[বাংলার দলিত কৃষক আন্দোলনের ইতিহাস অবহেলিত কিন্তু দীর্ঘ। তার সঙ্গে গভীরভাবে সংপৃক্ত দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ, দেশভাগ এবং উদ্বাস্তু সমস্যা। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে এই বিপন্ন প্রান্তিক উদ্বাস্তুদের সাড়ে তিনকোটি জনসংখ্যা (এর মধ্যে তিনকোটি প্রায় নমঃশূদ্র; যার একটি অংশ মতুয়া) যখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে তখন আবার ভাসিয়ে দেওয়া হয় একদিকে সি.এ.এ. নামক কিম্ভূতাকার টোপ, অন্যদিকে নতুন করে বেনাগরিক হওয়ার আশঙ্কা। সেই পরিস্থিতিতে খুবই প্রাসঙ্গিক উক্ত সম্প্রদায়ের একদা অবিসংবাদী নেতা যোগেন্দ্রনাথকে ও সমকালীন ইতিহাস নিয়ে চর্চা।]
কথারম্ভ
‘‘বাংলা ছিল মুসলিম প্রধান ও তপশিলিজন অধ্যুষিত। কংগ্রেসের হিন্দুওয়ালা নেতারা সুভাষচন্দ্রকে কংগ্রেস থেকে তাড়ালেন। মুসলিম লিগের অবাঙালী নেতারা ফজলুল হককে লিগ থেকে তাড়ালেন। ব্রিটিশ যুদ্ধনীতি পূর্ব পরিকল্পনামত সিঙ্গাপুর, মালয়, থাইল্যান্ড ও ব্রহ্মদেশ থেকে পশ্চাদপসরণ করে বাংলাকে যুদ্ধের পূর্ব রণাঙ্গন করে তোলে। ফলে, নিম্নবঙ্গকে ধ্বংস করে দেওয়া হল ও যুদ্ধের রেশন চালাতে বাংলায় ঘটল ৪৩-র দুর্ভিক্ষ। ৪৫-এ ম্যালেরিয়া মহামারী। ১৯৪০ পর্যন্ত ও ১৯৪৫-র পর হিন্দুু-মুসলমান দাঙ্গা ছিল বাংলার নিজস্ব রাজনীতি।
ভারতের অন্য কোন প্রদেশ থেকে বাংলা কোনো প্রকার সাহায্য পায় নি। এমনকি সর্বাধিক সংখ্যক রাজবন্দীদের জন্যও তারা জেলখানায় জায়গা দেয়নি।
এই নতুন সময়ে বাংলার তপশিলি নেতা বরিশালের যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল ছিলেন অবিসংবাদী শূদ্র নেতা। তিনিই প্রথম বলেন, উচ্চবর্ণ হিন্দুদের রক্ষা করা শূদ্রদের কাজ নয় ও মুসলমানদের সাথে শূদ্রদের শ্রেণীগত মিল অনেক বেশি। এই শূদ্র যোগেন মন্ডলই একমাত্র যিনি পাকিস্তানকে তাঁর স্বদেশ বলেছিলেন ও সেই কালবেলায় ভারতবর্ষ-ধ্যানটিকে রক্ষা করেছিলেন।
যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল প্রায় সম্পূর্ণ বিস্মৃত এখন। ১৯৩৭ তেকে ১৯৪৭ অবধি দশটি বছর তিনি ছিলেন বাংলার নমঃশূদ্রদের অবিসংবাদী নেতা। বাংলার ও ভারতের রাজনীতিতে পরে তিনি প্রধানতম বিসংবাদী নেতা হয়ে ওঠেন। ১৯৪৩এ খাজা নাজিমুদ্দিনের প্রাদেশিক মন্ত্রীসভায় তিনি ছিলেন। ৪৬-এ পুননির্বাচিত হয়ে সারওয়ারদির মন্ত্রীসভাতেও। ১৯৪৬-এ তিনি মহম্মদ আলি জিন্না কর্তৃক অন্তবর্তী মন্ত্রীসভায় মুসলিম লিগের প্রতিনিধি মনোনীত হওয়ায় হিন্দু ও মুসলিম দুই জাতেরই শত্রু হয়ে পড়েন। তিনি পাকিস্তানের প্রথম মন্ত্রীসভায় আইনমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৫০-এ কলকাতায় চলে আসেন। আম্বেদকর ও যোগেন মন্ডল তাঁদের শূদ্রতার কারণে কোনো জাতীয়তাবাদেই গৃহীত হন নি। কিন্তু বহু নিন্দার পর কংগ্রেস দলিত-ভোটের জন্য আম্বেদকরকে জাতীয়-আখ্যানের দেবমন্ডলিতে জায়গা করে দেয়। বাংলা বিভক্ত হওয়ায় যোগেন মন্ডল সম্পর্কে তেমন কোনো দায় বা ভয় জাতীয়তাবাদীদের ছিল না। তাঁকে তাই ইতিহাস থেকে স-ম-পূ-র্ণ মুছে দেওয়া হয়েছে। তাঁর নাম এখন কোনো স্থানীয় ইতিহাসের ফুটনোটেও থাকে না।’’—‘বরিশালের যোগেন মন্ডল’, দেবেশ রায়
‘‘…বাংলার নমঃশূদ্রদের এই অবিসংবাদী নেতা এক হৃতসর্বস্ব দলিত পরিবার থেকে শুধুমাত্র নিজের মেধা ও মননে উঠে এসেছিলেন প্রথমে বঙ্গীয় ও পরবর্তীতে জাতীয় রাজনীতির সামনের সারিতে। বরিশালের জল-নদী-খাল-বিল-আকাশ-মাটি যেমন তাঁকে গড়েছিল, তেমনই গড়েছিল তাঁর অস্পৃশ্য সমাজ এবং বর্ণহিন্দুুদের সঙ্গে সেই সমাজের তীব্র ও চিরন্তন অভিঘাত।…
যোগেন উপলব্ধি করেন, মুসলমানের রক্তে হাত রাঙিয়ে বর্ণহিন্দুদের দাঙ্গা থেকে রক্ষা করা কিংবা বর্ণহিন্দুুর হয়ে লাঠি-সড়কি-বল্লম-কুড়ুল—নিয়ে মুসলিম মহল্লায় চড়াও হয়ে অগ্নিসংযোগ, গৃহদাহ, লুঠতরাজ ও হত্যালীলা চালানো কখনও, কিছুতেই বর্ণহিন্দুর অস্পৃশ্য নমঃশূদ্রদের দায় হতে পারে না। বরং বরিশাল, ঢাকা, যশোর, খুলনা, শ্রীহট্ট, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহে গরিব মুসলমানের সঙ্গে সহাবস্থানের অভিজ্ঞতায় নমঃশূদ্ররা দেখেছেন, বর্ণহিন্দুদের সঙ্গে তাঁদের যতটা সামাজিক দূরত্ব, মুসলমানের সাথে ততটাই নৈকট্য। আর এখান থেকে যোগেনের মুসলিম-দলিত ঐক্যের ভাবনা ও তার নিজস্ব তত্ত্ববিশ্বে সেই ধারণার উত্তরণ।…
অস্পৃশ্যতার অভিশাপ এড়াতে প্রতিবাদী আম্বেদকর বৌদ্ধধর্মকে বরণ করেন। যোগেন কিন্তু এই সামাজিক অভিশাপের রাজনৈতিক প্রতিবিধান খুঁজে নেন দলিত-মুসলিম সংহতিতে এবং সে জন্য তাঁকে ধর্মান্তরিত হতে হয় না।
এই মুসলিম সংসর্গ কখনও যোগেন মন্ডলকে নমঃশূদ্র তথা দলিতদের স্বার্থরক্ষার অবিচল ব্রত থেকে সরিয়ে নেয়নি, বরং দলিত স্বার্থের সুরক্ষার তাদিগই তাঁকে মুসলিম লিগের সংসর্গে টেনেছিল। কিন্তু সে জন্য তাঁকে তখনকার বঙ্গদেশে ক্রমশঃ মেরুকৃত ও সংহত হতে থাকা সমগ্র হিন্দু সমাজের নিন্দা ও শাস্তি শিরোধার্য করতে হয়। কায়েদ-এ-আজমের স্বপ্নভ্রষ্ট পাকিস্তানের উত্তরোত্তর সাম্প্রদায়িক বিবর্তনে হতাশ যোগেন কলকাতায় ফিরে এলে আবার অচ্ছুতই হয়ে যান—এবার বিভক্ত, হিন্দু বঙ্গের রাজনীতিকদের কাছেও। শেষ পর্যন্ত অনাদরে, অবহেলায়, গৃহশত্রুতায় দীর্ণ, ক্লিষ্ট যোগেন কোণঠাসা হতে থাকেন। এবং বিস্মৃতও।
সমসাময়িক দলিত নেতাদের চরম বিরোধিতা যোগেনকে সহ্য করতে হয়েছিল। তাঁরা মনে করতেন, আদতে হিন্দু নয় বলেই তাঁরা বর্ণহিন্দুদের কাছে অস্পৃশ্য। হিন্দুুত্বে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ব্যাকুলতা তাঁদের থেকেই যায়। পক্ষান্তরে যোগেন মনে করতেন, হিন্দুুরা যখন তাঁদের লাখেরাজ স্বর্গের কাঁটাতারের বাইরেই অচ্ছ্যুৎদের বার করে দিয়েছে, তখন হিন্দুু হওয়ার জন্য এই কাঙালপনা কেন? ভারতে ঘটে যাওয়া একের-পর-এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বর্ণহিন্দুদের স্বার্থে দলিতদের ব্যবহার করার ঘটনা দেখিয়ে দেয়, যোগেনের উপলব্ধিজাত ধারণা কত অভ্রান্ত ছিল। তাঁর তাত্ত্বিক সূত্র আত্মস্ত করতে পারলে আজকের দলিত রাজনীতি নিছক নির্বাচনী পাটিগণিতের স্বার্থে ব্রাহ্মণ-ঠাকুরদের নিয়ে মায়াবতীর ‘সর্বজনসমাজ’-এর খোয়াব দেখত না, বরং কাঁসিরামের সূত্র অনুযায়ী ‘তিলক-তরাজু ঔর তলোয়ার/ইনকো মারো জুতে চার’, এই শ্লোগানেই স্থিত থাকত।’’—গৌতম রায়, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’।
“Even if India get freedom, what she would do with this iretreavable loss of such a briliant and rare legal brain to politics.
—তদানীন্তন বরিশাল কোর্টের বিশিষ্ট উকিল কুলদারঞ্জন দাসগুপ্ত যোগেন মন্ডলের ওকালতি ছেড়ে রাজনীতিতে যোগদানের পর।
‘‘যোগেন মন্ডল বরিশালের মেগাস্থিনিস।’’
—দুর্গামোহন সেন, সম্পাদক ও প্রকাশক, সেইসময়কার বরিশালের নামী সাপ্তাহিকী ‘বরিশাল হিতৈষী’।
‘‘লীগের তপশিলি প্রতিনিধি মন্ডল হয়েছেন আইনমন্ত্রী। তিনি গ্রামে গ্রামে তপশিলিদের রাজনৈতিক মিটিং করে বেড়ান।’’—সম্রাট ৬ষ্ঠ জর্জকে বড়লাট লর্ড ওয়াভেল ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৭।
‘‘এটাকে আইনের আওতায় বিচার করলে সত্যি করেই প্রধানত সামরিক ও বেসামরিক কর্তৃপক্ষের ক্ষমতার আনুপাতিক ভাগের কথা উঠবে। আমার মনে হয় না, মার্শাল ল জারি করতে আদেশ দেয়া হয়েছিল বা গভর্ণর তা করতে অস্বীকার করায় অনানুগত্য দেখানো হয়েছে। আইনের দিক থেকে ও কমনসেন্সের দিক থেকে এটাকে, এই কঠিন পরিস্থিতিতে, আলোচনার বিষয় হিসাবেই দেখা উচিত। আইনের খাঁচায় নয়।… কলকাতায় যা হয়েছিল। সিভিক অথরিটি ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছিল কিন্তু নির্বাচিত সরকারকে তা জানায়নি। গভর্ণর তাঁর ক্ষমতা ব্যবহার করেন নি। কলকাতা, পাঞ্জাব, নোয়াখালি, বিহার—সর্বত্রই এই সন্দেহ তৈরি না হয়ে পারবে না যে সব পক্ষকেই কর্তৃপক্ষ হিন্দুু-মুসলমান-শিখ-তপশিলি ভাগাভাগি সাব্যস্ত করার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়। তাঁরা যে স্বাধীনতা দিয়েছেন, সেটা দেখাতেও চাইছিলেন।’’
—পাঞ্জাবে ব্যাপক দাঙ্গাহাঙ্গামার পরিপ্রেক্ষিতে অন্তবর্তী সরকারের ক্যাবিনেট মিটিংএ লর্ড মাউন্টব্যাটেনের প্রশ্নের উত্তরে আইনমন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল, জুন ১৯৪৭।
‘‘আমি শিডিউলও না, হরিজনওনা। বামুন যদি জন্মপরিচয়ে বামুন হয়, আমি তা হলে আমার জন্ম পরিচয়ে চাঁড়াল। চাঁড়াল হিন্দু নয়। হিন্দুকে রক্ষা করাও তার দায়িত্ব নয়।’’—যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল বিধানসভার বক্তব্যে।
বরিশাল
একদা চন্দ্রদ্বীপ বরিশাল অশ্বিনী দত্তের দেশ। এতদূরে এত দুর্গম একটি জেলাকে সারা বাংলায় যে প্রাধান্যে তিনি নিয়ে গেলেন, সে বরিশালবাসীর গৌরবকথা। জনসেবা, শিক্ষা, জাতিবৈরিতার অবসান, এক নাগরিক সমাজ তৈরি করে তোলার দরকার ও এক সামাজিক নৈতিকতা, তাঁর কাছ তেকে বরিশালবাসী শিখেছিল ও বরিশালের কাছ থেকে সারা বাংলা শিখতে চাইছিল। দূরত্ব ও দুর্গমতা হয়ত বরিশালকে এমন সমষ্টিবদ্ধ জীবন তৈরি করার পক্ষে দরকারি বিচ্ছিন্নতা দিয়েছিল। বরিশালের বিচ্ছিন্নতা ছিল বরিশালবাসীর একক বৈশিষ্ট্যের চিহ্ন। ও কতকটা উদ্ভট এক স্থানপ্রেমের অনড় অবলম্বন। বরিশালে ছিল সতীন সেনের মত সমাজসেবী এবং জাতীয়তাবাদী ও বিপ্লবী নেতা। বিশিষ্ট সহজিয়া দার্শনিক আরজ আলি মাতব্বরের বাড়ি ছিল বরিশালের লামছরিতে। বরিশাল ‘রূপসী বাংলা’র কবি জীবনানন্দেরও প্রাণভূমি। বরিশালের আরেক গর্ব চারণ কবি মুকুন্দ দাস।
বরিশাল খালবিলের দেশ, পঞ্চাশ পা যেতে হলেও সেখানে একটা খাল পেরতে হয় আর সেইসব খালে ভরা জোয়ারের জল সমুদ্র থেকে কলকলিয়ে বয়ে আসে প্রায় সব বাড়ির পৈঠায় দিনে বার কয়েক। বরিশাল জুড়ে নমঃশূদ্র আর মুসলমান জনগোষ্ঠী ছড়ানো। এখানকার বেশীরভাগ মুসলমান ফরাইজি। বামুন, কায়েত, বৈদ্যরা খুব নামডাক নিয়ে থাকতেন শহরগুলিতে। তাঁদের থাকার গ্রামগুলোও তাঁরা শহুরে করে নিয়েছিলেন। বরিশালের জমিদারির ব্যবস্থাও ছিল আলাদা। একজন মধ্যস্বত্বভোগীর জমি থেকে ধাপে-ধাপে নেমে গেছে উপস্বত্বভোগীরা। জমিদার থেকে উপস্বত্বভোগীরা প্রায় পুরোটাই প্রায় ছিল, উচ্চবর্ণের হিন্দু। মুসলমান আর নমঃশূদ্ররা পুরোটাই প্রায় ছিলেন জমিদারির চাষী। কীর্তিপাশা, রায়েরকাঠি, বাটাজোড়, কোদালধোয়া, গৌরনদী, হিজলা, জলাবাড়ি আরো সব নামডাকের জমিদারি ছিল। ১৯২০ থেকে সরকার ভাঙনের নদীর চরে দখল মেনে নিতে শুরু করেন। সেই চরের দখল নিতে জমিদাররা এই নমশূদ্র আর মুসলমান জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতো। তখন থেকেই এই স্থলদেশে মারামারি-কাটাকাটির জায়গা হয়ে যায়। কিন্তু তাতে হিন্দু-মুসলমান ভাগাভাগি ছিল না। জমিদাররা নিজ স্বার্থে মামলা-মোকদ্দমা-অশান্তি লাগিয়ে রাখত। জমির দখল নিয়ে ‘নমঃ’ ও ‘শ্যাখ’ বা ‘মেয়াদের’ মধ্যে কাজিয়া-বিবাদ লাঠালাঠি-খুনোখুনি হলেও কোন অসদ্ভাব ছিল না। তারা এক সাথেই বসবাস, কৃষিকাজ, মাছধরা, নৌকো বাওয়া প্রভৃতি কাজ করে যেত। একসাথে চলত আনন্দ অনুষ্ঠান।
বরিশালের এক জলময় পশ্চাদভূমির সঙ্গে বরিশাল শহরের সম্পর্ক ছিল একেবারে আষ্টেপৃষ্টে। পুবে আড়িয়াল খাঁ, পশ্চিম কীর্তনখোলা নদী। দুটো জুড়ে দেওয়া মাঝারি এক নদী। সদরে বাংলা খ্যাত ব্রজমোহন কলেজ, হাইস্কুল, ব্রাহ্মসমাজ, স্বদেশী আন্দোলন, পত্রপত্রিকা, কংগ্রেস ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল, কলকাতার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ। মিটিং, মিছিল। ১৯০৬-র আলোড়নকারী প্রাদেশিক সম্মেলন। তারপর ১৯২১এ আবার প্রাদেশিক সম্মেলন।
নদী বন্দর গুলি দিয়ে চাঁদপুর, ঢাকা, চিটাগাঙ, খুলনা বাংলার সর্বত্র স্টীমার সার্ভিস, খুলনা থেকে শিয়ালদা ট্রেন। বরিশালের বিখ্যাত বালাম চাল, নারকেল, সুপারি, ইলিশ, চিংড়ি ও অন্যান্য মাছ, ফলফলাদি। উপছে পড়া আরো কত ধরনের মাছ নদী, খাল, বিল, পুকুরে। কত ধরনের মাছ ধরার জাল, কত ধরনের নৌকো। লঞ্চ, স্টিমার, জাহাজ। অসংখ্য নদী। ছোটো বড়ো। নিজস্ব কথ্য ভাষা, রস-রসিকতা, আচার-সংস্কৃতি, পার্বন উৎসব। পুষুড়্যা বা পৌষ-পার্বন ছিল প্রধান উৎসব। চিতৈ পিঠা, সরা পিঠা, চুষি, পুলি, পাটিসাপটা প্রভৃতি চালের গুঁড়ো, নারকেল, দুধ, খেজুর গুড়ের তৈরি পিঠে-পুলি ছিল প্রধান আকর্ষণ। ছিপ, ট্যবইরা, গোলা নৌকো, পাটের নৌকো, ঘাসের নৌকা, পানসি, কাথানি, তালের ডিঙি, ডিঙি, সুপারিগাছের নৌকো, কাডামি, বাছারি থেকে গহনার বড় নৌকো। নৌকার উত্তেজক বাইচ প্রতিযোগিতা হত। কীর্তন প্রভৃতি ছাড়াও মাঝিদের ভাটিয়ালি, মনসামঙ্গল অবলম্বনে রয়ানি, ধান পোঁতার সারিগান, বিয়ের গান, মুর্শিদি, মারফতি, ধান ভানার গান, বাওয়ালি গান, জারি গান প্রভৃতি ছিল জনপ্রিয়। বিশেষ করে কবিগান আর যাত্রা। বিজয় সরকার, রাজেন সরকার প্রমুখরা ছিলেন বড় কবিয়াল। মৃৎশিল্প, তৈজস ও আসবাব নির্মাণ, কাঁসা, পিতল শিল্প, নকশিকাঁথা, লবণ শিল্প, ছোবড়া শিল্প, চাঁচ শিল্প, পাটি শিল্প, শোলা শিল্প, হোগলা শিল্প প্রভৃতি ছিল লোকশিল্প।
ছপছপানো জলে বিছন ছিটনো ধান হত সারা বছর। ছিটান শালি, গুড়জালি, পুঁটি ধান, খৈশিষ, হাওরের আগুরি, চলনবালাম, কাটারি কত ধানের নাম। সেই পাহাড়তলির সোলা নাইয়ের ঝিল থেকে, পশ্চিমের দিকের উত্তরে পাবনা-রাজশাহি জোড়া চলন বিল থেকে, সিলেটের বাওর বিল থেকে ঢাকা, ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা, যশোরের বিস্তৃত বিলাঞ্চলে এদের চাষ। পদ্মা, যমুনা, মেঘনা, আয়েত্রী, করতোয়া, ধলেশ্বরী, কীর্তনখোলা, ভৈরব, মধুমতী, বেহুলা, বংশী, লৌহজং, তেঁতুলিয়া, মলঙ্গী, কুমার, আড়িয়াল খাঁ, লোহালিয়া, পাঙাসিয়া, রাজগঞ্জ, কর্ণফুলি, ফেনি, তিতাস, সন্ধ্যা, বলেশ্বর নিয়ে এই বিস্তৃত পূর্ববঙ্গের নদীময় বিভাগ। বোহালিয়া, গলাচিপা, বারনাবাদ, কচা, কালিগঙ্গা, বিনাদপুর, বিষখালি বিধৌত জলময় বাংলার শেষ বদ্বীপ অঞ্চল বরিশাল।
বরিশালের লোকবাদ্য ছিল ঢোল, খোল, করতাল, দোতারা, জলতরঙ্গ, কলম তরঙ্গ, বাঁশের বাঁশি, শঙ্খ, শিঙা, খঞ্জনি, সারিন্দা। ডঙ্কা, কাঁসর, একতারা। লোক উৎসবের মধ্যে বিয়ে, মেলা, বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছিল। কৃষিকাজ ছাড়াও লোকপেশাগুলি ছিল : ওঝা, কলু, চুনারি, করাতি, কুমার বা কুম্ভকার, কামার বা কর্মকার, চামার/চর্মকার/ঋষি/মুচি, গাছি। গুনিন বা গণক, ঘরামি, ধোপা, জিয়ানি। ধুনকর, নলুয়া, নইক্দা, নাপিত, নৈচাবান্দ, পাটিয়াল। বাওয়ালি, বেদে, ময়রা, মাঝি, মিস্ত্রি প্রভৃতি। মাছ ধরা ছিল বাচ্চা বৃদ্ধ নারীদের এক সহযোগী পেশা। নদী, খাল, বিলে সম্বৎসর মাছ ধরা চলত। মাছ ছিল এক সহজলভ্য সুস্বাদু খাদ্যপ্রাণের যোগান। বহু রকম মাছ পাওয়া যেত। ভেটকি, ভোলা, আড়, বোয়াল, চিতল, পাঙাস, কাতলা, রুই, মৃগেল, কালবাউস, কই, মাগুর, শোল, ট্যাংরা, পাবদা, পুঁটি, সরপুঁটি, খলসে, মৌরালা, ফ্যসা… নানারকম চিংড়ি। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের কচ্ছপ, কাঁকড়া ও পাখি, পাঠা-খাসি-মুরগি রান্না হত অনুষ্ঠানে। আবার তাদের ধরার জন্য বহুরকম জাল ও সরঞ্জাম ছিল যেমন ছিপ, ঝাঁকি জাল, ধর্মজাল, মৈয়াজাল, খরা বা চাপা জাল, কৈয়া জাল, বেড়জাল, ইলশা জাল, বোডাজাল, পলো, চাঁই, খুচইন, কোঁচ, ওচা, ছাপি। নেশা বা মদ্যপ্রাণের প্রচলন ছিল না। কৃষক মাঝিরা হুকোয় অনেকে তামাক খেতো, কেউ কেউ বিড়ি, বাবুদের কেউ কেউ সিগারেট। হিন্দুুদের মধ্যে বহুবিবাহ প্রচলিত ছিল না। পুরুষদের মধ্যে স্ত্রীবিয়োগের পর কেউ কেউ দ্বিতীয় দার পরিগ্রহ করতেন। ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলনের পর বিধবা বিবাহের প্রচলন হয়। পিরোজপুরের নমঃশূদ্র সমাজসেবী অগ্নি মণ্ডল একাই দু হাজারের বেশি বিধবা বিবাহ দেন। তবে বাল্য বিবাহের সমস্যা ছিল। আমন, আউস ও বোরোধান হত অন্তত ১০০, ২২ ও ১০ রকমের। না লাগত জলসেচ, না সার, না কীটনাশক। আমন পাকত অগ্রায়ণে, আউস আষাঢ়ে, বোরো ফাগুনে। নদী বোট ও স্টীমারগুলিতে গরম ভাত আর ফাউল কারি এবং বরিশাল শহরের হোটেলগুলিতে ইলিশ রান্নার স্বাদ ছিল জগদ্বিখ্যাত।
বর্তমান বাংলাদেশের বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, পটুয়াখালি, ভোলা—ছয়টি জেলা নিয়ে নদীমাতৃক বরিশাল ডিভিশন অবিভক্ত বঙ্গে বরিশাল বা বাখরগঞ্জ নামে অবিভক্ত ছিল। জেলার দক্ষিণ পূর্ব দিকে মেঘনা, তেঁতুলিয়া, খয়রাবাদ, শাহবাজপুর, আগুনমুখী প্রমুখ বৃহদাকার নদীগুলি অসংখ্য ছোট বড় বদ্বীপ সৃষ্টি করে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে তেমনি দক্ষিণপশ্চিমে বিষখালি, পায়রা, মঠবেড়িয়া, হরিণঘাটা প্রভৃতি নদীও তৈরি করেছে অসংখ্য ছোট ছোট বদ্বীপ। এখানকার কুয়াকাটার সমুদ্রসৈকত এখন বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র। খুলনার দক্ষিণ অংশ ও বরিশালের দক্ষিণের কিছু অংশ নিয়ে সুন্দরবন। গভীর জৈববৈচিত্র্যপূর্ণ অরণ্য। এক সময় এবং এখনও কাঠ, মধু, মাছ প্রভৃতি সংগ্রহ করে বহু মানুষ জীবিকা অর্জন করেন।
নমঃশূদ্র
মাহিষ্য, নমঃশূদ্র ও রাজবংশী এই তিনজাত মিলে মোট বাঙালির প্রায় তিনভাগের একভাগ। ১৯১১-র সুমারিতে বাংলায় নমঃশূদ্রের সংখ্যা গোনা হয়েছিল প্রায় ২১ লক্ষ। এর মধ্যে আট লাখেরই বাসভূমি ছিল বাখরগঞ্জ, দক্ষিণ ফরিদপুর, নড়াইল, মাগুরা, খুলনা, বাগেরহাট মিলিয়ে যে ডাঙা সেখানে। নমঃশূদ্রদের যারা নেতা ছিলেন তারা যদি বা ১৯২০-’২৫ সালে জনগোষ্ঠীভিত্তিক নানারকম আন্দোলন করেছেন। সেসব আন্দোলন বেশীরভাগটাই ছিল হিন্দু বর্ণসমাজে নমঃশূদ্রদের জায়গা ওপরের দিকে তোলার চেষ্টা। ’৩০ সাল নাগাদ সেই নেতারা কৃষক নমঃশূদ্রদের নিয়ে মাথা ঘামাননি। তখন কাউন্সিল, লোকাল বোর্ড আর ডিস্ট্রিক বোর্ডে ঢোকার হাওয়া। নমঃশূদ্রদের নেতাদের অনেকেই কংগ্রেসেরও নেতা হয়ে গেছিলেন—কেশবচন্দ্র দাস, মোহিনী মোহন দাস। কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ নেতা বিশিষ্ট উকিল মৌলবি ফজলুল হক, তিনি বরিশালের চাখারের বাসিন্দা, কৃষক প্রজা পার্টি তৈরি করে মুসলমান রাজনীতির এই ফাঁকটি ভরাট করলেন। মুসলিম লিগ ছিল মুসলমান নবাব-জমিদার-ব্যবসায়ীদের এবং কংগ্রেস ছিল বর্ণহিন্দু রাজা-জমিদার-ব্যবসায়ীদের দল। এমনকি অশ্বিনীকুমারের ‘স্বদেশবান্ধব সমিতি’র অর্ধেক নেতাই ছিলেন জমিদার।
নমঃশূদ্র নেতারা বর্ণাশ্রম ও শূদ্র দাসত্ব নিয়ে সেভাবে ভাবেন নি। ১৯৩৫-র ‘ভারত শাসন আইন’ অনুযায়ী প্রাদেশিক আইনসভা গঠন এবং ‘কমিউনাল এওয়ার্ড’ মেনে মুসলমান, শিখ, তপশিলি, ইউরোপীয়ান, অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান প্রমুখদের জন্য আসন সংরক্ষিত রেখে ১৯৩৭এ প্রায় সার্বজনীন ভোটাধিকার নিয়ে যে ভোট হল—সেটাকে উপলক্ষ করে বরিশালে নমঃশূদ্রদের নতুন নেতৃত্ব তৈরি হয়ে গেল নিজে থেকেই। সেই নেতৃত্বের প্রধান ও প্রথম ব্যক্তি—যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল, বি.এ., বি.এল.। যিনি কলকাতা থেকে ওকালতি পাশ করে উচ্চবর্ণ হিন্দুুদের নিয়ন্ত্রণে খানদানি বরিশাল বারে ঢুকে বছর খানেকেরই মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা জিতে এবং স্বকীয় আইনসঙ্গত দক্ষ সওয়াল করে নামযশ করে ফেলেছেন, আবার আইনসভার প্রার্থীও হয়ে গেছেন। ইতিমধ্যে তিনি অবশ্য ইউনিয়ন ও ডিস্ট্রিক বোর্ডের মেম্বার। আবার দাঁড়িয়েছেন তপশিলি সংরক্ষিত নয় সাধারণ আসনে। বিপক্ষে দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রার্থী বাটাজোড়ের জমিদার, অশ্বিনী দত্তের ভাইপো এবং কংগ্রেস জেলাসভাপতি সরল কুমার দত্ত। নমঃশূদ্র ও মুসলমানদের এবং সমর্থনকারী উচ্চবর্ণের একাংশের ভোটে পরিশ্রমী ও কাজের মানুষ যোগেন্দ্রনাথ অসাধ্য সাধন করলেন। সারা ভারতে তিনিই একমাত্র তপশিলি প্রার্থী যিনি সাধারণ আসনে জিতে বাংলার প্রাদেশিক আইনসভায় গেলেন। স্বতন্ত্র তপশিলি হিসাবে। এছাড়াও তাঁর ভোটারদের মধ্যে ছিল বাগরি, ধনন্তরী, কৈবর্ত, জোলা, ধোপা, মালো, দুলে, যুগি প্রমুখ নিম্নবর্গীয় ও পশ্চাদবর্তী জাতগুলি। জেতার পর বরিশাল শহর সহ বরিশাল জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে যোগেন্দ্রনাথ বিপুল অভ্যর্থনা পান। রব ওঠে : ‘‘জয় যোগেন মন্ডল জয়।’’ এর আগে ১৯২৫এ অগৈলঝরাতে বিশিষ্ট সমাজসেবী ও শিক্ষাব্রতী ভেগাই হালদারের নেতৃত্বে কংগ্রেসের যে প্রজা সম্মিলনী হয় তাতে যোগেন্দ্রনাথ ছিলেন স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান এবং তিনি বিদায়ী বক্তব্য রেখেছিলেন।
ক্ষমতা মানে হিন্দুু উচ্চবর্ণের, বিশেষত ব্রাহ্মণের, ক্ষমতা। তাই ক্ষমতাবান হওয়ার একটাই অর্থ—হিন্দু হওয়া, উচ্চবর্ণ হওয়া ও ব্রাহ্মণ হওয়া। নিজেদের ব্রাহ্মণত্ব প্রতিষ্ঠাই তো নমঃশূদ্রদের মননচর্চার প্রধান বিষয়। সেই বিষয় নিয়েই প্রমাণপঞ্জি তৈরি করা হয়েছে। বল্লাল সেনের ব্রাহ্মণবাদ যে ব্রাহ্মণরা মেনে নেননি, তারা নিজেদের পরিচয় দিয়েছিল—আমরা নমঃব্রাহ্মণ না আমরা নমঃশূদ্র। তারপর তারা জলময় বাংলার জলে আত্মগোপন করলেন। ইতিহাসের এমন ব্যাখ্যার আরও কত সংস্করণ হয়েছে। সমস্ত সংস্করণের উদ্দেশ্য একটা কথাই প্রমাণ করা—নমশূদ্ররা শূদ্র নয়। নমশূদ্ররা বৌদ্ধ ব্রাহ্মণ—বল্লাল সেন কনৌজি ব্রাহ্মণদের পরামর্শে তাদের পতিত বলে শূদ্র করে দেন। নমঃশূদ্ররা চণ্ডাল নয়—কারণ চণ্ডালদের মত তারা গ্রামের বাইরে বাস করে না, চণ্ডালদের মত তারা ভাঙা মালসায় ভাত খায় না। খাওয়ার সময় জলপান চণ্ডালদের পক্ষে নিষিদ্ধ, নমঃশূদ্রদের পক্ষে নয়। নমঃশূদ্ররা চণ্ডালদের মত কেবল মরা মানুষের কাপড়চোপড়ই পরে না, কালো লোহার বালাও পরে না। নমঃশূদ্ররা অবৈদিক ব্রাহ্মণ, তাই নমঃশূদ্রদের উপবীত ধারণ। এই আত্মপরিচয় তো উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে ১৯৩৭-’৪৭এ নমঃশূদ্রদের অবিসংবাদী নেতা হিসাবে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের উত্থানের আগে, সমসময়ে ও পরে হয়ে এসেছে। হরিচাঁদ, গুরুচাঁদ, তারকচন্দ্র, গোপাল সাধু, হরিবর, মহানন্দ—এরা নমঃশূদ্রদের আধ্যাত্মিক আভিজাত্য রক্ষা করে এসেছেন, ‘মতুয়া ধর্ম’ প্রবর্তন করেছেন। আর এঁদের দেখে ও এঁদের ক্ষমতা-সংজ্ঞার সীমার মধ্যে, কুমুদবিহারী মল্লিক, শশিভূষণ ঠাকুর, রাধামোহন মন্ডল, ভগবতী ঠাকুর, প্রমথরঞ্জন ঠাকুর, মহানন্দ হালদার, মুকুন্দ মল্লিক ও আরো অনেকে উচ্চশিক্ষার শেষে বিদেশে গিয়ে ডিগ্রি এনে নিজেদের হিন্দুু উচ্চবর্ণের সমতুল্য করে তোলার চেষ্টা করেন।
আবার অগৈলঝরার মহাত্মা ভেগাই হালদারের মত নমঃশূদ্র জাগরণের প্রাণপুরুষরা ছিলেন। ভেগাই হালদার ছিলেন প্রায় নিরক্ষর। ভারতের সব তীর্থ ঘুরে এসে, নিজের বাড়িঘর পরিবার থাকা সত্ত্বেও অগৈলঝরার হাটের ওপর একটি খড়ের ঘর বানিয়ে থাকতেন। তিনি ছিলেন অশ্বিনীকুমারের একান্ত সহচর। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে বরিশালের নমঃশূদ্রদের তিনি সমাবেশিত করেন। ১৯০৬র অগৈলঝরাতে প্রজা সম্মেলনের ছিলেন প্রধান কর্মী এবং ১৯২৫-র অগৈলঝরাতে প্রজা সম্মেলনের প্রধান সংগঠক যেখানে মদনমোহন মালব্য, সরলা দেবী প্রমুখেরা যোগ দিয়েছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখরা তাকে গুরুত্ব দিতেন। স্বজাতীয় ও সহজাতীয়দের শিক্ষা বিস্তারে তিনি ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরে একটি প্রাইমারি ও একটি হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।
নমঃশূদ্রদের সেই সময় প্রতিষ্ঠিত নেতারা ছিলেন : যশোর পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান, কংগ্রেস নেতা ও এম.এল.এ. এবং পুণে প্যাক্টে স্বাক্ষরকারী রসিককৃষ্ণ বিশ্বাস; লন্ডনে গোল টেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারী ও পুণে প্যাক্টে স্বাক্ষরকারী বিরাট মণ্ডল; যজ্ঞেশ্বর মণ্ডল, রাইচরণ বিশ্বাস, ডাঃ মোহিনী মোহন দাস, জগৎ মন্ডল প্রমুখ। বনমালি দাস প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ‘নমঃশূদ্র শিক্ষা সমিতি’ এবং কলকাতায় নমঃশূদ্র ছাত্রছাত্রীদের জন্য ‘বাণীভবন’ মেস বাড়ি গঠন করেন।
গ্রামে নমঃশূদ্রদের পোশাক ছিল আট হাতি কোঁড়া ধুতি, লাল পাড়। সারা দিন ক্ষেতখামার, বিল হাওর, নদীনালায় কায়িক পরিশ্রম করে সন্ধ্যায় কীর্তন বা নামগান ছিল পরিচিত। মাঝে মাঝে বাতাসার হরির লুঠি বা গাজিবাবার সিন্নি বিতরণ।
তাদের বেশীরভাগেরই জমি না থাকলেও বা অল্প জমি থাকলেও উর্বর জমি, জল ভরা মাছ, গাছ ভরা ফল প্রভৃতি কারণে খাওয়াদাওয়ার অভাব ছিল না।
নমঃশূদ্ররা ছিল প্রধানত কৃষক এক গোষ্ঠী। পদ্মা-যমুনা-মেঘনার বদ্বীপ অঞ্চলে তারা কিভাবে এল তা নিয়ে নানা মত আছে। কেউ বলেন ১৭৬৯-’৭৫-র ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে বীরভূম, বর্ধমান, নদীয়া অঞ্চল থেকে খাদ্যের সন্ধানে এরা আসেন। আর এখানকার বিলগুলির উৎপত্তি সম্ভবত ১৭৭৮-র দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে বিধ্বংসী বন্যার ফল। সেই থেকেই তৈরি হয় নিচা ও উঁচা ভৈরবের বিল, বাগিয়া বিল, মাতলা বিল, কুমারের বিল, দুর্গাদহের বিল। শিব-আত্রাইয়ের বিল, চলন বিল, গোদাই বিল প্রমুখ।
হিন্দুু-মুসলমানের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐক্য উচ্চবর্ণের বানানো—মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে। ১৯২২এ বাথাডাঙ্গা হাটে কংগ্রেসি-খিলাফতিদের সাথে বয়কটবিরোধী শূদ্দুরদের লড়াই হয়েছিল। ১৯২৩-’২৬ হয়েছিল পদ্মবিলে নমশূদ্র-মুসলমান যুদ্ধ। অনেকে বলেন মুসলমানরা ধর্মান্তরিত শূদ্র। তবে এটি ঘটনা যে জমিজিরেত নিয়ে মাঝে মাঝে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ হলেও মুসলমান-নমঃশূদ্রদের মিলমিশই ছিল বেশী। উভয়েই ছিল গরীব কৃষক। একসাথে থাকা, খাওয়া, কাজ করা। বিপদ-আপদ- আনন্দ-উৎসব এক সাথে ভাগ করে নেওয়া। উভয় সম্প্রদায়ের মহিলারাও ছিলেন কর্মঠ, দক্ষ এবং অনেকাংশে স্বাধীন। খোলসচন্দ্র প্রমুখের লেখায় পাওয়া যায় বরিশালে উনিশ শতকের মাঝামাঝি অবধি যবনী (মুসলমান নারী) ও শূদ্রাণী খেয়ামাঝি ছিল।
১৯২১-র গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনে নমঃশূদ্ররা ছিল বিপক্ষে। ততদিনে নমশূদ্রদের মধ্যে বহুদিন কাজ করা খ্রীস্টান মিশনারিদের প্রভাবে অনেকেই শিক্ষিত। আবার ধর্মান্তর রুখতে নমঃশূদ্রদের মধ্যে ভক্তিবাদী মতুয়া ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গুরু গুরুচাঁদ নমঃশূদ্র সমাজের একাংশের মধ্যে ধর্মীয় নেতা ও গুরুর মান্যতা পেয়েছেন। সৎ চাষি থেকে সদগোপ, নবশাখের মত ‘চণ্ডাল’ থেকে ‘নমঃশূদ্র’ শব্দবন্ধে উত্তরণ হয়েছে। এতে একদিকে জনগোষ্ঠীকে আশ্বস্ত করা হয়েছে, পাশাপাশি মনুস্মৃতির অন্তর্গত বর্ণভেদ প্রথাকেও বজায় রাখা হয়েছে। গুরুচাঁদ বলেছিলেন অসহযোগে ভদ্দরলোকদের কি আসে যায়। এক ভাই উকিল, এক ভাই মাস্টার, এক ভাইয়ের ব্যবসা। উকিল গেল অসহযোগ করে জেলখানায়, মাস্টার নিল সংসারের দায় আর ব্যবসায়ী খদ্দর বেঁচে লাভ করল। এগুলো তাদের সাজে। নমঃশূদ্ররা চাষ ছেড়ে অসহযোগে গেলে, তার সে বছরের চাষ তো গয়া-গঙ্গা। নীরদ মল্লিক কাউন্সিলে বিরোধিতা করলেন। বাখরগঞ্জে কংগ্রেসের ডাকা হরতাল নমঃশূদ্র বাজারিরা ভেঙ্গে দিল। পটুয়াখালিতে পুলিশ-নমঃশূদ্ররা মিলে ভাঙ্গার চেষ্টা করল। উত্তর কলকাতায় স্বদেশী মিছিলে ধাঁঙর, ডোম, মেথররা ঢিল ছুঁড়ল। পিরোজপুরে প্রিন্স অফ ওয়েলসের আগমন উৎসব নমঃশূদ্ররাই ভরিয়ে দিল। ১৯২২এ গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন তুলে নেবার পর শুরু হল নানা আকারের নমঃশূদ্র সম্মেলন। দাবি উঠল জমির খাজনার হারের এবং জমির মালিকানার বদল চাই। ভীষ্মদেব মন্ডল কাউন্সিলে নমঃশূদ্রদের শিক্ষা ও চাকরির দাবি তুললেন। আবার নমশূদ্রদের রাজনীতির ভাগাভাগিও শুরু হল। বয়কটের পক্ষে-বিপক্ষে, বিধবা বিবাহের পক্ষে-বিপক্ষে।
উচ্চবর্ণের কাছ থেকে পাওয়া শান্তিহীন অপমান সত্ত্বেও নমঃশূদ্র সমাজের অনেক প্রধান ব্যক্তি উচ্চশিক্ষিত হয়ে বামুন-কায়েত সাজার চেষ্টা করলেন। মল্লিক ভাইরা ব্রিটিশ স্থাপিত কাউন্সিল ও হিন্দুত্ববাদী কংগ্রেসী রাজনীতির ক্ষমতার অলিন্দ বিচরণ করলেন। গুরুচাঁদ ঠাকুরের পৌত্র পি. আর. ঠাকুর বিলেত থেকে ব্যরিস্টারি পড়ে এসেও উপবীত ধারণ করে পারিবারিক ধর্মীয় বাণিজ্য-সাম্রাজ্যের শ্রীবৃদ্ধি করলেন। গড়ে তুললেন মতুয়া মিশন। সেখানে দৈব চিকিৎসা, এমনকি মহাজনি ব্যবসা শুরু হল। পাশাপাশি রাজনীতির প্রাঙ্গণটিও দখল রাখলেন কংগ্রেসের বিধায়ক হয়ে। দেড়শ দুশো বছর আগে নাকি নমশূদ্ররা জেলখানার মেথরের কাজ করত। পরে বিহার থেকে আসা মেথররা এই বৃত্তিটা নেয়। সেই নমশূদ্ররা ধাঁঙরের ছোঁয়া খায় না, ধাঁঙররা আবার চামারের ছোঁয়া খায় না।
যোগেন্দ্রনাথ
১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে অবিভক্ত বাংলার বরিশাল জেলার গৌরনদী থানার মৈস্তারকান্দি গ্রামে এক দরিদ্র নমঃশূদ্র যৌথ পরিবারে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের জন্ম। তাঁরা ছিলেন তিন ভাই, দুই বোন। যোগেন্দ্রনাথের বাবার নাম রামদয়াল মন্ডল। পারিবারিক পেশা ছিল নৌকার মিস্ত্রির কাজ। এ ছাড়াও বিল অঞ্চলে অল্প কিছু জমিতে ভাগ চাষ। তাঁদের অভাবী পরিবারের সকলের কায়িক শ্রমে কায়ক্লেশে কোনরকম সংসার চলত। অল্পবয়সে যোগেন্দ্রনাথ মাতৃহারা হন। বড় কাকিমার কাছে মানুষ। তাঁর আগে তাঁদের পরিবারে কেউ সেভাবে পড়াশুনার সুযোগ পান নি। প্রবল দারিদ্র ও প্রতিবন্ধকতার মধ্যে অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র যোগেন্দ্রনাথ স্থানীয় জলিল মাস্টারের পাঠশালা হয়ে অগৈলঝরা প্রাথমিক স্কুল থেকে ক্লাস টু অবধি পরে তারপর বারথি তারা বিদ্যালয় থেকে গণিত ও সংস্কৃতে লেটার নিয়ে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। তারপর বরিশাল শহরের বিএম কলেজ থেকে আই.এ. এবং কলকাতার ল কলেজ থেকে বি.এ. ও বি.এল. পাশ করেন। পড়া ও থাকা-খাওয়ার খরচ জোগাতে তাঁকে তাঁদের স্থানীয় কিন্তু সারা দেশে প্রচলিত চাঁদসি ক্ষত চিকিৎসা, গৃহশিক্ষকতা, প্রুফ দেখা, শিয়ালদা কোর্টে দরখাস্ত লেখা বহু ধরনের কাজ করতে হয়। স্কুলে থাকার সময়েই অশ্বিনীকুমার দত্তের বক্তব্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমাজ সেবার কাজ শুরু করেন এবং ‘লিট্ল ব্রাদার্স অফ দি পুওর’ সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে ১৯১৯-র বরিশালের সাইক্লোনে দক্ষিণে পটুয়াখালির দশমিনা, গলাচিপা অঞ্চলে ত্রাণ কার্য চালান। বারথি তারা স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে যোগেন্দ্রনাথের পড়াশুনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে। নতুবা সমস্ত উচ্চবর্ণের ছাত্রের মধ্যে একটি ‘চাঁড়াল’ ছাত্রের টিকে থাকা সম্ভব হত না। কলকাতায় বি.এ. ও বি.এল. পড়ার সময় যোগেন্দ্রনাথ থাকলেন তাঁর স্বজাতীয় বিশিষ্ট চাঁদসি চিকিৎসক ডাঃ প্যারীমোহন সরকারের কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের বাড়িতে। ডাঃ সরকারের দুইপুত্র পরিমল ও সুবিমলকে পড়াতেন। এম.এল.এ. নির্বাচিত হওয়ার পরও ডাঃ দাসের বাড়িতে থাকতেন। তাঁদের আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। পরিমল ও সুবিমল তাঁদের মামা যোগেন্দ্রনাথের আপ্ত সহায়কের কাজ করত। বরিশাল কোর্টে ওকালতির সময় এবং পরবর্তীতে বরিশাল গেলে যোগেন্দ্রনাথ মোক্তারবন্ধু প্রহ্লাদ দত্তের বাড়ি থাকতেন। বি.এম. কলেজে পড়ার সময় হস্টেলে থাকতেন এবং শূদ্র ছাত্রদের সরস্বতী পুজো করার অধিকার নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। যোগেন্দ্রনাথ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করতেন। তিনি উকিল, বক্তা ও বিধায়ক হিসাবে সুনাম অর্জন করেন। শোনা যায় তিনি প্রবল রসিক ছিলেন এবং ভালো পালাগান করতেন।
সততা, নিষ্ঠা, সংগ্রামী জীবন, পরোপকার, সমাজসেবা, তীক্ষ্ম মেধা ও স্মৃতিশক্তি, গভীর পাণ্ডিত্য, আইনি বুদ্ধি, চমৎকার সওয়াল-জবাব, নিজে স্বতন্ত্র তপশিলি বিধায়ক হলেও সমস্ত রাজনীতিকের সাথে সুসম্পর্ক ছিল। অশ্বিনী দত্ত, ভেগাই হালদার থেকে ফজলুল হক, মহম্মদ আলি জিন্না অনেকের সান্নিধ্যে এসেছিলেন। কিন্তু সবচাইতে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল শরৎচন্দ্র ও সুভাষচন্দ্র বসুর সাথে। শরৎ বোসের উৎসাহে যোগেন্দ্রনাথ রাজনীতির পাশাপাশি হাইকোর্টে ল প্র্যাকটিশ শুরু করেছিলেন।
যোগেন্দ্রনাথ সাধারণ ধুতি পাঞ্জাবি পরতেন। সরল জীবনযাপন করতেন। তাঁর স্ত্রী কমলা ও একমাত্র পুত্র জগদীশ দেশে শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন। তপশিলি ও নমঃশূদ্রদের এগিয়ে নিয়ে চলা ছিল তাঁর একমাত্র ধ্যান জ্ঞান।
যোগেন্দ্রনাথের রাজনীতি
১৯৩৭-র নির্বাচনের পরপরই বাংলার দাপুটে নেতা এবং সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক, যিনি পটুয়াখালি কেন্দ্রে হেভিওয়েট মুসলিম লিগ প্রার্থী খাজা নাজিমুদ্দিনকে পর্যুদস্ত করেন, যোগেন্দ্রনাথকে আহ্বান জানান তপশিলি ব্লক করে ফজলুল হকের প্রজাপার্টির সরকারকে সমর্থন করতে। ফজলুল হক যোগেন্দ্রনাথের চাইতে অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন, যোগেন্দ্রনাথকে খুব পছন্দ করতেন এবং তাদের সুসম্পর্ক অটুট ছিল। হক সাহেবের প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রেখেও যোগেন্দ্রনাথ ক্ষমতায় টিকে থাকার তাদের অনীতিনিষ্ট ও ক্রমপরিবর্তনশীল অবস্থান সমর্থন করেননি এবং প্রস্তাব পেয়েও মন্ত্রীত্বে যোগ দেননি।
জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ ও কৃষকদের ঋণ মকুবের মত জনপ্রিয় দাবিতে একচ্ছত্র মুসলমান ভোট পেয়ে ফজলুল হকের কৃষক প্রজাপার্টি মুসলিম লিগকে হারিয়ে দেয়। কংগ্রেস-প্রজাপার্টি সরকার অনায়াসে বাংলায় প্রাদেশিক সরকার গড়তে পারত। কিন্তু সংযুক্তপ্রদেশকে প্রাধান্য দিয়ে নেহরুর নেতৃত্বে কংগ্রেস হাইকমান্ড যৌথ মন্ত্রীসভার প্রস্তাব বাতিল করেন। তখন প্রদেশ কংগ্রেস নেতা শরৎ বসুর উদ্যোগে প্রজাপার্টির সরকারকে সমর্থন প্রস্তাবও প্রদেশ কংগ্রেস নেতা নলিনী সরকার, বিধান রায়, তুলসী গোস্বামী, কিরণশঙ্কর রায় প্রমুখ হিন্দুত্ববাদী কংগ্রেস নেতারা ভেস্তে দেন।
গান্ধীজি স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে, জাতিভেদ প্রথা অবসানের জন্য কোন আমরণ অনশন করেননি। কিন্তু দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে ব্রিটিশ সরকার যখন তপশিলিদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা ঘোষণা করলেন তখন এর বিরুদ্ধে গান্ধীজি আমরণ অনশন শুরু করে দেশজুড়ে এক সঙ্কট তৈরি করলেন। তখন কিছুটা বাধ্য হয়ে আম্বেদকর একটি মাঝামাঝি সমঝোতায় গেলেন। সই হল পুণে প্যাক্ট (১৯৩২)। এর ফলে আলাদা তপশিলি সংরক্ষিত আসন হল, কিন্তু নির্বাচনকারীরা থাকলেন শুধু তপশিলিরা নয় সকলেই। আসনসংখ্যাও কমল।
১৯৩৭এ বাংলায় প্রাদেশিক নির্বাচনে ৩২ জন তপশিলি প্রার্থী বিধায়ক হন এবং তার মধ্যে ১৩ জন ছিলেন নমঃশূদ্র। তাঁরা মিলে তৈরি করলেন ‘বেঙ্গল অ্যাসেমব্লিজ ইনডিপেনডেন্ট শিডিউল কাস্ট মেম্বার্স লিগ’ যার সভাপতি হলেন হেমচন্দ্র নস্কর ও সম্পাদক যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল।
কংগ্রেসের হিন্দুুত্ববাদী নেতৃত্ব কৃষক প্রজাপার্টিকে সমর্থন না দেওয়ায় মন্ত্রীত্বলোভী নলিনীরঞ্জন সরকারের মধ্যস্থতায় হক সাহেবের সাথে মুসলিম লিগের বোঝাপড়া হয় এবং মুসলিম লিগ, ইউরোপীয়ান ও অ্যাংলো-ইনডিয়ান বিধায়কদের সমর্থনে হক সাহেব বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন এবং মন্ত্রীসভা গঠন করেন। মন্ত্রীসভায় কৃষক-প্রজাপার্টি বিরোধী মুসলিম লিগের বহু নবাব-জমিদার মন্ত্রী হন। প্রবল হক বিরোধী নাজিমুদ্দিন, সোরয়াবর্দি সহ। হিন্দুদের মধ্যে মন্ত্রী হন নলিনীরঞ্জন সরকার, বিজয়প্রসাদ সিংহ রায়, শ্রীশ কুমার নন্দী, প্রসন্ন কুমার রায়কত ও মুকুন্দবিহারী মল্লিক। মন্ত্রীসভা ঘোষণার সময় গভর্ণর হাউসে আমন্ত্রণ জানিও যোগেন্দ্রনাথকে মন্ত্রী করা হয় না। বিভিন্ন কিসিমের পরস্পর বিরোধী ব্যক্তি ও দল যোগ দেওয়ায় এই মন্ত্রী সভা প্রথম থেকেই ছিল নড়বড়ে, ক্ষমতাও ছিল সীমিত এবং ব্রিটিশ গভর্ণরকেন্দ্রিক।
এবার ইউরোপীয়ান ও অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সমর্থনে না পারা যাচ্ছিল ব্রিটিশ লগ্নী পুঁজির বিপক্ষে ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সমর্থনে সিদ্ধান্ত নেওয়া অন্যদিকে মুসলিম লিগের যোগ দেওয়ায় না পারা যাচ্ছিল জমিদারদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া। ফলে সম্পাদক সামসুদ্দিনের নেতৃত্বে প্রজাপার্টির ভাঙ্গন ঘটে। এর উপর নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে চলছিল সরকারকে ফেলে দেওয়ার লাগাতার চক্রান্ত। সেইসময়ের প্রধান সংবাদপত্রগুলিও ছিল রাজা-নবাব-জমিদার ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। হয় হিন্দুত্ববাদী কংগ্রেসের অথবা মৌলবাদী মুসলিম লিগের সমর্থক।
যোগেন্দ্রনাথ ক্রমশ আইনসভার বিষয়গুলি রপ্ত করার চেষ্টা করছিলেন। বহু জটিলতা, বহু নিয়মকানুন। বহু প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় বাদানুবাদ, বিরোধিতা, ফন্দিফিকির, লবিভাগ…। স্পিকার নির্বাচন নিয়ে অচলাবস্থা। হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্ব ও বিদ্বেষ, পাবলিক গরম করা। তলে তলে ব্রিটিশ সওদাগরি সংস্থা—নবাব, রাজা, জমিদার—ব্যবসায়ী—মন্ত্রীদের নিজ স্বার্থরক্ষা। তপশিলি বিধায়করা বিভক্ত ও অন্যের বাহক। বিরাট মন্ডল প্রজাপার্টির হুইপ, মুকুন্দ মল্লিক মন্ত্রী, রাধাকান্ত দাস কংগ্রেসের ডেপুটি হুইপ। কিন্তু যোগেন্দ্রনাথ প্রথম থেকেই তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত বক্তব্য ও আইনি যুক্তি দিয়ে তপশিলিদের স্বার্থে অবস্থান নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। জমিদারি কাছারিতে তপশিলি প্রজাদের প্রতি অস্পৃশ্যতামূলক আচরণ রোধে তাঁর উত্থাপিত প্রস্তাব কংগ্রেস বিধায়ক মীরা দত্তগুপ্ত সমর্থন করেন। বিধানসভার সেশন শেষ হওয়ার পর যোগেন্দ্রনাথ বরিশাল ফিরে জেলাপ্রশাসন ও জেলার নেতৃত্বস্থানীয়দের নিয়ে উন্নয়নমূলক কাজে অংশ নেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল সমস্ত সরকারি ব্যবস্থায় তপশিলি সংরক্ষণ চালু করা, অগৈলঝরা স্কুলকে মডেল স্কুল গড়া সহ নমঃশূদ্র এলাকায় আরও স্কুল—কলেজ স্থাপন, মাইলারার পশ্চিমে খাল কেটে জল বের করে চাষের জমি বের করা। যোগেন্দ্রনাথের শ্বশুর খাগবাড়ির প্রহ্লাদচন্দ্র বারুই অগৈলঝরা স্কুল নির্মাণে প্রথম অর্থদান করেন। যোগেন্দ্রনাথ সহযোগীদের নিয়ে তাঁদের গৌরনদী সংলগ্ন স্বজাতি অধ্যুষিত ফরিদপুরের গোপালগঞ্জ, পদ্মবিল, মতুয়া পীঠস্থান ওরাকান্দি প্রভৃতি পরিভ্রমণ করেন।
বর্ণহিন্দুুরা চিরটাকাল নমঃশূদ্র, রাজবংশী, ধাঁঙর, মেথর, ডোম সহ শূদ্রদের উপর অত্যাচার শোষণ করে গেছে, ‘চাঁড়াল’ বলে ও নানাভাবে অপমান অপদস্থ করে গেছে। এর বিরুদ্ধে পিতৃপুরুষরা অনেক আন্দোলন করেছেন। আবার একটি অংশ পৈতে পরে পুজোপার্বন করে পদবী বদলে ব্রাহ্মণ হওয়ার চেষ্টা করেছে। তারা না ঘরকা না ঘাটকা হয়ে গেছে। বর্ণাশ্রম প্রথায় জাতিবিন্যাসে বর্ণহিন্দুরা তাঁদের শূদ্রত্ব ঘোচায় নি। যোগেন্দ্রনাথ নিজের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি দিয়ে আরও বেশী বেশী করে বুঝতে পারেন নিজেদের শূদ্রত্ব প্রতিষ্ঠাই পথ। তাই উচ্চবর্ণের জমিদার শিক্ষিতদের হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ তাঁকে ছোঁয় না। হিন্দুত্ববাদী কংগ্রেসী রাজনীতির তপশিলি আন্দোলনকে আত্মস্মাৎ করা থেকে আম্বেদকরের মত তিনি দূরে থাকার চেষ্টা করেন। ব্রিটিশ শাসনে তপশিলিদের সংরক্ষণকে কাজে লাগিয়ে দরিদ্র, অশিক্ষিত, পশ্চাদপর স্বজাতির উন্নয়নের ব্রত নেন।
প্রায় সমস্ত ব্যবস্থা করে ফেলা সত্ত্বেও আমলাতান্ত্রিক বাধায় ও সঙ্কীর্ণ রাজনীতির জন্য অগৈলঝরা স্কুলের কাজ এগোয় না। এর জন্য যোগেন্দ্রনাথকে অধিবেশনের ফাঁকে রাইটার্সে মন্ত্রী সেক্রেটারিদের ঘরে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। বিধানসভায় যোগেন্দ্রনাথের প্রস্তাব গ্রামের স্কুলের তপশিলি ছাত্রদের মাইনে মকুব নাকচ হয়ে গেল। এমনকি তপশিলি বিধায়ক পুলিন মল্লিক বিরোধী বক্তব্য রাখলেন। ইতিমধ্যে হোম সেক্রেটারির অনুরোধে এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুমোদনে যোগেন্দ্রনাথ সরকারি আতিথেয়তায় রওনা দিলেন সিলেটের হবিগঞ্জে ব্রাহ্মণ-নমঃশূদ্র দাঙ্গা থামাতে। পথে গোয়ালন্দ ঘাটে দেখলেন অজস্র ‘হিন্দু হোটেল’। বেশ কিছু ‘বামুন ঠাকুরের হোটেল-হিন্দু ব্রাহ্মণদের জন্য’, ‘শুধুমাত্র হিন্দু বিধবা ও ব্রাহ্মণদের ষোল আনা নিরামিষ ভোজনালয়—জাত ভাঁড়াইবার চেষ্টা করিবেন না’, কিছু মুসলমান হোটেলের হোর্ডিং দেখলেন। কিন্তু পেলেন না কোন ‘শূদ্র হোটেল’। শূদ্রদের মুসলমান হোটেলে খেতে হয়। সঙ্গী এসডিও, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটদের সাথে কথা বলে দেখলেন সবই বর্ণ হিন্দু, কিছু খানদানি মুসলমান। দেশে জমিদারি। হবিগঞ্জে গিয়ে ভাল করে খোঁজ নিয়ে জানলেন এটি একটি পরিত্যক্ত স্থানে মন্দির ঘোষণা করে ব্রাহ্মণদের ঘোটলা। এক বছরে দুজন নমঃশূদ্র খুন হয়েছে। হবিগঞ্জের নমপাড়ায় সর্বজনগ্রাহ্য তুলসীমালা আখড়ার সাহায্যে নমঃশূদ্রদের আগে সঙ্ঘবদ্ধ করলেন। তারপর ব্রাহ্মণদের সাথে তর্কযুদ্ধে জয়ী হয়ে দুপক্ষের সমঝোতা করে দাঙ্গা বন্ধ করলেন।
স্বতন্ত্র তফসিলি এমএলএ হিসাবে এবং বিধানসভায় তাঁর বিশিষ্ট ভূমিকার জন্য যোগেন্দ্রনাথ নীহারেন্দু দত্ত মজুমদার, বঙ্কিম মুখোপাধ্যায়, আবুল হাসেম, হেমন্ত সরকার, বেগম শাকিনা মৌজিদদাজা, হেমন্ত বসু, ডঃ মেঘনাদ সাহা, ডাঃ রহমান বহু বিশিষ্ট রাজনীতিকদের সংস্পর্শে আসেন এবং প্রায় সবদলের মন্ত্রী ও বিধায়কদের সাথে যোগেন্দ্রনাথের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। এইভাবেই তিনি অত্যন্ত ঘনিষ্ট হয়ে ওঠেন বাংলা তথা ভারতের বিশিষ্ট রাজনীতিক শরৎচন্দ্র বসু ও সুভাষচন্দ্র বসুর। তারা দুজনেই যোগেন্দ্রনাথকে খুব পছন্দ করতেন। যোগেন্দ্রনাথও তাঁদের পরিবারের একজন হয়ে গেছিলেন। ১৯৩৮-’৪১ অবধি সুভাষের কংগ্রেস সভাপতি হওয়া, গান্ধীগোষ্ঠী কর্তৃক কোণঠাসা হয়ে পদত্যাগ, বাংলা প্রদেশ কংগ্রেসে আকচাআকচি থেকে মহানিষ্ক্রমণ অবধি নিজে কংগ্রেসে যোগ না দিয়েও যোগেন্দ্রনাথ সুভাষের রাজনৈতিক সচিবের কাজ করে গেছেন। পাশাপাশি বারবার জেলের ভেতরে ও বাইরে ব্রিটিশ পুলিশের অত্যাচারে অসুস্থ সুভাষের চাঁদসি চিকিৎসা করেছেন। সুভাষের নির্দ্দেশে তিনি অ্যালবার্ট হলে তফশিলিদের বড় সভার আয়োজন করেন, বড়তলা থেকে প্রার্থী হয়ে জয়লাভ করে কলকাতা কর্পোরেশনের কাউন্সিলার হন। এই সময় ’৩৯এ শরৎ বোসের বাড়িতে এআইসিসি সম্মেলনে গান্ধী সহ কংগ্রেসের জাতীয় নেতৃত্বের সাথে সাক্ষাত হয়। গান্ধীর সাথে তফশিলি মন্ত্রী-বিধায়কদের আলোচনায় গান্ধীর হরিজনদের মন্দিরে প্রবেশের মাধ্যমে এবং সকলকে কংগ্রেসে যোগদানের মাধ্যমে জাতিভেদ সমস্যার অবসানের তত্ত্ব যোগেন্দ্রনাথকে ক্ষুব্ধ করে। ইতিমধ্যে অন্যদের নিয়ে যোগেন্দ্রনাথ ‘অল বেঙ্গল শিডিউল্ড কাস্ট ফেডারেশন’ গড়ে তোলেন। এরপর বরিশালে গেলে হক সাহেব আন্দামান ফেরত কয়েকজন বিপ্লবীর সাথে যোগেন্দ্রনাথের সাথে দেখা করতে আসেন। তাদের মধ্যে অনেক আলোচনা হয়। বরিশাল কৃষক সমিতির প্রতিষ্ঠা হয়। মাহিলাড়ায় হয় সফল কৃষক সম্মেলন। ব্রিটিশের অধীন কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের জমিদারদের সরকার কৃষকদের জন্য প্রচুর চোখের জল ফেললেও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তজাত বিধি ব্যবস্থার কোন পরিবর্তন করছিল না। উল্টে ১৯২৮-র অ্যামেন্ডমেন্টে আন্ডাররায়ত বা কোর্ফা প্রজা করে কৃষক উচ্ছেদের পথ সুগম করা হল। নীহারবাবু, বঙ্কিমবাবুদের মার্কসীয় আলোচনা, লেনিনের বই যোগেন্দ্রনাথের ভালো লাগত। ১৯১৭-র রুশ বিপ্লব উদ্দীপ্ত করত। কিন্তু শ্রেণী সংগ্রামের মাধ্যমে বর্ণাশ্রমের জন্মগত শূদ্রদের শূদ্রস্থ ঘুচবে বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তাঁর দেখা সব মার্কসিষ্টরাইতো বামুন-কায়েত-বৈদ্য কিংবা ওমুক বাবু তমুকবাবু। ইতিমধ্যে যশোরের বিভিন্ন এলাকায় দাঙ্গার পর রসিককাকা তাঁকে ডেকে পাঠালেন। তারপর যশোরের ঝিকরগাছা, মাগুরা, ছিরিপুর, কুইলা, নরাইল, শালিখা, লোহারতালা, লাউজানি, পানিসারা বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ঘুরে রসিকলাল বিশ্বাস ও যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল দেখলেন বাইরে থেকে হিন্দু মিশন, ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ প্রভৃতির স্বেচ্ছাসেবকরা এসে গুজব ছড়িয়ে ও কলকাতার কাগজে সেগুলি পল্লবিত করে মুসলমান-নমঃশূদ্র দাঙ্গা বাঁধাচ্ছে। হিন্দুত্ববাদী কংগ্রেস এক পক্ষ, লিগ অন্য পক্ষ। ব্রিটিশ প্রশাসন নিষ্ক্রিয়। তারা অনেক চেষ্টায় দাঙ্গা বন্ধ করলেন। মিশন ও সঙ্ঘের ক্যাম্পগুলি হটিয়ে দিলেন।
এর মধ্যে বিধানসভায় যোগেন্দ্রের চেঁচামেচিতে তপশিলিদের প্রতিবছর বিদেশ যাওয়ার বৃত্তি, ১৯ জনের ডাক্তারি পড়ার বৃত্তি, অন্যান্য বৃত্তি, ফাণ্ড, চাকরিতে সংরক্ষণ চালু হয়েছে। কিন্তু উচ্চবর্ণের নেতা আমলা আধিকারিকরা নানা কায়দায় এগুলি আটকে দিত।
সেইসময় বন্দীমুক্তি আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন, মুসলিম লিগের আন্দোলন, গ্রামে ভাগচাষীদের আন্দোলন নিয়ে কলকাতা ও রাজ্য সরগরম। অনাস্থা, খেয়োখেয়ি, ষড়যন্ত্র নিয়ে মন্ত্রীসভা টালমাটাল। হক সাহেব যোগেন্দ্রনাথকে মন্ত্রী হবার প্রস্তাব দিলেন। যোগেন্দ্রনাথ ঐ টালমাটাল অবস্থায় সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন না। সেই সময় যোগেন্দ্রনাথ তপশিলিদের নিজস্ব রাজনৈতিক দল তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পাশাপাশি সুভাষ বসুর সাথে কাজ করছেন। সুভাষের বাড়িতেই প্রাক্তন বিপ্লবী, আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট নেতা, পরবর্তীতে কংগ্রেস ও ট্রেড ইউনিয়ন নেতা মানবেন্দ্র রায়কে দেখলেন, দেখলেন বিপ্লবী ডাঃ যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায় ও আরো অনেককে। বরিশালে ব্যাপক সাইক্লোনে ভোলা প্রভৃতি অঞ্চল ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত ও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেই ভয়ঙ্কর দুর্যোগ, দুস্তর স্রোত আর উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যে যোগেন্দ্রনাথ তেতুঁলিয়া, দৌলতখান, গয়াভাংগানি, লতা নদীর সীমানায় নৌকা করে ভাসানচরে পৌঁছান। সেখান থেকে দুদু মিঞাকে সঙ্গে নিয়ে বরিশাল শহরে পৌঁছে ত্রাণের তদারকি করেন। পরে সুভাষচন্দ্র বসুকে খুলনা হয়ে ভোলা ও বরিশালে নিয়ে আসেন। বরিশালে সুভাষচন্দ্রের বিশাল সভায় সভাপতিত্ব করেন যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল। সুভাষের নির্দেশে ইরাণি বংশোদ্ভুত বিশিষ্ট আইনজীবী, নেত্রী ও কাউন্সিলার শাকিনার নেতৃত্বে কলকাতা কর্পোরেশনের ২০ হাজার ধাঁঙর-মেথর যে ঐতিহাসিক ধর্মঘটে অংশ নেন যোগেন্দ্রনাথ তাঁদের তপশিলি সংগঠন নিয়ে তাতে যোগ দেন এবং নিজে মেয়র সিদ্দিকি সাহেবের সাথে আলোচনা চালিয়ে কর্পোরেশনকে দাবীগুলি বেশিরভাগ মেনে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
লিগ-হক মন্ত্রীসভার পতনের পর প্রগ্রেসিভ কোয়ালিশন গড়ে তুলে ১৯৪১এ হক সাহেব আবার প্রধানমন্ত্রী হন ও মন্ত্রীসভা গঠন করেন। হক সাহেবকে সমর্থন করে কংগ্রেসের শরৎ বোস গোষ্ঠীর ২৮ জন, কৃষক প্রজার ১৯ জন, হিন্দু মহাসভার ১২ জন, তপশিলি স্বতন্ত্র ১২ জন, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ২ জন, শ্রমিক ১, কংগ্রেস ও ন্যাশনালিস্ট ২৭ জন। ব্রিটিশ সরকার শরৎচন্দ্র বসুকে গ্রেফতার করে। হক সরকার মুসলমানদের জন্য বেশ কিছু সুবিধা ঘোষণা করলেন। ততদিনে পাকিস্তানের দাবি উঠে এসেছে। সেন্সাসে নিজেদের গোষ্ঠীর লোক বেশি দেখাতে দাঙ্গা শুরু হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের আক্রমণে নাজেহাল হয়ে ব্রিটিশ সিঙ্গাপুর, মালয়, বারমা থেকে পিছু হটে বাংলাকে পূর্ব রণাঙ্গণ তৈরি করছে। বারমা থেকে উদ্বাস্তুরা আসছিলেন। বেঙ্গল টেনান্সি বিল হারিয়ে গেল, গঠন হল ফ্রাউড কমিশন। পাটচাষীদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলে যোগেন্দ্রনাথ বিধানসভায় ও পাটশ্রমিকদের সভায় পাটচাষীদের পক্ষে বললেন।
ঢাকা শহরে এবং নারায়ণগঞ্জে দাঙ্গা শুরু হলে আবার যোগেন্দ্রনাথের ডাক এল। সঙ্গে গেলেন রসিকলাল বিশ্বাস। যোগ দিলেন ঢাকার বিশিষ্ট চিকিৎসক এবং তপশিলি ও কংগ্রেস নেতা মোহিনীমোহন দাস। ডাঃ দাস ও তাঁর স্ত্রী মুন্সিগঞ্জে তপশিলিদের মন্দিরে প্রবেশ নিয়ে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। এখানেও দেখা গেল বর্ণহিন্দুরা ইন্ধন জুগিয়েছেন। সাহারাও। অনেক কষ্টে মুসলমান এবং গোয়ালা, শাখারি, নমঃশূদ্রদের মধ্যে হিংসা সাময়িক বন্ধ করা গেল। কিন্তু যোগেন্দ্রনাথ এক পশ্চিমা হিন্দুত্ববাদী দুর্বৃত্তের আক্রমণে আহত হলেন।
দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলি থেকে ইম্পাহানি প্রমুখ ব্যবসায়ীকে দিয়ে সমস্ত খাদ্য শস্য সরিয়ে নেওয়া হল ব্রিটিশ সেনার জন্য এবং জাপানিরা এলে যাতে না পায় তাই। এর সাথে নৌকা, সাঁকো সব ভেঙ্গে ফেলা হল। যোগেন্দ্রনাথ বিষয়টি বুঝতে কর্তাব্যক্তি এমনকি সামরিক অধ্যক্ষর সাথে দেখা করলেন। তারপর বরিশাল গিয়ে দেখলেন করুণ অবস্থা। কলকাতা শহর জুড়ে যুদ্ধভীতি, জাপানি বোমার আতঙ্ক, মন্ত্রী-আমলাদের দুর্নীতি, ব্যবসায়ীদের মজুতদারি, কালো বাজারি। আইনশৃঙ্খলার অবনতি। অন্যদিকে সুভাষের নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ্ বাহিনীর আগমন ও ভারতের মাটিতে প্রবেশ। ভারত জুড়ে ভারতছাড়ো আন্দোলন। বাংলায় ভয়াল দুর্ভিক্ষ। শ্যামা-হক সরকারের ব্যর্থতা। হক সরকার পড়ে গেল। এবার নাজিমুদ্দিনের কোয়ালিশন সরকার হল। এবার যোগেন্দ্রনাথকে মন্ত্রী করা হল। ১৯৪৩-র ২৪ এপ্রিল ঐ মন্ত্রীসভায় যোগেন্দ্রনাথ ছাড়াও তপশিলিদের মধ্যে পুলিনবিহারী মল্লিক ও প্রেমহরি বর্মন মন্ত্রী হলেন। মন্ত্রীসভার ডেপুটি লিডার হলেন মুকুন্দবিহারী মল্লিক ও রসিকলাল বিশ্বাস। পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি হয়েছিলেন অনুকূলচন্দ্র দাস, বঙ্কুবিহারী মণ্ডল ও রসিকলাল বিশ্বাস। কথিত আছে যোগেন্দ্রনাথ নাজিমুদ্দিনকে চাপ দিয়ে তপশিলি মন্ত্রীর সংখ্যা বাড়িতে নিয়েছিলেন। কিন্তু, সেইসময় তাঁর মূল কাজ ছিল দেশ ও গ্রাম থেকে নিরন্ন মানুষের আসা স্রোতে খাদ্য ও ত্রাণ যোগানো। যশোর রোডে বারাসতের কাছে লঙ্গরখানা খোলা হল। কিন্তু তা যে বড্ড অপ্রতুল। বাংলার দুর্ভিক্ষে ২০-৩০ লক্ষ মানুষ মারা গেলেন, বেশীরভাগই গ্রামের গরীব কৃষক। ব্রিটিশ ইম্পাহানিদের এই তৈরি করা দুর্ভিক্ষে প্রাণ গেল তাঁর বরিশাল-খুলনা-যশোর-ফরিদপুরের অসংখ্য স্বজনের।
এরপর যোগেন্দ্রনাথের সাথে হিন্দু মহাসভার টক্কর লেগে গেল। চারিদিকে হাহাকার ও সাম্প্রদায়িক পরিবেশে হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লিগের একাংশ দাঙ্গার ইন্ধন জ্বালিয়ে যাচ্ছিলেন। গোপালগঞ্জকে নিয়ে বড় পরিকল্পনা নিয়ে শ্যামাপ্রসাদ সদলবলে সেখানে গেলে যোগেন দলবল নিয়ে সেখানে গিয়ে মিটিংতো দূরের কথা লঞ্চ থেকে তাদের নামতেই দিলেন না। এর ফলে বাংলায় যোগেন্দ্রনাথ হিন্দুত্ববাদী কংগ্রেসের শত্রু তো ছিলেনই আর.এস.এস.—হিন্দু মহাসভার প্রধান শত্রু হয়ে উঠলেন।
অন্যদিকে যোগেন্দ্রনাথ ১৯৪৩-’৪৬এ নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রীসভার সদস্য এবং বিধানসভায় ২১ জন তপশিলি স্বতন্ত্র বিধায়কদের নেতা হিসাবে একজন নিয়ামক নেতা হয়ে উঠেছিলেন। তপশিলি সম্প্রদায়ের মধ্যে যাঁরা এর আগে নেতৃত্বের স্বীকৃতি পেয়েছিলেন হয়তো অর্থের জোরে বা খ্যাতির জোরে বা প্রতিষ্ঠার জোরে, তাঁরা যোগেনের নেতা হয়ে ওঠায় ও বাংলা আইনসভায় সরকার রাখা না রাখার কর্তা হয়ে ওঠায় প্রথমে অখুশি হলেন, তারপর বিরক্ত হলেন, তারপর ঈর্ষা করতে লাগলেন ও শেষে তাঁর বিরোধিতায় সক্রিয় হয়ে উঠলেন।
১৯৩৭-র ভোটে একটি বিষয়ে যোগেন্দ্রনাথ সারা ভারতে ছিলেন অদ্বিতীয়। তিনি সাধারণ আসনে দাঁড়িয়ে জিতেছিলেন। সাধারণ আসনে ভোটার ছিলেন সকলেই, নানা জাতের হিন্দু। সারা ভারতের ১০টি প্রদেশে হাজারের উপর সাধারণ আসনে বর্ণহিন্দুরা কোন তপশিলিকে ভোট দেয়নি। একমাত্র যোগেন্দ্রনাথ ছাড়া সাধারণ আসনে কোন তপশিলি জেতেননি। অথচ আমরণ অনশনে গান্ধীজি মৃতপ্রায় হয়েছিলেন—তপশিলি হিন্দুদের আলাদা ভোট নাকচের দাবিতে। গান্ধীজি বলেছিলেন হিন্দুদের ভাঙ্গতে দেব না। আসলে তিনি হিসাব কষে দেখেছিলেন যে ভারতের হিন্দু জনসংখ্যা থেকে তপশিলিদের আলাদা ভোট করলে বর্ণহিন্দুরা জিততেই পারবেন না।
দ্বিতীয় যে বিষয়ে যোগেন্দ্রনাথ অদ্বিতীয় ছিলেন তা হল প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসনের দ্বিতীয় ভোটের আগে সারা ভারতে তপশিলিদের একটি মাত্র রাজনৈতিক সংগঠন ‘ভারতীয় তপশিলি ফেডারেশন’ গঠন। আম্বেদকরের সাথে। এই ফেডারেশন তপশিলি আসনগুলিতে প্রার্থী দিয়েছিল। কিন্তু কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ কেন্দ্রিক মেরুকরণ হওয়া রাজনীতিতে একমাত্র যোগেন্দ্রনাথ জিতে বিধায়ক হলেন। বাকি প্রার্থীরা পরাজিত হল। ১৯৪৬এ বাংলার সোরাওয়ারদির মুসলিম লিগ কোয়ালিশন মন্ত্রীসভাতেও যোগেন্দ্রনাথ বিচার, আইন ও পূর্তবিভাগের মন্ত্রী হলেন।
যোগেন্দ্রনাথেরে তৃতীয় অদ্বিতীয় হওয়ার কীর্তি হল ‘সংবিধান রচনা পরিষদে’র সদস্য-নির্বাচনে আম্বেদকর বম্বে থেকে হেরে যান। বল্লভভাই প্যাটেল প্রকাশ্যে বলেছিলেন আম্বেদকর যাতে কোনভাবেই গণপরিষদে ঢুকতে না পারেন কংগ্রেস সে ব্যবস্থা করে রেখেছে। যোগেন্দ্রনাথ আম্বেদকরকে বাংলায় ডেকে এনে যশোর-খুলনা থেকে প্রার্থী করলেন। কংগ্রেস এক তপশিলি বিধায়ককে অপহরণ করেছিল। যোগেন্দ্রনাথ তাঁর তরুণ সমর্থকদের পাঠিয়ে রংপুর থেকে ঐ বিধায়ককে উদ্ধার করেন এবং আম্বেদকরকে ভাল ভোটে জিতিয়ে গণপরিষদে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
১৫ হ্যারিসন রোডের তপশিলি ফেডরেশনের এক সভায় পরিকল্পিতভাবে পি.আর. ঠাকুর, মুকুন্দ বিহারী মল্লিক, উপেন এদ্বারদের নেতৃত্বে যোগেন্দ্রনাথকে আক্রমণ করা হয়। অন্যদিকে অগ্নি মণ্ডলের নেতৃত্বে হিন্দুমহাসভাপন্থী তপশিলি নেতৃত্ব তাঁকে হিন্দু বিরোধী হিসাবে আক্রমণ করেন। আম্বেদকরের সঙ্গ নেওয়ার জন্যও তাঁকে সমালোচনা করা হয়। যোগেন্দ্রনাথ তাঁর তপশিলি ও শূদ্রকেন্দ্রিক রাজনীতির জবাব দেন, গত ১০ বছরের কাজে সালতামামি ব্যাখ্যা করে উচ্চবর্ণের প্রবল বাধার বিষয়গুলি তুলে ধরেন। এরপর বাংলা জুড়ে সাম্প্রদায়িক আবহে তপশিলি নেতৃত্ব বিভক্ত হয়ে পড়ে। একটি বড় অংশ ‘মতুয়া’ গুরু পি. আর. ঠাকুরের নেতৃত্বে কংগ্রেসের দিকে ঝোঁকেন। আরেকটি অংশ হিন্দু মহাসভার প্রতি। যোগেন্দ্রনাথ তাঁর শূদ্রকেন্দ্রিক উচ্চবর্ণীয় কংগ্রেস ও হিন্দুমহাসভা বিরোধী রাজনীতিতে অটল থেকে স্বাভাবিক মিত্র মুসলিম লিগ—কোয়ালিশন মন্ত্রীসভায় এবং তপশিলি ফেডারেশনের কাজ করতে থাকেন।
কংগ্রেস ইতিমধ্যে সুভাষচন্দ্রকে তাড়িয়েছিল। মুসলিম লিগ হক সাহেবকে তাড়াল। জিন্না হয়ে উঠলেন সর্বেসর্বা। ওদিকে কংগ্রেসে নেহরু ও প্যাটেল ক্ষমতা দখল করেছেন। জাপান ও আজাদ হিন্দ্ ফৌজ পরাজিত। সুভাষচন্দ্র নিরুদ্দেশ অথবা হত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী ব্রিটিশ। তারা তখন নিজেদের কর্তৃত্ব অটুট রেখে ভারতকে ভাগ করার কাজ শুরু করে দিয়েছে। কংগ্রেস ও লিগ নেতারা ক্ষমতার লোভে তাতেই সামিল। আর এই কাজটি ত্বরান্বিত করতে দেশ জুড়ে তৈরি করা হয়েছে সাম্প্রদায়িক আবহ ও দাঙ্গা।
গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতিতে ১৯৪৬-র আগস্ট কলকাতায়, তারপর নোয়াখালিতে, তারপর বিহার, পাঞ্জাব, দিল্লি, অন্যত্র হল একের পর এক ভয়ানক দাঙ্গা, খুন, রক্তপাত, লুঠ, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ। ফলশ্রুতিতে দুই সম্প্রদায়ের আক্রান্ত মানুষের আতঙ্ক, ভিটেমাটি ত্যাগ ও উদ্বাস্তুর স্রোতে সামিল হওয়া। যোগেন্দ্রনাথ তার স্বজাতি অঞ্চলে এই দাঙ্গা-রক্তপাত অনেকটাই আটকাতে পারলেন এবং স্বজাতিদের আশ্বস্ত করলেন দেশে থেকে যাওয়ার জন্য। সেই পর্যায়ে বাঙালি মুসলমানরা নমঃশূদ্রদের গায়ে হাত দেয়নি।
ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে ভাইসরয় ওয়াভল ১৯৪৫এর সেপ্টেম্বর একটি অন্তবর্তী সরকার গড়লেন দিল্লিতে। নেহরু প্রধানমন্ত্রী হলেন। কংগ্রেস ১২ জন মন্ত্রীর তালিকা দিল। জিন্না প্রথমে রাজি না হলেও ৫ অক্টোবর পাঁচজন মন্ত্রীর নাম ঘোষণা করে যোগ দিলেন। লিগ-কোয়ালিশনের এই পাঁচজন মন্ত্রী ছিলেন—লিয়াকৎ আলি, চুন্দ্রিগড়, আবদুর নিস্তার, গাজনফর আলি ও যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল। সাম্প্রদায়িক আবহে এবং অনেকখানি ইর্ষায় কংগ্রেস থেকে আরম্ভ করে অন্যদলের নেতাদের দ্বারা যোগেন্দ্রনাথের বিপক্ষে কুৎসা শুরু হল। কেন্দ্রের অন্তবর্তী সরকারের আইনমন্ত্রী হিসাবে যোগ দিতে যোগেন্দ্রনাথ দিল্লি গেলেন।
এরপর মাউন্টব্যাটেন এসে দেশভাগ ও ক্ষমতা হস্তান্তর ত্বরান্বিত করলেন। ভারত ও পাকিস্তান এই নামে দেশ বিভক্ত হল। যোগেন্দ্রনাথ তাঁর শূদ্রত্বের তত্ত্ব নিয়ে তাঁর স্বজাতি ও স্বদেশকে (যা বাটোয়ারার পর পড়ল পাকিস্তানে, পূর্ব পাকিস্তানে) নিয়ে পাকিস্তানে রইলেন। জিন্না তাঁকে পাকিস্তানের গণপরিষদের অস্থায়ী সভাপতি এবং পাকিস্তানের আইনমন্ত্রী করলেন। ৫ আগস্ট সিন্ধু এক্সপ্রেসে করে পাকিস্তানের তদানীন্তন রাজধানী করাচির দিকে যাত্রা করলেন যোগেন্দ্রনাথ। পরে আইনের সাথে তিনি পাকিস্তানের শ্রম, কমনওয়েলথ ও কাশ্মীর বিষয়ক মন্ত্রী হন।
কিন্তু জিন্না পরবর্তী পাকিস্তানে শাসনতন্ত্রের ক্রমবর্দ্ধমান সামরিকিকরণ, ইসলামিকরণ ও পাঞ্জাবীকরণে তিনি কোণঠাসা হয়ে পড়েন। পশ্চিম পাকিস্তানি প্রভাব পূর্ব পাকিস্তানেও পরে। সাম্প্রদায়িক শক্তি ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে। ব্যাপক হিন্দু বিরোধী দাঙ্গায় বহু নমঃশূদ্রও হতাহত হয়। উদ্বাস্তুর স্রোত ভারতের দিকে ছোটে। এর প্রতিবাদে তিনি পাকিস্তান মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করে ভারতে ফেরেন। উচ্চবর্ণীয় কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার প্রভাবাধীন স্বাধীন ভারত তাকে আগেই ব্রাত্য করেছিল। এবার ইসলামিক সামরিক বাঙালী বিদ্বেষী পাকিস্তানও করল। উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে মুসলমান ও তপশিলি ঐক্য এবং ফলিত ক্ষেত্র পাকিস্তানের তত্ত্বায়ন বিফল হওয়ায় হতাশ যোগেন্দ্রনাথ মাত্র ৪৬ বছর বয়সে যাবতীয় নিন্দা ও বিদ্রূপ নিয়ে যখন ভারতে ফিরলেন তখন তাঁর স্বদেশ ভেঙ্গে গেছে, জন্মভূমি শত্রু দেশ, স্বজাতি রাস্তায় স্টেশনে বা ক্যাম্পে গাদাগাদি করে মরছে। যাবতীয় সমালোচনার মধ্যেও তাঁর স্বজাতি নমঃশূদ্র, তপশিলি ও উদ্বাস্তুদের ত্রাণ, পুনর্বাসন ও উন্নয়ন নিয়ে কাজ করে গেলেন ১৯৬৮তে মৃত্যু অবধি। তিনি ১৯৫২-র নির্বাচনে বেনিয়াপুকুর-বালিগঞ্জ কেন্দ্রে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে প্রার্থী হয়ে পরাজিত হন। প্রথমে SBBS ও UCCR-র সাথে উদ্বাস্তুদের নিয়ে কাজ করছিলেন। দণ্ডকারণ্যে উদ্বাস্তুদের পাঠানোর বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্বে দেন। পরে UCCR ব্রাত্য করে দিলে ১৯৫৭এ তৈরি করেন ‘ইষ্ট ইন্ডিয়া রিফিউজি কাউন্সিল (EIRC)’। কিন্তু ধারাবাহিক চেষ্টা করেও তিনি সফল হন না কারণ ততদিনে তপশিলি উদ্বাস্তুদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিয়ে নিয়েছে সিপিআই, কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা এবং ধর্মীয় নেতৃত্ব দখল করে নিয়েছেন চব্বিশ পরগণার গাইঘাটায় ঠাকুরনগর প্রতিষ্ঠা করে মতুয়া গুরু ও কংগ্রেস নেতা পি. আর. ঠাকুর।
যোগেন্দ্রনাথের তত্ত্বায়ন
১৯০৫-র ব্রিটিশ কর্তৃক বঙ্গভঙ্গের পর একদিকে উচ্চবর্ণ শিক্ষিত জমিদারদের স্বদেশী আন্দোলন এবং বিপ্রতীপে ঢাকার নবাব, মুসলমান জমিদার এবং দ্রুত মুনাফা করা মুসলিম ব্যবসায়ীরা একদিকে সন্ত্রাসবাদীদের অন্যদিকে পির মৌলবিদের এনে বাংলায় প্রথম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু করে। যদিও এক্ষেত্রেও মূল দ্বন্দ্ব ছিল অত্যাচারী হিন্দু জমিদারদের গরীব মুসলমান এবং নমঃশূদ্র, হাজং ও অন্যান্য কৃষকদের শোষণ। ঈশ্বরগঞ্জ, কুমিল্লা, জামালপুর, দেওয়ানগঞ্জে দাঙ্গা হয়।
ব্রহ্মোত্তর, মহাত্রাণ, দেবত্র, লাখেরাজ, সিকিমি তালুক, হুজুরি তালুক, নিমত্তসত তালুক, হাওলা, নিম হাওলা, ওমত নিম হাওলা, ইজারা, মিরাশ ইজারা, মিরাশ মালগুজার, কায়েম করজা, মেয়াদি করজা, জোত—নানা কায়দায় জমির ভাগ দেখিয়ে, না দেখিয়ে, কম দেখিয়ে, খাজনার হার কমিয়ে জমিদাররা সরকারকে কর ফাঁকি দিত। অন্যদিকে খাজনার পরও ঈশ্বরবৃত্তি, তহুরি, বিবাহ কর, পার্বনী, বিদ্যালয় খরচ, তীর্থখরচ, ডাক খরচ, ভোজ খরচ, গাজন, থিয়েটার, গোলাপূজা, মণ্ডপ সেলামি, মাচা—নানারকম বেআইনি আদায় করে কৃষকদের রক্তশূন্য করে দিত। আর না দিতে পারলে ভিটে মাটি উচ্ছেদ ও অত্যাচার। আবার এক্ষেত্রেও জমিদারদের পেয়াদা ও লেঠেলের দায়িত্ব পালন করত মুসলমান ও নমঃশূদ্রদের মধ্যেকার শক্তিধর নইক্দা জওয়ানরা। শোনা যায় প্রতাপাদিত্য ও বারো ভুইঞাদের সৈনিক ছিল নমঃশূদ্ররা। জমিদার-চুকানিদার-দর চুকানিদার—বর্গাদার মধ্যসত্বভোগীদের আদায়। নতুন জাগা নদীর চর দখল। এসবেও তারা।
যোগেন্দ্রনাথ শুধুমাত্র হিন্দুশাস্ত্রের ও হিন্দু আইনে অবগাহন করে নয় নিজের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও গভীর উপলব্ধিতে বুঝেছিলেন যে সব ধর্ম গ্রহণ করা যায়, এক হিন্দুধর্মে জন্ম নিতে হয়। আর শূদ্র সবসময় শূদ্রই থেকে যায়। অনেককিছুর মধ্যে তাঁর মনে পড়ে যায় বালকবেলার তেঁতুলকাঠির হাটের সেই দৃশ্যটি। লোভ সামলাতে না পেরে একটি বালক ঘোষ মশায়ের দোকানের সাজানো জিভে গজার স্তুপ থেকে একটি চুরি করেছিল। তাতে কামড় দেওয়ার আগেই ধরা পড়ে। ঘোষ মশায়ের দোকানের লোকেরা তার উপর ঝাঁপিড়ে পড়ে হাতা, শিক, ডাণ্ডা, শেষে আখার জ্বলন্ত খড়ি দিয়ে মেরে মৃতপ্রায় করে দিয়ে খালের জলে তিন ডুব দিয়ে দোকানে প্রবেশ করে। এরপর ঘোষ মশায় বারকোষের সমস্ত জিভে গজা মাটিতে ফেলে বলেন ‘‘চাঁড়ালের ছোঁয়া মিষ্টি আমি খদ্দেরদের বেচতে পারব না। চাঁড়ালের ছোঁয়া যাদের লেগেছে তারা তিন ডুব না দিয়ে আমার দোকানে ঢুকতে পারবে না।’’ তাই আইন সভায় হক মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে ঐতিহাসিক ভাষণের শেষে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল ১০ আগস্ট ১৯৩৮এ বলেন, ‘‘…কিন্তু আমরা দায়িত্ব সহ আইনসভায় আজ ঘোষণা করতে চাই—কোন নমঃশূদ্র বা রাজবংশী বা তপশিলি জনগোষ্ঠীর একজনও আর উঁচু জাতের হিন্দুদের জীবনমান রক্ষা করতে মুসলমানদের সাথে দাঙ্গা করবে না। হিন্দু-ঐক্য একমাত্র তখন সরব হয় যখন বর্ণহিন্দুরা আক্রান্ত হন। আমরা হিন্দু না।’’
রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে যোগেন্দ্রনাথ কংগ্রেস, ফরোয়ার্ড ব্লক ও হিন্দু মহাসভার উচ্চস্তরে আমন্ত্রিত ছিলেন। কিন্তু নিজের লক্ষ্য ও আদর্শে স্থির থেকে সেই আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দেন। আম্বেদকরের সাথে যোগেন্দ্রনাথ ‘অল ইন্ডিয়া সিডিউল কাষ্ট ফেডারেশন’ তৈরি করেন। মহারাষ্ট্রের দলিত নেতা আম্বেদকরকে মেনে নেন এই তপশিলি জাতি ফেডারেশনের নেতা হিসাবে। যোগেন্দ্রনাথের তত্ত্ব ছিল তপশিলিদের রাজনৈতিক পরিচয় তপশিলি। অন্য পার্টি বা আন্দোলনে তপশিলিরা থাকতে পারে। যেমন মজুর ও কৃষক আন্দোলনে। কিন্তু তাদের রাজনৈতিক পরিচয় তপশিলি হিসাবে। যোগেন্দ্রনাথ অবশ্য নিজেকে শূদ্র বা চাঁড়াল বলতেই বেশি পছন্দ করতেন।
ভারতের স্বাধীনতা পাওয়ার চেষ্টার একেবারে শেষ দিকে সারা ভারতে লিগ নেতৃত্ব বাদ দিয়ে একমাত্র যোগেন্দ্রনাথ পাকিস্তান প্রস্তাব সমর্থন করেছিলেন। তার আগে তিনি বাংলা ভাগের বিরোধিতা করেছিলেন। তপশিলি হলেও হিন্দু থাকেন নি। পাকিস্তান প্রস্তাব মানলেও, পাকিস্তানের মন্ত্রী হলেও, মন্ত্রীত্বের সুবাদে পশ্চিম পাকিস্তানে থাকলেও মুসলিম হন নি। জন্ম থেকে তিনি মৃত্যু অবধি গর্ব ও স্পর্ধা নিয়ে শূদ্রই ছিলেন।
৫০-র দাঙ্গায় পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যালঘু প্রধানত নমঃশূদ্র হত্যায় তিনি তীব্র প্রতিবাদ করেন। জিন্নাহীন পাকিস্তানে সামরিক-সাম্প্রদায়িক-পাঞ্জাবি জাত্যাভিমানি পরির্তনে তাঁকে কোনঠাসা ও হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়। ১৯৫০ এই তিনি মন্ত্রীত্ব ত্যাগ করে ভারতে ফিরে আসেন। উচ্চবর্ণ ও কংগ্রেস পরিবেষ্টিত আবহে আমৃত্য কুৎসা, নিন্দা ও ব্যর্থতার ঐকতানের মধ্যেও তিনি যথাসাধ্য তপশিলি, নমঃশূদ্র এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুদের জন্য কাজ করে গেছেন।
কোন রাজনৈতিক নেতাকে, সারা ভারতে এতটা অপমানিত হতে হয় নি, এতটা ঘৃণিত হতে হয় নি। এতটা তুচ্ছ হয়ে যেতে হয়নি। হিন্দুয়ানি যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের মতকে, শূদ্রের এই স্বাধীনতা ও সাহস মেনে নিতে পারেনি, যে, নিজের শূদ্র-পরিচয়টাকেই একমাত্র পরিচয় করে তোলে ও হিন্দু পরিচয়কে অস্বীকার করে একেবারে ছলচাতুরিহীন সরলতায়। একলব্য ও শম্বুকের মত, এই শূদ্রের কোন ব্রাহ্মণ অস্ত্রগুরু বা হিন্দু-অবতারের দরকার হয়নি। হিন্দু সংস্কারে এই অস্পৃশ্য নমঃশূদ্র, অস্পৃশ্য থেকে গিয়ে নিজের শূদ্র আত্মপরিচয়ের মাহাত্ম্য রচনা করেছেন।
[বিশেষ কৃতজ্ঞতা: শ্রী দেবেশ রায় এবং ‘বরিশালের যোগেন মন্ডল’
কৃতজ্ঞতা: শ্রী রণজিৎ কুমার শিকদার, শ্রী সুরেন্দ্রনাথ শিকদার, ডাঃ হরিপদ রায়, শ্রীমতী অলকানন্দা রায়, শ্রী জগদীশচন্দ্র মন্ডল, শ্রী নীতিশ বিশ্বাস ও অন্যান্য।
বাংলাদেশের লোকজসংস্কৃতি গ্রন্থমালা—বাংলা একাদেমি, ঢাকা।]