“অ্যাই সুকন্যা, বারোটায় পিএসএম থিওরি ক্লাস শুরু—পৌনে বারোটা বাজে—এ মা, তোর তো ভাত খাওয়াও হয়নি—অ্যাঁ! পায়ে ক্রিম মাখছিস বসে বসে? চ’ চ’, আর রূপচর্চা করতে হবে না—-যত্তসব!”—নীপার বকুনি।
“সুকন্যা, তুই যে বললি, উত্তম সুচিত্রার সিনেমা? কোথায়? ওটা তো বিকাশ রায়ের ‘জীবন তৃষ্ণা’—কি অসাআআধারণ রে!”— সেবা-র হার্টথ্রব বিকাশ রায়, সেই প্রথম জানতে পারলাম।
লেডিজ হোস্টেলের ঠিক মুখোমুখি অবস্থান অ্যানাটমি বিল্ডিংএর, আগেও লিখেছি। হোস্টেলের তিনতলার ঘরগুলোর ঠিক উল্টোদিকে ডিসেকশন রুম।
আমাদের ইয়ারের ছেলেদের ডিসেকশন শেখাচ্ছিলেন ডঃ মলয় খান। রাশভারি স্যার, খানিক ভীতিপ্রদও ছিলেন।
কিছুক্ষণের জন্য স্যার বাইরে গেছেন। এরই মধ্যে কোনো একজন সহপাঠীর নজর পড়ল উল্টোদিকের লেডিজ হোস্টেলের একটি ঘরের জানলায়। পাল্লা খোলা। ঘরের অসচেতন অধিবাসিনী পোশাক পরিবর্তন করছে। একেবারে এ টু জেড। মূহূর্তের মধ্যে ডিসেকশন ফেলে গোটা ক্লাস অ্যানাটমি হলের জানলায়। টুকরো মন্তব্য। উফ্, আফ্ গোছের শব্দ উড়ে বেড়াচ্ছে চারদিকে। অনেকটা দূর বলে হোস্টেলবাসিনী পর্যন্ত পৌঁছচ্ছে না।
যাহোক, সব ভাল জিনিসেরই শেষ তাড়াতাড়ি হয়, এই আপ্তবাক্য মেনে বেশ পরিবর্তন ঝটপট শেষ হয়ে গেল। ঠিক তখনই, এক দঙ্গল তরুণকে বিমূঢ় করে মলয় খান স্যারের গম্ভীর গলা বেজে উঠল—“কাম অন বয়েজ, দ্য সিন ইজ ওভার। লেটস গেট ব্যাক টু ওয়ার্ক।”
“কি রে, সুকন্যা, তোর পরীক্ষা কেমন হলো?”— ইএনটি থিওরি দিয়ে বেরোনোর পরে প্রথম প্রশ্ন জয়িতার।
“ঐ একরকম। চলেবল”– নিজস্ব ডায়লেক্টে বললাম আমি।
“তার মানেই ফাটাফাটি লিখেছিস! অ্যাই, সক্কলে শোন, সুকন্যা আজ কাগজ ফাটিয়ে, ডেস্কে আনসার লিখে এসেছে! হেহেহেহে!”
“মেয়েরা কস্মিনকালেও লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে সিনেমার টিকিট কাটে না—” নিউ এম্পায়ারের ভিড়ে ঠাসা কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আমার সন্ত্রস্ত স্টেটমেন্ট। সঙ্গিনী চার ‘হোস্টেলাইট’দেরও সঙ্কুচিত দশা।
ব্যতিক্রম নন্দিনীদি। হলের মাথায় ঝোলানো ভিভিয়েন লি-র পোস্টারের দিকে স্বপ্নাবিষ্ট চাহনি দিয়ে বলল—“কুছ পরোয়া নেহি! এই সিনেমার জন্য চার ঘন্টাও লাইন দেওয়া যায়।”
ডাইনিং রুমে সকালের ঘুমভাঙা গজল্লা। কেউ ওয়ার্ডের নবলব্ধ অভিজ্ঞতার ব্যাখ্যা করছে বন্ধুদের কাছে, আবার কেউ পরীক্ষার টেনশন ভাগ করে নিচ্ছে অন্যদের সঙ্গে। কেউ আবার এর মধ্যেই টুক করে গিয়ে পাশের কিচেন থেকে চেখে আসছে দুপুরের মেনুর ঝুরো আলুভাজা।
বালিকাবয়সের ‘ক্রিকেট ক্রেজ’ চলে যাবার পরে, আমি নতুন করে কোনো খেলার(বা খেলোয়াড়ের) ভক্ত হইনি আর।
তবে ব্যাপারটা যখন বিশ্বকাপ ফুটবল, আর ম্যাচগুলো যখন টিভিতে লাইভ দেখাচ্ছে—তা সে যতই ডাইনিং রুমের চোদ্দ ইঞ্চি সাদাকালো হোক না কেন—খেলা দেখাটা একটা ধর্মাচরণের মতো হয়ে গিয়েছিল। কেউ জার্মানির ভক্ত তো কেউ আর্জেন্টিনার—কেউ আবার ইংল্যান্ডের সাপোর্টার! খেলার বিন্দুবিসর্গ না বুঝেই আমি নেদারল্যান্ডসের সাপোর্টার হয়ে গেলাম। জার্সির উজ্জ্বল কমলা রঙটার জন্যই কি না কে জানে?
খেলা একদিন শেষ হল। রেশ রয়ে গেল উন্মাদনার। হোস্টেলে একটা মোটাসোটা হুলো বেড়াল ঘোরাঘুরি করত—আমি সেটাকে দেখতে পেলেই মশারি টাঙানোর রড নিয়ে তাড়া করতাম। সোমা বেড়ালটার আদরের নাম দিয়েছিল—লোথার ম্যাথেউস। সময়ে অসময়ে সে ব্যাটাচ্ছেলে সোমার পায়ে মাথা ঘষে চলে যেত।
এক সকালে ঘুম থেকে উঠে, ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে, রুমের দরজা খুলতেই আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল।
“সোমা, অ্যায় সোমাআআ, দেখে যা, তোর ম্যাথেউস আমার ঘরের সামনে হেগে রেখে গেছে!”
সেটা নব্বইএর দশকের দোরগোড়া। কত কিই না ঘটবে তার পরে! মুক্ত অর্থনীতি, ভুবনায়ন, টেলিকমিউনিকেশনের যুগান্ত— আবার, বাবরি ধ্বংস, জাতিদাঙ্গা, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের মাথাচাড়া দেবার ঘটনা—অর্থাৎ পাঁচকদম এগিয়ে গিয়ে দশকদম পিছিয়ে আসা।
এক টাকায় তিনটে সিঙ্গাপুরি কলা আর দেড়-দু’টাকায় ভেজ রোলের স্বপ্নমেদুরতা থেকে আমরা, বিশ্বনাগরিকরা ভেঙে পড়ব স্পেনসার্স, কেএফসি আর বাস্কিন রবিন্সের বাস্তবে।
সেই ঘূর্ণি সময়ের আবহে আমরা ক’জন, জীবনমিনারের সিঁড়ির পিচ্ছিল ধাপগুলোয়, যে যার নিজের মতো করে যখন টাল সামলাতে ব্যস্ত— আমাদের তরুণ মনের ওপর আছড়ে পড়লো এক বোহেমিয়ান গিটারবাদক, তার অচেনা শব্দ আর অজানা সুর নিয়ে।
“প্রথমত আমি তোমাকে চাই
দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে চাই
তৃতীয়ত আমি তোমাকে চাই,
শেষ পর্যন্ত—তোমাকে চাই”।
কাকে চাইব, কেনই বা, সেসবে মন দেবার আগেই তুমুলভাবে আলোড়িত হয়ে গেল আমাদের মনোজগৎ।
আমাদের মধ্যে ছিল কিছু সুপ্ত নক্ষত্র। সোনালি ভট্টাচার্য্য ওই পৃথুল শরীরে অমন অসাধারণ নৃত্যবিভঙ্গ কি করে ফুটিয়ে তুলতো, আজও তা আমার কাছে আশ্চর্যের। দারুণ আবৃত্তিও করতো ও। নাটকে অভিনয়ও করেছিল, কিন্তু লেখালেখি করত বলে আমার কানে অন্তত আসেনি কোনোদিন। কিন্তু পরে জেনেছি, আমাদের ‘মেডিকোস ৮৬’ -র ছাত্রছাত্রীদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়ের কাব্যকীর্তির বেশির ভাগই ওর সৃষ্টি।
আমাদের কলেজ ফেস্ট যার নাম, ‘অ্যাগন’, সেখানে শ্রোতাকে মাত করে দেওয়া থেকে যার শুরু—তার গলার কারুকাজে সেদিন শুধু মুগ্ধ হতাম আমরা, আর আজ অগণিত গুণমুগ্ধ যে নক্ষত্রের—তার নাম পার্থ, পার্থসারথি ভটচাজ—সকলে তাকে চেনে পার্থসারথি একলব্য নামে।
তা, এই পার্থ-র সঙ্গে, প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের ফাঁকে টেবিল বাজিয়ে আমি গেয়েছি হেমন্ত-সন্ধ্যার ডুয়েট—বসে বসে শুনেছে আমার সহপাঠীদের ছোট্ট গ্রুপ। হ্যাঁ, এই আমি, হোস্টেলে যার বাজখাঁই গলা শুনলে, পিঙ্কিদি-রা বলে উঠত–বাপ, কি অমাইক ভয়েস! যেন টাটা সেন্টারের ছাদ থেকে চৌরঙ্গিতে ট্যাকসি ডাকছে।
পার্থকে পরে কখনো জিজ্ঞাসা করা হয়নি, যে সন্ধ্যা বা গীতা দত্তের গান আমার গলায় ও সহ্য করত কি করে?
সেই পার্থ, যে আনন্দবাজারের দ্বিতীয় পাতায় কোনো গানের জলসার বিজ্ঞাপনে শিল্পীদের নামের ক্রম দেখে মাঝেমধ্যেই ঠোঁট ফোলাতো —“কোনো মানে হয়! হেমন্ত-র নাম অন্য শিল্পীদের মাঝখানে!”
“তো কির’ম হওয়া উচিৎ ছিল রে?”
“হয় লিস্ট শুরুই হবে হেমন্তের নাম দিয়ে — মানে প্রথম নামটাই ওঁর — নয়ত, সব নামের শেষে বোল্ড টাইপে লেখা থাকবে, এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়! ব্যস!”
প্যারাসাইটোলজি আর ফরেনসিক ও ফার্মার চাপে আমার অ-পাঠ্য বই পড়া শিকেয় উঠেছিল। শুধু মিলস অ্যান্ড বুনসের বটতলা রোম্যান্সগুলো পড়তাম চাপ কাটাতে। বটতলা বলছি বটে, কিন্তু আমার উল্টোদিকের রুমের বাসিন্দা মৌসুমী—যে খুব রোগা ছিল বলে তাকে আমরা চিংড়ি বলে ডাকতাম— একদিন খুব রেগে গিয়ে বলেছিল—“সুচিত্রা-উত্তমের রোমান্স দেখতে পারিস বসে বসে, আর মিলস অ্যান্ড বুনের বেলায় নাক সিঁটকোচ্ছিস। টিপিক্যাল ওল্ড ক্যালকেশিয়ান হিপোক্রেসি”—
চিংড়ি রাঁচির প্রবাসী বাঙালি ছিল।
বাংলা বইপ্রীতি আটকে ছিল শারদীয়া দেশ, আনন্দবাজার আর পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলায়। মনে আছে, ফার্স্ট এমবিবিএস পরীক্ষা শেষ হবার পরে আমার সেকেন্ড হ্যান্ড হার্পারটা কলেজ স্ট্রিটের পুরোনো মেডিক্যাল বইএর দোকানে তিরিশ টাকায় বেচে দিয়েছিলাম মা বাবাকে না জানিয়ে। সন্দেশের পুজো সংখ্যা কিনব বলে। তাতে ছাপা হয়েছিল নতুন ফেলুদা কাহিনী—ডক্টর মুনশির ডায়েরি।
ডানবার বন্ধ হবার পর মাস দেড়েকের মাথায় বাবা পেয়ে গিয়েছিল নতুন চাকরি। নৈহাটি আর হালিশহরের মাঝামাঝি একটা জায়গায়, একটা কাগজকলে। এটা প্রাইভেট পেপার মিল ছিল না। পশ্চিমবঙ্গ সরকার অধিগৃহীত মিল ছিল — আধা সরকারি সংস্থা। তাই বোধহয়, মা বাবার নিশ্চিন্ততা একটু গভীর ছিল এবার।
যতদিন না সেই চাকরি পেয়েছে বাবা, আমাকে ফিরতে দেয়নি হোস্টেল থেকে। বাঙ্গুররা আলো জল সব বন্ধ করে দিয়েছিল ডানবারের মেস কোয়ার্টারে। ভাগ্যিস, গারুলিয়া মিউনিসিপ্যালিটির জলের লাইনটা ছিল। তা-ও ওই কয়েকটা দিন অবর্ণনীয় কষ্ট আর অনিশ্চয়তার মধ্যে কেটেছিল মা বাবার — হোস্টেলের নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছাড়িয়ে আমাকে আর সেসবের মধ্যে টেনে আনতে চায়নি ওরা।
হাজিনগরের সেই পেপারমিলে কাটানো কয়েক বছর, সম্ভবত আমার মা বাবার কাটানো সবচেয়ে আনন্দের সময়। নিশ্চিন্ত নির্ঝঞ্ঝাট চাকরি। সন্তানের সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ। জাগতিক সমস্ত সুখের উপকরণ সাজানো চতুর্দিকে। গঙ্গার ধারের, ব্রিটিশ আমলের সেই বিশাল কোয়ার্টার। সামনে বিস্তীর্ণ লন। পিছনে কিচেন গার্ডেন। মালী, বেয়ারা, জমাদার, ড্রাইভার হামেহাল হাজির।
আমার যে বাবার কলেজের মাইনের অর্ধেক নরেনের মুদিখানার দেনা শোধ করতে বেরিয়ে যেতো বলে বাড়িতে মাছ আসতো কালেভদ্রে, সেই বাবা প্রতি রবিবার অফিসের গাড়িতে নৈহাটির বাজারে গিয়ে ডিকি ভর্তি বাজার করে ফিরত — ফ্রিজে জায়গা অকুলান হয়ে পড়ত। লাইব্রেরির হলদে হয়ে যাওয়া পাতার বইগুলো পড়ে যে মায়ের পাঠতৃষ্ণা মেটাতে হতো, তার জন্য পাবলিশারের ক্যাটালগ ধরে ধরে পেটি করে বই আসত কলকাতা থেকে — বাবা বাঁধিয়ে দিতো পেপার মিলের মোটা খয়েরি বোর্ড পেপারে।
কিন্তু, হাজিনগরের কথা এখন থাক। আমার কলেজজীবনের মুহূর্তগুলোর সঙ্গে নতুন করে আলাপ করি বরং।
“দিলীপদা কিন্তু তুলিকে অসম্ভব পছন্দ করেন, বল?”
“হুম, তুলিকে সব স্যারেরাই খুব ভালবাসেন। সেদিন হসপিটালের গেট দিয়ে ঢুকবার সময় ডঃ অশোক ব্যানার্জি গাড়ির জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে ওর বিনুনি টেনে দিয়ে গেছেন।হিহি—”
“দাঁড়া, ডেমোকে বলে দেব—”
“দে না”— লজ্জায় লাল তুলির জবাব —
“আমার ঘেঁচু হবে—”
দিলীপদার কাছে আমরা সার্জারির টিউশন নিতাম। আর অশোক ব্যানার্জি স্যার আমাদের কলেজের সার্জারির প্রফেসর ছিলেন।
ডেমো আমার ক্লাসমেট। ডেমনস্ট্রেটর থেকে ডেমো। যে কোনো বিষয়ে খুব বিশদে বোঝাতে পারতো ডেমো। তাই পিতৃদত্ত নাম স্বপন চলে গিয়েছিল অন্তরালে। তুলির সঙ্গে তখন চলছিল তার পূর্বরাগের পালা। আজ তুলি ডেমোর ভারভার্তিক ঘরণী — দুটি কৃতী সন্তানের মা।
মিঠু, আমার আরেক ক্লাসমেট সুনন্দন, তার দিদির বিয়ে — আমরা অর্ধেক ক্লাস হলাম নিমন্ত্রিত। মায়ের সাউথ ইন্ডিয়ান সিল্ক আর চোখের মোটা কাজলে, ল্যাকমে শ্যাম্পুতে ফাঁপানো ফুরফুরে চুলে আর রুমমেট সুজাতাদির লিপস্টিকে, খুব সেজেছিলাম সেই সন্ধেবেলা। দল বেঁধে যাওয়া হয়েছিল পার্ক সার্কাস থেকে মোমিনপুর। দু’একজন ডে স্কলার মেয়েও সেই রাতে বিয়েবাড়ি থেকে ফিরে, রয়ে গিয়েছিল হোস্টেলে। মহাশ্বেতা তাদেরই একজন।
পরদিন সকালে এজমালি বাথরুমের সামনে বেসিনে দাঁত মাজতে এসে মহাশ্বেতার মুখোমুখি হলাম, আয়নারও আগে। আমার চোখে ধ্যাবড়ানো বাসি কাজল, আর উস্কোখুস্কো চুলের গুছি ঢাকা কপাল দেখে মহাশ্বেতার উচ্ছ্বাস —“তোকে না, একদম পুরোনো ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট এরা-র হিন্দি ফিল্মের হিরোইনের মতো লাগছে, জানিস?”
সেই মহাশ্বেতা, যে কি না হোস্টেলে শুধু ডাল ভাত মাছ খেতে দেওয়া হয় জেনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বলেছিল —“দুধ খাস না তোরা? তাহলে খাস কি?”
ফার্মাকোলজি থিওরি ক্লাসে লেকচার থিয়েটারে জায়গা নেই একফোঁটা। দেরিতে ঢুকেছি। বসার জায়গা দূরস্থান, দাঁড়াতেও হচ্ছে কষ্টেসৃষ্টে। তারই মধ্যে কানের কাছে ফিসফিস —“তুই আর সুস্মিতা সেদিন কোথায় গেছিলি রে? একসাথে বেরোতে দেখলাম।”
“সিনেমা।”—ক্লাসে ফিসফিস করা বিলকুল না পসন্দ আমার। ফার্মার হেড কড়া প্রফেসর। আগের দিনই সুগতকে ধমকেছেন —
“ইউ স্টুপিড বয়। স্টুপিড বয় ইউ আর–” বলে। (এমন বকুনিতে ক্লাসসুদ্ধ হাসির কলরোল উঠেছিল যদিও।)
প্রশ্নকর্তা নাছোড়। “কি সিনেমা রে?”
“পুষ্পধনু” —
উফ্, এবার চুপ করতে পারে তো তিবরটা!
বিস্মিত প্রশ্ন এলো এবার —“তামিল?”
আমাদের হোস্টেলাইট বন্ধুদের মধ্যে প্রথম বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিল অর্পিতা। মেসোমশাই, মানে, অর্পিতার বাবা তখন রিটায়ার করে বেহালার গড়াগাছায় বাড়ি করে চলে এসেছেন।
আমাদের পরস্পরের বাবাদের আমরা মেসোমশাই বলে সম্বোধন করতাম। ব্যতিক্রম ছিলেন জয়িতার বাবা। ওরকম হ্যান্ডসাম, আপাদমস্তক রোম্যান্টিক কোনো বাবাকে মেসোমশাই বলে ডাকা যায়? তাই সেই মাইডিয়ার মানুষটি, যাঁকে বন্ধুর বাবা বলে ভাবার চাইতে বন্ধু হিসেবে ভাবতেই বেশি ভালবাসতাম আমরা, জয়িতার সেই ‘বাবি’কে আমরা কাকু ডাকতাম।
অর্পিতার বিয়েতে দল বেঁধে গিয়েছিলাম সক্কলে। একেবারে চিৎপুরের যাত্রাপালার ছন্দা চ্যাটার্জি কিম্বা বীণা দাশগুপ্তা মার্কা হিরোইন সেজে। হাজরার এক ম্যারেজ হল ভাড়া করা হয়েছিল সে বিয়েতে। দূর থেকেই প্যান্ডেল আর আলো নজরে আসছিল।
বাড়িটার কাছে পৌঁছে দেখলাম, নিমন্ত্রিতের ভিড় তখনো শুরু হয়নি। সামনের একটু বারান্দামতো জায়গায় দাঁড়িয়েছিলেন মেসোমশাই। আমাদের দেখে চিনতে পেরে, বললেন —“ও, তোমরা এসে পড়েছ। যাও যাও ভিতরে যাও, রুমাকে সাজানো হচ্ছে।”
রুমা অর্পিতার ডাকনাম।
সবাই হইহই করতে করতে বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়ল। আমিও।
কিন্তু ওই হুল্লোড়, আলো, সাজগোজ, লোভনীয় খাবারের সুবাস — কিছুই আমাকে সেভাবে আন্দোলিত করতে পারল না।
আমি যে মেসোমশাইএর মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। আমি তো দেখেছি, আয়োজন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা একজন তৃপ্ত গৃহস্বামীর মুখের আড়ালে আর একটা মুখ। নিজের বড় আদরের মেয়েকে চিরদিনের জন্য কাছছাড়া করার অনিবার্য দুঃখের মুখোমুখি হওয়া একটা অন্যরকম মুখ।
সেই মুহূর্তে আমার বাবার মুখটা ভেসে উঠেছিল চোখের সামনে। আমার বাবাকেও তো কোনোদিন এই কষ্ট পেতে হবে! দুচোখে অদৃশ্য অশ্রু নিয়ে ভাঙাচোরা মুখে ‘ফেয়ারওয়েল’ দিতে হবে তার ‘বাপি’কে?
নিস্পৃহ পৃথিবী আর নিষ্ঠুর নিয়মের জাঁতাকলে পড়া অসংখ্য বাবাদের জন্য ভীষণ মন খারাপ লেগেছিল সেদিন!
ছেলেরা বিয়ে করে। মেয়েদের বিয়ে হয়।
ছেলেরা বউ নিয়ে ফেরে। মেয়েরা বরের ঘরে যায়। ছেলেরা বংশরক্ষা করে। মেয়েরা গোত্রান্তরিত হয়। তাই ছেলেরাই শ্রাদ্ধাধিকারী। মেয়েরা নয়।
ধুত্তোর পৃথিবী! আর ধুত্তোর তার শাস্ত্র!
দুনিয়া বনানে ওয়ালে,
কেয়া তেরে মন মে সমাই—
কাহে কো দুনিয়া বনাই তুনে
কাহে কো দুনিয়া বনাই—
(ক্রমশ)