ডিসক্লেইমার: পুরো ঘটনাটি ঘটেছে ইংল্যান্ডে। অতএব, এদেশে কারো গায়ে লাগার কথা নয়। শুধু মাত্র ভবিষ্যতে কিছু আজব প্রাণীদের অদ্ভুত কর্মকাণ্ড রোধ করতে, একটি রিমাইন্ডার হিসেবে এই লেখাটি লিখে রাখতে হলো।
*********
গর্ভাবস্থায় মা কে ফোলিক এসিড নামক একটি উপাদান নিয়ম মেনে প্রথম বারো সপ্তাহ খেতে দেয়ার কথা। ৪০০ মাইক্রোগ্রাম করে। এটি হু গাইডলাইন। বিজ্ঞানসম্মত এই উপাদানটি দেওয়ার কারণ হলো – সেটি গর্ভের সন্তানের ব্রেন ও স্পাইনাল কর্ডের কিছু জন্মগত অসুখ প্রতিরোধ করে, যাদের এককথায় নিউরাল টিউব ডিফেক্ট বলে। আসলে এই টার্মটি ব্যবহার করা হয় অনেকগুলো অসুখকে বোঝাতে। সেই নিয়ে বিশদে যাবো না।
যেটা বলার, সেটা হলো – হঠাৎ সারা পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি করে দেয়া একটি মামলার রায় ঘোষিত হয়েছে ইংল্যান্ডে। এবং তার পরদিন যথারীতি আমাদের দেশের সব সংবাদপত্র সেই খবরের বাংলা অনুবাদ ছাপিয়ে ফেলেছে!! আশা করি অনেকেই খবরটি পড়েছেন।
মামলার বিষয়বস্তু কি?
বিষয় হলো: একজন জেনারেল প্রাকটিশনার, ডাঃ মিচেল, কুড়ি বছর আগে একজন মহিলাকে গর্ভধারণের আগে নাকি যথাযথ উপদেশ দিয়েছেন!! সেই উপদেশ মেনে মহিলা গর্ভবতী হন এবং একটি কন্যাসন্তান জন্ম দেন। দুর্ভাগ্যবশত, সেই মেয়েটি জন্ম নেয় এই নিউরাল টিউব ডিফেক্টের অনেকগুলো অসুখের একটি সঙ্গী করে। যে অসুখে তার স্পাইনের নিচের দিকে একটা ফাঁকা জায়গা দিয়ে স্পাইনাল কর্ড, নার্ভ ও কিছুটা ফ্যাট বেরিয়ে আসে।
সেই মেয়েটি একজন প্রতিবন্ধী অ্যাথলিট। যথেষ্ট চেনা মুখ। এবং ঘটনাটি আরো লাইমলাইটে আসার কারণ হলো – এই মামলাটিও করেছে সেই মেয়েটি! তার দাবি – ডাক্তার যদি ঠিকঠাক উপদেশ দিত, তাহলে সে জন্মাতো না!!
মহামান্য আদালত, একটি অতি আকর্ষণীয় রায় দিয়েছেন – ডাক্তারকে মিলিয়ন ডলার জরিমানা করেছেন!!
এবার সংক্ষেপে এই চাঞ্চল্যকর ঘটনার নানা ঘনঘটা পর পর লিখে যাবো। তার সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
১. বাদীর দাবি – ২০০১ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি তার মা, ওরাল পিল খাওয়া বন্ধ করেন এবং ২৭ শে ফেব্রুয়ারি ডাক্তার মিচেলকে দেখান। এবং এই সময়ে তিনি কোনরকম যৌন মিলন করেননি!
মানে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়ার সময় তিনি কোনভাবেই গর্ভবতী ছিলেন না। অবশ্য, এক্ষেত্রেও ময়ূরের মত চোখের জলের থিওরি থাকলে কিছু বলার নেই!
২. সেইদিনের নোটে লেখা ‘adv. Folate if desired, discussed’. তার মানে ফোলিক এসিডের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে রোগীর সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছিল।
এবার desired কথাটি ধরে টানবেন না, কারণ – কোন ওষুধ রোগী খাবেন কি খাবেন না, সেটি তার ইচ্ছের উপরেই নির্ভর করে!! আবার … desired, discussed কথাটি দিয়ে এটাও প্রমাণ করা যায় – ডাক্তার বলেছিলেন – যদি গর্ভবতী হন, তাহলে আপনি চাইলেই ফোলেট নেয়ার কথা ভাবতে পারেন। সেক্ষেত্রে কবে গর্ভবতী হয়েছেন, তার প্রমাণ জরুরি। যাকগে।
৩. ২৭ শে ফেব্রুয়ারি ওই মহিলা কিছুতেই গর্ভবতী হতে পারেন না। প্রাথমিক দাবিতে অবশ্য বাদীপক্ষ দাবি করেছিল – যে গর্ভাবস্থায়ই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েছেন। ধোপে টিকবে না বলে পরবর্তীতে সেই দাবি থেকে সরে আসেন। মহামান্য বিচারক অবশ্য রোমাঞ্চকর সুড়সুড়ির লোভে সেটি বেমালুম এড়িয়ে গেলেন।
৪. কুড়ি বছর আগে একজন ডাক্তার কি কি কথা বলেছিলেন, সেই অনুযায়ী রোগী চলেছেন কিনা, তার জন্য প্রমাণ রোগীর বয়ান! ডাক্তারের নয়! যদিও লেখা আছে!
পেন্নাম ধর্মাবতার! আপনাদের আজব কাণ্ডকারখানা বোঝা দুষ্কর!
৫. একজন ডাক্তার কুড়ি বছর আগেকার কথা মনে রাখেননি। প্রেসক্রিপশনও রাখেননি। সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? যা নোট দেয়া আছে, তাতেই তো প্রমাণ যে – একজন ডাক্তারের যা বলার তিনি বলেছেন!!
৬. চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক কোন তথ্যে নিয়ে যদি মামলা হয়, সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতামত কি জরুরি নয়? সেরকম কোন মতামত নেওয়া হয়নি এক্ষেত্রে! যদিও, ডাক্তারির বেলায় সবদেশেই, সবখানেই সবাই বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত। ধর্মাবতারই বা হবেন না কেন!!
৭. এই কেস থেকে বোঝা যায়, NHS নিয়ে গর্বিত ইংল্যান্ডে বহুদিন আগে থেকেই প্রিন্যাটাল অ্যাডভাইস নেয়ার চল ছিল। প্রিন্যাটাল ইনভেস্টিগেশনও হতো। যেমন, ইউএসজি, ট্রিপল টেস্ট ইত্যাদি। নিউরাল টিউব ডিফেক্টের ক্ষেত্রে আমরা জানি – সেগুলো প্রায় নিখুঁত রেজাল্ট দেয়।
এক্ষেত্রে সেগুলো কেন করানো হলো না , যদি করানো হয় কেন সেই অনুযায়ী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতামত নেওয়া হলো না বা প্রেগন্যান্সি টার্মিনেশন করা হলো না, কেন অসুখ আছে জানা সত্ত্বেও একটি সন্তানকে জন্ম দেওয়া হলো, সেসব প্রশ্নের উত্তরে ধর্মাবতার নীরব !!
৮. সবচেয়ে বড় কথা হলো – একটি বিচার ব্যবস্থায়, বাদীকে যতটা সুযোগ দেওয়ার কথা, বিবাদীকেও সমান সুযোগ দেওয়ার কথা অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করতে। সেটা না করতে পারা বিচার ব্যবস্থার ব্যর্থতা ছাড়া কিছুই নয়! কোন একটি অদ্ভুতুড়ে বিষয় পেলেই যদি ধর্মাবতারদের সুড়সুড়ি লাগে, বিচারের নামে অবিচারই হয়!
৯. এবার আসি একটু বিজ্ঞানসম্মত তথ্য প্রমাণে। না, বিশদে বলার জন্য এ লেখা নয়।
ফোলিক এসিড সাপ্লিমেন্ট দরকারি। বিজ্ঞানসম্মত ভাবেই প্রমাণিত – গর্ভবতী মাকে এটি দেওয়া হলে, জেনারেল পপুলেশনের মধ্যে নিউরাল টিউব ডিফেক্ট নিয়ে জন্মানো বাচ্চার সংখ্যা কমে।
কিন্তু সেটা কতটা কমে? পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে – মোটামুটি সত্তর শতাংশ ক্ষেত্রে এই ফোলিক এসিডের অভাবই নিউরাল টিউব ডিফেক্ট এর কারণ! সেটা আছে কিনা – ঠিকঠাক জানা দরকার। আবার কিছু গবেষণায় এটাও দেখা গেছে – তেমন কোন সম্পর্ক নেই।
বাকিটা? WHO এর তথ্য বলছে এটা। ধর্মাবতার – দেখেছেন সেই তথ্য?
১০. নিউরাল টিউব ডিফেক্টের ক্ষেত্রে বাকি কারণগুলো অনেকেই জানেন। তার মধ্যে জেনেটিক মিউটেশন থেকে নানা রকম ওষুধ সেবন, স্মোকিং, অ্যালকোহল ইত্যাদি নানা কারণ আছে। এবং সেগুলো সম্বন্ধে বিজ্ঞান পুরোপুরি অবহিত ।
এবার সেই কারণগুলো কে ধর্মাবতার কিভাবে বাপি বাড়ি যা বলে ছক্কা মেরে দিলেন?
সুড়সুড়ি নয়??
১১. সবচেয়ে দুঃখের বিষয় – এই রায় দেওয়ার একটি বড় কারণ – বিচারপতি ধরে নিয়েছেন – মহিলার ফোলিক এসিডের অভাব ছিল!! সেই বীজগণিতের এক্স-কে ধরে নেয়ার মত!রেট্রোস্পেকটিভ উপায়ে মহামান্য ধর্মাবতার সেটি কি করে প্রমাণ করলেন যে সত্যিই অভাব ছিল?? কোন প্রমাণ কেউ দিতে পারেনি!!
তা এক্স-এর ভ্যালু কি পাওয়া গেল?? নাকি এটাও এক্স-এর সুড়সুড়ি? অন্য কিছু ধরা গেল না?
১২. যখন ধর্মাবতার ধরেই নিলেন (অবশ্যই অন্য কারণ নেই – সেই প্রমাণও থাকার কথা!), রোগীর ফোলিক এসিডের অভাব ছিল, বা রোগীও সেটা জানতো, তাহলে তার জন্য রোগী কি করেছে? ওষুধ খেয়েছে নাকি ডায়েট ঠিক করেছে?? এই না করাটা কোন যুক্তিতে ধর্মাবতার এড়িয়ে গেলেন?? নাকি রোগীর পাপ বললে, সুড়সুড়ি খাওয়া রায় দিতে একটু সমস্যা হতো??
১৩. যদ্দু্র জানা গেছে- রোগী একবারই ওই ডাক্তারকে দেখিয়েছেন। যদি তিনি জানতেন, তার ফোলিক এসিডের অভাব আছে, পরবর্তী কালে কেন ওই রোগী ফের ডাক্তারের পরামর্শ নেয়নি?? নাকি ডাক্তারের দায়িত্ব বাড়ি গিয়ে বলে আসার – শোনো, তোমাকে ফোলিক এসিড খেতে হবে কিন্তু!
ধর্মাবতাররা দেখছি – সুযোগ পেলেই রোগীর বা রাষ্ট্রের দায়িত্ব ডাক্তারের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে খুব পারদর্শী! মনে করা যাক, অ্যাম্বুলেন্স নেই বলে ডাক্তার নিগ্রহের ঘটনা! মনে করা যাক, বেড নেই বলে ডাক্তারের দোষ! মনে করা যাক, অক্সিজেন নেই বলে ডাক্তারের জেল!! এক্ষেত্রে কবি এবং ধর্মাবতার সমার্থক, অতএব নীরব !!
১৪. আসি জরিমানার প্রসঙ্গে। এটি খুব কিউট ব্যাপার। একজন ডাক্তার – সে যত বড়ই হোক, কত টাকা ভিজিট নিয়েছেন? আন্দাজ? জরিমানার তুলনায় এক হাজার ভাগের এক ভাগ ও নয়।
এবার এই যে জরিমানার পরিমাণ, সেটি কিন্তু ধর্মাবতার ঠিক করছেন! কিসের ভিত্তিতে? দেবা না জানন্তি, কুতো মনুষ্যা!
এবার এই আদালত ব্যাপারটিতে আসুন। সেখানে উকিলরা একদিনে যা ভিজিট নেন, সেটির পরিমাণ ধর্মাবতাররা জানেন। এবার ধরা যাক, একটি খুনের মামলায় ভুল রায় দেওয়া হলো। একজন মানুষ সারাজীবন জেল খাটলো । অন্য ধর্মাবতার রেট্রোস্পেকটিভ তথ্য প্রমাণ দেখে উকিলকে জরিমানা করলেন। এমন জরিমানা যে, ঘটি বাটি বিক্রি করে উকিলের পেশাদার জীবনই শেষ হয়ে গেল !!
তাহলে কি বলা যায় না যে – যে কোন পেশাদারকে ধ্বংস করে দেওয়াই ধর্মাবতারদের কাজ!!আরো বড় কথা – এই রকম জরিমানা করলে, আদালতে উকিল নামক পেশাদাররা স্বমহিমায় বেঁচে থাকেন কি করে?? সব কেস তো আর সবাই জেতেন না!! এরকম হেরে যাওয়া কেউ যদি ক্ষতিপূরণ দাবি করেন, ধর্মাবতাররা তখন কিছু করতে পারেন? পারবেন?
***
তো এই মামলা নিয়ে অনেক কিছুই বলা যায়। এরকম বহু মামলায় আমরা দেখেছি – কোন রকম যুক্তিতর্কের ধারে কাছে না গিয়ে ধর্মাবতারগণ স্রেফ সুড়সুড়ির পরিমাণের উপর ভরসা করে পেশাদার, বিশেষতঃ ডাক্তারদের বিরুদ্ধে নানা রকম বিদঘুটে রায় দেন। রোগী বললো মানেই আদালত অবতারের ভূমিকায় চলে আসেন। বিপরীত ক্ষেত্রে অবশ্য ওনারা হিরন্ময় নীরবতা পালন শ্রেষ্ঠ মনে করেন। না হলে এতো এতো ডাক্তার নিগ্রহের ঘটনায় ওনাদের একটুও সুড়সুড়ি না লেগে পারে কি করে?? সেগুলোতে একটি রায়ও কি এমন চাঞ্চল্যকর হয়ে উঠেছে?? ওঠেনি!! ওঠে না!!
এই মামলা নিয়ে যে পরিমাণ উৎসাহ দেখলাম সব মিডিয়ায়, তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এদেশেও যে এমন মামলা হবে না, তার কোন গ্যারান্টি নেই। সেদিনও ধর্মাবতারগণ এমন সুড়সুড়ি লাগা রায়ই দেবেন, বলাই বাহুল্য!!
তাই একটু বলে রাখা ভালো – সুড়সুড়িরও একটা বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা আছে। সেটা জানুন।কনটেম্পট অফ সায়েন্স – বলে যদি কিছু থাকতো, এসব ক্ষেত্রে আপনাদের হাতে বাটিও থাকতো না।
অবশ্য – সেটি যে ধর্মাবতারদের জন্য শাপে বর হয়ে দাঁড়িয়েছে, এই মামলা তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ!
* তথ্য প্রমাণাদি দিয়ে লেখা ভারাক্রান্ত করলাম না। যে কেউ পৃথিবীর সব তথ্য গুগল খুঁজে দেখে নিতে পারেন।