সবকটি প্রতিবেদন হয়ত তেমন উঁচু মানের হয় নি। তবে এদের মধ্যে থেকে অন্তত পঞ্চাশটিকে নির্বাচন করে আমার পরবর্তী বই হিসেবে প্রকাশ করা যেতেই পারে- কি বলেন? বই প্রকাশ নিয়ে যদিও আমি সাময়িক উৎসাহ হারিয়েছি। তবে তা আবার ফিরে এলে নতুন করে ভাবা যেতেই পারে। আপনাদের সকলের অনেক মতামত ও সমর্থন পেয়েছি। তাই একে এতদিন চালিয়ে গেলাম। আমার মত সাধারণ লেখকের পক্ষে এর থেকে বড় পুরস্কার আর কীই বা হতে পারে?
হেয়ার ট্র্যান্সপ্লান্ট-২
হেয়ার ট্র্যান্সপ্লান্ট অপারেশন যদিও লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে হয় তবু সেই অপারেশন অনেক ধাপেধাপে হয় বলে শেষ হতে অনেক সময় লাগে। আমার সব কিছু শেষ হতে প্রায় আট-নয় ঘন্টা লেগে গেছিল। অনেকে মিলে এই অপারেশনে যুক্ত থাকেন। সার্জেন একজনই কিন্তু তাঁর সহযোগী অনেকে থাকেন। সারা মাথাতে ইনজেকশন দিয়ে সবার আগে আপনার মাথার চামড়াকে অবশ করা হয়। তারপর মাথার পেছনে দুই কানের মাঝ থেকে একটা চামড়ার লম্বা অংশ কেটে সেলাই করে দেওয়া হয়। এটা হতে অনেকটাই সময় লাগে।
তারপর চারজন মহিলা সহযোগী সেই চামড়ার স্ট্রিপ থেকে গোড়া শুদ্ধ চুলের ফলিকলগুলোকে খুব দক্ষতার সাথে আলাদা করেন। এই কাজে খুবই ধৈর্য ও দক্ষতা লাগে তাই মেয়েদের এই কাজে নিযুক্ত করা হয়। এই কাজ হতে হতে আপনার লাঞ্চ হবে। আপনি ছাড়াও বাকিরা একই সাথে লাঞ্চ করবেন। তারপর আপনার মাথায় যেখানে চুল লাগানো হবে সেখানে নিডল দিয়ে গর্ত করে তাতে চুলগুলো গোড়াসুদ্ধ লাগিয়ে দেওয়া হয়। অপারেশন চলাকালীন রক্তপাত বন্ধ করার জন্য যেখানে চুল লাগানো হচ্ছে সমানে সেখানে নর্মাল স্যালাইন দিয়ে ওয়াশ করা হয়।
সব চুল লাগানো হলে আপনার কপালে টেনে একটা লিউকোপ্লাস্ট লাগিয়ে দেওয়া হয় যাতে চোখ মুখ কম ফোলে। অ্যান্টিবায়োটিক ও ওষুধপত্র খুব সামান্য। ব্যথা অল্পস্বল্প হবে। দ্বিতীয় দিন থেকে চোখমুখ বেশ ফুলে যাবে। প্রথম দুদিন একটু সাবধানে থাকতে হবে যেন চুল লাগানো জায়গায় বেশি ঘষা না লাগে। দুদিনের পর থেকে আপনি বেবি শ্যাম্পু দিয়ে স্বাভাবিক শ্যাম্পু পর্যন্ত করতে পারবেন। দুদিনে আপনার চুলের গোড়া পুরোপুরি সুস্থিত হয়ে যাবে। এরপর আপনার চিন্তার কিছু নেই।
হেয়ার ট্র্যান্সপ্লান্ট করার পরে কিন্তু দুটো ওষুধ আপনাকে সারাজীবন ব্যবহার করতে হবে। একটি মিনোক্সিডিল। যেটি দিনে দুবার চুলের গোড়ায় ২ মিলি করে লাগিয়ে যেতে হবে। অন্যটি ফিনাস্টেরাইড ১ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট। এই দুটো ওষুধ আপনাকে সারাজীবন ব্যবহার করে যেতে হবে। এই ওষুধ যেমন আপনার প্রতিস্থাপিত চুলকে স্থায়ী করবে তেমনি অন্যদিকে আপনার যে চুল আছে তার ঝরে পড়া আটকাবে এবং কিছুটা নতুন চুল গজাতেও সাহায্য করবে। ছয়-সাত মাস পরে হয়ত যেখানে নতুন চুল লাগানো হয়েছে সেখানে ওষুধ না লাগালেও চলবে কিন্তু মাথার অন্য জায়গায় আপনাকে ওষুধ লাগিয়েই যেতে হবে।
মিনোক্সিডিলের সাধারণভাবে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। কিন্তু ফিনাস্টেরাইড যেহেতু ‘ডি এইচ টি ব্লকার’ তাই প্রথম দিকে কিছুটা লিঙ্গ শক্ত হতে ও ইরেকশন স্থায়ী হতে বাঁধা দেয়। তাই ডাক্তারবাবুরা যাঁরা সবেমাত্র বিয়ে করেছেন তাঁদের এই ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন না। কিন্তু কিছুদিন ব্যবহারের পরেই এই অসুবিধে প্রায় কেটে যায়। তখন আর সমস্যা হয় না। দেখুন আমার মাথার সামনের দিকেই চুল লাগানো হয়েছে। আমার মাথার মাঝখানেও চুল অনেক কমে এসেছে। তাই যদি ওষুধ না লাগাই তাহলে সেই সামান্য কয়েকটা চুলের ঝরে পড়া আটকানো খুব মুশকিল।
আরেকটা কথা খুব জানা দরকার। আপনার মাথায় যে চুল লাগানো হয়েছে আগামি তিন থেকে চার মাসের মধ্যে তারা সব ঝরে গিয়ে নতুন চুল গজাবে। তাই সেই সময়ে হতাশ না হয়ে আপনাকে ধৈর্য ধরতে হবে। সাধারণত একবছরের মধ্যে নতুন চুল গজানো প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে যায়। আমার এই ডিসেম্বরের তিন তারিখ এক বছর হয়েছে। আমি আমার অপারেশনের দিন তোলা আর একবছর পরে তোলা একটা ছবি দিয়েছি। তাহলে আপনাদের ধারণা অনেকটা পরিষ্কার হবে।
আপনি একটা হেয়ার ট্র্যান্সপ্লান্ট-এর পর কতটা ফলাফল আশা করতে পারেন? দেখুন প্রতিস্থাপিত চুল কখনই আপনার আগের চুলের মত ঘন হবে না। কারণ আপনার আগে চুলের সংখ্যা ও ঘনত্ব অনেক বেশি ছিল। খুব বেশি চুল যদি গায়েগায়ে লাগানো হয় তবে প্রতিস্থাপিত চুল উপযুক্ত রক্ত সরবরাহ পায় না। তাই ফলিকলগুলো নষ্ট হয়ে যায়। তবে সার্জেনরা চুল এমনভাবে লাগিয়ে দেন যাতে আপনাকে দেখতে ভালো লাগে। আপনার মাথায় যে চুল কমে এসেছে সেটা বাইরে থেকে দেখে বোঝা না যায়। প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে যাদের অনেকটা টাক তারা কবার হেয়ার ট্র্যান্সপ্লান্ট করতে পারবেন? সেটা নির্ভর করছে আপনার কতটা ‘হেয়ার ব্যাঙ্ক’ আছে তার ওপর। অর্থাৎ মাথার ওই বিশেষ অঞ্চলে কত চুল আছে? যত বেশি চুল থাকবে আপনি ততবার হেয়ার ট্র্যান্সপ্লান্ট করতে পারবেন। সার্জেনরা সাধারণত দুটি হেয়ার ট্র্যান্সপ্লান্ট-এর মধ্যে এক বছরের ব্যবধান রাখতে চান। যদিও তার আগেও হতে পারে।
হেয়ার ট্র্যান্সপ্লান্ট ও ওষুধ ছাড়াও ‘জি এফ সি’ বা ‘গ্রোথ ফ্যাক্টর কন্সেট্রেট’ বলেও একটা চিকিৎসা আছে। সেখানে আপনার শরীরের রক্ত নিয়ে তাকে সেন্ট্রিফিউজ করে রক্তরস ও অনুচক্রিকাকে আপনার মাথায় চামড়ার নীচে ইঞ্জেক্ট করা হয়। আমাকে প্রথমে পাঁচটা ‘জি এফ সি’ সাইকেল করার কথা বলা হয়েছিল। আমি চারটে সাইকেল করি। তারপর কোভিডের জন্য আর করা হয় নি।
এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল কলকাতায় এর খরচ কেমন? মোটামুটিভাবে প্রতি ফলিকল ৪০ টাকা আমি এই রেটেই করিয়েছি। অন্য ডাক্তারবাবুর কাছে এর রেট আলাদা হতে পারে। আমার মাথার সামনে ২০৫০ টির মত ফলিকল লাগানো হয়। হিসেব করুন প্রায় ৮২,০০০ টাকার মত। তার সাথে ১২% জি এস টি এবং একটা জি এফ সি সাইকেলের জন্য ৭০০০ টাকা যোগ করুন। মোটামোটি এক লাখ টাকার মত খরচ। এরপর যদি আপনি আরও মাসে একটা করে আমার মত পাঁচটা জি এফ সি করেন তবে এর সাথে ৩৫০০০ টাকা এবং জি এস টি যোগ করুন। সাকুল্যে লাখ দেড়েকে দাঁড়াবে।
এটা আমার একটা হেয়ার ট্র্যান্সপ্লান্ট করতে খরচ হয়েছে। এর থেকে কম খরচ হবার সম্ভাবনা কম যদি আপনি ভালো কোনো সেন্টার থেকে ভালো প্লাস্টিক সার্জেন দিয়ে করাতে চান। আর যদি আপনার মাথায় টাক বেশি থাকে তবে এই খরচ আরো অনেকটাই বেড়ে যাবে। বিক্রমদা যথেষ্ট ভালো সার্জেন। আমার ফলাফলেও আমি যথেষ্ট খুশি। তবে আমি এই গোটা এক বছর ধরে আমার ওষুধ নিয়মিত খেয়ে গেছি। এখনও খাচ্ছি। এতে আমার চুল পরা যেমন কমে গেছে, মাথার মাঝখানেও অনেক নতুন চুল গজিয়েছে।
আমার অনেক চুলই পাকা। তাই আমাকে হেয়ার ডাই লাগাতে হয়। হেয়ার ট্র্যান্সপ্লান্ট-এর সাথে হেয়ার ডাইয়ের কোনো সমস্যা নেই। ডাক্তারবাবু আমাকে বলেছেন যে কোনো ডাই যা আমার সয় আমি তাই নির্ভয়ে লাগাতে পারি। এই হেয়ার ট্র্যান্সপ্লান্ট করা চুল কতদিন থাকবে? এটা সত্যিই লাখ টাকার প্রশ্ন। তবে সবাই বলে যেহেতু এই চুল ডি এইচ টি রেসিস্ট্যান্ট তাই এটি সারাজীবন থাকবে। পড়বে না। জানি না সত্যি কিনা। আমার তো পনের বছর থাকলেই হবে। আমার চুয়াল্লিশ পার হয়েছে। ষাট অব্দি থাকলেই হল।
হেয়ার ট্র্যান্সপ্লান্ট করার পর আপনাকে নিয়মিত চুলের যত্ন করতে হবে। প্রথম এক বছর কোনো বেবি শ্যাম্পু ব্যবহার করাই ভালো। তারপর থেকে আপনি যে কোনো শ্যাম্পুই ব্যবহার করতে পারেন। আমন্ড, কিসমিস, আখরোট, বাদাম, কাজু এগুলো ডি এইচ টি-কে কাজ করতে বাধা দেয়। তাই এগুলো খাবার তালিকায় রাখলে চুল ভালো থাকবে। মিনোক্সিডিল চুলকে একটু ড্রাই করে দ্যায় কারণ তাতে বেস অ্যালকোহল থাকে। তাই সপ্তাহে অন্তত একদিন ছেড়ে ছেড়ে শ্যাম্পু করুন। চুলকে খুশকি থেকে মুক্ত রাখুন। মাথায় তেল অন্তত শীতকালে না দেওয়াই ভালো।
সবাই তো আর হেয়ার ট্র্যান্সপ্লান্ট করাতে পারবেন না। যারা পারছেন না তারা ওষুধদুটো নিয়ম করে ব্যবহার করুন। ছেলেরা মিনোক্সিডিল ৫% ও মেয়েরা ২% সলিউশন ব্যবহার করবেন। ছেলেরা তো ফিনাস্টেরাইড ১ মিলিগ্রাম খাবেনই মেয়েরাও খেতে পারেন ক্ষতি কিছু হবে না। এই ওষুধ ব্যবহারে এক মাসের মধ্যেই ভালো ফল আশা করবেন না। চোখে পড়ার মত ফলাফল আসতে আপনাকে অন্তত পাঁচ থেকে ছয়মাস অপেক্ষা করতে হবে। এবং একে চালিয়ে যেতে হবে। বন্ধ করা চলবে না। আমাদের অ্যালোপ্যাথি শাস্ত্রে এই দুটো ছাড়া আর অন্য কোনো ওষুধ নেই। তাই বাজারের অন্য তেল বা শ্যাম্পু কিছু কাজ করে না বলেই আমার বিশ্বাস। কারণ আমি নিজে সেই পথ দিয়ে অনেকবারই হেঁটে এসেছি।
হেয়ার ট্র্যান্সপ্লান্ট আপনি করাবেন কিনা সেটা আপনার ব্যাপার। আমি আমার একবছরের জার্নির কথা আপনাদের জানালাম। চুল মানুষের ব্যক্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে। আপনাকে আগের থেকে যদি আপনার নিজের কাছে ভালো লাগে তাহলে অবসাদ অনেকটাই কেটে যায়। ছেলেরাই শুধু নয় মেয়েদের হেয়ার ট্র্যান্সপ্লান্ট করার হারও এখন অনেক বেড়ে গেছে। বার্ধক্যকে আমরা কোনোভাবেই আটকাতে পারি না কিন্তু আমার মত যাঁরা অকাল বার্ধক্যের শিকার তাঁরা নিজেদের যৌবন পুনরুদ্ধারের চেষ্টা একবার করে দেখতেই পারেন যদি আপনার সাধ্য থাকে। আর সরকারি হাসপাতালেও হেয়ার ট্র্যান্সপ্লান্ট হয়। যাঁরা সেখানে করাতে চান তাঁরা প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে যোগাযোগ করতে পারেন।
শেষে একটা কথাই বলার, আমি জানি না আমার মাথার চুল কতদিন থাকবে বা আদৌ আমি আরেকটা হেয়ার ট্র্যান্সপ্লান্ট করাবো কিনা। এই মুহূর্তে সেসব ভাবছিই না। হয়ত আর করাবো না। যা ফলাফল পেয়েছি সেটাই এখন কয়েক বছর উপভোগ করি। এমন ফলাফলও যে হতে পারে সেটা আমার স্বপ্নেরও অগোচর ছিল। তাই আমি যেটুকু পেয়েছি তাতেই আমি যথেষ্ট খুশি। আপনাদের সাথে আমার অভিজ্ঞতা বিনিময় করার উদ্দেশ্য হল যাঁরা এই নিয়ে ভাবছেন তাঁরা কিছুটা পজিটিভ দিকে ভাবতে পারবেন। এর ভালোমন্দ দুটো দিক নিয়েই আপনারা বিচার করতে পারবেন।
আমি যে সময়ের মধ্যে দিয়ে গেছি আরো বহু মানুষ সেই মানসিক অবস্থার মধ্যে দিয়ে যান বা যাচ্ছেন। আমি তাঁদের সহমর্মী। একজন ডাক্তার হিসেবে নিজের এই অভিজ্ঞতা বিনিময় করে আমি আপনাদের যদি সেই অবসাদের জগত থেকে বাইরে আনতে পারি আমার প্রতিবেদন তবেই সার্থক। একজন ডাক্তারের কাছে মানুষ যায় ফলাফল পেতে। সব রোগের নিরাময় নেই, সব সমস্যার সমাধান নেই- এটা সত্যি। কিন্তু যাদের সমাধান আছে তার সুবিধাটুকু মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া উচিত। অন্তত মানুষ তো জানুক যে এমনটা হয়। এমনটাও হতে পারে।
(শেষ)