“ডাক্তারবাবু দ্যাখেনতো আমার ছেলেটারে।” এক মাঝবয়সী লুঙ্গি গেঞ্জি পরা মানুষ একজন বছর ত্রিশের ছেলেকে আমার সামনের চেয়ারে বসিয়ে বললেন।
-কি হয়েছে? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
-এই শরীরটা দুর্বল, খাচ্ছে না, জ্বরজ্বর। উনি বললেন।
ছেলেটাকে দু একটা কথা জিজ্ঞাসা করে মনে হোলো বুদ্ধির জায়গাটা একটু কম আছে। ডাক্তারি ভাষায় বলে মেন্টাল রিটার্ডেশান।
তাই আবার সেই মানুষটাকে জিজ্ঞাসা করলাম, বাচ্চা ছিল যখন হামা দেয়া, বসা, দাঁড়ানো ঠিক সময়ে হয়েছিল কিনা।
বলল সে জানে না, ওর মাও জানে না।
আমি একটু অবাক এবং বিরক্ত ভাবে বললাম, তার মানে?
তখন যেন গোপন কথা বলছেন এভাবে মুখটা আমার কানের কাছে এনে বললেন, আমি তো ওকে রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছি। ছ সাত বছর বয়স তখন ওর। আমাদের গ্রামের রাস্তায় কাঁদতে কাঁদতে ঘুরছিল। বাবা মার কথা বলতে পারছে না। বাড়ি নিয়ে এসে মানুষ করলাম।
ওষুধ লিখতে লিখতে মনে মনে মানুষটাকে কুর্নিশ করলাম। নিজের ছেলে মেয়ে থাকা সত্ত্বেও এভাবে রাস্তার ছেলেকে আপন করে নেওয়া আমরা শহুরে লোকরা ভাবতেই পারিনা। আর ইনি সেটা অবলীলায় করে দেখালেন।
যাওয়ার সময়ঃ
আমাদের মেডিক্যাল ক্যাম্প, ৮.৬.২০২১, মঙ্গলবার, ছিল ইয়স রিলিফ নেটওয়ার্কের সাথে রায়দিঘির কলেজ মোড় থেকে আরো ১৬/১৭ কিলোমিটার দক্ষিণে মৃদঙ্গভাঙ্গা নদীর ধারে মহব্বত নগর গ্রামে।
এবার আমাদের দলটা বেশ বড়ো। ডাক্তারদের মধ্যে মানস, অনিন্দ্য, আপন, শর্মিষ্ঠা আর আমি। স্বাস্থ্যকর্মী অর্পিতা। আর প্রচুর শুকনো খাবার, দুধের কার্টুন নিয়ে সমাজকর্মী প্রীতিদি।
বাইপাসে টেগোর পার্কে দুটো গাড়ির রিপোর্টিং টাইম ছিল সাড়ে সাতটা। বাঙালির টাইমের মর্যাদা দিয়ে মাত্র ১৫ মিনিট লেট করে পৌনে আটটায় একজোট হয়ে আমরা ‘চলো ক্যাম্পে’ বলে স্টার্ট করলাম।
ক্যাম্প শুরুঃ
সাড়ে এগারোয় স্পটে পৌঁছে রুগি দেখলাম প্রায় ১২৫ এর কাছাকাছি। যেমন হয় ঝড়ঝঞ্ঝার পর। কিছু জ্বর, ডায়েরিয়া, চর্মরোগ। তবে অধিকাংশই ক্রনিক সমস্যা। অপুষ্টির বাচ্চা। বড়দের প্রেসার সুগার। বেশ কিছু জীবনযুদ্ধের চাপে সোমাটাইজেসান রোগ, অর্থাৎ নানারকম ব্যথা যন্ত্রণা, অম্বল, ঘুমের সমস্যা। কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো রোগ নেই।
যেদিক দিয়ে জল ঢুকেছিল গ্রামের সেই দিকটা একটু ঘুরে দেখলাম। প্রায় আট দশ ফুট উঁচু ভেড়ি ডিঙ্গিয়ে কোথাও বা ভেড়ি ভেঙ্গে জল ঢুকে গেছিল গ্রামে। এক গ্রামবাসী বললেন আয়লা দেখেছেন, আম্ফান দেখেছেন-এত জল কখনো দেখেননি।
একটা মাত্র টিউবওয়েল জলের তলায় চলে গেছিল। ওরা চট প্লাস্টিক দিয়ে কলটাকে মুড়ে দিয়ে নোংরা জল ঢোকা থেকে বাঁচিয়েছিল। প্রথম কিছুদিন সরকার থেকে ড্রামে করে এনে খাবার জলের ব্যবস্থা করেছিল। আমরা যখন গেছি জল সরে গেছে। তবে কিছু পুকুর মাঠ নোনা জলে নষ্ট হয়ে আছে।
দুপুর দুটোয় এখান থেকে উঠে পরের ক্যাম্প পুরকাইৎঘেরিতে যাই। একটা বাচ্চাদের স্কুলে আমরা বসি দুপুরের খাবার খেয়ে। এখানে কমিউনিটি কিচেন চালাচ্ছিল অভিজিৎ, মানোয়ার, অনিমেষ, রাহুল, সংগীতারা বেশ কিছুদিন ধরে। আজকে ওরাই আমাদের সাহায্যকারী স্বেচ্ছাসেবক, ইয়স রিলিফ নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে। নাম লেখা, রুগীকে মাস্ক পরান, ভীড় নিয়ন্ত্রণ করা সব কিছুই করছিল।
দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে আবার রুগী দেখতে শুরু করলাম বিকেল তিনটে থেকে।
স্কুলটা বেশ সুন্দর করে তৈরি। পার্টিশানের ওপর দিকগুলো ফাঁকা। এছাড়া জানালা আছে। ফুরফুরে হাওয়ার সাথে আমরাও ফুরফুরে মেজাজে রুগী দেখছি। চারজন ডাক্তার দেখছি। বয়সে ছোটো সদ্য ডাক্তার আপন, অর্পিতা আর প্রীতিদির সাথে ফার্মেসি সামলাচ্ছে। রুগি বেশ কম। আমরা অরিজিৎদের বলছি আর কি এবার বাড়ি চলে যাই। ওরা বলছে, বসো রুগী আসবেই।
তাই হোলো চারটের আসপাশে ঢেউ এলো। চারজনেও সামলানোই মুশকিল। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। স্কুল ঘর অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। ফিরতে হবে অনেকখানি। তাই সাড়ে পাঁচটাতে নতুন নাম এন্ট্রি বন্ধ করলাম। ফিরে গেল অন্তত কুড়ি ত্রিশ জন। দেখলাম দুশোর মত।
সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। ক্লান্তও আছি।এ ই সময় কয়েকজন বয়স্ক মানুষ ভয়ে ভয়ে এলেন। আমি বসে ছিলাম। একটু দূরেই দেখলাম অনিন্দ্য ব্যাগ ঘাড়ে করে ‘আমি এদের দলের কেউ নই’ মত মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। অগত্যা দেখতে হোলো। আবদারে প্রেসারটাও মেপে দিতে হোলো। পাশের ঘরে তখনো শুনে যাচ্ছি শর্মিষ্ঠা বোঝাচ্ছে কুরকুরে খাবার থেকে সেদ্ধ ডিম খাবার উপকারিতা বেশী। মানস দশ মিনিট ধরে এক বাচ্চার বাবা মাকে বোঝাচ্ছে বুডেসোনাইড শ্বাসনালী কিভাবে খুলে শ্বাস কষ্ট কমায়। মানস হচ্ছে সেই শ্রেণীর ডাক্তার যে পাঁচতারা চেম্বার হোক আর গাছতলায় ক্যাম্প হোক, রোগের মেরিট দেখেই চিকিৎসা করবে, যত সময় লাগে লাগুক।
সব গুছিয়ে নিয়ে ভলান্টিয়ারদের ইচ্ছেতে ওদের সাজানো লাইব্রেরিতে গেলাম। লাইব্রেরিটা মানোয়ারের কাকার উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল। মূলত ধর্মীয় বই রাখা হোতো। আমরাও দেখলাম গীতা বাইবেল কোরানের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। তবে গত একবছর অরিজিতদের মানুষের পাশে থাকার প্রচেষ্টাতে গ্রামের লোককে বোঝাতে পেরেছে অন্য বইও দরকার। এখন গল্প কবিতার বইও আছে। দাবী আসছে কিছু টেক্সট বই রাখার।
ফিরতে ফিরতেঃ
এবার ফেরার পালা। গাড়ি চলছে দ্রুত। আধো অন্ধকারে সাঁতসাঁত করে বেরিয়ে যাচ্ছে গাছপালা বাড়িঘরদোরের সিল্যুট। সবাইকে ঝিমুনিতে পেয়েছে। ভাবছিলাম সত্যি কি একদিন ক্যাম্পে গিয়ে মানুষের খুব উপকার হয়? কেন ক্যাম্প করি?
এর উত্তর সম্ভবত এক এক জনের কাছে এক এক রকম। যে সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছে সে একরকম ভাবে।যে সমাজসেবা করে সে একরকম ভাবে। যে ভগবানে বিশ্বাসী সে একরকম ভাবে। তবে এই কাজটি যে মানুষের পাশে থাকার সৎ চেষ্টা, এ ব্যাপারে সবাই একমত।
এবার নিজেকে প্রশ্ন করলাম। একদিন ক্যাম্প করে মানুষের কি সত্যিই খুব উপকার হয়? উত্তর… না। তাহলে কেন করি? উত্তর…না করে পারি না তাই!
সৎ স্বীকারোক্তির জন্য ধন্যবাদ।
যত টুকু উপকার হয়, শুন্যের থেকে সেটাই তো বেশি!
ডাক্তার বাবু আপনার সৎ স্বীকারোক্তি ও অপূর্ব পর্যবেক্ষণ মুগ্ধ করল।নমস্কার।
ডাক্তার বাবু আপনার সৎ স্বীকারোক্তি ও অপূর্ব পর্যবেক্ষণ মুগ্ধ করল।নমস্কার।আমার email id te vul ache.hobe mookerjeashyamol@gmail.com
শেষ উত্তর টার জন্য মানুষ এখন ও দিন বদলের স্বপ্ন দেখে!
” Na kore pari na tai” … Sotti ato sohoj kore o ato jotil prosner uttor deoa jay!!
অনবদ্য, ভাই।
খুব ভাল লাগলো পড়ে। এরকম মানসিকতার সাথে আরো অনেক অনেক camp হোক এই আশা। করুণাময় তোমাদের মঙ্গল করুন ….?
Sobai Jodi, Somaj er proti nijer role ta ektu ektu kore Korey…then we are miles ahead on “road less travelled” and I guess it’s need courage, which you have Sumit Da.
Best wishes to all in the team.
লেখাটা পড়া এবং উৎসাহ দেওয়ার জন্য সকলকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
এই ভাঙনকালেও কেউ কেউ সাঁকো বাঁধতে ভালোবাসেন। সেই সব আনন্দের অভিযাত্রীদের প্রণাম জানাই।
না গিয়ে থাকতে পারেন না তাই জান, এটা আপনার বা আপনাদের তরফের কথা।
“ডাক্তারবাবুরা এসেছিলেন। তাঁরা কত যত্ন করে আমাদের দেখলেন। ওষুধ দিলেন। আমরা ভালো হয়ে যাব। ওরা আবার আসবেন নিশ্চয়ই ।তখন আজ যারা যাওনি তারা জেও গো।”
আমার মনে হল এটাই ওদের তরফের কথা। এটা একদম ঠিক না হলেও ঠিক এর কাছাকাছি অন্তত।
এই ক্যাম্প করে অন্তত: কিছু মানুষকে বোঝানো যায় যে সমাজকর্মীরা তাদের পাশে বিপদের দিনে এসে দাঁড়ায়।
Kursinsh tomader…