Central Council of Indian Medicine বা CCIM-এর সাম্প্রতিক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে surgery-র ৩৯টি এবং নাক,কান,গলা ও চোখের ১৯টি অপারেশনের ট্রেনিং দেওয়া হবে যথাক্রমে আয়ুষ শল্যতন্ত্র ও আয়ুষ শলক্যতন্ত্র পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোর্সে, যাতে ভবিষ্যতে এই কোর্সের ছাত্রছাত্রীরা স্বাধীনভাবে এই সমস্ত অপারেশন করতে পারেন। বস্তুত ২০১৬ সালের বিজ্ঞপ্তিতে কিন্তু এই ট্রেনিং এর উল্লেখ আছে; যদিও কী কী অপারেশন করতে পারবেন তার নাম করে বিস্তারিত ভাবে আলোচিত ছিলো না। এই শিক্ষা পদ্ধতির প্রয়োগও শুরু হয়ে গেছে আগেই..এখন শুধু পাকাপাকি আইনগত বৈধতা লাভ করলো।
এখন প্রশ্ন হলো পরিপূর্ণ শিক্ষা ছাড়া শল্যচিকিৎসা সম্ভব কিনা বা নৈতিক কিনা, কেননা এর প্রয়োগ হচ্ছে অন্য মানুষের উপর নিজের উপর নয়। নৈতিকতার আবার দুটি ভাগ আছে ..আইনগত এবং সামাজিক। আপাতত সম্ভব কিনা তার একটু আলোচনা করা যাক……..
ডাঃ নর্মান বেথুন জীবনের শেষ দুবছর চীনের রেড আর্মির সঙ্গে কাটিয়েছেন যুদ্ধক্ষেত্রে। তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে নিজের আঙুল কেটে ফেলেন স্ক্যালপেলে। সেটা কিন্তু disposable surgical gloves পূর্ববর্তী সময়। আর একটি infected patient ,,, %এর ক্ষতস্থান পরীক্ষা করতে গিয়ে সংক্রমণ আরও বাড়ে এবং উনি septicemia তে মারা যান। ডাঃ বেথুন হাতেকলমে অনেককে প্রশিক্ষিত করেন। তার এক প্রিয় ছাত্র যে একসময় মেষপালকের কাজ করতো এবং পরে রেড আর্মিতে যোগদান করে, সর্বক্ষণ তার সঙ্গে থাকতো। ডাঃ বেথুন যখন গুরুতর অসুস্থ সে ভয়ে ভয়ে জানালো অনুমতি পেলে সে হাতটা amputation করতে পারে। ডাঃ বেথুন পরিষ্কার ভাবে জানান তার দক্ষতা ইউরোপের যে কোনো সামনের সারির সার্জেনদের থেকে কোনো অংশে কম নয় আর তার কাছে অপারেশন করাতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। কিন্তু এই অবস্থায় amputation করেও কোনো লাভ হবে না কারণ সংক্রমণ সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে।
আরও পরের এক উদাহরণ দক্ষিণ আফ্রিকার এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবক হ্যামিলটন নাকি যে হাসপাতাল চত্বরে মালির কাজ করতো। প্রথমে ডাঃ রবার্ট গেজ, পরে বিশ্ববিখ্যাত ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ড এবং বহু বছর রোজমেরি হিকম্যানের সহকারী হিসেবে অত্যাশ্চর্য কাজ করেছেন। ছাত্রদের অপারেশন দেখিয়েছেন ..এমনকি anatomical নাম উল্লেখ করে পড়িয়েছেনও।অবসরের পরে ২০০২ সালে সেই দেশের রাষ্ট্রপতির বিশেষ সম্মান ও ২০০৩ সালে কেপ টাউন বিশ্ববিদ্যালয় কর্ত্তৃক Master of Medicine সাম্মানিক উপাধিতে ভূষিত হন। মৃত্যুর পরে Associated Press তার শোকবার্তায় জানায় ১৯৬৭ সালে ডাঃ বার্নার্ডের ঐতিহাসিক হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন অপারেশনে donor দুর্ঘটনায় মৃত ডেনিস ডারবাল এর হৃদপিণ্ড দ্রুততার সঙ্গে সংগ্রহের কাজ করেছিলেন হ্যামিলটন নাকি। অপারেশনে নাকির অসাধারণ দক্ষতা ও ক্ষিপ্রতার জন্যই তাকে এই কাজে ব্যবহার করা হয়। কয়েকদিন পরে অবশ্য Associated Press এই সংবাদ থেকে পিছিয়ে আসে যথেষ্ট তথ্যনির্ভর নয় বলে। প্রসঙ্গত ‘৬৭ সালে apartheid law অনুযায়ী কোনো কৃষ্ণাঙ্গ দ্বারা শ্বেতাঙ্গের অপারেশন(মৃত হলেও) গুরুতর আইন ভঙ্গ বলেই গণ্য হওয়ার কথা। তাই ঘটনা সত্য হলেও তথ্যনির্ভর হওয়া মুশকিল।
আমাদের জীবনেও উদাহরণ প্রচুর …….।
ছাত্রাবস্থায় ও হাউসস্টাফ থাকাকালীন অর্থোপেডিক plaster room এ জানকী নামে এক Group D কর্মচারী ছিলো। শুধু জানকী তো পুরুষের নাম সম্ভব নয়, নিশ্চয়ই দু একটা অক্ষর পরে ছিলো সময়ের সঙ্গে হারিয়ে গেছে। তখন C arm ছিলো না অনুমানের উপর অনেকটাই নির্ভর করতে হতো। জানকীর অভিজ্ঞতা এত বেশী ছিলো যে শিক্ষকদেরও দেখেছি তার কাছে final opinion নিতো..’কি জানকী, ঠিক আছে তো?’
চাকরিতে join করার পরে এমার্জেন্সিতে সাধারণত Group D স্টাফরাই সেলাই করতো। সার্জেনদের দরকার হতো কালেভেদ্র। একবার তখন এক মহকুমা হাসপাতালে আছি এমার্জেন্সি ডিউটিতে..। একটি স্কুলের শিক্ষয়িত্রীকে নিয়ে একদল মানুষ হৈ হৈ করে ঢুকে পড়লো। মহিলার একটা কাণ বাজে ভাবে ছিঁড়ে গেছে টিউব ওয়েলের হ্যান্ডেল খুলে গিয়ে ছিটকে কাণে লেগে। ঐ অঞ্চলে এই দুর্ঘটনা খুব বিরল ছিলো না। প্রচুর পরিচিত লোক থাকায় Group D স্টাফ যে ছিলো সে একটু ইতস্তত করছিলো। বাধ্য হয়ে আমাকেই হাত লাগাতে হলো। নিজের কাজ নিজেরই পছন্দ হলো না..বললাম ‘অধিকারীদাকে ডাকো’। ডাঃ অধিকারী সেদিন surgeon on call ছিলেন। অধিকারীদা এসেই বললো ‘OT তে পাঠিয়ে দাও’। OT থেকে বার হয়ে এমার্জেন্সিতে এসে আমায় জিজ্ঞাসা করলেন ‘নিশ্চয়ই তুমি সেলাই করেছো?’ আমি বললাম ‘খুব খারাপ হয়েছে?’ অধিকারীদার উত্তর ‘ঐ সেলাই থাকলে মহিলার আর বিয়ে হতো না। আমি নতুন করে সেলাই দিয়েছি’। তখনও পর্যন্ত ঐ শিক্ষয়িত্রী অবিবাহিত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তার বিবাহ হয়ে ছিলো কিনা জানি না। তবে আমি বোধহয় তার পরে আর এই দুঃসাহস দেখানোর স্পর্ধা দেখাই নি।
এখন করেন কিনা জানি না, এক সময় অনেক ডাক্তাররা যত্ন সহকারে কাজ শিখিয়েছিলেন এমার্জেন্সি ও OT স্টাফদের। বাকিরা শিখতো তাদের senior দের কাছ থেকে ..আমরাও যেমন শিখে এসেছি।
চুঁচুড়া হাসপাতালে এমার্জেন্সির স্টাফেরা খুবই দক্ষ ছিলো। ডাঃ হাসনাত নাকি তাদের হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছিলেন। ডাঃ হাসনাত অসাধারণ ভালো মানুষ এবং অত্যন্ত পারদর্শী সার্জেন ছিলেন। একবার বিধায়ক নির্বাচিত হন..বর্তমানে প্রয়াত।
চন্দননগর হাসপাতালে লক্ষণদা ছিলো sweeper by designation ।কোন্ কাজ জানতো না ?.. সারাদিন হাসপাতালে পড়ে থাকতো। যখন যে ওয়ার্ডে দরকার..লক্ষণদার ডাক পড়তো আর সেটা কিন্তু অর্থের বিনিময়ে নয়..।
OT র অনেক সিস্টার তো বিভিন্ন বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞানের অধিকারী।
শুধু সিস্টার কেন বহু প্রতিষ্ঠিত সার্জেনের OT assistant কিন্তু non medical person।
সর্বোপরি ও পরিশেষে জীবন্ত না হলেও মৃতদেহের উপর ছুরি চালাতে ডোমদের থেকে দক্ষ ক জন ডাক্তার আছেন?
এতগুলি উদাহরণ দেওয়ার উদ্দেশ্য কিন্তু এটা নয় আয়ুষ সার্জেনদের সার্জারি করার পুরো অধিকার আছে। অধিকার আছে কি নেই এই প্রসঙ্গের থেকে অনেক জরুরী মানুষ বা সমাজের কাছে এর আদৌ কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে না নেই।…..
সারা দেশে NEET PG’21 তে MS Surgery তে( Orthopaedic, Eye, ENT সমেত ) আসনসংখ্যা থাকছে ১০,৮২১..যেখানে আয়ুষ শল্যতন্ত্র সামান্য ও শল্যতন্ত্র ক্ষার কর্ম এবং অনুশাস্ত্র কর্ম.. শল্যতন্ত্রের দুটি বিভাগ মিলিয়ে সারা ভারতে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট আসন মোট ৭০ আর শলক্যতন্ত্র(চোখ, নাক, কান ও গলা) এ আসনসংখ্যা মোট ২৫টি। So, total number of Ayush surgeon per year wil not be more than 95….!!!
তাহলে…..? কী এমন কারণ ঘটলো যে এই কতিপয় তথাকথিত সার্জেনদের জন্য প্রায় যেচেই এতো বিতর্ক ডেকে আনা হলো? আর যাই হোক এর থেকে জণগণের কোনো লাভ হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। তাহলে কী কারণে এত সব কাণ্ড? এটাও কী নানা জরুরী জিনিস থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার আরও একটা অতি সুকৌশলী চাল অনাবশ্যক কিছু বিতর্ক তৈরি করে?
যাই হোক, নিশ্চয়ই কারণটা খুব অকিঞ্চিত্কর নয় এবং সোজাসাপ্টা স্বাভাবিক ডাক্তার বনাম আয়ুষ দ্বন্দ্ব তো নয়ই। সর্বোপরি অন্তর্নিহিত কারণ বা বিষয়বস্তু যাই থাকুক .. সরকারি উৎসাহ দান বা মদত তো থাকতেই হবে। রাজ্যে যেমন অনুপ্রেরণা ছাড়া গাছের পাতাটিও নড়ে না কেন্দ্রেও তেমনিই কোনো কেন্দ্রীয় সংস্থা কখনই কোনো সবিশেষ অঙ্গুলি হেলন বা গ্রীবার উৎসাহব্যঞ্জক ভঙ্গিমা ছাড়া যে এক পাও অগ্রসর হবে না সেটা নিয়ে অন্তত বিতর্ক আছে বলে তো জানি না।
তাই কারণ মূলত দুটি। এক, শাসক দল যে প্রাচীন ভারতীয় কৃষ্টি , সংস্কৃতি ও জ্ঞানের ধারক ও বাহক এটা প্রমাণ করাটা জরুরী। আর, দ্বিতীয় কারণটা হলো স্তাবকতা। সব সময়ে সব জমানাতেই এই স্তাবকরা থাকে, তবে পরিবর্তিত আর্থসামাজিক পটভূমিকায় এরা বর্তমানে অনেক বেশী বেপরোয়া ও অকুতোভয়। কে কত চমকপ্রদ কাজ করে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুকে তুষ্ট করে নিজস্ব কিছু স্বার্থসিদ্ধি করতে পারে তার প্রতিযোগিতা তো নিরন্তর বহমান…..’এ খেলা চলছে নিরন্তর’।
এবার আসি প্রথম কারণটায়….কী মনে হয় আমাদের দেশের শাসককুল সত্যিই খুব আন্তরিক বা অতীব ভাবিত দেশের ঐতিহ্য এবং অতীত জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা নিয়ে? এই শল্যতন্ত্র তো modern medicine অনুযায়ীই হবে। তাহলে আয়ুষের নাম করে back door দিয়ে অল্প কিছু সংখ্যক লোক ঢুকিয়ে প্রাচীন জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার কোন মহান উদ্দেশ্য সাধিত হচ্ছে কে বলবে? আয়ুর্বেদ ভেষজ এর ক্ষেত্রে তো বিশাল জায়গা পড়ে আছে রিসার্চ ও পরীক্ষার জন্য.. সত্যিকারের কোনো উৎসাহ দেখা গেছে সে ক্ষেত্রে?
গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িক মহাজ্ঞানী চিকিৎসক জীবক তক্ষশিলায় অধ্যয়নকালে একবার তার শিক্ষক তাকে এক অরণ্যে প্রেরণ করেন উদ্ভিদ বা গুল্মের অপ্রয়োজনীয় কিছু উপাদান সংগ্রহের জন্য। বহু চেষ্টা করেও জীবক এমন কোনো উদ্ভিদ বা গুল্মের দেখা পান নি যার কোনো ভেষজ গুণ নেই। এটার মধ্যে অতিশয়োক্তি আছে, কাহিনী আছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় ভেষজের অনুসন্ধান ও প্রয়োগ শিক্ষার এক বিশাল ব্যাপ্তি ও অধ্যয়নের ধারাকে অবশ্যই নির্দেশ করে যা পরবর্তী কালে অনেকটাই অবলুপ্ত হয়েছে বৌদ্ধ্য যুগের অবসান ও ব্রাহ্মণ্যবাদ যুগের পুনরাভিত্থানের সঙ্গে সঙ্গে। জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার প্রাচীন ইতিহাসের অনুসন্ধিৎসা বা অনুসন্ধান এতো শস্তায় হওয়া সম্ভব?এতে চমক বা বিভ্রান্তি ছড়ানো যায় তার বেশী কিছু নয়……
তাই প্রতিবাদটা cross pathy বা ডাক্তারি বিদ্যাকে লঘুকরণে সীমাবদ্ধ না রেখে আরও অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত হওয়াধ উচিত যে..’ আয়ুর্বেদ শাস্ত্র নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্র বিশাল..রাজনীতির ছোট আঙিনা থেকে দয়া করে একে মুক্তি দিন….’।
চিকিৎসা বিদ্যায় কৌশল বা চমৎকারিত্বের স্থান কিন্তু সত্যিই সীমিত….