ডেভিড হেয়ার (১৭৭৫ – ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দ)
ভারত তখন ব্রিটেনের প্রধান এবং স্বর্ণ ডিম্ব প্রসবকারী উপনিবেশ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একাই এখানে লুঠপাট চালাচ্ছে। সেই সময় অনেক যুবকের মত স্কটল্যান্ডের ২৫ বছর বয়সী এক তরুণ ভাগ্যান্বেষণে দীর্ঘ জাহাজ যাত্রা করে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রধান কেন্দ্র এবং ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী কলকাতায় এসে উপস্থিত হন। ঘড়ি নির্মাণ, মেরামতি ও ঘড়ির ব্যবসা করে তিনিও লাভের মুখ দেখেন। কিন্তু মুনাফার পাহাড় নিয়ে অন্যান্য ব্রিটিশদের মত দেশে না ফিরে এই দেশটিকে ভালবেসে এখানেই থেকে যান।
এদেশের সাধারণ মানুষের দারিদ্র্য, দুর্দশা, অশিক্ষা, স্বাস্থ্যহীনতা, অসচেতনতা, পশ্চাদপদতা দেখে তিনি অত্যন্ত ব্যথিত ও বিচলিত হন। তিনি এদেশের মানুষকে শিক্ষিত ও সচেতন করার কাজে ব্রতী হন। তিনি রামমোহন রায়ের ঘনিষ্ঠ হন এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘ আত্মীয় সভায় ‘ যোগদান করেন। সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি স্যার হাইডে ইস্ট, রামমোহন, বাবু বুদ্ধিনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখের সহযোগিতায় ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে ‘ হিন্দু কলেজ ‘ (বর্তমান প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) স্থাপন করেন।
একই বছরে ‘ স্কুল বুক সোসাইটি ‘ তৈরি করে ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় পাঠ্য বই প্রকাশ করতে থাকেন। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে রাধাকান্ত দেব দের সঙ্গে নিয়ে ‘ ক্যালকাটা বুক সোসাইটি ‘ গঠন করেন। এরপর প্রবল প্রচেষ্টা চালিয়ে এবং প্রচুর পরিশ্রম করে ঠনঠনিয়া, কালিতলা, আরপুলি প্রভৃতি জায়গায় কয়েকটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন যার মধ্যে বর্তমান ‘ হেয়ার স্কুল ‘ অন্যতম। ইংরেজি ও বাংলা মাধ্যমের ঐ স্কুল গুলিতে অন্যান্য শিক্ষকদের সাথে তিনি নিজেও পড়াতেন। প্রতিদিন তিনি হিন্দু কলেজ ও স্কুল গুলিতে যেতেন এবং প্রতিটি ছাত্রের সঙ্গে সংযোগ রাখতেন, তাদের উৎসাহ দিতেন। ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে তৈরি করলেন ‘ লেডিজ সোসাইটি ফর ফিমেল এডুকেশন ‘ ।
এরপর এই অকৃতদার ভারতবন্ধু সমাজসেবী শিক্ষাবিদ তাঁর দোকান ও ব্যবসা বিক্রি করে দিয়ে সর্বক্ষণের জন্য শিক্ষা প্রসারে ব্রতী হন। ছাত্রদের বৃত্তি দিতেন এবং বিভিন্ন পল্লীতে গিয়ে অভিভাবকদের তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর জন্য বোঝাতেন। দেশে না ফিরে বর্তমান বি বা দি বাগে র কাছে (বর্তমান হেয়ার স্ট্রিট) একটি গৃহে স্থায়ীভাবে থেকে তিনি শিক্ষা বিস্তারের কাজ করে চললেন। বলাইবাহুল্য এদেশীয় রক্ষণশীল এবং তাঁর মুনাফাসর্বস্ব স্বদেশীয় দের কাছ থেকে যথেষ্ট বাধা পেয়েছেন ও বিদ্রুপ শুনে গেছেন। কিন্তু এসবে ভ্রুক্ষেপ না করে হাসিমুখে নিজ লক্ষ্যে অটল ছিলেন। বিশিষ্ট সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রচিত ‘ সেই সময় ‘ উপন্যাসে চমৎকার বর্ণনা আছে হেয়ার সাহেব কে ঘিরে উৎসাহী বালকদের আনন্দ নৃত্যের। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁর কলেরা রোগে মৃত্যু হয়। তিনি নিরীশ্বরবাদী (Athiest) ছিলেন। মানবতায় বিশ্বাসী ঈশ্বরে অবিশ্বাসী এই পরহিতে জীবনদানকারী শিক্ষাব্রতী কে মৃত্যুর পর খ্রিস্টিয়ান মিশনারীরা কোন গোরস্থানে জায়গা দিলেন না। গোলদিঘির পাড়ে (বর্তমান কলেজ স্কয়ার) তদানীন্তন হিন্দু কলেজের প্রাঙ্গণে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। তাঁর মৃত্যুর খবর শুনে সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে এসেছিল। হাজার হাজার শহরবাসী তাঁর মরদেহতে শ্রদ্ধা জানাতে রাস্তায় নেমে আসেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০ – ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দ)
প্রাচ্যের মহাপণ্ডিত, শিক্ষাবিদ, আধুনিক বাংলা ভাষা ও লিপির স্রষ্টা, অনুবাদক, লেখক, প্রকাশক, সমাজ সংস্কারক, দরিদ্র আদিবাসীদের চিকিৎসক এবং বাঙালি জাতির অন্যতম বলিষ্ঠ ধারক বিদ্যাসাগর বিরল এবং অনন্য কর্মবীর চরিত্র। মেদিনীপুরের ঘাটালের বীরসিংহপুর গ্রামের দরিদ্র পরিবারের এই দামাল, জেদী ও প্রতিভাবান বালক কিভাবে মাত্র নয় বছর বয়সে কলকাতায় এসে একাধিক ঘিঞ্জি, মলিন, অস্বাস্থ্যকর পল্লীতে বাস করে প্রবল দারিদ্র্য আর কষ্টের মধ্যেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একের পর এক পরীক্ষায় খুব ভালো ফল করে উত্তীর্ণ হয়ে সংস্কৃত কলেজে বারো বছর ধরে সংস্কৃত ব্যাকরণ, সাহিত্য, অলঙ্কারশাস্ত্র বা ভাষা, বেদান্ত, স্মৃতি ও জ্যোতির্বিদ্যা আয়ত্ব করে তারপর ২১ বছর বয়সের মধ্যেই আইনশাস্ত্র অধ্যয়ন সম্পূর্ণ করলেন; কত দক্ষতায় জোড়াসাঁকোর বিদ্যালয়ে এবং ফোর্ট উইলিয়াম ও সংস্কৃত কলেজে ছাত্রদের শিক্ষা দিলেন এবং সংস্কৃত কলেজের সহ – সম্পাদক হিসেবে ও নিজ উদ্যোগে শিক্ষায় সংস্কার আনলেন; কিভাবে শক্ত সংস্কৃত ধাঁচা থেকে আধুনিক বাংলা লিপি, বর্ণ, ভাষা, ব্যাকরণ ও সাহিত্যের জন্ম দিলেন; কিভাবে বাংলা ভাষায় শিক্ষাদান ও শিক্ষাবিস্তারের জন্য বহু পুস্তক নিজে রচনা করে ও অন্যদের দিয়ে রচনা করিয়ে প্রেস তৈরি করে ছাপিয়ে প্রকাশ ও বণ্টন করলেন; কিভাবে সমস্ত সামাজিক ও ধর্মীয় বাধার বিরুদ্ধে ঋজু প্রত্যয় নিয়ে এবং রাত জেগে ধর্মশাস্ত্র গুলে খেয়ে চরম অবহেলিত ও নির্যাতিত বাঙালি বিধবাদের পুনর্বিবাহ প্রচলন করলেন (Hindu Widows’ Remarriage Act 1856); কিভাবে আর্থিকভাবে রিক্ত হয়ে গিয়েও নিজ খরচে ও উদ্যোগে বিধবাদের বিবাহের ব্যবস্থা করলেন; কিভাবে প্রবল খাটাখাটি করে শিশুবিবাহ এবং কুলিন ব্রাহ্মণদের বহুবিবাহ প্রথার বিরুদ্ধে সমস্ত বাধার মধ্যে বিরোধিতা করে গেলেন এবং যার পরিণামে বিবাহের ন্যূনতম বয়স হল ১২ বছর (Age of Consent Act 1891); কিভাবে কালান্তক কলেরা সহ রোগাক্রান্ত অবহেলিত মানুষদের শুশ্রুষা করতেন; শীত গ্রীষ্ম অশক্ত শরীর নিয়েও দৌড়াদৌড়ি করে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে বড়িষা হাই স্কুল থেকে শুরু করে গ্রাম বাংলায় একের পর এক স্কুল, মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেন; কিভাবে নীরবে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন, অকালমৃত দুর্জয় সাংবাদিক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের পরিবার সহ দুঃস্থ পরিবার, পত্রিকা ও সংস্থাগুলির পাশে দাঁড়িয়েছিলেন; কিভাবে অক্ষয় কুমার দত্ত, দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ প্রমুখদের সঙ্গে নিয়ে আধুনিক ও বিজ্ঞান শিক্ষার প্রচেষ্টা চালান; কিভাবে শেষ বয়সে ভগ্ন শরীরেও সাঁওতাল পরগনার কর্মটরে সাধারণ গ্রামবাসী ও সাঁওতাল জনজাতিদের মধ্যে থেকে তাদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার ও বিকল্প অর্থনীতি গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালান; হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর কাছ থেকে আমরা জানতে পারি কিভাবে ভারতের ইতিহাস রচনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন; …. এসবই বহু চর্চায় ক্লিশে। কিভাবে প্রবল পাণ্ডিত্যের জন্য ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে বিদ্যাসাগর হলেন, হলেন করুণা ও দয়ার সাগর তাও গৌণ।
এই খর্বকায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ চরিত্রের প্রধান গৌরব রবীন্দ্রনাথের বিশ্লেষণে অজেয় পৌরুষ ও অক্ষয় মনুষ্যত্ব। মহাকবি মাইকেল মধুসূদনের দৃষ্টিতে প্রাচীন ভারতীয় ঋষিদের মত জ্ঞান, ইংরেজদের মত পুরুষকার আর বাঙালি মায়ের হৃদয়ের সমাহার বিদ্যাসাগর। পণ্ডিতমন্যরা যতই কাটাছেঁড়া করুন ‘ বর্ণ পরিচয় ‘ আজও বাঙালি শিশুর প্রবেশিকা, ব্যর্থ বিপ্লবীরা ‘ ব্রিটিশের বাণিজ্যতরী ‘ আখ্যা দিলেও ব্রিটিশ রাজপুরুষদের কাছে তাঁর ভারতীয় হিসাবে আত্মসম্মানবোধ ও দৃঢ়তা প্রমাণাতীত। সেই যুগেও এরকম মুক্তচিন্তা, যুক্তিবাদ, নিরীশ্বরবাদ, অনমনীয় কর্মোদ্দীপনা, প্রতিষ্ঠান গঠন, সাহিত্য চর্চা, আধুনিক শিক্ষা বিস্তার, সফল পুস্তক ব্যবসা সহ বহুমুখী কর্মকাণ্ড বিরলতম। কেউ তাঁকে দেবতার উপর স্থান দিয়েছেন, কেউ তাঁর মূর্তি ভেঙেছেন। ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ দোষারোপ আক্রমণ, কুপমণ্ডুক পশ্চাদপদ ধর্ম ও সমাজ তো চালিয়েই গেছে। কিন্তু নিরুত্তাপ একরোখা এই খর্বকায় আটপৌরে বাঙালি পণ্ডিত সমগ্র জাতির উপর ছাতা মেলে দীর্ঘ আলপথ ধরে এগিয়ে চলেছেন। তাঁর কর্মালোকে সমাজ ঋদ্ধ ও উত্তীর্ণ হয়েছে। তাঁর ছায়া ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।