“পদে পদে মিল খুঁজি গুনে দেখি চোদ্দো/ মনে করি লিখিতেছি ভয়ানক পদ্য”। হিজবিজানি গরমের মধ্যে বসে বসে সুকুমার রায় পড়ার সময় একটা করোনা রোগীর ফোন এলো “হাতুড়েবাবু আমার অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে বিরানব্বই হয়ে গেছে”
উনি বিনা দ্বিধায় বললেন “এক্ষুণি হাসপাতালে চলে যান”
“কিন্তু মশয় আমার তো শ্বাসকষ্ট কিচ্ছু নেই!আপনার যতো গিড়িম্বারি কান্ড” বলে খটাৎ করে রোগী ফোন নামিয়ে দিলেন।
অতঃপর হাতুড়েবাবু বসলেন বিস্তারিত করে অক্সিজেন কমে যাওয়ার বিবৃতি লিখতে।
শ্বাসকষ্ট কাকে বলে?
এটা একটা অনুভূতি। যখন মনে হয় কষ্ট করে শ্বাস নিতে হচ্ছে সেটাই শ্বাসকষ্ট। এটা বসে বসে, শুয়ে শুয়ে অথবা হেঁটে চলে, কাজ করে যেকোনও অবস্থায় হতে পারে। এতে নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের মিনিট প্রতি হার/ rate বেড়ে যায়(Medical research council)।
করোনা রোগীদের একটা সময়ের পরে রক্তের অক্সিজেন কমতে থাকে।
করোনায় ভর্তি হওয়া এক হাজার খুব অসুস্থ রোগীর মধ্যে কেবলমাত্র18.7% রোগী শ্বাসকষ্টের কথা বলেছেন (Guan)।
খুব ক্রিটিক্যাল অবস্থার করোনা রোগীও মুখে কথা বলে জানাতে পারেন যে তাঁর কোনও কষ্ট হচ্ছে না।
করোনায় কেন শ্বাসকষ্ট হয় না?
এটা আমরা যতো সম্ভব সহজ ভাষায় বোঝানোর চেষ্টা করছি।
প্রথম হচ্ছে আমাদের শ্বাসকষ্টের অনুভূতি বুঝে নিয়ে সেই ভাবে কাজ করে আমাদের মস্তিষ্ক। এই অনুভূতিগুলো আমাদের শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে মস্তিষ্কে আসে। প্রথমতঃ ফুসফুসের স্ট্রেচ রিসেপ্টার এবং পেশীদের স্ট্রেচ রিসেপ্টার, পেরিফেরাল স্ট্রেচ রিসেপ্টার, পেশীর স্ট্রেচ রিসেপ্টর (যারা কাজ করলেই অক্সিজেন চাহিদা বাড়ে এবং আমরা দ্রুত লয়ে নিঃশ্বাস নিই) এবং কেমো রিসেপ্টার (কার্বডাইঅক্সাইড এক্ষেত্রে কেমিক্যাল পদার্থ)- এরা সবাই আমাদের মস্তিষ্কের রেস্পিরেটরি সেন্টার এবং পন্স, যারা আমাদের রেস্পিরেটরি ড্রাইভ তৈরি করে, সেখানে খবর পাঠায়। পরে হাইপোথ্যালামাস এবং মস্তিষ্কের অন্যান্য অংশ এই রেস্পিরেটরি সেন্টারকেও নিয়ন্ত্রন করে । কোভিড মস্তিষ্কের ক্ষতি করে দ্যায় এবং এই ড্রাইভ বা বেশী নিঃশ্বাস নেওয়ার প্রয়োজনটা বন্ধ করে দ্যায়।
এবারে আমরা বলি এরা কি ভাবে কাজ করে।
আপনি কিয়ৎক্ষণ শ্বাস বন্ধ করে থাকলেই আপনার দম বন্ধ লাগবে-রক্তের কার্বডাইঅক্সাইড বেড়ে যাবে এবং তার ফলে ফুসফুস ও অন্যান্য জায়গা থেকে স্ট্রেচ এবং কেমো রিসেপ্টাররা ব্রেইনকে বলবে ‘বেশী করে নিঃশ্বাস নাও তাড়াতাড়ি নিঃশ্বাস নাও। বাড়তি কার্বডাইঅক্সাইড কমিয়ে অক্সিজেন বাড়াও’। কার্বডাইঅক্সাইড এই ক্ষেত্রে একটা কেমিক্যাল স্টিমুলেন্টের কাজ করে।
কোভিডে এটা কেন ঘটছে না?
বন্ধু মনে রাখবেন ক্ষতি হচ্ছে কিন্তু আপনি টের পাচ্ছেন না। অথচ আপনি ক্রমশঃ মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে পড়ছেন।
যথাসম্ভব জটিলতা বাদ দিয়ে- প্রায় অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এবার বলি কোভিড কী ভাবে এই মেকানিজমটা বা বাড়তি অক্সিজেনের চাহিদাটা বন্ধ করছে।
কোভিড হলে আমাদের শরীরের শিরা ধমনীতে রক্ত ক্লট করতে শুরু হয়। এটা কোভিডের তৈরি করা ‘সাইটোকাইন স্টর্মের’ একটা অংশ। এর ফলে রক্ত সংবহন ক্ষতিগ্রস্ত হয় । যেহেতু কোভিড ভাইরাস আমাদের শরীরের অ্যাঞ্জিওটেনসিনকে( কিডনি থেকে বেরিয়ে আসা ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রক একটা হর্মোন) আশ্রয় করে কোষের মধ্যে ঢোকে তাই রক্তের অ্যাঞ্জিওটেনসিনও সমানুপাতে কমে যাবে। এছাড়া রোগের প্রভাবে রক্তের হিমোগ্লোবিন ভেঙে রক্তের ‘সেরাম হীম লেভেল’ এবং ক্ষতিকর লোহার আয়ন বেড়ে গিয়ে লোহিত রক্ত কণিকাদের মেরে ফ্যালে(ferroptosis){Liu et al} ।
এর ফলাফল হিসেবে শিরা ধমনীর দেওয়ালের ক্ষতি হচ্ছে। অন্য দিকে ক্ষতিগ্রস্ত লিভার থেকেফাইব্রিনোজেন বেশী তৈরি হচ্ছে। ফলে সমস্ত শিরা ধমনী ক্লট হয়ে বন্ধ হয়ে শরীরের প্রত্যন্ত অংশ আর প্রয়োজনীয় অঙ্গ(যথা হার্ট ইত্যাদি) নষ্ট হয়ে যাবে- অথচ আপনি টেরও পাবেন না।
যেহেতু রক্ত শরীরের সব জায়গায় গিয়ে অক্সিজেন দিতে পারছে না এবং একই সঙ্গে কার্বডাইঅক্সাইডও ফেরত নিতে পারছে না সুতরাং রক্তের কার্বডাইঅক্সাইডের পরিমাণও বাড়ছে না, সেটা কোষের ভেতর জমে থাকছে। তাই ঐ সব কেমো রিসেপ্টাররাও বুঝতে পারছে না যে শরীর কতটা ক্ষতিগ্রস্ত। এটাকে সাইলেন্ট বা হ্যাপি হাইপক্সিয়া বলে (Tobin et al)। এই ক্ষেত্রে অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে (স্বাভাবিক 95-100%) চল্লিশ হয়ে গেলেও আপনি টের পাবেন না । অক্সিমিটারে অক্সিজেন স্যাচুরেশন কম (95%এর কম) দেখালেই মাপ মতো স্টেরয়েড এবং হেপারিন নিতে হবে। প্রথম অবস্থায় রক্ত জমাট বাঁধা আটকাতে অ্যান্টিপ্লেটলেটই যথেষ্ট।
সেই জন্য বাড়িতে অক্সিমিটার রাখুন অথবা মোবাইল অ্যাপ ডাউনলোড করে (এটি সঠিক মাপ দেবে না, তবুও অক্সিমিটারের কালোবাজারির সময় আপনাকে কিছুটা আন্দাজ দেবে) বারবার অক্সিজেন স্যাচুরেশন মাপুন।
নিজে নিজে ওষুধ খেয়ে মৃত্যু ডেকে আনবেন না।