আজকালকার দিনে এক বিরাট সমস্যা মোটা হয়ে যাওয়া। লিভারে চর্বি জমে যাচ্ছে, ওজন বাড়ার জন্য হাঁটু ব্যথা শুরু হয়ে যাচ্ছে অল্প বয়সেই, ব্লাড-সুগার-প্রেসার-কোলেস্টেরল সব স্থূলতার হাত ধরে একে একে চলে আসছে। তার সাথে বাড়ছে ডিপ্রেশন। সবাইকে ওজন কমানোর কথা বলতেই সবাই বলেন, ডাক্তারবাবু এমন একটা কিছু ওষুধ দিন যা খেলে ওজন কমে যায়।
সত্যি বলতে গেলে ওজন কমানোর কোনো ওষুধই সেভাবে কিছু কাজ করে না। এখন অল্প বয়সের প্রচুর সংখ্যক বাচ্চারাও স্থূলতার সমস্যায় আক্রান্ত। WHO স্থূলতা বা ওবিসিটিকে এখন একটি ‘অসুখ’ বলেই নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। এই স্থূলতার মহামারী পশ্চিম দেশগুলোর মত যে আমাদের দেশেও ছড়িয়ে পড়েছে তার প্রধান একটা কারণ আমাদের খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ও কায়িক শ্রমের অভাব। এসব আমরা সবাই জানি। বহুবার বহু জায়গায় এসব নিয়ে আলোচনাও হচ্ছে। তাই আজকে সেসব নিয়ে আমি বলতে আসি নি। আজ এমন কয়েকজনের কথা বলব যারা ওবিসিটিকে জয় করে আমাকে এবং তার সহকর্মীদের চমকে দিয়েছেন।
আমাদের ডাক্তারদের সাথে মেডিকেল রিপ্রেসেন্টেটিভদের একটা গোপন সম্পর্ক আছে। সেটা এতই গোপন যে আমরা তাকে সহজে প্রকাশ করি না। আমি যখন ‘স্টেথোস্কোপ’ লিখছি তখন এক রিপ্রেসেন্টেটিভ আমাকে খুব বিনীতভাবে একদিন বলেছিল, ‘স্যার আপনি আমাদের নিয়ে একদিন লিখুন’। তাদের জীবিকার সমস্যা ও যন্ত্রণা নিয়ে লেখার কথাই হয়ত সে বলতে চেয়েছিল। আমি তাকে কথা দিয়েছিলাম কিন্তু লেখার ব্যাপারে সাহস করি নি।
কারণ তাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক অনেকটা উপপত্নীর মত। খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অথচ তা নিয়ে বাইরে বলার কোনো উপায় নেই। মাঝে মাঝে তাই মনে হয় বলেই দিই, জো দিওয়ার হাম দোনোমে হ্যাঁয় ও গিরা দে… কিন্তু বলা আর হয়ে ওঠে না।
আমি শনিবার সকালে একঘন্টা রিপ্রেসেন্টেটিভদের মিট করি আমার চেম্বারে। সপ্তাহে একদিন একঘন্টা বলে স্বাভাবিকই খুব ভিড় হয়। বিগত এত বছর ধরে একই মানুষগুলোর সাথে দেখাসাক্ষাতে তাদের প্রতি স্নেহ ও প্রেম জন্মেই যায়। অনেক সময় অনেক ব্যক্তিগত কথাবার্তাও হয় সময়-সুযোগ হলে। বিগত বেশ কয়েক মাস ধরেই প্রিতমকে দেখতে দেখতে আজ তাকে না বলে পারলাম না।
প্রিতম সান ফার্মার রিপ্রেসেন্টেটিভ। ও অনেকদিন ধরেই আমার কাছে আসছে। গত বছর ও যখন আসত কোমরের বেল্ট প্রায় ফেটে যাবার মত অবস্থা। বিরাট ওজন। গালে, ঘাড়ে, গলায় প্রচুর ফ্যাট। এই ওজন বেড়ে যাওয়াটা ওদের প্রফেশনের একটা দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। সারাদিন বাইকে করে ঘুরে বেড়ায়। প্রতিদিন বাইরে খাওয়া-দাওয়া করতে হয়। চেম্বারের বাইরে-ভেতরে আমাদের মিট করার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। আর সবার ওপরে কর্পোরেট চাকরি। যতটা দ্যায় ততটা চুষেও নেয়। তাই এই শারীরিক ও মানসিক চাপের প্রভাব পড়ে স্বাস্থ্যের ওপর। তার ওপর তো আছেই আমাদের সামনে সর্বক্ষণ হাসিমুখে থাকার কষ্টকর প্রচেষ্টা।
এই সবের প্রভাবেই যে বাচ্চা ছেলেটা নতুন আসছে কয়েক মাসের মধ্যেই তার চেহারায় বিরাট পরিবর্তন চোখে পড়ে। আমি সবার কথা বলছি না। কিন্তু ওদের বেশিরভাগেরই ওজন বেড়ে যাওয়াটা একটা প্রফেশনাল সমস্যা। এটা আমার মত সব ডাক্তাররাই হয়ত লক্ষ্য করে থাকেন।
আমরা মোটা হয়ে যাওয়া রুগিদের সবাইকে খাওয়া-দাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে বলি। বলি মিষ্টি কম খেতে। কার্বোহাড্রেট কম খেতে। আমাদের চিকিৎসাবিজ্ঞানে খুব দ্রুত ওজন কমানোর জন্য দুরকমের ডায়েট পরিকল্পনা খুব জনপ্রিয়। হলিউডের স্টার থেকে বলি টলি সবাই একে অনুসরণ করে। একটি ‘কিটো ডায়েট’ অন্যটি ‘মডিফায়েড অ্যাটকিনস্ ডায়েট’। এই দুই রকম ডায়েটেরই প্রধান বক্তব্য হল শর্করা জাতীয় খাবার একদম কমিয়ে দেওয়া এবং বেশি প্রোটিন ও ফ্যাট প্রধান খাদ্যতালিকায় নিয়ে আসা। আর সপ্তাহে নিয়ম করে উপবাস করা। এই দুই সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে গেলে শরীরকে বাধ্য করা হয় যাতে সে শর্করা ছেড়ে ফ্যাটকে প্রধান জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে। তাই শরীরের ফ্যাট তাড়াতাড়ি কমে আসে। ওজন কমে যায়। এই কমে আসার সময়টা অনেকক্ষেত্রেই খুবই দ্রুত।
এই যে ডায়েটের কথা বললাম এটা কিন্তু নতুন কিছু ধারণা নয়। খ্রিস্টের জন্মের আগে থেকেই গ্রিকরা দীর্ঘদিন মৃগিরোগের চিকিৎসায় এই ডায়েটের ব্যবহার করত। আধুনিক যুগের মানুষ দীর্ঘদিন মৃগিরোগের চিকিৎসায় এই ডায়েট ব্যবহার করে এসেছে। আজ যদিও মৃগির অনেক নতুন নতুন ওষুধ বেরিয়ে গেছে তবু ‘রিফ্র্যাক্টরি এপিলেপসি’ বা যে মৃগিরোগ ওষুধে সারছে না তাদের ক্ষেত্রে এখনো এই ডায়েট অনুসরণ করা হয়। ঘটনাচক্রে দেখা গেছিল এই খাদ্যাভ্যাসের ফলে রুগিদের ওজন দ্রুত কমে যাচ্ছে তাই পরবর্তীকালে একে ওজন কমানোর জন্য ব্যবহার করা শুরু হয়। আজ তা অসম্ভব জনপ্রিয়।
মনে রাখতে হবে শুধু ডায়েট নয়, এর সাথে নিয়মিত শরীরচর্চা করা খুব জরুরি। প্রিতম কিন্তু নিজের ওজন কমানোর জন্য পুরোপুরি কিটো ডায়েটের দিকে যায় নি। সে নিজের খুব মৌলিক কিছু সমস্যা সমাধানের দিকে জোর দিয়েছে। ও প্রথমেই নিজের অতিরিক্ত কোল্ড ড্রিঙ্কস আর অন্য জাঙ্ক ফুড খাবার প্রচন্ড লোভনীয় অভ্যাস একদম বর্জন করেছে। মিষ্টি খাওয়া একদম বন্ধ করে দিয়েছে। আর সারাদিনের খাবার পরিমাণ খুব কমিয়ে দিয়েছে।
আমি আমার রুগিদের মধ্যে দেখেছি যারা স্থূলতার শিকার তার বেশিরভাগই খুব খেতে ভালোবাসেন। তবে খুব কম সংখ্যক হলেও বলেন তারা শুধু জল খেয়েও ফুলে যাচ্ছেন। সেটা অন্য ব্যাপার। প্রিতম বুঝতে পেরেছিল ওজন কমাতে হলে তার খাবার লোভ না কমালে হবে না। তাই সে নির্মমভাবে নিজের দীর্ঘদিনের লোভকে দূর করেছে। তার সাথে তার প্রচন্ড ব্যস্ত কর্পোরেট চাকরি সামলেও মাঝে মাঝে সকালে-বিকেলে হাঁটার অভ্যাস চালু করেছে। যখন খুব খিদে পায় সে নাকি সঙ্গে ভিজে আমন্ড রাখে। খেয়ে জল খেয়ে নেয়। এতে ওর খিদেটা কমে আসে। জল খাওয়াটা বাড়িয়েছে। আর এভাবেই গত বছর জুন থেকে শুরু করে এই বছরের মার্চের মধ্যে এই দশ মাসে ও পঁচিশ কেজি ওজন কমিয়েছে। গত বছর ওর ওজন ছিল পঁচানব্বই আজ ওর সত্তর। আজকেই আমার ওজন মাপার যন্ত্রে ও ওজন করে দেখল।
এই ওজন কমার ফলে আমার চোখে ওর বয়স প্রায় দশ বছর কমে গেছে। একদম এক বাচ্চা ছেলে বলে মনে হচ্ছে ওকে। সবচেয়ে বড় কথা মানুষ যখন খুব মানসিক উদ্যোগ নিয়ে নিজের জন্য কিছু করে সফল হয় তখন সফলতা আত্মবিশ্বাস হয়ে তার ব্যক্তিত্ত্বের মধ্যে দিয়ে বাইরে ছড়িয়ে পড়ে।
আজ ওকে দেখে আমার তেমনই মনে হল।
প্রিতম কিন্তু একা নয়। আমার কাছে দেবজিৎ বলে একজন আসে ডক্টর রেড্ডিস কোম্পানির। সেও গত কয়েক বছর আগে এমনই বিরাট ওজন কমিয়ে ছিপছিপে হয়ে গেছে। আগে আমার কাছে বিনীত বলে একজন আসত সেও খুব অল্প সময়ে ওজন কমিয়েছিল। ওকে আমি মাঝেমাঝেই সন্ধ্যেবেলায় হোম ভিজিট করতে গেলে র্যাকেট খেলতে দেখতাম।
প্রিতম, দেবজিৎ বা বিনীত এরা যে শুধু ক্রমবর্ধমান ওবিসিটিতে আক্রান্ত মেডিকেল রিপ্রেসেন্টেটিভদের আদর্শ তাই নয় এরা সকলেরই আইডল হতে পারে। এরা কেউই কোনো ডায়েটিশিয়ানের কাছে যায় নি বা রোজ জিমে যায় না। এরা খুব মৌলিক কিছু জীবনযাপনের পরিবর্তন করে নিজেদের ওজন কমিয়েছে। এখানেই শেষ নয়। ওদের এটা বজায় রাখতে হলে এই অভ্যাস চালিয়ে যেতে হবে। ওরা নিজেরাও সেটা জানে। অনেকেই রোগা হবার পরে বলেন, ডাক্তারবাবু এখন আমি বেশি খেতেই পারি না। আগে লোভনীয় খাবার দেখলে আমার জিভে জল আসত এখন সেসব খাবার দেখলে আমার চোখে জল আসে। নতুন অভ্যাস আস্তে আস্তে জীবনাদর্শ হয়ে ওঠে।
মানুষ চেষ্টা করলে পারে না এমন জিনিস কমই আছে। আমার যেসব রুগিরা আমার কাছে এসে রোগা হবার জন্য ওষুধ চান তারা প্রিতমকে দেখে উৎসাহিত হতে পারেন। অনেকেই শারীরিক অসুবিধের জন্য শরীরচর্চা করতে পারেন না। বয়স্ক লোকদের ক্ষেত্রে এটা খুবই সত্যি। তারা নিজেদের খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ঘটিয়ে অনেকটাই ওজন কমাতে পারেন। আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি যে আমরা বাঙ্গালিরা খুবই মিষ্টি ভক্ত। আমাদের মিষ্টির মায়া কাটানো কঠিন। শুধু মিষ্টি খাওয়াটা কমাতে পারলেও বেশ কিছুটা ওজন কমতে পারে।
প্রিতমের দুটো ছবি দিলাম। একটা দশ মাস আগের, একটা আজকের আমার চেম্বারে তোলা। আপনারাই বলুন ওকে কি চেনা যাচ্ছে?
Highly inspirational write up ?