নতুন বছরে পুরনো মাল – পুরনো বলতে একেবারে দু’হাজার বছরের পুরনো – আপনাদের উপহার দিতে চাই।
একটি চিঠি।
রোমান দার্শনিক তথা নাট্যকার সেনেকা-র একটি চিঠি। লুসিলিয়াস-এর উদ্দেশে লিখিত। চিঠির সময় সুনির্দিষ্টভাবে জানা নেই। তবে সেনেকা জন্মেছিলেন খ্রিস্টজন্মের দুই-তিন বছর আগে। আর মারা গিয়েছিলেন পঁয়ষট্টি সাধারণাব্দে। মৃত্যুটা খুব অদ্ভুত। রোমসম্রাট নিরো-র একান্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি – নিরো-র বাবা ছেলের শিক্ষক হিসেবে সেনেকা-কে নিয়োগ করেন এবং পরবর্তী সময়ে, নিরো সম্রাট হওয়ার পর, সেনেকা নিরো-র পরামর্শদাতা হিসেবে নিযুক্ত হন – হ্যাঁ, অত্যাচারী হিসেবে ইতিহাসে কুখ্যাত সম্রাট নিরো-র কথাই বলছি – অবশ্য শোনা যায়, যে, পরবর্তী সময়ে নিরো যখন অত্যাচারী হয়ে ওঠেন, সেনেকা তখন নিজেকে সরিয়ে নিতে চান, যদিও নিরো তাঁকে সরে আসতে দেননি – তবে শেষমেশ নিরোর বিষনজরে পড়েন তিনি। তিনি সম্রাটকে হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, সেনেকা-র বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ ওঠে। নিরো-র নির্দেশেই তাঁকে আত্মহত্যা করতে হয়।
সেসব কথা থাক। আপাতত চিঠিটা। ইংরেজি অনুবাদ থেকে আমার বঙ্গানুবাদ। কিছু কিছু জায়গায় বাক্যগত কিছু পরিবর্তন করেছি – মনে হয়েছে, তাতে চিঠিটা পড়তে সুবিধে হবে – বাড়াবাড়ি স্বাধীনতা নেওয়া হয়ে গিয়েছে বলে মনে হলে মার্জনা করবেন।
.
প্রিয় লুসিলিয়াস,
একদম ঠিক ভেবেছ তুমি। যেভাবে ভাবছ, ঠিক ওভাবেই এগোও। নিজেকে মুক্ত করো। সময় বাঁচাও, সময় জোগাড় করো। সময়, যা তোমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছিল – জোর করে, বা চালাকি করে – অথবা স্রেফ তোমার নজর এড়িয়ে যেভাবে সময় বয়ে যাচ্ছিল – সেই সময়গুলো বাঁচাও। বিশ্বাস করো, পরিস্থিতিটা আমি যেমন বলছি তার থেকে এতটুকু আলাদা নয়। জীবনের বরাদ্দ সময়ের কিছু অংশ আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়, কিছুটা নেওয়া হয় চুরি করে আর কিছুটা চলে যায় স্রেফ চুপিচুপি। তারপরও আমি বলব, সবচাইতে লজ্জাজনক ক্ষয় হলো সেই ক্ষয়, যা ঘটে অযত্নের কারণে। মন দিয়ে ভাবতে বসলে দেখবে, লুসিলিয়াস, আমাদের জীবনের অধিকাংশটা কেটে যায় ব্যর্থতায়, বড় অংশ কাটে অর্থহীনভাবে আর আস্ত জীবনটাই অতিবাহিত হয়ে যায় অমনোযোগে, মনোযোগহীনতায়।
আচ্ছা, এমন অন্তত একজনকে দেখাও তো, যে মানুষটা সময়ের একটা নির্দিষ্ট দাম ধার্য করেন, যিনি প্রতিটি দিনের একটা মূল্য দেন, এবং যিনি উপলব্ধি করতে সক্ষম যে তিনি প্রতিদিনই মারা যাচ্ছেন। শেষের কথাটা অদ্ভুত শোনাল? দেখো, মৃত্যুকে আগামী কোনও ঘটনা হিসেবে দেখতে চেয়ে আমরা নিজেরাই শুধু নিজেদের ঠকাই, কেননা আমাদের অনেকটা মৃত্যু ইতোমধ্যেই ঘটে গিয়েছে। জীবনের যে সময়টা আমরা পেছনে ফেলে এসেছি, তা তো মৃত্যুর দখলে চলে গিয়েছে। অতএব, প্রিয় লুসিলিয়াস, যা করছ বলে লিখেছ, ঠিক সেভাবেই জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে জড়িয়ে বাঁচো। তুমি যদি বর্তমান দিনটিকে জাপটে ধরতে পারো, তাহলে প্রতিটি আগামীকালের উপর তোমায় কম নির্ভর করতে হবে। মনে রেখো, জীবনের মুহূর্তগুলোকে যতই ভবিষ্যতের জন্য মুলতুবী রাখতে চাইবে, তারা ততই ঝড়ের বেগে বয়ে যাবে।
দেখো, বাকি আর কিছুই তো আমাদের হাতে নেই, শুধু বরাদ্দ সময়টুকু ছাড়া। প্রকৃতি এমনভাবে আমাদের তৈরি করেছে, যে, শুধুমাত্র একটি উপাদান, যা কিনা সবচাইতে ক্ষণস্থায়ী দ্রুতধাবমান ও পিচ্ছিল, একমাত্র তার উপরেই আমরা নিজেদের অধিকার দাবি করতে পারি – অথচ সে উপাদান এমনই, যা থেকে যে চায় সে-ই যখন-তখন আমাদের বঞ্চিত করতে পারে, অতি সহজেই। আর মানুষের বোকামো এমনই, যে, এই মহামূল্যবান সময় হাতে পেয়েও সে তুচ্ছাতিতুচ্ছ সস্তা উপাদান সংগ্রহের পেছনে অমন দুর্মূল্য বস্তুটি ব্যয় করতে থাকে। খানিকটা সময় যদি উপহার পাওয়া যায়, তার জন্য কেউই কৃতজ্ঞ থাকার কথা ভাবে না। অথচ এ এমনই উপহার, যা কৃতজ্ঞ ব্যক্তির পক্ষেও ফেরত দেওয়া অসম্ভব। তুমি নিশ্চয়ই ভাবছ, এবিষয়ে এত উপদেশ দিতে বসেছে যে মানুষটা – অর্থাৎ আমি – সে ব্যাপারটা কীভাবে সামলাচ্ছে। খুব সৎভাবে বলি, জমাখরচের হিসেবটা আমি ঠিকভাবেই রাখি – যেমনটা একজন খরুচে অথচ সাবধানী লোকের পক্ষে স্বাভাবিক। আমি কখনোই বলব না, যে, আমার সময়ের কোনও বাজে খরচ নেই – আমি শুধু এটুকুই বলব যে, আমি জানি কোথায় কেন ও কীভাবে এই বাজেখরচ হচ্ছে। আমার দারিদ্র্যের কারণটা আমি যে কারও কাছে ব্যাখ্যা করে দিতে পারব। নিজেদের কোনও দোষ ছাড়াই যাদের সম্পদ ও সঞ্চয় তলানিতে এসে ঠেকেছে, আমার অবস্থা তেমনই। এ ব্যাপারে সবাই আমাকে ক্ষমা করে দেয়, কিন্তু কেউই আমায় সাহায্য করতে পারে না। আমার এই অবস্থা নিয়ে কী বলব তাহলে? দরিদ্র? হতদরিদ্র? যতটুকু পড়ে আছে, সেটুকুনিতেই যে সন্তুষ্ট থাকতে পারে, তাকে তো আমি দরিদ্র বলতে পারি না। কিন্তু তোমার উদ্দেশে আমার পরামর্শ – তোমার জীবনের বরাদ্দ সময়, যা তোমার নিজের একান্ত সম্পদ, সেটুকু আগলে রাখো। অল্পবয়সেই কাজটা শুরু করতে চলেছ, এটা সত্যিই ভালো কথা। কেননা, আমাদের পূর্বপুরুষরা যেমন বলতেন – পাত্রের তলানিতে এসে না পৌঁছানো অবধি কারোরই অপচয় বন্ধের কথা মনে পড়ে না – আর এ তো নতুন করে বলার কিছু নেই, যে, তলানিতে শেষমেশ যেটুকু পড়ে থাকে, তা পরিমাণে অপর্যাপ্ত তো বটেই, গুণগত মানের দিক থেকেও খারাপ। ভালো থেকো।
.
সবাইকে আমার তরফে নতুন বছরের শুভেচ্ছা। আর নমস্কার।