মাঝবয়সী, ৪০-৪৫ বছরের মানুষ। কাজ করতে গেলে ভয়, বাইরে বেরোলে ভয়, বেশি মানুষ দেখলে ভয়, একা থাকলে ভয়। তার সঙ্গে জুড়ে আছে অনেকদিন ধরে চলতে থাকা মনখারাপ, যেটা আর মনখারাপের স্তরে নেই, অবসাদে ঘিরে রয়েছে মুখমণ্ডল। যে কোম্পানিতে ভদ্রলোক চাকরি করেন, নিজের হাতে দাঁড় করানো কোম্পানি, সেখানে তিনি সম্মান পান না। তার সঙ্গে জড়িয়ে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক। ওষুধ এবং কাউন্সেলিং শুরু করা হলো, দুসপ্তাহ পরে এসে বললেন, এখন মনমেজাজ কিছুটা ভালো, দৈনন্দিন কাজ করতে ইচ্ছে করছে একটু একটু। এটুকু পাওনা..
৩৫ বছর বয়সী ভদ্রমহিলা। চেয়ারে বসতে পারছেন না, চেয়ারে নাকি ময়লা। কোনো জায়গায় হাত দেবেন না, সবখানে ময়লা। দিনে স্নান করেন তিন চারবার, হাত ধোয়ার কোনো শেষ নেই। সঙ্গে হাজব্যান্ড এসেছেন, তিনি বললেন, রাত্রেবেলা শোবার আগে বাথরুমে ফ্রেশ হবার জন্য গেলে বিছানায় ফিরতে বেজে যায় ভোর তিনটে-চারটে! ওষুধ শুরু হলো, ওষুধ নিয়মিত খাওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোঝানো হলো, দুমাস পরে এখন হাত ধোয়ার পরিমাণটা কমেছে, ফ্রেশ হয়ে বিছানায় ফিরে আসছেন রাত ১২:৩০-১টার মধ্যে। সাফল্য? অবশ্যই..
২৪ বছর বয়সী ছেলে। অফিসে কাজ করে। ছোটোবেলা থেকে বাবা-মায়ের মধ্যে সমস্যা, পরিবারে আর্থিক সমস্যা, পরিবারের লোকজনের কথায় কথায় বেরোলো ছোটোবেলা থেকেই সোশ্যাল স্ট্যাটাস-আর্থিক অবস্থা সম্বন্ধে খুব সচেতন এবং ক্রিটিকাল। হঠাৎ একদিন সামান্য ঝগড়াঝাঁটির পর অত্যন্ত রেগে যাওয়া, জিনিসপত্র ভাঙচুর করা, বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া শুরু হয়। এবং চলতেই থাকে তার পর থেকে। গত কিছুদিন থেকে সে বলছে, রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মারা গেছেন, এখন আপাতত সে মুখ্যমন্ত্রী ঠিক করার দায়িত্বে আছে, সৌরভ গাঙ্গুলীকে করা হবে পরের প্রধানমন্ত্রী, মোদীজি আসছেন মিটিং করতে। ভর্তি করা হলো, ওষুধ শুরু করা হলো, কিছুদিন পরে ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে আবার কাজকর্ম শুরু করবেন। প্রতিনিয়ত ওষুধ খেয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করবেন, আগের মতো..
১৫ বছর বয়সী মেয়ে। শান্ত, চুপচাপ, পড়াশুনায় মোটামুটি। হঠাৎ একদিন দিদিমণি ক্লাসে পড়া ধরতে ধরতে মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। তারপর থেকে অজ্ঞান হতেই থাকল মাঝে মধ্যেই। ৫-১০-১৫ মিনিট চোখ বন্ধ করে উল্টে পড়ে যায়, সেসময় কোনো ডাকে সাড়া দেয় না, কোনো খিঁচুনি হয় না বা মুখচোখ বেঁকে যায় না। ঘরের লোক হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি শুরু করলেন, এই স্ক্যান সেই পরীক্ষা ওই ওষুধ, মেয়ে আর ভালো হয় না। ঘুরেফিরে নৌকা এসে ঠেকলো সাইকায়াট্রির আউটডোরে, ওষুধ শুরু হলো, ঘরের লোকজনকে বোঝানো হলো এরকম অজ্ঞান হবার সময়ে কী কী করতে হবে আর কী হবে না। গত তিনমাসে তার মাত্র একবার অজ্ঞান হবার ঘটনা ঘটেছে। পাওয়া তো বটেই..
২৭ বছর বয়সী হিন্দু নামের বিবাহিত মানুষ। একটি মেয়ে আছে। কাজকর্ম করতে তাঁর বড়ই অনিচ্ছা, ঘর চলে বাবার বন্ধ লেদ কারখানার সঞ্চয়ে, বাড়িতে এ নিয়ে নিত্য ঝামেলা চলে অনেকবছর ধরে। হঠাৎ একদিন তিনি বলতে শুরু করলেন, তাঁর মুসলিম ঘরে জন্ম, তিনি আব্বাস সিদ্দিকীর পরিবারের ছেলে। এর সঙ্গে ছিল ডিল্যুশন অফ লাভ, মেসেঞ্জারে একটি মেয়ের প্রোফাইলে মেসেজের পর মেসেজ করে যান রিপ্লাই বা সিন হওয়া ছাড়াই, গত প্রায় এক বছর। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কেউ ক্ষতি করে দেবে এমন ভয়, একলা ঘরের কোণে বসে থাকা। ভর্তি করে চিকিৎসা শুরু হলো, সুস্থ জীবনে ফেরানোর লড়াই..
৪০ বছর বয়সী ভদ্রমহিলা। বিবাহিত, দুটি সন্তান আছে। গত একবছর ধরে তাঁর বারবার মনে হতে থাকে, তাঁর গোপনাঙ্গে কোনো পুরুষাঙ্গ ঢুকে রয়েছে। সারাদিন ধরে এই মনে হওয়া, শারীরিক অস্বস্তি ফিরে ফিরে আসতে থাকে, চাইলেও তাড়াতে পারেন না। তার সঙ্গে আছে দাড়িওয়ালা মানুষের প্রতি অহেতুক অতিরিক্ত ভয়, বারবার চান করা এরকম লক্ষণ। যে কথাগুলো সমস্যাগুলো বলছেন তিনি, বাস্তব জীবনে সেগুলোর কোনো ভিত্তি নেই, কিন্তু তাঁর মানসিক অবস্থায় সেই ভিত্তি বড়ই শক্তভাবে প্রোথিত। SSRI গোত্রীয় ওষুধ শুরু করা হলো, কয়েক মাস ধরে আস্তে আস্তে ডোজ বাড়ানো হলো, থেরাপি শুরু করা হলো, এখন সুস্থ হবার পথে..
৪০ বছর বয়সী গৃহবধূ। সংসার, কাজকর্ম, ছেলেপুলে সামলানোর মধ্যে দিয়ে দিন কেটে যায়। হঠাৎ গোটা শরীরের বিভিন্ন জায়গায় চিনচিনে ব্যথা, শিরায় টান লেগে যাওয়া ঘাড়ের পাশ থেকে হাত পর্যন্ত, যন্ত্রণায় প্রতিটি দিন দুঃসহ হয়ে ওঠা শুরু হলো। মেডিসিন, নিউরো, স্ক্যান, এমআরআই, নার্ভের ওষুধ, কোনোমতেই ব্যথা কমে না। এখানে এলেন, আগের সব ওষুধ বন্ধ করে সাইকায়াট্রিক ওষুধ শুরু করা হলো, ব্যথা কমতে শুরু করলো। ওষুধ খেয়ে যেতে হচ্ছে, ব্যথাটাও একদম চলে গেছে তা নয়, কিন্তু ব্যথাটুকু যাতে ব্যথাতেই আটকে থাকে, পুরো জীবন না হয়ে ওঠে, তার পথে হাঁটা শুরু করেছেন তিনি..
সাইকায়াট্রি। মানসিক রোগ। এমন এক ডিপার্টমেন্ট, এমন এক ডাক্তারের বিভাগ, যেখানের কথা বলতে হয় ফিসফিস করে, নীচু স্বরে, পাছে কেউ শুনে ফেলে। এমন সব রোগ, যেগুলো সাধারণ মানুষ বোঝে না, বোঝে শুধু পাগল আর পাগলামো। এমন ওষুধ, যেসব নাকি কোনোদিন বন্ধ করা যায় না, সারাজীবন খেয়ে যেতে হয়, আর প্রচুর সাইড এফেক্ট, তাই খেতে নেই। তবু এই ওষুধের জোরেই মানুষ নিজের জীবন ফিরে পাচ্ছেন, রোগের বাইরে নিজের জীবনটা চিনে নিতে সাহায্য করছে হাজারো মানুষকে এই ওষুধ। প্রতিটা রোগীর রোগের ধরণ কিছুটা আলাদা, আবার আসলে একই, তার মধ্যে থেকে চিনে নিয়ে, খুঁজে নিয়ে রোগের ট্রিটমেন্ট, যে রোগ ধরার জন্য কোনো রক্ত পরীক্ষা, কোনো স্ক্যান, কোনো ছবি এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। কিন্তু তাও রোগগুলো আছে, রোগীরাও আছেন, তাঁরাও অন্যান্য ডিপার্টমেন্টে আসা রোগীদের মতোই মানুষ, রোগকে হারিয়ে তাঁরাও প্রতিনিয়ত ফিরে আসছেন জীবনে, তাঁদের থেকে টুকরো টুকরো সাফল্য ধার নিয়ে আমরাও হাঁটছি, ‘পাগল’ থেকে মানসিক রোগে অসুস্থ মানুষের গ্রহণযোগ্যতার ক্রমবিবর্তনের দিকে..
[ছবি: বাইপোলার ম্যানিক একজন পেশেন্টের লেখা শায়রি,আউটডোর টিকিটের পেছনদিকে..]