প্রথমেই একটা জিনিস সাফ সাফ বলে দেওয়া যাক। স্টেরয়েড জিনিসটা মোটেই ভয়প্রদ কিছু নয়। এবং, তার পরেই যোগ করে দিই- যদি উপযুক্ত ব্যবহার হয়। বস্তুত, ব্যবহার শুরু হওয়ার পর থেকে স্টেরয়েড যে পরিমাণ জীবন বাঁচিয়েছে কিংবা রোগকষ্ট লাঘব করেছে তাতে তাকে অ্যান্টিবায়োটিক, টিকা বা ওআরএস-এর সাথে এক সারিতে রাখাই যায়।
শুরুটাও বেশিদিন আগে নয়। প্রথম স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ ব্যবহারের নিদর্শন পাওয়া যায় ১৯৩০ সাল নাগাদ। তখনও তার নাম স্টেরয়েড হয়নি। প্রথমদিকে মূলত টেস্টোস্টেরন জাতীয় যৌগ ব্যবহার হ’ত। প্রথমে মুখে খাওয়া হ’ত। পরে জানা যায়, মুখে খেলে অধিকাংশটাই লিভারে ধ্বংস হয়ে যায়। তখন পেশীতে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে নেওয়া আরম্ভ হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সৈন্যদের মধ্যে শক্তিবর্ধক হিসেবে স্টেরয়েড নেওয়ার চল শুরু হয়। নাৎসী ক্যাম্পগুলোতে যুদ্ধবন্দীদের ওপর স্টেরয়েড প্রয়োগ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়। শোনা যায়, হিটলার নিজেই নাকি স্টেরয়েড নিতেন এবং তার ফলে তাঁর মধ্যে স্টেরয়েড সাইকোসিসের লক্ষণ দেখা যায়। ১৯৫৬ সালের ওলিম্পিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের অ্যাথলেটরা নিজেদের শরীরে প্রচুর পরিমাণে শারীরিক সক্ষমতা বর্ধক ওষুধ প্রয়োগ করেন এবং খেলায় চোখ টাটিয়ে দেওয়ার মত সাফল্য পান। ১৯৫০ সালে প্রেডনিসোন আবিষ্কার এবং তার বানিজ্যিক উৎপাদন ৫ বছর বাদে। তারপর পরবর্তী ছয় দশকে স্টেরয়েড মডার্ন মেডিসিনের রাজপথ-অলি-গলি চষে বেড়িয়েছে। বর্তমানে মডার্ন মেডিসিনের প্রতিটি সাব-স্পেশালিটির সাথে স্টেরয়েডের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক।
প্রকারভেদ
আমাদের কিডনির ওপরে ছোট্ট দুটো অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি। তার বিভিন্ন অংশ থেকে বিভিন্ন ধরনের স্টেরয়েড বেরোয়।
ক> কর্টিকোস্টেরয়েড
তার দুটি ভাগ। ১. মিনারেলোকর্টিকয়েড (অ্যাল্ডোস্টেরন ইত্যাদি) ২. গ্লুকোকর্টিকয়েড (প্রেডনিসোলন, বিটামেথাজোন, ডেক্সামেথাজোন, হাইড্রোকর্টিজোন ইত্যাদি )
খ> সেক্স স্টেরয়েড। ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন, টেস্টোস্টেরন ইত্যাদি। সোজা কথায় বললে আমরা পুরুষ ও নারী হরমোন বলতে যা বুঝি সেগুলো।
গ> অ্যানাবলিক স্টেরয়েড
এই পোস্টে আমরা মূলত গ্লুকোকর্টিকয়েড আর অ্যানাবলিক স্টেরয়েড নিয়ে আলোচনা করবো। তবে সেসব পরবর্তী পর্বে। আপাতত চলুন আবার কয়েকটি ঘটনা দেখে নেওয়া যাক-
১.
পরিতোষ বাবু প্রবল হাঁপানির কষ্টে ভোগেন। হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। যে ওষুধ দিয়ে তাঁর চিকিৎসা হয় সেটা একটা স্টেরয়েড।
২.
মনামী ঘোষ সাত মাসের গর্ভবতী অবস্থায় প্রসব করেন। বাচ্চার ফুসফুস শক্তিশালী করতে যে ওষুধটা দেওয়া হয় সেটা স্টেরয়েড।
৩.
১৬ বছরের মেয়েটার জ্বর কিছুতেই নামে না। মাথার চুল উঠে যায়। মুখে ঘা। গালে আর নাকের ওপর কেমন প্রজাপতির মত দেখতে লাল দাগ। ডায়াগনোসিস হল- এসএলই। অন্যান্য ওষুধের সাথে স্টেরয়েডটাও শুরু হল।
৪.
৮০ বছরের ঠাকুমার গাঁটে ব্যথার চিকিৎসা হল গাঁটে স্টেরয়েড ইঞ্জেকশন দিয়ে।
৫.
যে টিবির কথা বলেছিলাম যেটা কিনা সাধারণভাবে স্টেরয়েড পেলেই ফুলে-ফেঁপে ওঠে সেখানেও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে স্টেরয়েড দিয়ে চিকিৎসা হয়।
৬.
মার সাথে ঝগড়া করে পনেরো বছরের মেয়েটা সিলিং থেকে ঝুলে পড়ে। হাসপাতালে যখন আনা হয় প্রায় শেষ দশা। আইসিইউ থেকে সুস্থ হয়ে বেরিয়েছিল বারো দিন বাদে। ওষুধ? সেই স্টেরয়েড।
৭.
তিন বছরের বাচ্চার পেচ্ছাব দিয়ে প্রোটিন বেরিয়ে যায় আর বাচ্চাটা ফুলতে থাকে। এখন স্টেরয়েড চিকিৎসার পর সুস্থ।
৮.
সারা গায়ে মৌমাছি হুল ফুটিয়েছিল আট বছরের ছেলেটার গায়ে। প্রবল ব্যথা, সঙ্গে শ্বাসকষ্ট। স্টেরয়েডে মুক্তি।
৯.
আশঙ্কাজনক কোভিডের কথা তো আগেই বলেছি।
*******
এরকম আরও অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যায়। বিশেষত, অটো-ইমিউন ডিজিজের চিকিৎসায় এবং অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি হিসেবে স্টেরয়েড বিপ্লব এনেছে। আবার আপনি বলবেন সেগুলো কী?
অটো-ইমিউন ডিজিজে আপনার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা আপনার শরীরকেই চিনতে ভুলে যায়। ভেবে নেয় বহিরাগত শত্রু। আর নিজের সাথে নিজের লড়াইতে আপনি রক্তাক্ত হন। তারপর শরীরের সালিশি সভায় বিবাদ মেটায় স্টেরয়েড। ইনফ্লামেশন মানে প্রদাহ। খুব সোজা করে বললে ওই ধরুন কাঁটা ফুটে জায়গাটা লাল হয়ে ফুলে উঠলো, ব্যথা হ’ল… এরকম একটা ব্যাপার। শরীরের মধ্যেকার প্রদাহ জিনিসটা বড্ড গোলমেলে। কখনও সেটা ভালো কখনও খারাপ। কাজেই বিস্তারিত আলোচনায় যাবো না।
এসব ক্ষেত্রেও স্টেরয়েড গুলোর নাম সেই একই। প্রেডনিসোলন, ডেক্সামেথাজোন, হাইড্রোকর্টিজোন। অর্থাৎ, প্রথম পর্বে যে নামগুলো দেখে আপনি নাক কুঁচকে আর চোখ গোল্লা করে ভয়ে ভয়ে তাকিয়েছিলেন সেই নামগুলোই এবার আশীর্বাদের নাম।
কী? ঘেঁটে গেলেন তো?
তাহলে লেখাটা চলুক? কী বলেন?
দরকারি