Wandering womb
******************
বহুদিন লালন ফকিরের গান শুনি না। লালনের গানের মধ্যে আমার প্রিয় গান –
“সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।
লালন বলে জাতের কি রূপ
দেখলাম না এই নজরে।।
সুন্নত দিলে হয় মুসলমান
নারীলোকের কি হয় বিধান।
বামন চিনি পৈতে প্রমাণ
বামনী চিনি কি প্রকারে।।”
গান থাক। আসল কথায় আসি। যখনকার কথা বলবো – তখন না এই আজকের দিনের হিন্দু মুসলমান ব্যাপার ছিল, না লালন ফকিরের গান ছিল! কিন্তু নারী পুরুষ ছিল!! আর কে না জানে, নারীকে আদিম যুগ থেকেই কোন না কোন উপায়ে “ব্যবহার” করা হয়েছে! চিকিৎসা ক্ষেত্রও তার ব্যতিক্রম নয়।
আসুন, চলে যাই দ্বিতীয় শতকে। রোমান সাম্রাজ্যের অধীন প্রাচীন গ্রীসের কাপ্পাডোসিয়াতে ছিলেন একজন ফিজিশিয়ান – নাম অ্যারিটিউস বা Aretaeus.
তাঁর লেখা থেকে জানা যায় – তিনি মনে করতেন –
মহিলাদের গর্ভাশয় মানে uterus, শরীরের মধ্যে ঘোরাফেরা করে, পেটের মধ্যে ভেসে থাকে। ব্যাপারটা খুব কিউট, তাই না??
Womb কথাটি আমরা ব্যবহার করি গর্ভাশয় বোঝাতে। Wandering শব্দটি ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন স্থানে বিচরণ করে এমন কিছুকে বোঝাতে। যদিও wandering womb কথাটির সঠিক বাংলা কি হতে পারে বুঝতে পারছি না। বিচরণকারী গর্ভাশয় বলা যেতে পারে!!
অনেক সময় প্লীহার ক্ষেত্রে আমরা এমন ঘটনা ঘটতে দেখেছি। সেটির ব্যাখ্যাও আছে। কিন্তু তা বলে গর্ভাশয়?
Aretaeus সেই সময়ে যথেষ্ট নামী ফিজিশিয়ান ছিলেন।
তাঁর ধারণা ছিল- গর্ভাশয় শরীরের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়, এবং এক এক জায়গায় থাকার সময় এক এক রকম শারীরিক সমস্যা তৈরি করে! ভাবা হতো – গর্ভাশয় শরীরের মধ্যে আরেকটি শরীর। জীবনের মধ্যে আরেকটি জীবন।
স্বাভাবিকভাবেই নারী শরীরের ভেতর এহেন অদ্ভুতুড়ে ব্যাপার নিয়ে কৌতুহলের শেষ ছিল না! এই কারণে কেউ কেউ নারীকে ডাইনিবিদ্যায় পারদর্শী বলেও অভিহিত করতো!
হিস্টিরিয়া বলে যে কথাটি আমরা জানি, যেটি অল্পবয়সী মেয়েদের ক্ষেত্রে বেশি হয় বলে ধরা হতো, সেটির কারণ হিসেবে দেখানো হলো এই বিচরণকারী গর্ভাশয়কে!!
নারীদের কিছু বলার ছিল তখন? মনে হয় না! এখন বলার থাকে?? খানিকটা … হয়তো।
তখনকার কথা ছেড়ে দিলাম। ষোড়শ শতকে অব্দি এডওয়ার্ড জর্ডন বলে একজন বাবা গোছের পণ্ডিত এই একই ধারণা নিয়ে hysteria-কে মেয়েদের অসুখ বলে চিহ্নিত করেছেন!!
কে বলে – এমন কুসংস্কার অপবিজ্ঞান অবিজ্ঞানে শুধু ভারতবর্ষেরই উত্তরাধিকার??
লিখবো ক্রমশঃ।
এবার নিজের সাধারণ জ্ঞান প্রয়োগ করুন!! নিজের ইন্দ্রিয়কে কাজে লাগান!
আপনি নিজে, আপনার বাপ দাদা চৌদ্দগুষ্টিতে কেউ কখনো দেখেছেন যে, নারী যখন গর্ভবতী হন, তখন তাঁর গর্ভাশয় নিচের পেট ছাড়া শরীরের অন্য কোথাও ছিল??
দেখেননি! থাকতে পারে না, কারণ – সৃষ্টির প্রথম থেকেই ওটি তলপেটে ছিল, আছে, থাকবে! অন্য কোথাও যাবার কোন প্রশ্ন ই ওঠে না! কারণ, সেটি তলপেটে ই থাকে! এবং অন্য সব কিছুর মতোই তার নির্দিষ্ট স্থান আছে। কিন্তু আপনি না জানলে গ্যাস যেমন পাকস্থলী থেকে মাথায় উঠে যায়, কখনো কখনো জয়েন্টের মধ্যে ঢুকে যায় – তেমনি গর্ভাশয়ও যেখানে খুশি ঘুরে বেড়াতে পারে!!
এবার এই নিয়ে কেউ আপনাকে মুরগি বানালে আপনি কি করতে পারেন?? যদি কেউ বলে – চুপ! যোগসেদ্ধ বাবা বলেছে মানে গর্ভাশয় বিচরণ করে, আপনি কি করতে পারেন??
কিছুই না! আপনার মগজ বন্ধক রাখা থাকলে কিছুই করতে পারেন না!!
আবার পারেনও! কি পারেন? একবিংশ শতাব্দীতে এসে, গণতান্ত্রিক দেশে বাস করে অন্ততঃ হাতে কলমে প্রমাণ চাইতে পারেন!! সেটুকু চাওয়ার মতো শিক্ষা না থাকলে, অন্ততঃ গুগল কে জিজ্ঞেস করতে পারেন। হ্যাঁ, লিখতে না পারলেও, কথা বলেই জিজ্ঞেস করা যায়!!
এবার দেখা যাক, এই অভিশাপ থেকে মুক্তি এলো কি করে। Soranus বলে আরেকজন ফিজিশিয়ান ছিলেন প্রায় ওই একই সময়ে। গ্রীসের এফিসাস-এর ফিজিশিয়ান হলেও তিনি প্রাকটিস করতেন আলেকজান্দ্রিয়ায়! যিনি ওই সময়েই গাইনিকোলজির উপর চার খণ্ডের বিস্তারিত গবেষণা প্রকাশ করেছেন! তিনি বললেন – নাহ্! এই বিচরণকারী গর্ভাশয় এর ধারণা ভুল! ওটি সামান্যই নড়াচড়া করতে পারে!!
আরো বড় আঘাত এলো এই অসম্ভব ধারণার উপর – যখন দ্বিতীয় শতাব্দীতে Galen নামক বিখ্যাত মানুষটির আবির্ভাব ঘটলো! আধুনিক শরীরবিদ্যার ইতিহাসে প্রথম যিনি হাতে কলমে দেখাতে শুরু করলেন শরীরের কোথায় কি আছে!! মূলতঃ বানরের শরীর ব্যবচ্ছেদ করে তিনি শরীরবিদ্যার জ্ঞান লাভ করতেন। আর কে না জানে, বানর শিম্পাঞ্জিই আমাদের পূর্বপুরুষ!! প্রায় তেরোশো বছর তাঁর দেয়া জ্ঞানের উপর ভরসা করেছে আধুনিক সভ্যতা!! অথচ অবাক করার মতো ব্যাপার – তিনিও বিশ্বাস করতেন – থিওরি অফ ফোর হিউমরস-এ!! প্রায় প্রাচীন ভারতের বায়ু পিত্ত কফের মতো চারটে উপাদান!!যেটি আজকের দিনে অচল!!
তো স্বাভাবিকভাবেই, বিচরণকারী গর্ভাশয় ও সেই জ্ঞান দিয়ে নারী শরীরের রোগের ব্যাখ্যা খোঁজার যে অপপ্রয়াস সেই সময়ে চলেছে, ক্রমেই সেটি অচল হয়ে গেছে! বিজ্ঞান হাতে কলমে প্রমাণ করে দেখিয়ে দিয়েছে – কারো মুখের কথাই শেষ কথা নয়! বিজ্ঞান দাঁড়াবে যুক্তি, তর্ক, প্রমাণ ও ফলাফলের উপর!! যত বড় বাবাই হোন না কেন, Galen-ই হোন না কেন, সবাইকে আসতে হবে বিবর্তনের ছাঁকনি পেরিয়ে!!
আজকের দিনে প্রথাগত শিক্ষা না পাওয়া একজন মানুষকেও বলে বোঝান দেখি – গর্ভাশয় বিচরণ করে!!খালি দাবি করে দেখুন তো একবার!! আপনাকে পাগলা গারদে ভরে দেবে!!
বাবারা কি এমনি এমনি গ্যারান্টি দেয়?? গ্যারান্টি না দিলে, ভয় না দেখালে যে ক’জন এখনো এইসব ধাপ্পাবাজিতে ভুলে ভুল করে, তাঁরাই তো বাবাদের ঠিকানা দেখিয়ে দেবে!!
অথচ, এই সময়েও নানা বিষয় নিয়ে বড় বড় স্বঘোষিত সবজান্তা জ্ঞানীরা মানুষকে বোকা বানানোর চেষ্টায় লেগে আছেন! কেউ কেউ ভুলভাল গবেষণা অব্দি দেখাতে চলে আসেন!! বলি, যুক্তি তর্ক প্রমাণ ফলাফলে এতো অনীহা কেন??
ভালো করে বুঝে নিন – সেদিনের Aretaeus-কে মানুষ ছুঁড়ে ফেলেছে, এমনকি Galen-এর হিউমরস-এর থিওরি ও!! কিন্তু একই সঙ্গে Galen-এর শরীরবিদ্যার প্রমাণিত জ্ঞান কে বিজ্ঞান বলেই আজো মেনে চলেছে!! বিবর্তনের ধাপে ধাপে এই যে সমস্যায় পড়া এবং সেখান থেকে বেরিয়ে আসার ফলপ্রসূ প্রচেষ্টার নাম বিজ্ঞান!!
কে বলেছে বিজ্ঞান ট্রাডিশনাল চিন্তা ভাবনাকে যাচাই করেনি? কে বলেছে দরকারি জ্ঞান কে যত্ন করেনি?? বহু আয়ুর্বেদিক গাছ গাছড়ার উপকারী দিককে শুদ্ধ থেকে শুদ্ধতম উপায়ে ভালো কাজে লাগিয়েছে আধুনিক বিজ্ঞান!!
ধাপ্পাবাজি বন্ধ করে প্রমাণ নিয়ে আসুন!
ততক্ষণ লালন ফকিরের গান শুনি আমি –
সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।
লালন বলে জাতের কি রূপ
দেখলাম না এই নজরে।।
সুন্নত দিলে হয় মুসলমান
নারীলোকের কি হয় বিধান।
বামন চিনি পৈতে প্রমাণ
বামনী চিনি কি করে।।”
নারীর শরীরে যে বিচরণকারী গর্ভাশয় থাকে না, তার সুন্নত হয় না, নারীর জন্য দরকারি বিধান যে বিজ্ঞান দিতে পারে, সেটা ডাক্তার না হয়েও, বাবা না হয়েও, বেশি লেখাপড়া না করেও লালন ফকির জানতেন!
আপনি জানেন কিনা ভাবুন!! ভাবতে ভাবতে, একবার কল্পনার টাইম মেশিনে চেপে ঘুরে আসবেন নাকি দ্বিতীয় শতাব্দীতে??
(চলবে)