নবজাতক বাড়িতে আসার পর তার যত্ন নিয়ে বিভিন্ন সময়ে লিখেছি। আজ নবজাতকের জন্মের সময়ে হাসপাতালে কীভাবে যত্ন নেওয়া হয় সে ব্যাপারে জানবো।
মূল বিষয়ে যাওয়ার আগে কিছু সংজ্ঞা জেনে নেওয়া দরকার।
- নবজাতকঃ নবজাতক কথাটি ঠিক সাহিত্যের সদ্যোজাত অর্থে ব্যবহার হয় না। চিকিৎসা বিজ্ঞানে নবজাতক বলতে ২৮ দিন বা তার কম বয়সী শিশুদের বোঝায়।
- পরিণত নবজাতকঃ ৩৭ গর্ভ-সপ্তাহ পূর্ণ করা নবজাতক।
- অপরিণত নবজাতকঃ ৩৭ গর্ভ-সপ্তাহের আগেই জন্ম নেওয়া নবজাতক।
- কম ওজনের নবজাতকঃ ২.৫ কেজির কম ওজনের শিশু।
লেবার রুম বা ধাত্রীগৃহে শিশুর যত্ন
১.
ধাত্রীবিদ্যায় প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী শিশুর জন্মের আগে থেকেই শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। গ্লাভস, গাউন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পোষাক পরে নেন। মা ও শিশুর মল-মূত্র, রক্ত ও অন্যান্য দেহরসের (যা সংক্রামকও হতে পারে) ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সতর্কতা নেন।
২.
পাঁচ ধরনের পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে নজর দেওয়া হয়- স্বাস্থ্যকর্মীর পরিষ্কার হাত, শিশুকে ধরা এবং রাখার জন্য পরিষ্কার কাপড় ও তোয়ালে, নাভি কাটার জন্য পরিষ্কার ব্লেড বা কাঁচি, নাভির রক্তপাত বন্ধ করার জন্য পরিষ্কার ক্লিপ বা সুতো, নাভিকে পরিচ্ছন্ন রাখা এবং নাভিতে কিছু না লাগানো। নবজাতকের নাভি শুকনো রাখতে হয় এবং কোনও লোশন বা মলম লাগানোর দরকার হয় না। নাভিতে গোবর, চরণামৃত, ফুল, বেলপাতা, জমজম পানি ইত্যাদি কিছুই দেওয়া যাবে না।
৩.
শিশুর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া আটকাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। শিশুকে মায়ের পেটের ওপর রেখে দেওয়া হয়। এর অনেক উপকারিতা আছে। এই দুটি বিষয় নিয়ে পরে বিষদে আলোচনা করবো।
৪.
শিশু মায়ের জরায়ুর বাইরে এলেই নাভির নাড়িস্পন্দন সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয় না। তাই ন্যূনতম ৩০ সেকেন্ড বাদে নাড়ি কাটা হয়। এর ফলে প্লাসেন্টা বা গর্ভফুল থেকে কিছু পরিমাণ বাড়তি রক্ত শিশুর শরীরে প্রবেশ করে। এই বাড়তি রক্ত শিশুর রক্তাল্পতা প্রতিরোধে সাহায্য করে।
৫.
আগে থেকে গরম করে রাখা কাপড় দিয়ে শিশুর দেহ থেকে রক্ত ও মলমূত্র পরিষ্কার করা হয়। এই কাজটি খুব আলতো ভাবে করা হয় যাতে ত্বকে লেগে থাকা মোমের মতো পদার্থ না মুছে যায়। এই মোম জাতীয় পদার্থ শিশুর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া আটকাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ও ধীরে ধীরে নিজের থেকেই শিশুর ত্বকের সাথে মিশে যায়।
৬.
শিশুর পেট থেকে ২-৩ সেমি. দূরে নাভি কাটা হয়। রক্ত বন্ধ করার জন্য ক্লিপ লাগানো হয়। তার পরেও সেখান থেকে রক্তপাত হচ্ছে কিনা সেদিকে নজর রাখা হয়। শিশুর মলমূত্র থেকে নাভিকে দূরে রাখতে হয়। এই সময়ই নাভির জন্মগত ত্রুটি আছে কিনা দেখে নেওয়া হয়।
৭.
শিশুর হাতে পরিচয়জ্ঞাপক নম্বর লাগানো হয়।
৮.
শিশুর ওজন নেওয়া হয়।
৯.
শিশুর মাথা থেকে পা অব্দি খুঁটিয়ে দেখা হয়- কোনও জন্মগত ত্রুটি আছে কিনা। এই কাজটি সাধারণত চিকিৎসক করেন। শিশুর তাপমাত্রা নেওয়া হয়।
১০.
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্তন্যপান শুরু করা হয়। সিজারিয়ান সেকশনের ক্ষেত্রেও জন্মের এক ঘন্টার মধ্যে স্তন্যপান শুরু করা দরকার।
১১.
ভিটামিন কে ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়। এই ভিটামিন শিশুর রক্তপাতের রোগ প্রতিরোধ করে।
১২.
শিশুর লিঙ্গ, জন্মের সময়ের ওজন, সামগ্রিক সুস্থতা ইত্যাদি বিষয়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা শিশুর পরিবারের সাথে কথা বলেন। স্তন্যপান ও শিশুর যত্নের ব্যাপারে উপদেশ দেওয়া হয়।
১৩.
মা ও শিশুকে এক জায়গায় রাখা হয়। শিশুকে মায়ের কাছে, মায়ের বুকে রাখা উচিত।
জন্মের প্রথম কয়েক ঘন্টার মধ্যেই এগুলো করে ফেলা হয়। শিশু সম্পূর্ণ সুস্থ থাকলে ধাপে ধাপে এই সাধারণ যত্নগুলি নেওয়া হয়। এর মধ্যেই কোনও শিশুর কিছু শারীরিক সমস্যা হ’লে ধাপগুলি অনেক জটিল হয়ে যায়। সে সম্পর্কে পরে কোনোদিন লিখবো।