খেয়াল করে দেখলাম, বেশ কিছুদিন হলো তেমন কিছু লিখিনি – এমনকি ফেসবুকেও এটাসেটা খবর দেওয়ার বেশি কিছু সেভাবে পোস্ট করিনি। এর পেছনে বেশ খানিকটা দায় পরিমল ভট্টাচার্যর, বা সুনির্দিষ্টভাবে বললে, তাঁর সদ্য-প্রকাশিত উপন্যাসটির। তাঁর “সাতগাঁর হাওয়াতাঁতিরা” এমন এক আশ্চর্য কেতাব – গভীর পাঠ ও পর্যবেক্ষণশক্তি, সঙ্গে অবিশ্বাস্য কল্পনাশক্তি ও লিখনদক্ষতার মিশেল – সবমিলিয়ে সে এমন এক আশ্চর্য মায়াজগৎ যেখান থেকে বেরিয়ে আসা মুশকিল তো বটেই, তার চাইতেও বড় সমস্যা হলো, এরকম একটা বই পড়তে থাকলে নিজের আর কিছু লিখতে ইচ্ছে করে না। অবশ্য আপনি বলতেই পারেন, এ হলো নিছকই আলসের অজুহাত। কিন্তু লেখক সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের একটি কথা খুবই মনে ধরল। একটি বইয়ের গ্রুপে, লেখালিখি প্রসঙ্গে উনি মন্তব্য করেছেন – প্রথমে নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, আপনি পড়তে বেশি ভালোবাসেন, নাকি লিখতে। উত্তর যদি দ্বিতীয়টা হয়, তাহলে লেখালিখি আপনার জন্য নয়। আর যদি পড়তেই ভালোবাসেন, তাহলে ভেবে দেখুন, লেখালিখির হ্যাপায় যাবেন কেন? তো আমার ক্ষেত্রে উত্তরটা খুবই স্পষ্ট – আমি বই পড়তে ভালোবাসি, অন্য সবকিছুর তুলনায় বহুগুণে বেশি ভালোবাসি। আপনিই বলুন, তারপরও কি লেখালিখির হ্যাপা পোয়ানোর মানে হয়? তবু, পড়তে যখন ভালোবাসি, আজ একটা সদ্য-পড়ে-ওঠা বই বিষয়ে নিজের ভালোলাগার কথা লিখে রাখা যাক। না, “সাতগাঁর হাওয়াতাঁতিরা” নিয়ে কিছু লেখার জায়গায় এখনও পৌঁছাইনি – আজ বলব আরেকখানা বই নিয়ে।
প্রজাতন্ত্র দিবসে লিখতে বসেছি যখন, তাহলে একটি দেশপ্রেমমূলক বইয়ের কথা বলি। না, এই দেশপ্রেম সীমান্তে বন্দুক নিয়ে সীমানারক্ষা তথা সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখার কাজে নিয়োজিত নয় – এমনকি দেশ তথা রাষ্ট্রের শাসন অটুট রাখার দায়িত্বেও নিয়োজিত নয়। এই দেশপ্রেম নিছকই এক আটপৌরে মেয়ের আটপৌরে ভালোবাসার কাহিনী। এই “নিভৃত কথন” বইটা আমার চোখে দেশপ্রেমেরই গল্প – দেশকে ভালোবাসার কাহিনী। দেশ বলতে সেখানে মানুষ – না খেতে পাওয়া, আধপেটা খাওয়া, বিনা-চিকিৎসায় ভুগতে থাকা মরে-যাওয়া মানুষ… অথচ মেয়েটা সে ভালোবাসাকে দেশপ্রেম বলবে কিনা, আমি জানি না…
যেখানে পাস করার পরই মেয়ে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন করে বড় ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন না দেখে মা-কে বলে… “চাকরি করব মা। গ্রামে যাব। সেখানে থেকে, জীবনে সব ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর কাছে চিকিৎসা পৌঁছে দেবার খুব ইচ্ছে আমার। তার জন্য এমবিবিএস-ই যথেষ্ট বলে মনে করি আমি।”…
পড়ে কী মনে হচ্ছে? কী ভাবছেন? একেবারে সুগভীর আদর্শরসে চুপচুপে করে চুবিয়ে তোলা একখানা বই? নাহ্! উপরের উদ্ধৃতিটি বইয়ের চুরানব্বই পাতা থেকে নেওয়া। এবং বইটি মাত্র একশ ছাপ্পান্ন পাতার। এই কথার আগের তিরানব্বই পাতায় বা পরের বাষট্টি পাতার মধ্যে কোথাও কোনও মহৎ আদর্শবাদিতার কথা উচ্চকিত স্বরে বলা নেই। বইটা এক মেয়ের বড় হওয়ার গল্প – মধ্যবিত্ত ঘরের সাধারণ এক মেয়ের গল্প, যার বাবা ভদ্রস্থ চাকরি করলেও ঘনঘন চাকরি বদলের কারণে যে মেয়ের আস্তানা বারবার বদলে যায়, জীবনেও অল্পবিস্তর অনিশ্চয়তা থাকে – যে মেয়ের প্রিয় বিষয় সাহিত্য হলেও পরিবার-পরিস্থিতিগত কারণে তাকে ডাক্তার হয়ে উঠতে হয় – ডাক্তারি পড়াও আর পাঁচটা সাধারণ ছাত্রছাত্রীর মতো – আর পাঁচজনের মতোই, হস্টেলে থাকতে থাকতে যে মেয়ের বন্ধুর সংখ্যা বাড়ে আর বাবা-মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক আলগা হতে থাকে – সম্পর্কে দূরত্ব আস্তে আস্তে এমনই যে বাড়ি তৈরির সময় বাবা-মা মেয়ের সঙ্গে পরামর্শটুকু করেন না, আর সেজন্য যে মেয়ে আপনমনে অভিমানী হয়ে থাকে… সাধারণ, খুব সাধারণ একটা মেয়ে… যার জীবনে মহৎ কিছু করে ফেলার স্বপ্ন নেই, মহান আদর্শবাদিতার সোচ্চার স্লোগান নেই… শুধু গ্রামে চাকরি করতে গিয়ে ভাঙা কোয়ার্টারের বাসিন্দা হয়ে মায়ায় জড়িয়ে যাওয়া আছে – “কোয়ার্টারের নোনাধরা দেওয়াল, ক্যাঁচকোচে টিউবওয়েল, জাফরিঘেরা অপরিসর জানলায় টাঙানো গোলাপফুল আঁকা গ্রাম্য পর্দা, সব কিছু বড় মায়ায় বেঁধে ফেলে তাকে।”
আর আছে অদ্ভুত কিছু বর্ণনা, যা মায়ায় বেঁধে ফেলবে পাঠককেও…
“নিখিলদার বুড়ি মায়ের কাশির আওয়াজ, দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরে সিস্টার রাণুদির স্বামীর টিউবওয়েল পাম্প করে জল তুলে স্নানের আওয়াজ, রাতজাগা প্যাঁচার গুমগুমে আওয়াজের সঙ্গে মিশে যেতো আমার মশারির নীচে বিবিধ ভারতীর আপ কি ফরমাইশের মন কেমন করা সুর – ‘ম্যায় জিন্দগী কে সাথ নিভাতা চলা গয়া -’”
তো মেয়েটি সাধারণ, এবং ডাক্তারও সাধারণ, তদুপরি এক সাধারণ সময়ে ঘটে চলা সাধারণ জীবনের সাধারণ কাহিনী… যে মেয়ের চোখে ডাক্তার হওয়ার অর্থ মানুষকে ভালোবাসা, সহায়-সম্বলহীনের কাছে চিকিৎসা পৌঁছে দেওয়া… হ্যাঁ, বাবা-মাকে ভালোবাসার মতোই, তার কাছে, এগুলোও স্বাভাবিক ও সাধারণ… এই তো মাত্র বছরকয়েক আগেকার কথা লিখেছেন লেখক, তবু এই অতিসাধারণ ও অতিস্বাভাবিক চিন্তাগুলো পড়তে পড়তে এত আশ্চর্য লাগে কেন?! তবে কি আমরাই… অসাধারণ না হতে পেরে, স্রেফ সহজসাধ্য বলেই, অস্বাভাবিক হয়ে উঠলাম?!
প্রণাম নেবেন, সুকন্যাদি। সামনাসামনি দেখা হলে পা ছুঁয়ে প্রণাম করব। এত অকপট এত সহজ আর এত অনায়াস আপনার গদ্য, তার লাবণ্য মন থেকে মুছবে না কখনোই। এই বই যে একবার পড়বে, সে ভুলতে পারবে না।
অনেক ভালোবাসা রইল, ঐন্দ্রিল- এই বইটা পড়ানোর জন্য কৃতজ্ঞ হয়ে রইলাম। লেখাটা এতটুকু আবেগ-জ্যাবজেবে না হলেও এতখানি আবেগপ্রবণ আমি খুব বেশি বই পড়ে হইনি। বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন পুণ্যব্রত গুণ, প্রত্যাশিতভাবেই সংক্ষিপ্ত এবং চমৎকার।
বইয়ের প্রকাশক – প্রণতি প্রকাশনী। দাম – একশ কুড়ি টাকা। ছাপা নির্ভুল, বাঁধাইও দিব্যি – বইয়ের মধ্যে বেশ কিছু লাইন-ড্রয়িং রয়েছে (আলাদা করে নাম দেওয়া নেই, অনুমান করা যায় ছবিগুলো প্রচ্ছদশিল্পী শ্রাবণী মিত্ররই আঁকা, সম্ভবত), সেগুলোও দিব্যি – সবমিলিয়ে, এককথায়, জলের দর।
প্রণতি প্রকাশনীর বই পেতে হোয়াটসঅ্যাপ করুন – +91 81000 42650 – এই নম্বরে।
বইমেলায় প্রণতি প্রকাশনীর স্টল নম্বর ১২৫
(আত্মপ্রচার করে নেওয়া যাক – এই স্টলে আমার দুখানা বই, “টুকরো স্মৃতি ছেঁড়া শোক” এবং “চিকিৎসা : বিজ্ঞান/ কাণ্ডজ্ঞান”, পাওয়া যাবার সমূহ সম্ভাবনা)










