রুগী দেখার ফাঁকে চোখ পড়ল ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা এক রূপসী মহিলা। বেশ বড়সড়ো এক ছেলে কোলে। সোজা তাকিয়ে আমার দিকে—আমার কাজকর্ম লক্ষ্য করছে মনে হয়।
তার পালা আসতে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম। চোখ পড়ার মতই। গ্রাম বাংলার সেই প্রতীকী বধূ, ডাগর চোখ। তেল দিয়ে টানটান করে বাঁধা চুলের জোয়ার, পাট ভাঙ্গা শাড়ীতে টান টান শরীর। সেই যে, ‘কোনো এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোনো’। একরাশ উজ্জ্বল হাসি নিয়ে মেয়েটি বললো ‘ডাক্তারবাবু আমার ছেলে’–।
যদিও হাসার কিছু ছিল না। মিষ্টি দেখতে বছর ছয়েকের ছেলেটির দু পা’ই পঙ্গু। সারা গায়ে পেচ্ছাপের গন্ধ। এক বছর আগে মেরুদন্ডের হাড় ভেঙ্গে যায়। রোগীর ভীড়ে বেশী কথা বলার সময় নেই। ভর্তি করে নিলাম।
*****
ছেলেটির নাম শরৎ। শরৎ কেন কে জানে? শরৎকালে জন্মেছিল? নাকি রোদ ঝলমলে শরতের আকাশ বলে? (নাকি শরতের আকাশ রোদ ঝলমলে বলে?) শরতের বাবা রিক্সা চালায়।
শরৎ আমার তত্ত্বাবধানে হাসপাতালে ভর্তি রইল সাত-আট মাস। আমি নতুন চাকরীতে ঢুকেছি। একটা বড় হাসপাতালের সহ-অধিকর্তা। আমার কাছে শরৎ তখন একটা প্রতিজ্ঞা। আমি রিহ্যাবিলিটেশন স্পেশালিষ্ট। শরতকে রিহ্যাবিলিটেড করতে হবে। তার পুনর্বাসনই তার চিকিৎসা। শরতের বাড়ী ছিল পশ্চিমবঙ্গের কোনো এক গ্রামে। কোন গ্রাম তাতে আর এখন কিছু যায় আসে না। সামান্য জমি। বাবা দিনমজুর। (সেই জমিতে শরতের বাবার তখন সামান্য চাষবাস)। বাড়ীতে লাউ, উচ্ছে, কুমড়ো। নিকনো উঠোন। সন্ধ্যের প্রদীপ। (সন্ধ্যা-প্রদীপ)। চোখে স্বপ্ন—আরো কিছু জমি। ধান চাষ। শরৎ খেলে বেড়ায়। ছ’বছর পূর্ণ হলে স্কুলে ভর্তি হবে।
বড় দাদাদের দেখে জাম গাছে চড়তে গিয়েছিল। বেশী নয় হাত চারেক উঠেই পড়ে গেলো। প্রথমে সবাই ভেবেছিল এইটুকু পড়ে কিছু হয়নি, কিন্তু পা’দুটো অসাড় হয়ে গেলো। পেচ্ছাপ-পায়খানার হুঁশ থাকল না। কবিরাজ, মালিশ, তেল, সরকারী হাসপাতাল, ধারদেনা—সেই এক গপ্পো।
তরুণ বাবা—মা। চোখে স্বপ্ন, মনে তেজ। অতঃপর বাড়ী ঘর বেচে কলকাতায়। এসে গেল, ‘ডাকিনী যোগিনী’। বাবা রিক্সা চালায়। এদিক ওদিক ঘুরে শেষে আমাদের হাসপাতালে—পুনর্বাসনের আশায়।
শরৎ ভর্তি হলো। শতৎ আমার চ্যালেঞ্জ। ওর পুনর্বাসন আমার প্রতিজ্ঞা।
শরতের রোগটা একটু জটিল। মেরুদন্ডের একনম্বর লাম্বার ভাটিব্রা ভাঙ্গা। কোনো চিকিৎসাতেই দু’পায়ে বল আর ফিরবে না। সারাদিন ফোঁটা ফোঁটা পেচ্ছাপ। ফলত নিতম্বে ঘা এক বছর ধরে।
প্ল্যান মাফিক এগোলাম। প্রথমে ঘা সারানো। ক্যাথেটার পরানো যাতে ক্ষতস্থান পেচ্ছাপে না ভিজে যায়। মাসখানেক শরৎ ক্যাথেটার পরে থাকলো।
কিন্তু ক্যাথেটার তো বেশীদিন পরিয়ে রাখা যায় না। তাতে মূত্রাশয়ে বার বার সংক্রমণ হতে থাকে। মেরুদন্ডে চোটের পর যে পক্ষাঘাত হয় তার প্রথম জটিলতা পেচ্ছাপের সংক্রমণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যে সমস্ত সৈনিক মেরুদন্ডে চোট পেয়ে ঘরে ফিরেছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই এক-দেড় বছরের মধ্যে মারা যান পেচ্ছাপের এবং মূত্রাশয়ের সংক্রমণে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আবিষ্কৃত হয় এক নতুন পদ্ধতি যাকে বলা হয় I.C.C. (Intermittent self catheterisation), রুগী নিজেই পরিষ্কার হাতে দিনে পাঁচ/ছ বার পেচ্ছাপের রাস্তায় নল (ক্যাথেটার) পরবেন। পেচ্ছাপ হয়ে গেলে নল বার করে সাবান দিয়ে ধুয়ে শুকোতে দেবে। সারা পৃথিবী জুড়েই মেরুদন্ডে চোট পাওয়া রুগীরা এই পদ্ধতি অবলম্বন করে সুস্থ আছেন।
কিন্তু ছ’বছরের শরৎ কি নিজে তা পারবে? চেষ্টাতো করতেই হবে। শরতের মা’কে নিয়ে পড়লাম। তাকে I.C.C. বোঝালাম। আর বললাম দিনে রাতে শরতকে চার পাঁচবার I.C.C. করিয়ে দিতে।
শুরু হলো লড়াই। দেখা গেল দু’বার I.C.C.-র মাঝেও শরতের নিজে থেকে কিছুটা পেচ্ছাপ হয়ে প্যান্ট ভিজে যাচ্ছে। অতএব জল কম খাওয়ানো আর কিছু দামী ওষুধ রোজ, যা হাসপাতালে পাওয়া যায় না। শরতের মা’য়ের দাঁত চেপে উত্তর—‘হ্যাঁ। আমরা ওষুধ কিনব। যে ভাবেই হোক।‘
শরতের পেচ্ছাপের সমস্যা মিটল।
পরের অধ্যায় দাঁড় করানো, হাঁটানো। দু’পায়ের জন্য দু’টো ক্যালিপার তৈরী করা হলো। ক্যালিপার হচ্ছে লোহার রড লাগানো জুতো—হাঁটুর ওপর পর্যন্ত রডগুলো তোলা। পায়ের বিভিন্ন অংশে চামড়ার বেল্ট পায়ের সাথে রডকে বেঁধে রাখে। কিছু দিনের মধ্যেই শরৎ ক্যালিপার পরে দু হাতে দু’টো ক্র্যাচ নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। কি আনন্দ তার। সারাদিন ধরে টকটক করে হেঁটে বেড়াচ্ছে। উজ্জ্বল মুখ তার। কত কথা—এইবার সে স্কুলে ভর্তি হবে।
*****
সন্ধ্যেবেলা সল্টলেকে আমার আবাস থেকে ধীরে সুস্থে হেঁটে চলেছি ক্রেশ থেকে আমার ছেলেকে আনতে। ক্রেশের কাছে একটা মোড় ঘুরতেই দু’জন দৌড়ে এসে ঢিপ ঢিপ করে প্রণাম। তাকিয়ে দেখি শরতের বাবা—মা। এতদিন বাবাকে ভাল করে চোখেই পড়েনি। শরৎ জুড়ে তো শরতের মা। বাবার ছিপছিপে শান্ত বলিষ্ঠ চেহারা। শরতের মা বলল—‘যাও। ডাক্তারবাবুকে রিক্সায় পৌছে দিয়ে এসো’।
আপত্তি জানিয়ে আমার জিজ্ঞাসা—‘কোথায় থাকো তোমরা?’
আঙ্গুল তুলে দেখাল—ফাঁকা মাঠে কিছু ঝুপড়ি বাড়ী। তাকিয়ে দেখলাম। এই বিশাল (মাঠে) ক’দিন পরে গড়ে উঠবে সিটি সেন্টার।
আমার চ্যালেঞ্জ একটা বড় ধাক্কা খেল। শরতের পুনর্বাসনের কি হবে? আজ নয় কাল তারা এখান থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাবে। ভেসে বেড়াবে। কোন এক বস্তীতে আশ্রয় পাবে। সেখানে কি শরতের I.C.C. করানো যাবে? পরিষ্কার হাত, পরিষ্কার ক্যাথেটার? ওষুধ জুটবে? স্কুলে পড়বে?
এই ধরনের ছিন্নমূল সংসারের সন্তানের কি পুনর্বাসন হয়? তাদের পুনর্বাসন কি তাহলে শুধু হাসপাতালের চৌহদ্দির মধ্যে? হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলে আবার যে কে সেই? আমার চ্যালেঞ্জ আমারই ধৃষ্টতা।
আরো এক মাস কেটে গেছে। ভাঙ্গা মন নিয়ে শরতের চিকিৎসা চালিয়ে গেলাম। শরতের ঝকমকে মুখ, আশাভরা চোখ—আমার হতাশা ওকে ছোঁয়নি। ও স্কুলে ভর্তি হবার স্বপ্ন দেখে চলেছে।
একদিন রাউন্ডে গিয়ে দেখি শরতের মা নেই। তার জায়গায় এক অশীতিপর বৃদ্ধা। শরতের ঠাকুমা। ভাবলাম একদিন ছুটি নিয়েছে। কে I.C.C. করাবে? একটু বিরক্ত হলাম। তবে মেনেও নিলাম।
দু-একদিন গেল। প্রতিদিনই দেখি সেই বৃদ্ধা। রাগ হয়ে গেল। বৃদ্ধা কানে কম শোনেন। তাঁকে I.C.C. করাবার পদ্ধতি বোঝাতেই পারলাম না। শরতকে জিজ্ঞাসা করলাম—‘মা কোথায়?’। শরৎ নিরুত্তর। ওকে বললাম তার বাবা যেন পরের দিনই আমার সাথে দেখা করে।
পরের দিন আমার চেম্বারে শরতের বাবা এল। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। বসতে বললাম। কুন্ঠিত ভাবে বসল। একচোট গালাগালি দিলাম। বললাম—‘আমি এত চেষ্টা করছি। শরতের মা নেই কেন? তোমার মাকে দিয়ে কিছু হবে না।‘
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে নিচু গলায় শরতের বাবা যা বলল তার সারমর্ম হলো—শরতের মা চলে গেছে-অন্য পুরুষের সাথে।
চমকে উঠলাম। আছে আর নেই এর বিভাজনে থেমে নেই সামাজিক পরিবেশ—শহুরে বস্তীতে ঢুকে পড়েছে অসংস্কৃতির নোনাজল। পরিচিত মূল্যবোধ ভেঙ্গে চুরমার। নতুন কিছু গড়ে উঠেছে কি?
এই অন্ধকারে শরতের পুনর্বাসন?
শরৎ আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেল। গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত, কিন্তু হল না। আমাদের দেশে চারিদিকে কত গল্প!
দশ বছর কেটে গেছে। সরকারী হাসপাতালের চাকরী ছেড়ে দিয়েছি অনেকদিন।
এক কম খরচের বেসরকারী হাসপাতালে রুগী দেখছি। হঠাৎ দেখি শরতের বাবা। আর হ্যাঁ সঙ্গে শরতের মা’ও। ভেঙ্গে যাওয়া সংসারে জোড়াতালি দিতে ফিরে এসেছে। শরতের বাবা এখন রিক্সা ছেড়ে গাড়ী চালায়। পোষাক—আষাকে উন্নতি হয়েছে।
স্কুলে পড়া শরতের হয়নি। ক্যালিপার ভেঙ্গে গেছে। সেই সরকারী হাসপাতালে ফিরে গিয়ে বিশেষ সুবিধে করতে পারেনি শরতের বাবা-মা। এতদিন পরে আমায় খুঁজে পেয়ে ওদের আশা।
আমি জানি না আমি কি করব। রাস্তার অচেনা গর্তগুলো আমি অনেকটা চিনেছি। বড় সাবধানে পা ফেলতে হবে।
আহ্। ভালো থেকো ডাক্তার বাবু, ডা.আশিস কুণ্ডু সুন্দর, স্তরের চেয়েও নির্মম। ভালবাসা জেনো সপরিবার।