লক ডাউনের প্রাথমিক দিন গুলিতে আমার ড্রাইভারকে না করেছি আসতে|অবশ্যই মাইনে পত্তর দিয়েছি|তবে আসল কথা হল এসময় আমার লাল গ্লামারটাই ছিল আমার বাহন|বাইকে বসলে হাওয়া লাগে, এলোমেলো চুল দাপড়ে বেড়ায়| বাইরের পৃথিবীটা দৃশ্যমান থাকে ত্রিমাত্রিক খুঁটিনাটি নিয়ে|সেসময় চেম্বার শেষ হতো লহমায়|ভয় ভয় মানুষদের টুকরোটাকরা সমস্যা সামলে আমিও ফিরে আসতাম ভটভটিয়ে|একাকী রাস্তার অকাল রাত্রিতে|অকাল তো বটেই দেখতাম সন্ধ্যা রাত্রিতে শুনশান বাজারঘাট|বাড়ির উঠোনে প্রতিবেশী মানুষেরা গল্প করছে আলস্যে|আমার মনে পরতো ছোটবেলার কথা|
সন্ধ্যার পর খুব একটা কাজ ছিলো না মানুষের|দোচালা টালির ঘরের বারান্দার হ্যারিকেনে দুলে দুলে লেখাপড়া হতো| হ্যারিকেনের ঘোলাটে আলো আরো বেশি ঘোলাটে হয়ে যেত ভীড়করা পোকাদের ভীড়ে|বাবা, বিনোদ জ্যেঠু,শ্যামল কাকু বাঁশের মোড়ার উপর বসে গল্প করতো এরকমই|এরকমই নিরিবিলি রাস্তা ঘাট|এরকমই আলস্য জীবন| মুড়িমাখা আর প্লেটছাড়া চায়ের কাপের মতো বাহুল্যহীন সন্ধ্যা|হ্যারিকেনের একপাশে সহজপাঠ, কিশলয় উল্টে রেখে অকস্মাৎ ঘুমিয়ে পড়া| চিন্তাহীন|
উঠোনের সান্ধ্য আড্ডাটুকু ঘিরে দানা বাঁধছিলো আমার নস্টালজিক অতীত|ভালোই লাগছিলো|কিন্তু ক্রমেই বাঁধন ছিঁড়েছে সেইসব দিনের স্বপ্নরা|হসপিটালের ইমার্জেন্সিতে শূন্যে নেমে আসা কেস- কামারীর সংখ্যাটা বেড়েছে একটু একটু করে|প্রতিবেশীর লাঠির বাড়িতে সেলাই হওয়া স্ক্যাল্প আস্ফালন করেছে ঘেন্নায়| একটু একটু শুরু হওয়া কর্মদিন প্রতিযোগী পৃথিবীকে নামিয়ে এনেছে লহমায়| লকডাউনের পৃথিবীতে একটু একটু ফিরে এসেছে ঘেন্নাদিন| ক্রমশই দেরি হতে থাকা চেম্বারে ভীড় করেছে দিশাহীন হতাশাচ্ছন্ন মানুষ|যেহেতু বিশেষজ্ঞবিহীন এই মফস্বল, জেনারেল আউটডোরে ভীড় করা মানুষ ,.., সব বয়েসী ..লম্বা অপেক্ষার লাইন পেরিয়ে শুনিয়ে গেছে ..ঘুম হয় না স্যার …মাথা ঝিম ঝিম করে ..দুর্বলতা ..ইত্যাদি ইত্যাদি| বাস্তবিক বিশেষ কিছু খুঁজে না পাবার পরও মাঝরাতের ইমার্জেন্সিতে ছুটে এসেছে উদ্বেগে| কেমন একটা লাগছে স্যার …লকডাউনের পৃথিবীতে সমস্যা জর্জর মানুষেরা হতাশার আন্টিডোট খুঁজতে এসেছে হাসপাতালে|চিকিৎসায়|
এইটুকুও ভালো| মানুষ ভরসা রাখছে বিজ্ঞানে|
সুন্দরবনে এসেছিলাম ক্যাম্পে| এদিকে ইনফেকশন, অপুষ্টি, অকাল বার্ধক্য,আর লকডাউনে, আটকে যাওয়া চিকিৎসা বিভ্রাটের পেসেন্টই বেশি|
রুগী দেখতে দেখতে গল্প হয়|আমফানের গল্প|টিন উড়ে যাওয়া|উঠোনের উপর একমানুষ নোনাজলের গল্প|ভেঙে যাওয়া বাঁধের গল্প|
প্রতিটি বাচ্চার গলায় কালো সুতোয় একটা করে মাছের প্রতিকৃতির কবজ টাইপ|
জিগ্গেস করেই ফেল্লামঃ মাছ কেন?
এই কবজ পরলে পুকুরে ডুববে না|
এই কবজ পরতে পরতেই সাঁতার শিখে নেয় এরা|
তবে আজকের ক্যাম্পে ঘুমের ওষুধ চায়নি কেউ|সারাদিন অসম্ভব পরিশ্রম করে এরা ঘুমোয় স্বপ্নহীন| নিশ্চিন্তে|
স্বপ্নদেখা ঘুম গাঢ় নয়|তাতে মিশে থাকে না পাওয়ার, হারাবার হতাশা|