১.
ভাতঘুমটা একটু বেশিই হয়ে গেছে আজ। যখন ঘুম ভাঙলো তখন প্রায় সন্ধে হয়ে এসেছে। ধীরে ধীরে বিছানায় উঠে বসে স্নেহময়। আজ আর কোনও তাড়া নেই। বাড়ির পেছনের জানলাটা খুলে দেয়। এই জানলা দিয়ে বড় রাস্তাটা দেখা যায়। আজ আকাশ একটু মেঘলা। এমনিতেই রাস্তাঘাটে লোকজন কম, তার ওপর থম মেরে থাকা আবহাওয়া মিলিয়ে অদ্ভুত একটা অস্বস্তি। বিকট আওয়াজ করে দুটো বাইক বেরিয়ে যায়। সন্ধেবেলা পাখিগুলো বাসার ফিরে কিচিরমিচির জুড়েছে। আগে বোঝা যেতো না। লকডাউনে লোকজনের ভিড় আর দূষণ কমে আসায় পাখিদের আনাগোনা বেড়েছে।
পেন্ডুলাম দেওয়া ঘড়িটায় ঢং ঢং করে ছ’টা বাজলো। জানলার কাছ থেকে সরে আসে স্নেহময়। অনেকগুলো কাজ বাকি আছে। ইলেকট্রিক কেটলিতে চায়ের জল বসিয়ে সান্ধ্য এক্সারসাইজ শুরু করে সে। প্রথমে খানিকটা ফ্রি-হ্যান্ড আর স্কিপিং। তারপর সিট-আপ, পুশ-আপ আর সাড়ে-সাত কেজির ডাম্বেল দুটো নিয়ে খানিক কসরত। চায়ের কাপে চা ঢেলে একটা ঢাকনা দিয়ে ঢেকে স্নান করতে ঢোকে। বেশ গরম পড়েছে। আধ ঘন্টা ব্যায়াম করে ঘামে গা জবজবে হয়ে গেছে। ভালো করে স্নান সেরে চায়ের কাপ হাতে চেয়ারে গুছিয়ে বসে স্নেহময়। আকাশী রঙের পাঞ্জাবীটা গলিয়ে নেয়। এই পাঞ্জাবীটা তার বড্ড প্রিয়। লেখার খাতাটা টেনে লিখতে থাকে প্রিয় কবির ক’টা লাইন..
২.
ডা. স্নেহময় ব্যানার্জি এলাকায় বেশ পরিচিত নাম। বেশ ক’বার তাঁর চিকিৎসার গুনগান ফলাও করে সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। লোকে বলে, স্নেহময় স্যারের সাথে কথা বললেই নাকি অর্ধেক রোগ সেরে যায়। তাঁর কথা বলার ধরনটিও একদম সোজাসাপ্টা। ইনিয়েবিনিয়ে কথা বলা তাঁর ধাতে নেই। সোজা বলে দেন, ‘হজমের সিরাপ খাওয়া আর গঙ্গার জল খাওয়া এক ব্যাপার’ কিংবা ‘রক্তের ইনফেকশনটা বেশ বেশি। ওষুধপত্র দিলাম, দেখা যাক। তবে মানুষের শরীর.. মেশিনের মতো গ্যারান্টি বলে কিছু হয়না। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করবো, এইটুকু বলতে পারি।’
অনেকদিন একটানা হাসপাতালে কাজ করে পড়াশোনা ঠিকমতো হচ্ছিল না। ডাক্তারিতে মাঝে মাঝেই পড়াশোনা ঝালিয়ে নিতে হয়। নতুন জিনিস শিখতে হয়। আরও একবার উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য মনস্থির করে নেয় স্নেহময়। বহুদিন আগে থেকেই হাসপাতালে বলা ছিল, পড়তে যাওয়ার আগে একমাস কোথাও ডিউটি করবে না। এই একমাস শুধু নিজের জন্য। নতুন প্রশিক্ষণ মানেই আবার সেই হাড়ভাঙা খাটুনি.. চব্বিশ ঘন্টা, সাতদিন। খাওয়া-ঘুমের ঠিক থাকে না। তাই তার আগে একটু অক্সিজেন ভরে নেওয়া..
৩.
হঠাৎ করোনার অতিমারী শুরু হ’ল। সারা পৃথিবী ভয়ে কাঁপছে। বড়ো বড়ো সুপার-পাওয়ার দেশগুলোতেও মৃত্যুমিছিল। এ মারণ ভাইরাস শাসক-শোষিত মানে না, ধনী-দরিদ্র মানে না, ধর্ম মানে না, ডাক্তার-রোগী মানে না। তার উদ্যত থাবার সামনে সবাই নত, সবাই সমান খড়কুটো।
স্নেহময়ের এখন ছুটি। পেশেন্ট, হাসপাতাল থেকে নিরাপদ দূরত্বে তার একক, বে-রুটিন, ছন্নছাড়া জীবনযাপন। প্রয়োজনাতিরিক্ত ঘুম, গল্পের বই, ফেসবুক, সিনেমা, এক্সারসাইজ.. সব মিলিয়েও হাঁফিয়ে উঠলো স্নেহময়। পাঁচদিন যেতে না যেতেই স্নেহময় বুঝতে পারলো স্টেথোস্কোপ একটি নাছোড় শৃঙ্খল। কাজ করতে করতে একঘেয়ে লাগলে মনে হয়- ক’দিন রোগজ্বালা, ব্লাড রিপোর্ট, ইঞ্জেকশন সব ছেড়েছুড়ে নিজের মতো সময় কাটাই। আবার পেশেন্ট ছেড়ে এলে এক নিদারুণ অস্বস্তি!! সে কষ্ট বলে বোঝানো মুশকিল। স্টেথোস্কোপ কখন যেন স্নেহময়ের শরীরের একটা অঙ্গ-ই হয়ে গেছে। কিছুদিন রোগী না দেখলে মনে হয় কেউ যেন শরীরের একটা অঙ্গ কেটে নিয়ে গেছে। বেড়ে চলা জ্বর, শ্বাসকষ্ট, পেটে ব্যথা, শুকিয়ে যাওয়া শরীর, র্যাশ.. উপসর্গের রহস্যভেদ না করা অব্দি স্নেহময়ের মুক্তি নেই। এ এক অদ্ভুত নেশা.. রহস্যভেদের নেশা। রোগের সাথে পাঞ্জা লড়ার নেশা।
ছুটির ছ’দিনের মাথায় স্নেহময় বাড়ির কাছের চেম্বারে রোগী দেখা শুরু করলো। বাজারে ভালো মাস্ক নেই, উপযুক্ত সুরক্ষা নেই। তবু, বিপদের দিনে পালিয়ে আসার চেয়ে লড়াই করাই সঙ্গত মনে হ’ল তার। অন্তত দূরদূরান্ত থেকে আসা ইমার্জেন্সি রোগীদের দেখতেই হবে। আর শুধু করোনা-করোনা করে অন্যান্য রোগগুলো ভুলে গেলে হবে? করোনার চেয়ে আরও অনেক মারাত্মক রোগ থাবা উঁচিয়ে আছে শিকারের অপেক্ষায়..
নিয়ম করে দেওয়া হয়.. হাত ধুয়ে চেম্বারে ঢুকতে হবে। রোগীর সাথে একজনের বেশি নয়। তিন-ফুট ছেড়ে ছেড়ে বসার চেয়ার..
৪.
কাল থেকে গা’টা ম্যাজম্যাজ করছিল। আজ সকালে একশো দুই জ্বর। গলাটাও খুশখুশ করছে। স্নেহময় দেরি না করে সোজা চলে গেল বেলেঘাটা আইডি।
স্নেহময় মোটামুটি প্রস্তুতই ছিল। যা ভেবেছে তাই। আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি হয়ে গেল।
সেদিন রাত থেকেই স্যোশাল মিডিয়ায় শুরু হ’ল বিষোদগার..
“শুয়োরের বাচ্চা, করোনা নিয়ে সবাইকে ছড়িয়ে গেল। ডাক্তার হয়েছে **!! **কে জুতোপেটা করা উচিত”
“এমনি কি আর ***র ছেলেদের পয়সার কাঙাল বলি? হারামির জন্য সবাই আজ বিপদে পড়লো..”
“ফিরুক শালা একবার.. কেলিয়ে বিন্দাবন বার করে দিব”
ডা. স্নেহময় ব্যানার্জি হাসপাতাল থেকে ফিরে এলে কী কী শাস্তি দেওয়া হবে সে নিয়ে পাড়ায় মিটিং হয়ে গেল কয়েকবার। প্রায় জনা সত্তর-আশি পাড়ার মাতব্বর টাইপের লোক বসে সিদ্ধান্ত নিল এবার থেকে পাড়ায় লক-ডাউন আরও জোরদার করতে হবে। একে অন্যকে বুঝিয়ে দিল কেন জমায়েত খুব খারাপ জিনিস। হাটে-বাজারে উত্তেজিত আলোচনা চললো ডা. ব্যানার্জির কুকীর্তি সম্পর্কে..
৫.
সাতাশ দিন বাদে ডা. স্নেহময় ব্যানার্জি বাড়ি ফিরলেন। রাস্তা দিয়ে ঢোকার সময়েই তাঁর সম্পর্কে মধুময় বিশেষণগুলো কানে আসছিল। তার মধ্যে টুবলুর বাবাও ছিল!! লক-ডাউনের বাজারে তখন কোথাও যাবার জো নেই, গাড়ি নেই। টুবলুর সাত দিনের জ্বর। স্নেহময় পেশেন্ট দেখবে না ভেবেই রেখেছিল। হাতে-পায়ে পড়ে গেছিলেন পরিতোষ বাবু, টুবলুর বাবা। বেশ খানিকক্ষণ ভেবে স্নেহময় বলেছিল, ‘এগারোটায় চেম্বারে আনুন..’
তিনদিন বাদে সুস্থ হয়ে গেছিল টুবলু।
…..
কবিতার লাইনগুলো লিখতে লিখতে পুরোনো কথার ভিড় এসে ছেঁকে ধরেছিল। না, না। এখন আবেগের সময় নয়। কাজ বাকি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একবার চুলটা ঠিক করে নেয় স্নেহময়, এখন অনেক চুল কমে গেছে। বাইসেপস্-টা একবার ফুলিয়ে দেখে। তারপর, নিজের মনেই হেসে ফেলে। মোবাইলে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজতে থাকে.. মেঘ কেটে চাঁদের হাল্কা আলো..
শেষবারের মতো বাইরের পৃথিবীটা একবার দেখে নেয় স্নেহময়। অ্যালকোহল সোয়াব দিয়ে কুঁচকির কাছে মোটা শিরার ওপরটা যত্ন নিয়ে পরিষ্কার করে। বুড়ো আঙুল আর তর্জনী দিয়ে সিরিঞ্জটা ধরে সোজা বসিয়ে দেয়..
৬.
সকালবেলা ডোরবেল বাজিয়ে বাজিয়েও দরজা খোলা গেল না। বেলার দিকে পুলিশ এসে দরজা ভেঙে..
মর্গে ঘুমিয়ে আছেন ডা. স্নেহময় ব্যানার্জি। পুলিশ এসে টেবিলের ওপর একটা চিরকুট পেয়েছে..
“এই ঘুম চেয়েছিলে বুঝি!
রক্তফেনামাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মত ঘাড় গুঁজি
আঁধার ঘুজির বুকে ঘুমায় এবার ;
কোনদিন জাগিবে না আর ।
কোনদিন জাগিবে না আর
জানিবার গাঢ় বেদনার
অবিরাম অবিরাম ভার
সহিবে না আর-
এই কথা বলেছিল তারে,
চাঁদ ডুবে গেলে-অদ্ভুত আঁধারে
যেন তার জানালার ধারে
উটের গ্রীবার মত কোন এক নিস্তব্ধতা এসে।”
শাস্তি দেওয়ার আগেই ফাঁকি দিয়ে পালালেন প্রমাণিত গণশত্রু..
**************************************
(এটি একটি কাল্পনিক গল্প। বাস্তবের সঙ্গে মিল খুঁজতে যাবেন না।)