০৯.০৮.২৪-০৮.০৯.২৪
৫৩. লিখতে লিখতে ভাষা ফুরিয়ে গেছে, কিন্তু বিচারের বাণী এখনো নিভৃতে নীরবে কেঁদে চলেছে। রোজ পুলিশ-প্রশাসনের কুকীর্তি সামনে আসছে- আমরা ভাবছি আর কত নীচে এরা নামতে পারে! কিন্তু তার পরের দিনই আরো নীচে নামার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে এরা। এর মাঝে একটাই আশা অভয়ার মা-বাবা এখনো হার মানেননি, তাঁরা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের মুখেই উঠে আসছে আত্মহত্যার গল্প দেওয়ার কথা, দেহ দেখতে না দেওয়ার কথা, তড়িঘড়ি দেহ বের করে আনার কথা, টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করতে চাওয়ার কথা, দেহ দায়িত্ব সহকারে পুড়িয়ে ফেলার কথা, এমনকি চাপ দিয়ে মিথ্যা বয়ান আদায় করার কথাও!! এতসব আমরা সিনেমায় দেখতাম, এখন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। ভাবতে শিখছি, ওই জায়গায় কাল আমরা যে কেউ থাকতে পারি- ধর্ষকের অত্যাচারের হাত থেকে বিচারের আশায় যতবার আমরা মাথা তুলে তাকাবো- রাষ্ট্র আমাদের ততবারই ধর্ষণ করবে। একজন ক্রিমিনালের হাতে ধর্ষণ, নাকি উচ্চশিক্ষিত অফিসারদের হাতে ধর্ষণ- কোনটা বেশি বেদনার, জানিনা। যেদেশে উচ্চ পদের পুলিশ অফিসার মাইকের সামনে অবলীলায় মিথ্যা বলে, সেদেশে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কোথায় ঈশ্বরই জানেন!!
৫৪. মিথ্যাবাদী শুধু পুলিশ, মেরুদণ্ডহীন শুধু পুলিশ- এরকম মনে করার কিছু নেই। উচ্চশিক্ষিত ডাক্তারেরাও কম যান না। এখন আস্তে আস্তে নর্থ বেঙ্গল লবির কুকীর্তি সামনে আসছে। কলেজের মাথারা স্বীকার করতে শুরু করেছেন অভীক দে, বিরূপাক্ষ- এসব হাঁটুর বয়সী লোকের কথায় তাঁরা পাশ-ফেল করিয়েছেন। অবশ্য এদের জন্য ফিরহাদ-মদনরাও পাড়ায় পাড়ায় ফোন করতেন, সেই খবরও আসছে। কিন্তু প্লিজ রাজনীতি করবেন না 🙏 তৃণমূল আসলে খুব মানবদরদী। তাদের একটা মানবিক মুখ আছে। প্লিজ রাজনীতি করবেন না।
কলেজে থ্রেট কালচারের কথায় আসি। সাগর দত্তে মেয়েরা বলছে ভাইভার সময় তাদের কীরকম আপত্তিকর প্রশ্ন করা হতো। আমাদের সময়ও মেয়েদের উপর এরকম অত্যাচার দেখেছি কিছু কিছু। আবার কাকলি বলছে, তাকে নাকি কোলে বসিয়ে পাশ করানো হয়েছে।
আমাদের কলেজে এক হাউসস্টাফ পরীক্ষা পাশ করলো হাসপাতালের মাথায় বসা একজনের কৃপায়- চোখের সামনে দেখলাম। সেই ছেলে পাশ করে তৃণমূলী থ্রেট কালচার চালায়, ফেস্টের পয়সায় গাড়ি কেনে- তাকে কেউ কিছু বলার নেই। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা, তার থ্রেট কালচারের শিকার আন্ডার গ্র্যাজুয়েট বাচ্চা মেয়েরাও- এমনকি তারা সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানোর পর্যায়তেও চলে গেছে। অথরিটি কোনো স্টেপ নেয়নি, বলা সত্ত্বেও। এত ভয় কীসের?? এদের শিরদাঁড়াটা কোথায়??
অভয়া ক্লিনিকের অনুমতি নেওয়ার সময় ধর্মতলার পুলিশ পর্যন্ত এসএসকেএমের নাম শুনে তার কথা জিগ্যেস করে, তার পিছনে কার কার হাত আছে সেকথাও বলে। কিন্তু কারো কিছু করার নেই। সবাই সব জেনেও চুপচাপ। আজ তার বিরুদ্ধে যার কাছে অভিযোগ জানানো হচ্ছে, সেই কলেজের মাথাও অস্বীকার করছেন, তাঁর সাথে ছেলেটির কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্ক নেই, অথচ সেই অভিযোগ জানানোর সময়ও তার ফোন থেকে বারবার ফোন আসছে!! কোন দেশে বাস করছি, নিজেরাও জানিনা। বুড়ো ভাম ডাক্তারগুলো নিজেদের বাড়ির নিচে লুঙ্গি পরে প্র্যাকটিস করলেও এদের পেট চলে যেত, কীসের লোভে এরা এই দুর্নীতিচক্রে প্রতিনিয়ত ইন্ধন যোগাচ্ছে ভগবানই জানেন। কত পয়সা এদের দরকার, কত ক্ষমতার আস্ফালনে এদের অর্গ্যাজম হবে, নিজেরাও জানেন না বোধ হয়।
৫৫. তবে যারা ধরা পড়ছেন, তার বাইরে সব ধোয়া তুলসীপাতা এরকম কিন্তু আদৌ নয়। নর্থ বেঙ্গল লবির বাইরেও প্রচুর দুর্নীতি রয়েছে। তারা মাঝে পাত্তা না পাওয়ায়, এখন আরো বেশি আন্দোলনে ঝাঁঝ বাড়াচ্ছেন। উদাহরণ শুরু করলে আজ সারাদিন কেটে যাবে। কুম্ভীরাশ্রু তো স্বয়ং ধর্ষকদলের পালিকা মাতা মমতা ব্যানার্জিও বিসর্জন করছেন। সব প্রতিবাদের ভাষা ও সুর একই নয়। আবার কারো কারো লক্ষ্য প্রতিবাদের মঞ্চে সবার সমবেত স্বরকে ভেঙে দেওয়া-
যেমন নবান্ন অভিযানে পুলিশকে চুড়ি পরার ইঙ্গিত নিয়ে সারাদিনের চর্চা। যেমন রাত দখলের রাতেও মেয়েদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠিত না হওয়া নিয়ে আলোচনা। আবার ঘোলা জলে মাছ ধরতে লাঠিতে ফেভি কুইক লাগিয়ে বসে থাকা রাম্বাম- তারা ভাবছে এই তো মানুষ খেপেছে- এবার যদি উল্টালে আমাদের কার্যসিদ্ধি হবে! এইসব হায়নাদের মাঝেও বিপ্লব চালিয়ে নিয়ে যাওয়া মুখের কথা নয়। তবে এখনো সেই কাজ প্রতিনিয়ত চলছে, রাজ্যে, দেশে, এমনকি বিদেশেও।
৫৬. প্রতিবাদ শুধু আরজিকরের ইস্যু নিয়ে নয়। মেডিক্যাল কলেজগুলোতে নবগঠিত রেসিডেন্ট ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশনগুলো সমস্ত দুর্নীতির বিরুদ্ধেই আওয়াজ তুলছে। সাথে রয়েছে ব্যাপক মিডিয়া কভারেজ- তাই অথরিটির কাছে বেশ মাথাব্যথা রয়েছে। চটিচাটা বর্তমান, কলকাতা টিভি (যার কর্ণধার কৌস্তভ রায় চিটফান্ড মামলায় ইডির আওতায় এবং সরকারি দাক্ষিণ্যে জেলের বাইরেও কার্যকলাপ চালাচ্ছে) ছাড়া বাকি মিডিয়া হাউস যথেষ্ট নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা করছে।
ক’দিন আগে বিভিন্ন কলেজের বাইরে সহায়তা কেন্দ্র খোলার নাম করে সরকারি রোগীদের বেসরকারি হাসপাতালে পাচার করার দুষ্টচক্র চলছিল। ব্যাপকভাবে প্রতিবাদ জানিয়ে তা তুলে নিতে বাধ্য করা হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় ইতিমধ্যে হাসপাতালে থাকা দালালচক্র, যার মাথায় সরকারি মদতপুষ্ট ডাক্তারেরাই রয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে লড়াই কে চালাবে! কীভাবেই বা চালাবে!!
৫৭. তৃণমূলী নেতারা লোকাল কাউন্সিলরের মাধ্যমে রোগী পাচার-চক্র শুরু করতে চাইলেও সাথে সাথে ‘বিনা চিকিৎসায়’ রোগিমৃত্যুর ভুয়ো খবর ছড়াতেও পিছপা নন। উপযুক্ত চিকিৎসা পাওয়ার পরও রোগীমৃত্যু নিয়ে মিথ্যা ন্যারেটিভ ছড়ানো, যেটা আরজিকরের উপাধ্যক্ষ নিজেই নস্যাৎ করেছেন- তাও অভিষেক ব্যানার্জির কুঞ্চিত কেশটাও উৎপাটন করতে পারবেনা কলকাতা পুলিশ। বরং কিছু তৃণপালিত ডাক্তার সেই ভাইপোর ট্যুইট মুখে করে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। অশিক্ষিত রাজনীতিবিদেরা নোংরামি করবে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এত পড়াশোনার পর যদি সেই পাঁকেই কাপড় নোংরা করতে হয়, তাহলে কীসের শিক্ষা, কীসের সংস্কৃতি!! ২০১৯-এও একইভাবে রোগিমৃত্যুর ভুয়ো ন্যারেটিভ দিয়ে আন্দোলন ভাঙা হয়েছিল- এবারও সেই একই প্রচেষ্টা! আলাপনের মতো এত বিচক্ষণ আমলাদের কিনেও সরকারের ভাবনায় নতুনত্বের অভাব স্পষ্ট।
৫৮. সিবিআই চলেছে সিবিআইয়ের তালে। এক মাস হতে চললো, তাদের অ্যারেস্ট লিস্টে এখনো একজনই। সন্দীপ ঘোষকে ধরা হয়েছে আর্থিক তছরূপের জন্য। সেই গোটা আঙ্গিকটাই আলাদা, অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত হয়েও। যে কলকাতা পুলিশ এত পারদর্শিতার সাথে সব তথ্যপ্রমাণ লোপাট করলো, তাদের নিয়ে সিবিআইয়ের কোনো বক্তব্য নেই। যে ডাক্তারেরা ওই বিভাগে কর্মরত, যারা সেদিন ডিউটি করেছেন, তাদের থেকেও কোনো সদুত্তর নেই। আমাদের ধরে নিতে হবে সরকারি হাসপাতালে একটা খুন হয়েছে- কেউ জানতো না, কেউ না!! তারপর ক্রাইম সীনের পাশে ঘর ভাঙা হলো, কেউ টের পেল না! যারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘর ভাঙা দেখেছে এবং যারা ভাঙিয়েছে- তারা সবাই জানে কে/কারা খুন করেছে- কিন্তু তাদের প্রশ্ন করছে কে!! মিডিয়ার লোকেরা ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম করছে, আসল ইনভেস্টিগেটররা এখনো কাউকেই সন্দেহ করে উঠতে পারছে না। আর এটা নতুন কিছু নয়। সিবিআই-ইডির বিচারাধীন রাজ্য সরকারি লুম্পেনরা যখন হাসপাতালে হলিডে হোমে থাকেন, তখন গোয়েন্দাবিভাগের আধিকারিকদের শরীরী ভাষায় কখনোই মনে হয়নি তাঁরা কিছু উদ্ধার করতে এসেছেন- তাঁদেরও অদৃশ্য কোনো সুতোয় নাচাচ্ছে বলেই মনে হয়। অবশ্য যে দেশে চিফ জাস্টিসও কেস নিতে ভয় পান, সেদেশে এ আর নতুন কী!!
৫৯. নিজেদের দায়িত্ব থেকে হাত ঝেড়েছে কেন্দ্রীয় সরকারও। চপওয়ালির কষ্টে চাওয়ালা পাশে দাঁড়াবে না তো কে দাঁড়াবে!! সে স্বাধীনতা দিবসে দু’কলি গেয়ে দিয়েছে অপরাধীর শাস্তি হবে। তার চ্যালারা ক’দিন রাস্তায় বসেছে- লাঠি খাওয়ার আগেই প্রিজন ভ্যানে উঠে পড়েছে, কিছু লোককে নবান্ন অভিযানের জন্য উসকেছে- ব্যস প্রধানমন্ত্রীর কাজ শেষ। আসলে যার নিজের হাতে উন্নাও, হাথরাসের রক্ত লেগে আছে, সেই হাত অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে উঠবেই বা কীকরে!! বাংলার মানুষের কষ্টার্জিত অর্থের কাটমানির ভাগ শুধু কালীঘাটে সীমাবদ্ধ আছে, সেটা ভাবা অন্যায্য- কী পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করলে গোটা দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে কিনে ফেলা যায়, সেটা একটা গবেষণার ব্যাপার বটে।
৬০. পরিশেষে আসল লোকের কোথায় আসি। সঞ্জয় রায়, সন্দীপ ঘোষ, বিনীত গোয়েলের আড়ালে আসল অপরাধী যিনি, যাঁর অঙ্গুলিহেলনে সবকিছু চলছে, কিন্তু কেউ তাঁর বিরুদ্ধে গলা তুলছে না, পাছে তার প্রতিবাদে রাজনীতির রং লেগে যায়!! এই ধর্ষণ ও তার তথ্যপ্রমাণ লোপাটের আসল কারিগর তিনিই- মমতা ব্যানার্জি। ধর্ষণের বিচারও চেয়েছেন, অন্যদিকে নিজের পুলিশ দিয়ে তথ্যপ্রমাণ গায়েব করেছেন। শুধু তাই নয়, প্রতিবাদী মানুষদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নেমেছে কখনো বারাসতে, কখনো মাথাভাঙ্গায়। বর্বরিক যেমন দেখেছিলেন, মহাভারতের যুদ্ধের সব কিছুই বাসুদেবের হাতের খেলা- সেরকমই এই খুন-ধর্ষণ ও তার পেছনে সব ষড়যন্ত্রের মূল কাণ্ডারী কে, সেটা আমরা সকলেই জানি, মুখে আনতে লজ্জা করছি। এবং তিনিও জানেন, যে সংখ্যালঘু ভোটব্যাংক তিনি অটুট রেখেছেন এবং পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি করে পেটোয়া ধামাধারীর দল তাঁর চারপাশে গজিয়ে উঠেছে- তার রাজনৈতিক পরাজয় এককথায় অসম্ভব।
তবে জেনে রাখুন, যারা এখনো প্রতিবাদে নামেননি- দিন আপনারও আসবে। হরিপালে স্কুলছাত্রীকে তুলে নিয়ে গিয়ে যৌন অত্যাচার করা হয়েছে- পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা একইভাবে কাজ করছে। স্টেট স্পন্সর্ড ধর্ষণ ও খুনে এই সরকার অন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। এই অসহায়তা আপনারও আসবে, শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র। আজ ক্ষুদ্র স্বার্থে নীরবতা পালন করলে, সেদিন আপনার প্রতিবাদকেও নীরব করে দেবে এই অমানুষ মমতার সরকার- সেই দিন দূরে নেই। তাই দালালি নয়, রাজপথে নামুন; আপস নয়, সংগ্রামে ফেটে পড়ুন। আজ নাহলে কোনোদিনই হবে না।