ইমারজেন্সি নাইট ডিউটি চলছিল। এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে খানিক আগেই। আরেক দফা নামবো নামবো করছে এই … এইবারে। খোলা জানালার ওপাশ থেকে চোখে আসছে নীলচে ঝলকের বিদ্যুৎ। জোলো হাওয়া অস্ত্র শানাচ্ছে শিরশিরে।
আমি, পি.পি.ই পরে চেয়ারে বসে ছিলাম বোকার মতো। শুনশান ইমারজেন্সি রুম ঝকঝকে তকতকে। রোগী আসেনি প্রায় বেশ কিছুক্ষণ হলো। অপ্রত্যাশিত নয় যদিও খুব একটা। এটা এই সেই লক ডাউনের শুরুয়াৎ থেকেই লক্ষ্য করে আসছি আমি। জরুরি রোগীর সংখ্যা কমে গেছে অস্বাভাবিক রকমের। রোগ-বালাই যদিও রাতারাতি কমে যায়নি আশা করছি। সম্ভবত ইমারজেন্সির সংজ্ঞাটাই বদলে গেছে এই অধুনা করোনা-কালে। ইমারজেন্সি মানেই এখন মূলত কোভিড সম্ভবত।
গরম পড়েছিল বেশ। বিশেষত সকালের দিকটাতে। হ্যান্ডওভার নিয়েছি যখন রাত ন’টার সময়তে, তখনও চ্যাটচ্যাটে গুমোট ছিল বিশ্রী। পিপিই-স্যুট এঁটে বসছিল গায়ের চামড়ার সাথে। হাসফাঁস লাগছিল বড্ডো। অস্বস্তি। উশখুশ। অধৈর্য।
এই এতক্ষণে একটু আরাম লাগছে অবশেষে। বা বরং “শীতশীত করছে” বলা ভালো। চপচপে ঘামের ওপর, বৈদ্যুতিন পাখার হাওয়া হুশহুশে।
উঠে, ফ্যানের রেগুলাটারটা কমাতে গেলাম। এক জোড়া মথ ঢুকে পড়েছে বৃষ্টি বাঁচিয়ে, ঘরে। টিউবের চারদিকে ঘুরে ঘুরে নাচছে ফড়ফড়। উগ্র আর সুতীব্র ফিনাইলের বাস। হাউজ কিপিং থেকে পরিস্কার করে গেছে এই মিনিট খানিক আগে। টিউবের আলো আর মেঝের টাইলসে তাই তারই সফেদ পিচ্ছিলতা। অন্যমনস্ক চোখে জরিপ করে যাচ্ছিলাম এইসবই। ডান হাতটা তখনও আলগোছে রাখা আছে রেগুলেটারের ওপরে। হঠাৎ, সিকিউরিটির ছেলেটা ঢুকলো। ইশারা করলো বাইরের দিকে–
— স্যার … ওই যে। আবার আসছে। দাঁড়ায়ে আছে বাইরে। চলেন।
এ ইঙ্গিতের অর্থ আমি বুঝি। বুঝে গেছি এই এতদিনে। এরা সব এ’রকম সময়েই আসে। ঠিক এইরকম রাত নিশুতে। চুপিচুপি। আসে, অথবা পুলিশে ধরে নিয়ে আসে রাস্তা থেকে। আদুড় গা কিংবা জামাপ্যান্ট মামুলি। ধ্বস্ত চোখমুখ। ঝুঁকে যাওয়া কাঁধ-মাথা।
ক্লান্ত, বড়ো ক্লান্ত লাগে আমার এরকম পরিস্থিতিতে। অনন্যোপায় রকমের ক্লান্ত। দীর্ঘশ্বাস চাপলাম একটা তাই ছোট্ট। বললাম– চলো। যাচ্ছি। তারপর হাঁটা লাগালাম পিছন পিছনে।
দশতলা প্রকান্ড সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালটার বাইরে রাত্রি নেমেছে প্রগাঢ়। সিমেন্টের খাঁ খাঁ চাতালে টাটকা কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির দাগ। আর সেইখানেই দাঁড়িয়ে আছে পাঁচজনে।
একটি পুরুষ। দুটি মহিলা। একটি খোকা। আর একটি খুকু। খুকুর বয়স মেরেকেটে সাত আট হবে। খোকাটি, নয় দশ। জড়সড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচজন মিলে।
গার্ড ছেলেটি বললো–” উত্তর চব্বিশ পরগণা থেকে আসছে সব স্যার এরা।…”
শুনে, এক ঝটকায় মাথার মধ্যে ব্ল্যাকবোর্ডটা ফুটে উঠলো আবার। চক দিয়ে লিখে রাখা পাঁচটা নিরীহ শব্দ। আর এঁটো দাঁতের একটি শিশুর মুখ। তৃপ্তির। ঝাড়া দিয়ে সেসব সরিয়ে দিলাম ক্ষণিকে। ডাকলাম পুরুষটিকে হাত নেড়ে–” এ-ত রাতে? কিসে এলে তোমরা ? কখন..? ত্তো … তোমাদের বাড়ি কোথায়?”
লোকটি এগিয়ে এলো দু এক পা। শস্তা টেরিকট জামা প্যান্ট শরীরে। গোড়ালির কাছে আর কব্জিতে গুটিয়ে রাখা এলোমেলো।
” বাড়ি মালবাজার স্যার। হাজিরা মুজিরা খাটতে গেছলাম। এই আমি … বউ আর, ছেলে মেইয়্যে। অই উনিও গিছলো। উনি পাশের বাড়ি হয় হামদের। ” লোকটা হাত উঁচিয়ে মহিলাকে বাঁ পাশের মহিলাকে দেখালো।
” তারপরোৎ লক ডাউন। খাইতে পাই না। খুব কষ্ট স্যার। খাওয়া খাঈদ্য মেলে না উদিকে। মালদা অব্দি হাঁটি আসিছি। সেলায় টেম্পু পাইলাম একটা। বেশি ট্যাঁকা নাই বলিয়া টেম্পুওলা এইখানোৎ ছাড়িয়া পলায় গেল।”
কাহন শুনতে শুনতেই নাম ধাম শুনে নিচ্ছিলাম আমি। বয়স। শারীরিক অসুবিধা। বডি টেম্পারেচার। যান্ত্রিক ভাবে জরিপ করে নিচ্ছিলাম ডাক্তারি। আপাত সুস্থ মানুষ পাঁচজন। দুটি শিশু। তিনজন পূর্ণবয়স্ক মানব-মানবী। দাঁড়িয়ে আছে পাঁচজনে মিলে পাশাপাশি। কাঁখে আর মাটিতে বোঁচকা বড়ো বড়ো।
আমার অস্বস্তি লাগছিল বড্ডো। অনেক চেষ্টাতেও আমি ব্ল্যাকবোর্ডটাকে কিছুতেই মুছতে পারছি না আর। মাস্ক, পি পি ই স্যুট, ক্যাপ, শ্যু কভার, গগলস সমেতও ল্যাংটো মনে হচ্ছে সহসা নিজেকে নিয়ন আলোর নীচে। বড্ডো, বড্ডো অসভ্য রকমের ল্যাংটো। খুকিটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি একটা চুষছিল। হঠাৎ এক মহিলার আঁচল টেনে ধরে চোখ বড়ো বড়ো করলো–” বাড়ি যাবা না মা? বাড়ি? বিষ্তি আসতেছে হুই গো! দ্যাখসো?…”
নাহঃ। আর বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয় এইখানে। ব্ল্যাকবোর্ডটা এবারে গিলে খাবে নয়তো। দ্রুত অ্যাম্বুলেন্সে খবর দিতে বললাম ওয়ার্ড মাস্টারকে। আর লোকটিকে বললাম– “কোয়ারান্টাইন সেন্টারে যেতে হবে। জানো তো?”
লোকটা হাসলো। মুখ ফিরিয়ে আকাশটা জরিপ করলো সেকেন্ডখানেক। তারপর আচমকা গলার স্বরটাকে নামিয়ে ফিসফিসালো –” জানি স্যার। অ্যারা … ওই অ্যাকটু ভ-য় পাতিসে। আমি বুঝায়ে দিবনি অখন। খালি একটু জলদি যদি…। বাচ্চাগুলার ঘুম পাইছে তো খুব…। তিন দিন আতিবেলায় ঘুমায় নাই ভালো কইরে। ”
১০২-এর অ্যাম্বুলেন্স চলে এলো মিনিট দশেকেই। বলতে গেলে একরকম খুশি মনেই উঠে গেল ওরা। খুকিটি বড় বেশি রকমের টরটরে। চোখে মুখে বড্ডো অকারণ রকমের আশ্চর্য হাসি। মায়ের আঁচল টানাটানি করা শুরু করলো আরো একবার প্রবল উৎসাহে–” বাড়ি যাইতেসি। বাড়ি যাইতেসি। এইই গাড়ি আনসে আমার বাবা। দেখসো? মা? বাড়ি যাইতেসি হামরা…।”
তারপর চলে গেল সক্কলে মিলে অ্যাম্বুলেন্সে চেপে।
রাতটা বড় গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে আজকে। স্থায়ী ভ্রু-কুঞ্চনের মতো সুতীব্র, সুগভীর গোলমেলে। পুরোনো সেই ছবিটা ঝটকা মেরে ফিরে আসছে বারবার।
একটা ব্ল্যাকবোর্ড। পাঁচটা শব্দ। আর একটি মেয়ে। এই তো… এই খুকিরই বয়সী অনেকটা হবে। তাকিয়ে ছিল ঠিক এম্নি রকম আশ্চর্য হাসি নিয়ে।
সেবার, অ্যাক্টিভ কেস ফাইন্ডিং-য়ের ফিল্ড ভিজিটে বেরিয়েছিলাম আমরা। বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিবি রোগী খোঁজ করা হবে স্বাস্থ্যদপ্তর থেকে। আর আমাকে তার পরিদর্শক হিসাবে নিযুক্ত করেছে সরকার বাহাদুর।
সঙ্গের যে ড্রাইভারটি ছিল, সে বিস্তর পোড় খাওয়া লোক। চাকরি করছে দীর্ঘ দিন হেল্থ ডিপার্টমেন্টেই। ব্লক হাসপাতালটা ঝাঁ ঝাঁ করে পেরিয়ে বাঁক নিল আচমকা ডান-হাতি। ” সাব সেন্টারের দিকে নিয়া নিলাম স্যার। সুপারভাইজার দিদিকে পায়া যাবেন তাহলে।”
তুমুল ঝড় হয়েছিল সেবার গত রাত্তিরে। সম্ভবত নিম্নচাপের সম্ভাবনাও ছিল দিন তিনেকের। মনে নেই ঠিক। তবে আকাশের মুখ ভার ছিল তখনও। ঠিক যেন সাবেকি স্লেট রঙের। এসব দিনে গ্রামের রাস্তা যেমন হয় আর কি! জমা জল আর ইট-খোয়াইয়ের উঁচুনিচুতে ক্ষতবিক্ষত একেবারে। গাড়িটা দুলছিল বিপজ্জনক রকম। নুয়ে পড়া বাঁশ ঝাড় এসে সপাটে ফিরতি চাপড় মারছিল উইন্ডশিল্ডে। ছেঁড়া পাতা চিপকে যাচ্ছিল চিকন চিকন।
ভাঙা একটা কালভার্ট ছিল ফুট দশেকের। মিটার পাঁচশ নীচে, হঠাৎ গজানো নদী। সেইসব কোনোক্রমে পেরিয়ে এসে সাবসেন্টারে পৌঁছে দেখি — তালা ঝুলছে সবুজ দরজাতে। দাওয়াতে গোটা তিনেক ছাগল আর সুতোর মতো প্রস্রাব জলধারা।
আমাদের তো মাথায় হাত! সুপারভাইজারকে ধরতে না পারলে ফিল্ড লেভেলের তথ্য পাওয়া মুশকিল। ফিরে গিয়ে উপরওয়ালাকে রিপোর্ট করা যাবে না ঠিক মতো। জানা যাবে না কেস ফাইন্ডিংয়ের হাল হকিকত। ড্রাইভার সাহেব দেখলাম যদিও সত্যিই বড় চৌখস। নির্বিকার এক্কেবারে। দরজা খুলতে খুলতে বললো–” খাড়ান। খোঁজ নিয়া দেখতাসি কিছু একটা কইরে।” বলে, একটা ঝোপের আড়ালে ধসধসিয়ে নেমে গেল। পেচ্ছাপ করতে গেল সম্ভবত। ফিরে এসে, খোঁজ নেবে এদিক সেদিক।
গাড়িতে বোকার মত বসে থাকতে ভালো লাগছিল না। ভ্যাপসা গন্ধ পেট্রোলের। নেমে পড়লাম তাই আমিও দোর ঠেলে। এ তল্লাটের পথঘাট সেভাবে চিনি না কিছুই। এলোমেলো দু চার কদম হাঁটছিলাম তাই একা একা। ছড়িয়ে নিচ্ছিলাম হাত পাগুলোকে টানটান করে। সবুজে সবুজ চারিধার। পাখি ডাকছে পিঁ পিঁ। ফড়িং উড়ে যাচ্ছে ঘাসের ডগায় গোঁত্তা মেরে মেরে। দেখলাম–বাঁ দিকে আরো একটা ছোট্ট বাড়ি আছে। দেখলেই বোঝা যায় ইস্কুল। প্রাইমারি। এক চিলতে উঠোন। একটা ফাঁকা ক্লাসঘর। বাইরের দেওয়ালে সরকারি বিজ্ঞাপন আঁকা প্রথামাফিক। প্রকান্ড একটা লাল রঙের পেনসিলের উপর ঠ্যাং ঝুলিয়ে চড়ে বসেছে এক জোড়া শিশু। বৃষ্টির জলে সে পেনসিলের বেশিরভাগই ধুয়েমুছে গেছে যদিও। তবুও… চেনা ছবি। বোঝা যায়…।
ঠিক ওইখানেই সেই ব্ল্যাকবোর্ডটাকে দেখেছিলাম আমি। দাওয়ার ভিতরের সিমেন্ট-দেওয়ালের সাথে খোদাই করে বসানো। চক দিয়ে লেখা ছিল কিছু। ভালো করে দেখব বলে দাওয়ায় উঠতে গিয়েই চমকে গেছি। এতক্ষণ খেয়াল করিনি। দেখা যাচ্ছিল না বাইরে থেকে। এক্কেবারে কোণার দিকে বাবু হয়ে মেঝেতে বসে আছে একটি খুকু। ধনুকের মতো পিঠটা, দেওয়ালে ঠেকনা দিয়ে রাখা। খাচ্ছিল কিছু একটা বসে বসে। ভাতই সম্ভবত। ঝোলে ঝোলে বন্যা হয়ে গেছে হলুদ। তিরতিরে গুঁড়ো মশলার দাগ। কোলের ওপর রাখা কাগজের থালাটা নেতিয়ে বেঁকে গেছে একেবারে।
খুকুটি মুখ তুলে হাসলো–” সেন্টারের দিদিমণিকে খুঁজতেছ? ওই চলে গেল ত হুই অইদিকে দিকে সাইকেল নিয়া।”
একা দাঁড়িয়ে আছি। হাতে সর’ম কাজবাজও নেই এক্ষুণি। ড্রাইভার এলে ভাবা যাবে খন । এসব ক্ষেত্রে যেমন হয় সাধারণত। সময় কাটানো আলাপ টুকটাক।
” কী খাচ্ছিস রে বাবু? বসে বসে?” জিজ্ঞাস করতে যাচ্ছিলাম তাই হাঁটুতে ভর দিয়ে ঝুঁকে। ব্ল্যাকবোর্ডটার ওপর চোখ পড়ে গেলো তার আগেই। সেই ব্ল্যাকবোর্ডটা। যার উপর লেখা শব্দগুলো এখন স্পষ্ট। শব্দগুলো এখন পাঁচটা।
ভাত
আলু সয়াবিন
এবং একটু নীচে, একটুখানি তফাতে, বড় বড় করে লেখা–
কাল– ডিম।
ড্রাইভার ফিরে এসেছে এরই মধ্যে। ঠিক কখন… খেয়াল করিনি। আচমকা পায়ের শব্দে মুখ ফেরালাম। ” এই তো…। এই… সেন্টারের দিদিমণিকে দেখছিস নাকি? ছেমড়ি?”
খুকিটি এবারে আর উত্তর দিল না ভাষাতে। মুখের ভিতর ওর চারটে আঙুল পোরা ভাত শুদ্ধ। মাথা ঝাঁকালো ওই ভাবেই। একদিকে দেখিয়ে দিল বাঁ হাত তুলে। ড্রাইভার শব্দ করে হাসলো । ওস্তাদের মতো হাসি। হেহঃ। হাত দিলো বকলসে ঝোলা চাবির রিঙে। গাড়ির দিকে এগোতে এগোতে বললো– চলেন স্যার। বুঝে গেছি…। চ্চলেন, সামনেই…।
” খা। আসি কেমন? খা… বসে বসে” বলে নেমে এলাম। থালায় তখনো অনেকখানি ঝোলমাখা ভাত। অস্বাভাবিক রকমের বেশি। এই এতখানি ভাত সম্ভবত খুকিটির খাওয়ার সাধ্যও নেই। মিছিমিছি নিয়েছে লোভে পড়ে। তবুও… বড্ডো আশ্চর্য সে লোভের বস্তু। ভাত আর সয়াবিনের ঝোল। খাচ্ছে চার আঙুলে তুলে তুলে মুখে পুরে। আর হাসছে বোকার মতো। যেন দিগ্বিজয় করেছে মস্ত একখানা।
গাড়ির দরজা টানতে গিয়ে চোখাচুখি হয়ে গেল আবার। খুকিটি যেন অপ্রত্যাশিত প্রশ্রয় পেল তাতে। হাত তুলে দেখালো ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে জুলুজুলু। রিনরিনে কণ্ঠে গলা উঁচিয়ে বললো… যেন চুপিচুপি বলছে … যেন ওর অনেক শত্রু … যেন গুপ্তধনের কথা পাঁচ কান না হয় কোনোমতে… সেইভাবে, ঠিক সে-ইভাবে আহ্লাদের সাথে বললো–” দেখসো? কাইল ডিম! গোটা দিবে। গো-টা ।”
এই ছবিটাই ঘুরেফিরে আসে। সেদিনের সেই খুকু আর আজকের খুকিটির মুখদুটো একই রকম এক্কেবারে। কিংবা, এদের সকলের মুখই একরকম হয়। অথবা কি জানি … মুখটা হয়তো আলাদা। মিলটা আদতে থাকে এদের চোখে। আশ্চর্য রকমের হ্যাংলা চনমনে চোখগুলোয়। জানি না। কিন্তু ঘুরে ফিরে আসে বারেবারে। অতর্কিতে। অজুহাত ছাড়া।
এসবই ভাবছিলাম। ইমারজেন্সি রুমে বসে বসে। এরকম ভাবনার ফুরসত মেলে না সহসা। মিলতো না কোনোমতেই। ইদানিং মিলছে। এই যে এইসব অলস রাত্রি যাপন। সুতোয় সুতোয় গিঁট পড়ে যাওয়া ভাবনাচিন্তা এলোমেলো। টরটরে খুকি, গোটা ডিম, চব্বিশ পরগণা, টেম্পো…।
হঠাৎ ওয়ার্ড বয় এলো। হাতে একতাড়া খাতা-কাগজ। টেবিলে রাখতে রাখতে বললো–” পার্টিকে পাইছি স্যার। বলে নাকি– চকলেট আনতে গিছলো। চা দোকানে। এই অ্যাখুন ফিরলো। এই যে…। কই… আসো। ভিত্রে…।”
খাতাটা কলবুকের। পাতার ফাঁকে বেড-হেড টিকিট আর ডেথ সার্টিফিকেটের কাগজ গোঁজা। কার্বন পেপার। আলপিন। ‘পার্টি ইনফরমেশন’ দস্তাবেজ। সবশুদ্ধ উল্টেপাল্টে দেখছিলাম আমি। এটা, পেন্ডিং কেস। বকেয়া। ডেথ কনফার্মেশন করে এসেছি ঘন্টা দেড়েক আগেই। বাড়ির লোককে ইনফর্ম করা হয়নি। ছিল না। সিস্টার বলছিলেন– এই তো ছিল…। স্যালাইন চেঞ্জ করতে এসেও দেখেছি। কই যে গেল…।
তখনই বলে এসেছিলাম পার্টি এলে নিচে পাঠাতে একবার। ডি.সি টাও তখনই লিখবো। নাম, ঠিকানা এসব আরো একবার মিলিয়ে নেওয়া দরকার। ভর্তির সময় তাড়াহুড়োতে কী বলতে কী বলেছে! পরে, ঝামেলায় পড়বে তখন বেচারিরা। দৌড়োদৌড়ি করতে হবে অফিসে অফিসে। থাক। পরেই লিখি।
সেই পার্টিই তবে এসেছে এতক্ষণে!
” কই? আসো ভিত্রে” ওয়ার্ড বয় বললো আবার। তারপর একটু থেমে, ইতস্তত করলো–” আমি নীচেই ওয়েট করি স্যার? ডাক দিয়েন। এই সামনেই… লালুর সাথে একটু দরকার ছিল…।”
আলতো মাথা ঝাঁকালাম। চোখ বুজেই খুললাম আবারও। মণি নাচালাম সামান্য ইঙ্গিতে –” যা। আড্ডা মার। ডেকে নেবো আমি শেষ হলে। এই ইনিই পার্টি? চকলেট? চকলেট আনতে গিছলা মানে? এত রাতে?”
‘পার্টি’টি মহিলা। বয়স পঁচিশ থেকে পঁয়তিরিশ যা খুশি হতে পারে। বোঝা যায় না ভালো। কচি কলাপাতা রঙের ফুল ফুল আঁকা শাড়ি। মুখে মাস্ক। গোলাপী কাপড়ের। চুল, ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা। ফিজিক্স ল্যাবের ফিনফিনে বাটখারার মতো দুল দুই কানে। এক ঝলক দেখলে ভিখারিও মনে হয় না। আবার বড়লোকও … । সুতোর কাজ করা কাঠের হ্যান্ডেলের একটা কাপড়ের ভ্যানিটি কাঁধে।
মহিলার চোখে জল নেই। কিরকম যেন একটা ভ্যাবলানো ভাব দৃষ্টিতে। তাকিয়ে আছে সরাসরি, সিধা আমার দিকে।
“চকলেট? এই এখন…? আচ্ছা…ঠিকাছে। বসুন।” আবারও বললাম আমি।
মহিলা সরাসরি জবাব দিল না। টুলে বসলোও না। স্রেফ চোখে ভাষা ফিরে এলো কিছুটা হলেও।
— মারা গেছে। তাই না? চকলেট…। চকলেট খাবে বললো। লেবু চকলেট। এরা বললো নীচে নাকি পাওয়া যায়…। মরে গেলো? খাওয়া পেল না? হ্যাঁ? এই জন্মে? আর খাওয়া পেল না?
গল্পটা কিছু কিছু মাথায় ঢুকছিল। চকলেটের বিষয়টাও। বাকি আর যা কিছু … বিলাপ-টিলাপ … ওসব অত না বুঝলেও চলবে। কিন্তু কথোপকথন চালানোটা দরকার। আমি বসে বসে নাম ধাম মিলিয়ে স্বামীর ডেথ সার্টিফিকেট লিখে যাব খসখস আর বউ চুপচাপ বসে থাকবে, এটা একটা কেমন জানি বিসদৃশ। নির্বিকার মুখে হাত চেপে ধরে শাঁখা পলা ভেঙে দেওয়া সদৃশ।
কথা বাড়ালাম তাই। কথা … বাড়াতে হয়। খেজুরে। অকিঞ্চিৎকর।
— কী করতো? স্বামী?
— দোকান ছিল। টেলারিং।
— ও। এখন তো… বন্ধ। তাই না? লক ডাউনের বাজারে যা অবস্থা!
— হ্যাঁ। বন্ধ। এক মাস। দেড় মাস।
— আর তুমি? তুমি কিছু করো?
বউটি থমকালো। নাক টানলো শব্দ করে। কাঁধের ভ্যানিটি ব্যাগটা পিছলে কনুইয়ে নেমে এসেছিলো। ঠিকঠাক করলো সময় নিয়ে। “বসি একটু। মাথাটা কেমন কেমন করতেসে …। ” বলে, টুল টেনে ধীরে ধীরে বসলো। ব্যাগটাকে, গুছিয়ে রাখলো কোলে। ভর দিলো। কনুইয়ের। তারপর হাসলো সামান্য। চোখের হাসি।
— এখন হাজিরা খাটি স্যার। লোকের বাড়ি বাড়ি। ছোটো দোকান। জমানো তো কিছুই নাই। দু এক টাকা যা ছিল…। তারপর হাজিরা খাটি। ও বাড়িতে তিনদিন ধরে পড়ে আছে। গাড়ি নাই। শেষে পঞ্চায়েতকে ধরে টোটোতে…। ডাক্তার বললো একটু আগে পেলে…। আগে কী করে আনি স্যার? কত টেরাই নিলাম। গাড়ি নাই। শেষে পঞ্চায়েতকে ধরে টোটোতে…।
এসব শুনতে ভালো লাগে না আমার ইদানিং। মাস্ক, পি পি ই, গ্লাভস, ক্যাপ … সবশুদ্ধ ল্যাংটো লাগে বড্ডো। অশোভনীয়, অ-স্বাভাবিক নগ্নতা। কথা ঘুরিয়ে দিলাম মোচড় মেরে।
–রেশন পাও না? রেশন? চাল ডাল আটা? দিচ্ছে তো। সরকারে…
মহিলা আচমকা ঝটাৎ করে চাইল আমার মুখের দিকে সরাসরি। সাদা চোখে, ঝকঝকাচ্ছে প্রশ্ন। তারপর … সামলে নিল। নরম হল প্রাথমিক সুতীব্র চাউনি অনেকটা। নাক টানলো। ব্যাগটা গোছালো পেটের কাছে। মাস্ক টানলো নাকের উপর। এবং তাকালো আবারও
— ভিখারি নই তো স্যার। ভিখারি না। ভিক্ষা করিনি। ওর তো দোকান ছিল। ছেলে মেয়ের ইস্কুল। ঘর আছে নিজের। ভিখারি তো না! শুধু ভাতে হয়? বলেন? শুধু ভাত আর ভাত? তাই খাইতাম এতদিন। ছেলেমেয়েগুলা … । ওরা কান্তো। রেশনের আটা বিক্কিরি করলাম একদিন। তারপর কয়দিন ভাত ডাইল তরকারি। … ডিম নাই। মাছ নাই …। ভিখারি তো না! অ্যার অসুখ করলো তারপর। লোকাল ডাক্তার…। সবজিও কিনিবার পাইতাম না আর। ভাত আর ভাত। লাস্টে এইখানে এসে ভাত পাইলো মানুষটা। সবজি। ডিম। মাছ। মা-ং-স-ও। খাইতে পারত না। বলত, রাইখে দাও। প্যাটে ব্যাদনা কমলে খাবোনে। ডিম দিছিলো আজ হসপিটালে সকালে। প্লাস্টিকে রাইখে দিলাম…। রাইত্যের মাছও। খালি বলে– ব্যথা কমলে খাবোনে। কাইল সকালে খাবো। ডিম খাবো। মাছ…। তারপর এই অ্যাকটু আগে কইলো লেবু চকলেট খাবো। গলা শুকনা লাগতেসে। জিভ্ভায় টেস্ট নাই। …”
ফুঁপিয়ে এবার আচমকা কেঁদেই ফেললো মহিলাটি। গোলাপি মাস্ক নেমে গেছে থুতনিরও নীচে। নাকে, মোটা জল।
— লেবু চকলেট খাইতে পারলো না স্যার। ডিম রাখছিলাম। ছেলেকেও দিই নাই। ডিম খাইতে পারলো না আর লোকটা আমার …।
আলু-সয়াবিনের ভিখিরি আমার দেখা ছিল। নিজস্ব ছোট্ট দোকান, ভদ্রাসন, ভদ্রলোকের ভিখিরি দেখিনি কোনোদিনও। আমার মন তীব্র রকমের বিষ ঢেলে চলেছিল ‘ লক ডাউন’ শব্দবন্ধের ওপর। মাস্ক, পি পি ই, গ্লাভস, ক্যাপ সত্ত্বেও চূড়ান্ত নগ্নতা।
ভদ্রমহিলা, কেঁদেই চলেছেন। গলা খাঁকারি দিয়ে ” নাম এবং ধাম” আরো একবার মিলিয়ে নিলাম আমি। পাখার হাওয়াতে ডেথ সার্টিফিকেটের পাতাটা হাতে ঠোক্কর মারছে ঠকঠক। ব্ল্যাকবোর্ডটা ক্রমে বড় হয়ে উঠছে মাথার ভিতরে। গিলে খাবে। গিলে খাবে এবারে এই সর্বস্বকে কৃষ্ণগহ্বর ক্রমে ক্রমে। আর সেই অপরিসীম অন্ধকারের মধ্যে হ্যাংলা হাসবে একটি শিশু।
বলবে উচ্চ কণ্ঠে – কাল ডিম।
*