ঠিক পঁচাত্তর বছর আগের ঘটনা। শুরুর শুরুটা করেছিল ব্রাজিল ও চিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। মৃত্যু মিছিল দেখেছে সারা পৃথিবী। ১৯৪৫ সালে ওই দুই দেশ প্রস্তাব দেয় যে এবার পৃথিবীবাসীর স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা যাক। একটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গড়া হোক, কিন্তু সেখানে যেন কোনো রাষ্ট্রশক্তি থাবা না বসায়। যুদ্ধ ক্লান্ত নিউইয়র্ক পরের বছর সেই প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে দেয়। আর বিশ্বনাগরিকদের স্বাস্থ্য নিয়ে সুদৃঢ় পদক্ষেপের সূচনা হলো সাতই এপ্রিল ১৯৪৮ সালে। তৈরি হলো ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশন বা ‘হু’।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্দেশ্যটা কি? কি কাজ করছে তারা? তাদের কাজে বিশ্ববাসীদের লাভটাই বা কি হচ্ছে? কোভিড পরবর্তী পৃথিবী কি চোখে দেখছে এই অর্গানাইজেশনকে? পঁচাত্তর বছর পুরনো এই সংগঠনকে নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন সাধারণ মানুষের মনে।
‘হু’র উদ্দেশ্যর পুঁথিগত উত্তর হলো “সর্বোচ্চ সকল মানুষের স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা”। ১৯৪টি রাষ্ট্রের প্রতিনিধি নিয়ে হু তৈরি। সদস্য দেশগুলোর নাগরিকদের বিভিন্ন ধরনের রোগ প্রতিরোধ করাই শুধু নয়, সার্বিকভাবে সুস্বাস্থ্যের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করাও কাজ ‘হু’র। এই কাজ করতে গিয়ে কিন্তু মাঝেমধ্যে রাজনৈতিক সীমার বাইরে গিয়ে সদস্য নয় এমন দেশের মানুষদের কথাও ভাবতে হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে। কারণ রোগের জীবাণুদের দেশের সীমা ছাড়াতে পাসপোর্ট ভিসার প্রয়োজন হয়না। বেশ কিছু রোগ পৃথিবী থেকে নির্মূল করার জন্য ‘হু’কে অসদস্য দেশে কাজ করতে হয়েছে বৈকি।
স্মলপক্সকে নির্মূল এবং পোলিওকে পৃথিবী থেকে প্রায় নির্মূল করা ‘হু’র এক বিরাট সাফল্য। এছাড়া ডিপথেরিয়া, পারটুসিস, টিটেনাস, মাম্পস, হাম, যক্ষা, প্রভৃতি রোগকে প্রায় নির্মূল করার দিকে এনে দিয়েছে এই সংস্থা তার বিশ্বব্যাপী টিকাকরণ প্রোগ্রামের মাধ্যমে। ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে হু। এইডস, ইবোলার মতো সংক্রামক রোগের পাশাপাশি হৃদযন্ত্রের বিভিন্ন রোগ এবং ক্যান্সার নিয়ে নানা কাজ করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কয়েকবছর আগে পর্যন্ত ইবোলা সংক্রমণ নিয়ে বেশ আতঙ্কগ্রস্ত ছিল সারা পৃথিবী। জেনিভায় অবস্থিত ‘হু’র সদর দফতর থেকে জানানো হয়েছে যে প্রায় একশো শতাংশ সফল একটি ইবোলা ভ্যাক্সিন আবিষ্কার করা গেছে।
কিন্তু এই বিশাল কর্মযজ্ঞের গৌরী সেন কে? সদস্য দেশগুলি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাজেটের মাত্র কুড়ি শতাংশ মিলেজুলে দেয়। প্রদেয় অর্থ একেকটা দেশের ক্ষেত্রে একেকরকম। কোনো একটি দেশের জনসংখ্যা এবং সম্পদের ওপর নির্ভর করে সেই দেশটি সদস্য থাকতে গেলে কত চাঁদা দেবে। এই ‘অ্যাসেসড্ কনট্রিবিউশন’-এর বাইরে বাকিটা বিভিন্ন দেশ এবং সংস্থা দান হিসেবে ‘হু’কে দেয়। এর মধ্যে আবার জার্মানি, জাপান এবং ইউরোপীয় কমিশন সিংহভাগ অর্থ যোগান দেয়। ২০১৮ সালে ‘হু’র বাজেট ছিল ৪.২ বিলিয়ন ডলার।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এগারোটি বিভিন্ন দিন পালনের জন্য চিহ্নিত করে রেখেছে। নানাধরণের রোগ প্রতিরোধ এবং স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের ওপর জোর দেওয়ার জন্যই এই দিনগুলোকে পালন করা হয়। এই দিনগুলো হলো -হেপাটাইটিস ডে, টিউবারকিউলোসিস ডে, চাঘাস ডিজিজ ডে, পেশেন্ট সেফটি ডে, ইমিউনাইজেশন উইক, নো টোবাকো ডে, এইডস ডে, ম্যালেরিয়া ডে, ব্লাড ডোনার ডে আর অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল অ্যায়ারনেস উইক। এই দশটির বাইরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনটি হলো ওয়ার্ল্ড হেল্থ ডে – বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জন্মদিন। ‘হু’র মুকুটে উজ্জ্বলতম পালক। এই দিনে প্রতিবছর একটা করে থিম ঠিক করা হয়। সেই থিম মাথায় রেখে সারাবছর চলে কাজকর্ম। ২০২৩এর থিম সকলের জন্য স্বাস্থ্য – “Health for All”। বিশ্বব্যাপী মানুষের থাকবে সুস্বাস্থ্যের অধিকার।
এতো সাফল্যের পরেও করোনাকালে বড়ো প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কোনো রোগের উৎপত্তি এবং সংক্রমণের ওপর নজরদারি একটি বড়ো কাজ ‘হু’র। এই সংক্রমণের পদ্ধতি এবং হারের ওপর নজর রেখে প্রতিরোধের পথরেখা তৈরি করা হয়। প্রয়োজনে জনগণের জীবন যাপনের পদ্ধতির পরিবর্তনের পরামর্শ দেয় বিশেষজ্ঞরা। লকডাউন, ফিজিক্যাল ডিস্ট্যান্সিং শব্দগুলো করোনাকালে শিকলের দাগ হয়ে মানবসভ্যতায় চিরকালের জন্য রয়ে যাবে। করোনার ওষুধ ও ভ্যাক্সিন নিয়ে চলেছে টালবাহানা। এইসবের সঙ্গে স্বাভাবিক কারণে জড়িয়ে গেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কিছু কিছু পদক্ষেপ জনগণের প্রশ্নের অপেক্ষা রাখে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবার ‘হু’র হিসাব মানতে নারাজ হচ্ছে সদস্য রাষ্ট্র। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভিডে মৃত্যুর একটা গাণিতিক হিসাব আছে। সেটি মানতে নারাজ স্বয়ং ভারত। ভৌগোলিক আকার এবং জনসংখ্যার এই বিশাল দেশের সাপেক্ষে এই অঙ্ক হযবরল-এর কাক্কেশ্বর কুচকুচের অঙ্কের মতো হয়ে দাঁড়ায় বলে ধারণা ভারতের।
তবু পঁচাত্তর বছর ধরে একটি সংস্থা লড়ছে। মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য প্রতিনিয়ত করে চলেছে চিন্তাভাবনা। ” এ লড়াই মৃত্যুর সঙ্গে মানুষের / আর হার-জিত দুটো কথাই যখন অভিধানে রয়েছে / বিনা যুদ্ধে কেউ কাউকে মাটি ছেড়ে দেবেনা।” বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কথা বলতে গিয়ে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে ‘কোট’ করা বোধহয় ভুল হবে না।