রম্য রচনা
সব পেশাতেই দু’চারটে ভুলোমনের মানুষ দেখতে পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীদের ভুলোমন হওয়া তো বাধ্যতামূলক। দু-একজন সুস্থ স্বাভাবিক বিজ্ঞানী যে নেই তা নয়। তবে কথায় আছে না- একসেপশন প্রুভস দা ল। তাদের কথা না ধরাই ভালো। নিউটন ডিম সেদ্ধ হতে কত সময় লাগে দেখতে ফুটন্ত জলে ঘড়ি ফেলে দিয়ে ডিম হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আইনস্টাইন নিজের বাড়ি চিনতে হামেশাই ভুল করতেন। তখন গুগল ম্যাপ ছিলনা, বেচারাকে একে তাকে জিজ্ঞেস করে নিজের বাড়ি ফিরতে হতো। বাড়ির মানুষদের চিনতে কিন্তু ভুল করতেন না তাঁরা। একটাই রক্ষে, পুরুষমানুষরা নিজেদের স্ত্রীকে সাধারণত হাড়ে হাড়ে চেনে। না চিনলে আইনস্টাইনের কপালেও নির্ঘাত দুঃখ থাকতো। সেই ভুল কখনো তাঁর হয়েছে বলে শোনা যায়নি।
ডাক্তারদের ভুলোমন হওয়া নিয়ে মজার মজার জোকস আছে। খুব নিষ্ঠুর একটা জোক হলো ডাক্তারবাবু অপারেশন শেষ হওয়ার পর আবিষ্কার করলেন হাতে ঘড়ি নেই। পেশেন্টের পেটে কান দিয়ে শুনলেন টিকটিক করে শব্দ হচ্ছে। ঘড়িটি সদ্য পেরনো বিবাহবার্ষিকীতে তাঁর স্ত্রী উপহার দিয়েছিলেন। ডাক্তারবাবুরও ঘাড়ে একটা মাথা। পেশেন্টকে অনেক কাকুতিমিনতি করে আবারও তার পেট কাটলেন ডাক্তারবাবু। একদম পচা, নির্জলা গাঁজা মিশেল দেওয়া গল্প। যেহেতু আমি পেশায় সার্জন এবং লোকের পেট কেটে বেড়াই, সেহেতু জানি যে এ গল্প সত্যি হতে পারেনা। তার ওপর লোকে বলে যে আমি নাকি ভুলোমনের আছি। তাই গল্পটা কোনো আড্ডায় কেউ শোনালে আমার গায়ে বেশ লাগে।
প্রথমত জানিয়ে রাখি ডাক্তাররা ঘড়ি পরে অপারেশন করে না। একটা আলাদা চেঞ্জরুম থাকে প্রতিটি হাসপাতাল এবং নার্সিংহোমে। সেখানে ঘড়ি, আংটি, বাইরে থেকে পরে আসা জামা, প্যান্ট সব খুলে রাখতে হয়। নার্সিংহোম অথবা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ডাক্তারদের জন্য শতচ্ছিন্ন, বেঢপ অথচ স্টেরিলাইজ বা জীবাণুশূণ্য করা কিছু পোশাক সেখানে রেখে দেয়। অনেকে সন্দেহ করে যে সেই পোশাক মালিকপক্ষ দু’একটা সার্কাস কোম্পানির ক্লাউনদের কাছ থেকে কেনে। ক্লাউনরা যখন সেটা পরার অযোগ্য হয়ে গেছে বুঝতে পারে তখন তারা সেটা বেচে দেয়। কেউ কেউ সন্দেহ করে রাস্তার ভিখারিদের কাছ থেকে অল্প দামে জামাগুলো কেনা হয় ডাক্তারদের জন্য। থার্ডগ্রেড হিন্দি সিনেমার নায়িকারাও সে পোশাক পরতে লজ্জা পাবে। যতনা ঢাকা পড়ে তার থেকে বেশি খোলা থাকে। একটাই স্বস্তির ব্যাপার যে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে এর ওপরেও সবুজ অথবা নীল জোব্বা পরতে হয়। দুটো পোশাক পরার মাঝের সময়টুকু খুব উদাসীন হয়ে কাটানোর আর্ট ডাক্তাররা সাধারণত শিখে যান। আমারও ভুলোমনের কিছু গল্প আছে। উপক্রমণিকাটা সেই গল্প শোনানোর জন্য।
আমি হাসপাতাল ছাড়াও দুটো নার্সিংহোমে অপারেশন করতাম। তখন আমার প্র্যাকটিসের প্রথমদিক। খুব ব্যস্ত। আসলে ব্যস্ততাটা যতটা নিজের কারণে তার থেকেও বেশি অ্যানাসথেটিস্ট বা অজ্ঞান করার ডাক্তারদের কারণে। তাঁরা জুনিয়র সার্জনদের সাথে বেশি অপারেশন করতে চাইতেন না। এক নম্বর কারণ জুনিয়ররা স্বাভাবিকভাবেই অপারেশন করেন অনেক আস্তে আস্তে। দ্বিতীয়ত, তাঁদের অপারেশন ঘেঁটে যাবার সম্ভাবনা অনেক বেশি। জ্ঞান না ফিরিয়ে অজ্ঞানের ডাক্তারবাবুর বেরনোর উপায় থাকেনা, ফলে তাঁকে পরের কেস ক্যান্সেল করতে হয়। ছোট্ট জেলা শহর, অ্যানাসথেটিস্টদের ভয়ংকর ক্রাইসিস। অ্যনাসথেটিস্ট পাওয়া আর ভোট মিটে যাওয়ার পরে নেতাদের দেখা পাওয়া একইরকম ভাগ্যের ব্যাপার। তবু সহৃদয় দুএকজন অ্যানেসথেসিয়ার ডাক্তারবাবু ঘন্টাখানেক এসব বালখিল্যদের জন্য ছেড়ে রাখতেন। এরকম একজন ডাক্তারবাবু ছিলেন শক্তিদা। ডাক্তার শক্তিপদ দে-কে সবাই খুব ভালোও বাসতো মান্যও করতো। সিনিয়র এই মানুষটির গাম্ভীর্যের আড়ালে দারুণ একটা রসিক মন লুকিয়ে ছিল। শক্তিদা বিকেল পাঁচটা থেকে ছটা পর্যন্ত আমার কেসে অ্যানাস্থেসিয়া দিতেন। আমিও “ঘন্টাখানেক, সঙ্গে শক্তিদা” বলে লাফিয়ে পড়তাম। একঘন্টা সাধারণত দেড়ঘন্টায় দাঁড়াতো।
সেদিন দুটো নার্সিংহোমে অপারেশন ছিল। প্রথম নার্সিংহোমটা শক্তিদার নিজস্ব। সাধারণত নার্সিংহোমগুলোয় দুটো ওটি থাকে। অন্য পাশের ওটিতে আমারই বয়সী একজন গায়নাকোলজিস্ট সিজার করবে। আমরা একই জায়গায় ড্রেস চেঞ্জ করে যেযার নিজের ওটিতে ঢুকে গেলাম। অপারেশন তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যেতে বাইকে চড়ে দ্রুত দ্বিতীয় নার্সিংহোমে। শক্তিদাও তাড়াতাড়ি সেখানে রোগীকে অজ্ঞান করে দিলেন। আমারও সেদিন অপারেশনে বেশি সময় লাগলো না। একেবারে নিশ্চিন্তি। দ্বিতীয় নার্সিংহোমের অন্যঘরে আমার বন্ধু স্থানীয় এক ডাক্তার কানের অপারেশন করছিলেন। সে দুজনের জন্য চা আনাতে বলে। আরাম করে বসে চায়ে চুমুক দিয়ে রাজপোশাক ছেড়ে নিজের পোশাক পরতে থাকি। টেবিল থেকে নিজের ঘড়িটা পরে কানের ডাক্তারের দিকে পড়ে থাকা বাকি ঘড়িটা এগিয়ে দিই। ও স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দেয় যে মোবাইল আবিষ্কৃত হবার পর থেকে সে ঘড়ি পরা ছেড়ে দিয়েছে। বিশেষ করে দম দেওয়া ঘড়ি তার একেবারেই না পসন্দ। কিছু বেয়াড়া বাচ্চা প্রায়শই বোতাম, ছোলা, পুঁতি এসব মহামূল্যবান সম্পত্তি কান বা নাকের গর্তে লুকিয়ে রাখতে ভালবাসে। এইসব দুর্বিনীত বাচ্চাদের কানে দম দেওয়ার জন্য তার নাকি হাত নিশপিশ করে। বিশেষ করে দম দেওয়া ঘড়িতে নিয়মিত দম দেওয়ার অভ্যাস থাকলে কিছুটা রিফ্লেক্সে হাত কান পেঁচিয়ে দেয়। বাচ্চাটার যত না কানে লাগে তার থেকে বেশি আপত্তি জানায় তাদের বাবা-মা। অভ্যাস ঠিক করার জন্য সে আর ঘড়ি পরেনা। শিশু নির্যাতনে ভয়াবহ সব শাস্তি হয়। সেটা কানের ডাক্তার ভালো মতন জানে।
এরপর আমার মাথায় নানা ধরনের দুশ্চিন্তার উদয় হলো। আমার নিজের ভুলমনত্ব নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তবে কি আমি দুটো ঘড়ি পরে বেরিয়েছি? যদি তাই হয়, তাহলে একহাতে দুটো ঘড়ি পরেছি না দুইহাতে দুটো ঘড়ি পরেছি? একহাতে দুটো ঘড়ি পরলে নির্ঘাৎ ভুলটা ধরা পড়ে যেতো। সমাধান বাতলে দিল ইএনটি স্পেশালিষ্ট। (সাধে কি বলে কান টানলে মাথা আসে! কান ধরে টানাটানি করে বলেই তো মাথাটা এতো তাড়াতাড়ি খোলে।) ঘড়িটা নিশ্চয়ই আগের যে ডাক্তার এই নার্সিংহোমে অপারেশন করে গেছে, সেই ফেলে গেছে। সুতরাং বুলাও ওটিবয় কো। ওটিবয় ভবদা একটা লম্বা লিস্ট দিলো। হিসাব অনুযায়ী শহরের প্রায় প্রত্যেক সার্জন সেদিন কোনো না-কোনো সময়ে ওই নার্সিংহোমে অপারেশন করেছে। বুঝলাম মামলা আমাদের হাত থেকে বেরিয়ে ফেলুদা কিংবা ব্যোমকেশের হাতে চলে যাচ্ছে। ভবদার হাতেই দায়িত্ব ছেড়ে দিলাম। উপযুক্ত প্রমাণসহ আসল মালিক যেন ঘড়িটি নিয়ে যায়।
তারপর আরও একটা সপ্তাহ কেটে গেছে। আরও একটা বিকেল পাঁচটা। শক্তিদা একটা গলব্লাডারে গোলযোগের রোগীকে সাফল্যের সাথে অজ্ঞান করেছেন। আমিও মাইক্রোসার্জারি করবো বলে পেশেন্টের পেটে ক্যামেরা ঢুকিয়েছি। প্রাত্যহিক নিয়ম অনুযায়ী শক্তিদা এইসময়ে সমস্ত প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা শুরু করেন। নতুন সার্জনদের কিকি করা উচিত এবং উচিত নয় সেটা ছিল সেদিনের মূল বক্তব্য। দু’একটা কথা বলার পরেই খুব ফিসফিস করে জানালেন যে আমি যেন কখনোই সার্জনস’ রুমে মূল্যবান কিছু রেখে না আসি। কারণ সপ্তাহখানেক আগে এক গায়নাকোলজিস্টের মহামূল্যবান একটি ঘড়ি চুরি গেছে। প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা দাম। পুলিশ এনকোয়ারি করছে এবং চোর ধরা পড়লো বলে।
আমি তখন দরদর করে ঘামছি। মনিটর জুড়ে গলব্লাডারের বদলে অন্য ছবি দেখছি। আমাকে পুলিশ কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে। সবাই আঙুল তুলে দেখাচ্ছে চার্লস শোভরাজ, বিজয় মাল্য, নীরব মোদির পরে ওই যাচ্ছে আরো একজন ঘড়ি চুরি করে সুইস ব্যাঙ্কে পাঠিয়ে দেওয়া চোর। প্রায় চোখে জল এসে যায়। শক্তিদাকে মাথা হেঁট করে বলি-“শক্তিদা আপনার সাথে দুইখান কথা আছে।”
শক্তিদা আমার ভানুত্ব প্রাপ্তিতে বেশ চিন্তান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন যে সবার সামনে বলা যাবেনা আলাদা করে বলবে।
কুকর্মের কথা আলাদা করে বলতে হয়। কোনভাবে কেসটা শেষ করে শক্তিদাকে পুরো ঘটনাটা লুকিয়ে জানালাম।
শক্তিদা খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন। “তুমি কি দামী ঘড়ি পরতে ভালোবাসো?”
ভালো তো বাসি, কিন্তু চুরি করে পরতে হবে? শক্তিদাকে বললাম যে ঘড়ি পরতে আমি একদমই ভালোবাসি না। ঘড়ি কি ভদ্রলোকে পরে নাকি? কুকুররা যেমন বকলস পরতে অপছন্দ করে আমিও তেমনি ঘড়ি পরতে অপছন্দ করি। সময়ের হাতে বাঁধা থাকা মোটেই ঠিক নয়।
অতঃপর শক্তিদা আমার কাছ থেকে অন্য নার্সিংহোমের ভবদার ফোন নাম্বার নিলেন। ভবদাকে ফোন করে ঘড়িটার ছবি তুলে পাঠাতে বললেন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে শক্তিদার হোয়াটসঅ্যাপে ভবদার পাঠানো ছবি চলে এলো। আমি দেখে জানালাম যে এটা সেই ঘড়িরই ছবি বটে।
এবার শক্তিদা যেন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের নতুন পুলিশ কমিশনার নীল বসু। ঘড়ি হারানো গায়নাকোলজিস্টকে এবার ফোন করা হলো। জলদগম্ভীর গলার স্বর। “তোমার ঘড়িটা উদ্ধার করা গেছে। কিন্তু সেটা উদ্ধার করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। কিছু লোককে ঘুষ দিতে হয়েছে। অনেক বিপজ্জনক জায়গায় অপারেশন চালাতে হয়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঘড়িটা অপরাধীর কাছ থেকে ছিনিয়ে আনা গেছে।” শক্তিদা এবার জেমস বন্ড। মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছিলাম একটা উড়ন্ত এরোপ্লেনের খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে ঠাঁই ঠাঁই করে গুলি চালাচ্ছেন উনি। ঘড়ির ছবি সেই গায়নাকোলজিস্টকে ফরোয়ার্ড করে দেওয়া হলো।
“হ্যাঁ, এ-ই তো আমার হারাধন”- আত্মহারা গায়নাকোলজিস্ট। গায়নাকোলজিস্ট খোঁচড়কে টাকা দেওয়া বাবদ পাঁচ হাজার টাকা গচ্চা দিতে রাজি হল।
এর সপ্তাহ খানেকের মধ্যে শক্তিদার নার্সিংহোমের সাথে যুক্ত সমস্ত ডাক্তারদের নিয়ে বিরাট পার্টি, কিছুটা সেই টাকায় আর বাকিটার স্পন্সরার শক্তিদা। অন্য নার্সিংহোম থেকে শুধু ভবদা নিমন্ত্রিত। পার্টির মাঝখানে শক্তিদা নিজের স্টাইলে আসল গল্পটা সবাইকে শোনালেন। সবার মধ্যে হো হো হাসির হল্লা। সেই গায়নাকোলজিস্ট খুশি হয়ে ঘোষণা করে দিলে যে সে পরে আরও একবার খাওয়াবে।
এর কয়েকমাস পরের আরেক বিকেল পাঁচটা। আমি আর সেই গায়নাকোলজিস্ট সেই নার্সিংহোমের চেঞ্জিংরুমে দ্রুত ড্রেস চেঞ্জ করছিলাম। দুঘরে দুজনের কেস আছে। ভদ্রলোক নিজের হাত থেকে ঘড়িটা খুলে দেখলাম কোমরে বাঁধা একটা দড়ির সঙ্গে জড়িয়ে নিলেন। চোখে চোখ পড়ে যেতে ফিক করে হেসে বলে “তোমাকে আর বিশ্বাস নেই।”
অসাধারণ। খুব মজার গল্প