আমার হাজারো শখের মধ্যে একটির কথা বলি- বহুদিনের শখ ছিল ছবি আঁকার! অন্যান্য হাজারো শখের মত এটিরও পরিণতি- সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গঙ্গাপ্রাপ্তি!
অমনি চোখ কুঁচকে তাকানোর কিছু নেই তো! ছবি আঁকার শখ ছিল …ছিল তো ছিল! এখন নেই! যদি বলি- আমারও তো শখ ছিল, আশা ছিল মনে …. দু’একজনের বুকে একটু আধটু চিনচিনে ব্যথা হতেই পারে, তা বলে কি আমি বলতেও পারবো না – গান গাওয়ার শখ আমারও ছিল, যেটা বাথরুম ছাড়া আর কেউ কোনদিন জানতে পারেনি??
আলবাৎ বলতে পারি। কারণ, আমি নিজের ক্ষমতায় বায়োলজির খাতায় পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ব্যাঙের পৌষ্টিকতন্ত্র ছাড়া কখনো কোন কিছুর ছবি আঁকিনি!! তা বলে কি বলতেও পারবো না??
ডাক্তারিতে প্রচুর ছবি আঁকতে হয়। বিশেষতঃ অ্যানাটমিতে।
একজন স্যার ছিলেন অ্যানাটমির, তিনি ধরে ধরে চোখের সামনে পাঁচ মিনিটের মধ্যে হিউম্যান বডির যে কোন জায়গার ত্রিমাত্রিক ছবি আঁকতে পারতেন! আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেও কোনদিন একটা ছবিতেও ত্রিমাত্রিক ব্যাপারটা আনতে পারিনি।
তো বাঁচার উপায় কি ছিল? স্যারেরাই বাঁচিয়ে দিতেন। বলতেন – schematic diagram এঁকে দিলেই হবে।
ব্যস! আর কে পায় আমাকে? বেশিরভাগ ছবিতে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় গোল্লা এঁকে তার ভেতরে অর্গানের নাম লিখে দাও! লিভার দেখতে কিডনির মত, ফুসফুস দেখতে হৃৎপিণ্ডের মত, ব্রেন দেখতে মলদ্বারের মত হোক না ! কি আসে যায়? স্কিম্যাটিক ডায়াগ্রামের ক্ষেত্রে কোন এক্সপার্ট কমেন্ট করা চলে না। প্রত্যেকটিই এক একটি স্বতন্ত্র ছবি। সে ছবির বোদ্ধা হতে চাইলে, পরীক্ষককে বুঝতে হত- আমি কি এঁকেছি!! না বুঝলে সেটা তাঁর ব্যর্থতা! খাতা দেখতে বসে গালাগালি করেছেন কিনা, সে তো আর আমার মত শিল্পীর জানার কথা নয়! তার ঘরের মানুষ হয়তো খানিকটা আঁচ পেয়ে থাকলেও থাকতে পারে!
বলা বাহুল্য, এরকম বহু শিল্পসৃষ্টিও আছে। বহু শিল্পীর নামী দামী শিল্পসৃষ্টির মাথামুন্ডু অনেকেই বোঝেনি, কিন্তু সেটি কোটি টাকায় বিক্রি হয়েছে!
অতএব, এক্ষেত্রে শিল্পীর দায় নেই সবকিছু বোঝানোর। আমারও ছিল না। কপাল খারাপ আমি শিল্পী তকমা পাইনি।
ধুর! আবার ভাট বকছি। এর উল্টোটাও আছে। ছবি কথা বলেছে, বলে। এই আপনার আমার মত সোজাসুজি কথা বলে! একদম চুড়ান্ত নির্লজ্জ ঠোঁটকাটার মত বলে দেয় সবকিছু। সোজা বলে দেয়- ওই রাজা, তোর কাপড় কোথায়?? শত শত বছরের পুরনো ছবির দিকে তাকিয়ে দেখুন- সেই সময় থেকে এই সময় – সব বলে দেবে! আপনি আলাদা করতেই পারবেন না- সেই সময় আর এই সময়ের মধ্যে কোন তফাৎ আছে কিনা!
বিদ্বজনেরা বলেন- এরকম ছবিই দেশ কাল পাত্রের সীমানা পেরিয়ে হয়ে ওঠে চিরকালীন।
ঠিক এরকমই একটি ছবি – “The Flatterers”।
১৫৯২ সালে আঁকা। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন, ১৫৯২। ছবিটির দিকে তাকিয়ে আমার মত ছবিকানা লোকও বুঝতে পারবে- বিখ্যাত এই ছবিটি ঠিক কি বলতে চায়।
ছবিটি নিয়ে বিশেষজ্ঞ দের ব্যাখ্যা আমি জানি না। জানার চেষ্টাও করিনি, কারণ অত আমার মাথায় ঢোকে না। কয়েকটি জায়গা আমার মত করে জাস্ট বলার চেষ্টা করছি বা জানার চেষ্টা করছি।
দুটি পাখি দেখা যাচ্ছে আকাশে।
হঠাৎ এই ছবিতে পাখি ওড়া, বেশ বেমানান লাগে তাই না??
কিন্তু এই পাখিগুলোকে দুটো শ্রেণীতে ফেলা যায়। এরা দূরের আকাশে স্বাধীন ভাবে ওড়ে। না, এরা তেমন লোভী নয় । বরং আকাশের বিশালতা এদের টানে। স্বাধীনতা এদের টানে। কেউ খুঁটিয়ে দেখতে পাক আর না পাক, এদের আকাশ আছে। আর আছে একটি বুক, যাতে স্বপ্ন গুলো অনেক বড়। আছে দুটি পাখনা- যার উপর অগাধ ভরসা! ঝড় কি করবে, সেই ভয় নেই।
তা বলে কি নিচে নামে না এরা? নামে। সেও বড্ড জৈবিক প্রয়োজনে। এদেরকে আরেকদল মানুষের সাথে মেলানো যায়, যারা শুধু মাত্র খাবারের লোভে নিচে নামে! বাকি সময় এমন ভাব করে যেন- সব পার্থিব বিলাসিতার ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলে। আদতে শকুনের মত। লাশ দেখলেই এরা দল বেঁধে নেমে আসে নিচে। তারপর বড় বড় ঠোঁট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খেয়ে নেয় বেওয়ারিশ লাশ। তারপর আবার অপেক্ষায় থাকে কবে গরু মরবে।
এরপর আসি – ছবির মূল চরিত্রে। ভালো করে তাকালেই দেখা যাবে- লোকটির মাথায় একটি তোয়ালে জড়ানো। এবং এই তোয়ালেটা যে লোকটির বৃহৎ আকৃতির নিম্নাঙ্গের বসন, সে নিয়ে দ্বিমত হবার কোন কারণ নেই। খেয়াল করে দেখুন – বহু নামী দামী মানুষ মাঝে মাঝেই এরকম পরনের তোয়ালে খুলে মাথায় জড়িয়ে নেন। হলিউড বলিউড থেকে রাজনীতি- তথাকথিত সাকসেসফুল রা কিন্তু এই কাজটি সজ্ঞানে, স্বেচ্ছায় করে থাকেন।
আম জনতা ভাবে- কি নির্লজ্জ রে বাবা! এরকম করে কেউ পরনের কাপড় দিয়ে পাগড়ি বানায়?? বানায়! সত্যিই বানায়!!
এবং এটি মাথায় জড়ানোর মূল উদ্দেশ্য হলো- মুখটা না দেখে লোকজন যেন পাগড়িটাই দেখে এবং সেইসঙ্গে অবধারিতভাবে তাদের নজর চলে যায় উন্মুক্ত নিম্নাঙ্গের দিকে!! মাঝখানের মুখ আর পেট যেন নজরে না পড়ে।
রিলেট করা যাচ্ছে?? মনে করুন – অজস্র সাম্প্রতিক ঘটনাবলী!
আপনি চাইলেই অজস্র উদাহরণ পেয়ে যাবেন। এবার বলবেন – জেনেশুনেই এরকম করে লাভ কি?? লাভ হলো আপনাকে আমাকে দুটো জিনিস দেখানো- এক – মাথার পাগড়ি, যেটা আসলে মূল্যহীন আবার কিছু ক্ষেত্রে (এক্ষেত্রে পড়ুন ধর্ম) পোশাকি পরিচয়ও! দুই – আপনি অবধারিতভাবে তাকাবেন অন্যের গোপন, নিষিদ্ধ জায়গার দিকে- যদিও সেটি প্রচলিত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে নোংরা, যদিও সেটির আকর্ষণ আপনাকে করে তুলবে পারভার্টেড!! আপনি অনায়াসে ভুলে যাবেন- লোকটির শ্বদন্তে হয়তো লেগে আছে কোন অসহায় মানুষের রক্ত! হয়তো পাকস্থলীতে পরিপাক হয়ে যাচ্ছে মানুষের মাংসও!
এবার ছবির বাকিটা সহজবোধ্য।
এই ধরনের চরিত্ররা আপনার পকেট কেটে ভরে নেয় নিজের মানিব্যাগ।।সেখান থেকে উপচে দু’চার আনা পড়ছে বা পড়বে অন্ধকারে। খেয়াল করুন- কয়েনগুলো যেখানে পড়ছে সেখানে গাঢ় রঙ। কালো। কারণ, অবৈধ উপায়ে অর্জিত পয়সা অন্ধকার ছাড়া তো কোথাও ঢালার উপায় থাকে না!
এবার রিলেট করতে করতে খেয়াল করুন- সেই অন্ধকার থেকে জন্মানো কতগুলো মেরুদণ্ডহীন কৃমিকীটদের। যারা একে একে জন্ম নিচ্ছে, আর তারপরেই হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে একটি গর্তের দিকে।
এক্ষেত্রে পায়ুদ্বার নিতান্তই নোংরা জায়গা বলে চিত্রিত। ঠিক সেই পথেই এগিয়ে চলছে কৃমিকীটরা। কেউ আগে, কেউ পিছে। কিন্তু খেয়াল করুন- একজনও ভাবছে না- ওটা একটি বৃহৎ পায়ুদ্বার, যেটি ব্যবহার করা হয় টয়লেট করতে। দেখুন- একজনও ভাবতে পারছে না তারা কোথায় ঢুকছে! পারবে কি করে ?
তাদের জন্মই তো হয়েছে অন্ধকারে। পয়সা থেকে। পয়সার লোভে। কেউ ভাবতেই পারছে না- কেউ কেউ তাকিয়ে দেখছে যে – এরা ঢুকছে… পায়ুপথে! এরা তাদের মেরুদণ্ড বিকিয়ে কোথায় ঢুকলো, সেটা সত্যিই বড় কথা নয়।
যাকগে … এই মজার ছবিটি কত আগে আঁকা, কিন্তু আজকের দিনে আরো অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। মানুষ হিসেবে এদের আপনি হয়তো কোথাও দেখে থাকতে পারেন, হয়তো এরা কেউ কেউ পাখি ও হতে পারতো!
কিন্তু … আরেক বিষয় বলে শেষ করি – যে গর্তে এরা ঢুকছে – দেখুন, সেখানে কি নিবিড় অন্ধকার! সেখানে বর্তমান, ভবিষ্যৎ সব অন্ধকার।
এই অন্ধকার আশেপাশে টের পান? টের পান এদের কোলাহল?
টের পান- এদের গর্তে ঢোকার আপ্রাণ ঠেলাঠেলিতে আমজনতা হিসেবে আপনার প্রাণ ওষ্ঠাগত?
রিলেট করুন … রিলেট করতে চেষ্টা করুন।
আমি বরং এই সুযোগে একটুখানি গান শুনি- তুমি কি কেবলই ছবি ??
Art:
“The Flatterers” – By Pieter Brueghel the Younger, 1592