক সময় রোগীদের ভর্তি নিতে বাধ্য হচ্ছেন কর্তৃপক্ষ।
সূত্রের খবর হাওড়া হাসপাতলে মৃত দেবীপাল দু সপ্তাহ আগে ব্যাঙ্গালোর থেকে ট্রেন জার্নি করে ফিরেছিলেন। এরপর এক সপ্তাহ আগে ডুয়ার্স বেড়াতে যান তিনি । ফিরে এসে সর্দি-কাশি জ্বর হওয়ার জন্য প্রাথমিকভাবে ডাক্তার দেখালেও পরে শ্বাসকষ্ট হলে হাওড়ার একটি সরকারী হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। সেখানে উন্নতি হচ্ছে না দেখে তাঁর পরিবারকে বেলেঘাটা আইডি-তে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু তাঁরা আইডি-তে না গিয়ে প্রথমে জেসওয়াল ও পরে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে হাওড়া জেলা হাসপাতালে রোগীকে ভর্তি করেন। ভর্তি হওয়ার সময় ওনার সমস্ত উপসর্গ দেখে স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসকেরাও বেলেঘাটা আইডি-তে পাঠানোর জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু কোন অজ্ঞাত কারণে স্বাস্থ্যকর্মীদের আপত্তিকে না মেনেই হাসপাতালের সুপার ওই মহিলাকে ভর্তি করেন। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য এইভাবে সংক্রমিত একজন রোগীকে সাধারণ হাসপাতালে ভর্তি নেওয়ার ফলে অন্যান্য রোগী ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে ও সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা থেকে যায়। সুপারের করোনা সংক্রমণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঘটনায় সেই আশঙ্কাই সত্যি প্রমাণিত হলো। সেই কারণেই নির্দিষ্ট সংক্রমণের চিকিৎসা হয় এমন হাসপাতালেই রোগীদের পাঠানোর প্রয়োজন।
হাওড়া জেলা হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মী ও নার্সদের অভিযোগ নির্দিষ্ট পিপিই ছাড়াই তাঁদেরকে ওই সংক্রমিত রোগের চিকিৎসা করতে হয়েছিল। এনআরএস এর ক্ষেত্রেও কোয়ারেন্টাইনে থাকা স্বাস্থ্যকর্মীরা অনেকেই একই অভিযোগ এনেছেন। এর আগে বেলেঘাটা আইডি ও মেডিকেল কলেজের স্বাস্থ্যকর্মীরাও প্রয়োজনীয় পিপিই পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন। অনেক জায়গাতেই পিপিই-র বদলে রেনকোট দিয়ে কাজ চালানোর চেষ্টা করা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে এই ধরনের অসাবধানতা স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়ানোর প্রধান কারণ। প্রসঙ্গত এর আগে ইতালিতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার স্বাস্থ্যকর্মী অসাবধানতাবশত করোনা রোগীদের থেকে সংক্রমিত হয়েছেন। বহু স্বাস্থ্যকর্মীরা মারাও গেছেন সেখানে। আমাদের দেশে সেই সংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মী বা হাসপাতাল কোনটাই নেই। সেই কারণেই চিকিৎসা কর্মীদের যথাযথ সংক্রমণকারী পোশাকের ব্যবস্থা করা ভীষণ প্রয়োজন।