সন্ধ্যার রাস্তা। লক ডাউনে শুনশান। কাজ শেষে কৌস্তভ বাড়ি তে যাচ্ছিলো– বাস থেকে নেমে রাস্তা পার হওয়ার সময় একটা সুমো গাড়ির ধাক্কায় ছিটকে পড়লো রাস্তা থেকে দূরে।
★★■★★■★★■
কৌস্তভ যখন হাসপাতালে পৌঁছোলো তখন অসাড় নিথর একটা দেহ। শুধু তখনও প্রাণ আছে– তার মানে তখনও আশা আছে।
বৃদ্ধ ডাক্তার মুখোশের আড়ালে স্বগতোক্তি করলেন “প্রচুর ব্লাড বেরিয়ে যাচ্ছে- সম্ভবতঃ লাঙ্গস আর লিভারে আঘাত লেগেছে– সিস্টার এক্ষুণি রিংগার চালান ….. ব্লাড আনতে পাঠান”
“কোনও ব্লাড ব্যাঙ্কে ব্লাড নেই … আগের পেশেন্টরাই ব্লাড পায়নি…”
বৃদ্ধের মনে পড়ে ব্লাড ব্যাঙ্কে একটা ফোঁটাও ব্লাড নেই।
“বাড়ির লোককে বলুন ব্লাড দিতে –ইমিডিয়েট … ফ্রেশ ব্লাড হলেই ভালো”
“স্যর এই লক ডাউনের মধ্যে তিনজন মাত্র সঙ্গে এসেছেন – মা বাবা আর বোন”
বৃদ্ধ ডাক্তার একটু ভাবেন। ওনার ক্যাপ আর মাস্কের মধ্যে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমে – নিশ্বাসের ভাপে চশমা ঝাপসা হয়ে যায়।
“ঠিক আছে। ওদের দেওয়া তিন ইউনিট ব্লাডে আপাততঃ চালিয়ে নেবো … সিস্টার আপনি ফোনে সার্জন কে ধরুন… আমি ওটি’র ব্যাপারটা দেখছি … আর টিটেনাস ইম্যুনোগ্লোবিউলিন একটা দিয়ে দিন, বেস লাইন টেষ্ট গুলো করে আর আইভি তে একটা এক্স সিরিজের অ্যান্টিবায়োটিক চালু করে…..”
বৃদ্ধ একটু অবাক হ’ন। প্রাণ বাঁচাতে সদা ব্যস্ত ওনাদের রুক্ষ চেহারার সিস্টার মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে কেন?
“সিস্টার, শরীর খারাপ লাগছে? আপনি ব্লাডটা ড্র করে পাঠান বাকি….”
“স্যর বাড়ির সবাই সদ্য ভ্যাক্সিনেটেড …”
বৃদ্ধ থমকে গেলেন। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য দফতর আর ন্যাশনাল ব্লাড ট্রান্সফিউশন কাউন্সিল( NBTC ) ঘোষণা করেছে কেউ ভ্যাক্সিন নিলে আঠাশ দিনের মধ্যে কোনও ব্লাড ব্যাঙ্ক তার ব্লাড নিতে পারবে না। তাহলে কোভিশিল্ড এর তাহলে দুটো ডোজের ক্ষেত্রে সত্তর দিন আর অন্যান্য ভ্যাক্সিন এর ক্ষেত্রে মোট ছাপ্পান্ন দিন ব্লাড ডোনেট করা যাবে না। এদিকে প্যাকড ব্লাড বেয়াল্লিশ দিন ব্যাঙ্কে রাখা যায় – বাকি সব সাতদিন। অর্থাৎ ভ্যাক্সিনেশন শুরু হওয়ার বেয়াল্লিশ দিন পর থেকে ব্লাড ব্যাঙ্ক শূন্য। তাহলে আঠাশ বছরের কৌস্তভ কেবল রক্তের অভাবে মা বাবা আর ডাক্তারের সামনে মারা যাবে?
কম বয়সে প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে কাজ করার সময় এমন ঘটতে বৃদ্ধ অনেক দেখেছেন। ওখানে ব্লাড ব্যাঙ্ক ছিলো না– বড়ো হাসপাতাল ছিলো বহু দূর। আর এই ঝাঁ চকচকে হাসপাতালে সব আছে। অথচ আইন এখন বিপক্ষে … সিস্টার নতমুখে ড্রিপ চালাতে থাকেন। আপাত কঠোর সিস্টারদের মনে পেশেন্টের জন্য বড্ড মায়া থাকে – বিশেষ করে বাচ্চা ছেলেমেয়েদের জন্য – কচি মুখখানি – আহারে কিছুই দেখলো না যে পৃথিবীটার ….।
বৃদ্ধের হাতে বেশী সময় নেই– তাড়াতাড়ি জানতে হবে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য দফতর কেন এমন নোটিশ জারি করেছে। কী কী অবস্থায় ব্লাড নেওয়া যায়? আইনের কোনও ফাঁক আছে কিনা? বুড়ো স্খলিত পায়ে নিজের কামরায় গিয়ে কাগজপত্র ঘাঁটতে থাকেন।
প্রথমেই জানা গেলো NBTC এই বছরের 17ই ফেব্রুয়ারি ভারত সরকারের সঙ্গে মিলে ঘোষণা করে “28 days post-vaccination deferral after the last dose of COVID-19 vaccination irrespective of the type of the vaccine received”.
সমগ্র ভারতের ডাক্তারেরা প্রশ্ন তোলেন “কেন এই বিজ্ঞপ্তি? এর পেছনে যুক্তি কোথায়? কী কারণে এই বিজ্ঞপ্তি জারি হলো? যেখানে লক ডাউনের পর থেকেই সব ব্লাড ব্যাঙ্ক রক্তশূন্যতায় ভুগছে? বেঙ্গালুরুর ব্লাড ব্যাঙ্কে হাহাকার উঠেছে। থ্যালেসিমিয়া, ক্যানসার রোগী, পথ দুর্ঘটনায় আহতদের, বড়ো বড়ো অপারেশন আর প্রসূতি মায়েদের জন্য প্রতিদিন রক্ত প্রয়োজন। অথচ প্রিয়জন তাকিয়ে দেখছে তাদের রোগীর মৃত্যু। আর ডাক্তার সে তো চিনির বলদ। মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করার চেষ্টা সে করতে পারে– জীবন মৃত্যু তার হাতে নেই।
বৃদ্ধ জানে আর একটু পরেই কৌস্তভ ইর্রেভার্সিব্ল শকে চলে যাবে তখন আর হাজার বোতল রক্তও তাকে ফেরাতে পারবে না। বুড়ো খুঁজে চলে জীবনের পক্ষে থাকা বিজ্ঞানের সূত্র। সিস্টার অন্য রোগীদের জন্য লড়াই করতে করতে তাকিয়ে থাকেন বৃদ্ধের দিকে পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায়।
এরপরেই পেলেন অস্ট্রেলিয়ান গভর্নমেন্ট, হেল্থ ডিপার্টমেন্টের নোটিফিকেশন। বলা হয়েছে কোভিড ভ্যাক্সিন যারা নিয়েছে তারা সাতদিনের পরেই ব্লাড ডোনেট করতে পারবেন, শুধুমাত্র ফ্লু ভ্যাক্সিনের ক্ষেত্রে কোনও বারণ নেই। যেমন হেপাটাইটিস বি ভ্যাক্সিনের দু সপ্তাহ পরে ব্লাড ডোনেট করতে পারবেন। এটা একটা সরকারি নোটিশ। এটায় বিজ্ঞান কোথায়? সাত দিনের পরেই বা কেন? প্রাণ ক্ষীণতর হয়ে আসে।তাড়াতাড়ি হে বুড়ো, সময় বড়ই কম। বুড়ো কাগজপত্র হাতড়াচ্ছেন – সময় ফুরিয়ে আসছে।
পাওয়া গেছে সিরিল জ্যাকুয়েট, এমডি, পিএইচডি, অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর অফ ট্র্যান্সফিউশন মেডিসিন, ন্যাশনাল চিলড্রেন হসপিটাল, এবং ডিরেক্টর অফ হিমাটোলজি ল্যাবরেটরি, ন্যাশনাল চিলড্রেন‘স হসপিটাল বলেছেন ভ্যাক্সিন নিয়ে রক্ত দিতে কোনও বাধাই নেই।
মাস্কের ভেতরে বৃদ্ধের হাপরের মতো নিশ্বাস পড়ে …. রেড ক্রস এবং এফডিএ ( এই নামটা সকলের পরিচিত) এরা বলছে “there is no deferral time between vaccine and blood transfusion”.
না, না, এগুলো কতগুলো উদ্ধৃতির সমাহার। বিজ্ঞান কোথায়? বুড়ো ভ্যাক্সিনের বই নামায়:- mRNA vaccine এর ক্ষেত্রে যেহেতু কোনও ব্লাড প্রোডাক্ট থাকে না এবং এটা জীবন্ত অকেজো ভাইরাসও নয় তখন কোনও বারণ নেই। উনি পাতা উল্টোতে থাকেন।
অবশেষে পাওয়া যায় কাঙ্ক্ষিত পাতাটি-লেখা আছে যাঁরা জ্যানসেন, ফাইজার, এ্যাস্ট্রা জেনেকা, মডার্না বা নোভাভ্যাক্স ভ্যাক্সিন পেয়েছেন তাঁদের ক্ষেত্রে সেই দিনই ব্লাড দিতে বাধা নেই। যাঁরা জীবন্ত নিস্ক্রিয় ভাইরাসের ভ্যাক্সিন পেয়েছেন তাঁদের ক্ষেত্রে দুই সপ্তাহ বারণ থাকবে। কেননা ঐ রক্ত থেকে দুর্বল রোগীর করোনা হতে পারে।
“না, ভয় নেই” বৃদ্ধ আশ্বস্ত হন। ভারতে করোনায় জীবন্ত নিস্ক্রিয় জীবাণু থেকে তৈরি ভ্যাক্সিন দেওয়া হয় না। উদ্ধৃতির অংশবিশেষ নিচে দেওয়া রইলো।
• The following eligibility guidelines apply to each COVID-19 vaccine received, including boosters: There is no deferral time for eligible blood donors who are vaccinated with a non-replicating inactivated or RNA-based COVID-19 vaccine manufactured by AstraZeneca, Janssen/J&J, Moderna, Novavax, or Pfizer.
• Eligible blood donors who received a live attenuated COVID-19 vaccine or do not know what type of COVID-19 vaccine they received must wait two weeks before giving blood.
অন্য এক জায়গায় লেখা আছে যেহেতু ভ্যাক্সিন নিলে পরে জ্বর বা অ্যালার্জি হতে পারে সেই জন্যে ভ্যাক্সিন এবং ব্লাড ডোনেশনের মধ্যে সাত দিনের ব্যবধান রাখা যেতে পারে। বৃদ্ধ খুশি মনে উঠে এসে কৌস্তভের বেড হেড টিকিটে উদ্ধৃতিটা লিখতে লিখতে সিস্টারকে ডাকেন। সিস্টার উজ্জ্বল মুখে এসে দাঁড়ান। হাসপাতালে কাজ করার সময় হারতে ভালো লাগে না। বাকি সব জায়গায় তো স্বাস্থ্য কর্মীরা হেরেই আছে।
বৃদ্ধ ডাক্তার রোগীর বাড়ির লোকেদের কাছে এগিয়ে যান। এবার কতগুলো ছকে বাঁধা প্রশ্ন। এরা সবাই প্রায় দশ দিন আগে ভ্যাক্সিন নিয়েছে। ডাক্তার কৌস্তভের বোনকে ডাকেন “আয়, কন্যা, আয় তোর দাদার জন্য রক্ত দিবি আয় …. ও সিস্টার ওটি রেডি করুন”
জীবনের রথ চলতে থাকুক। অবৈজ্ঞানিক আদেশের বিরুদ্ধে কন্ঠ ছাড়ো জোরে।