হাতুড়ে যখন বৃদ্ধ, তখন একটা ইউরোলজি ক্যাম্পে প্রাথমিক ঝাড়াই বাছাইয়ের কাজ এসে জুটলো ওনার কপালে। হাতুড়ে ভয়ানক খুশি। একবেলা খাওয়া ফ্রি তার ওপর কত্তো বড়ো ক্যাম্প, কত্তো কত্তো ডাক্তার। ঈলাহি ব্যাপার স্যাপার।
কফি আর বিশকুট (এটাই উপবাস ভঙ্গ!) খেয়ে বেচারা বুড়ো দেখে কেস অতি গুরুচরণ। প্রায় চারশো মানুষের অপেক্ষমাণ সারণী। দুটো মাত্র টয়লেট। তার সামনে ধারাবাহিক উত্তেজনা। কেবা আগে….কেননা কেউই হিসু ধরে রাখতে পারে না। হতমস্তিষ্ক বৃদ্ধ বাইরে এসে দুটো টাটকা সিগারেট সেবন করে মস্তিষ্কের বৌদ্ধিক ক্ষমতা বাড়িয়ে নিজের আশুকর্তব্য স্থির করলেন। ওনার কাজ হলো রোগ অনুযায়ী রোগীকে সঠিক বিশেষজ্ঞের বিভাগে পাঠানো।
ব্যাপারগুলো সহজপাচ্য নয় তাই আমরা ওনার কার্যপ্রণালী পর্যবেক্ষণ করে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করবো।
প্রথমেই বুড়ো চ্যাঁচালেন “যাঁর যাঁর সেরিব্রাল স্ট্রোক বা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে তাঁরা ঘরের পূর্ব কোণায় দাঁড়ান”
প্রথমে পূর্ব দিক সম্বন্ধে একটা গোল হয়েছিল কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দাদের সুচতুর সহযোগিতায় পূর্ব দিঙনির্ণয় করা গেল। হুইল চেয়ার গড়গড়িয়ে পূর্ব দিকে মানুষ জন হাজির।(প্রথম দল)
“যাঁদের মাঝে মাঝেই হি…মানে প্রস্রাবে জ্বালা হয় তাঁরা ঈশান কোণে গিয়ে দাঁড়ান”
তিনশত ঊনপঞ্চাশ জনের প্রবল কলরবে প্রাঙ্গণ মুখরিত হলো। বঙালি রবিঠাকুরের ঈশান কোণে ঈশানি ছাড়া কিছুই জানে না। বুড়ো এই একশত আঠারো জনের দলটাকে উত্তর পূর্ব দিকে বসালেন। (দ্বিতীয় দল) এঁরা সবাই বয়স্ক/বয়স্কা।
“যেনাদের কেবলমাত্র বাথরুমে যাওয়ার কথা ভাবলে জামা কাপড় নষ্ট হয় তাঁরা উত্তর দিকে যান”(তৃতীয় দল)
এবার নির্বাধায় একুশ জনের লজ্জামুখী কম বয়সী/মাঝবয়সী উত্তর দিকে গিয়ে হাজির।
“যাঁদের হি…. মানে প্রস্রাবের পরেও মনে হয় আহা আরেকটু হলেই ঠিক হতো- পুরোটা হয়নি…মনে হচ্ছে আরও রয়ে গেছে তাঁরা বায়ু কোণে উপস্থিত হৌন”
মাঝবয়সিনী মহিলা, বেশী বয়সিনী মহিলা, এবং ফিটফাট বুড়ো, আলুথালু বুড়ো সবাইকার চিৎকারে বায়ু দূষিত হয়ে উঠলো। এবং এবার বৃদ্ধ হাতুড়ে টাক চুলকোতে চুলকোতে সম্ভবতঃ পথনির্দেশক হিসেবেই উত্তর পশ্চিম কোণে গিয়ে দাঁড়ালেন। গনিয়া দেখা গেল এখানে একশত আটত্রিশ জন হাজির। (চতুর্থ দল)
পশ্চিমে গেলো মূলতঃ বাচ্চা এবং বয়ঃসন্ধিকালের ধাড়ি বাচ্চারা। এদের রাত্তিরে নিদ্রাকালে শয্যায় হিসু হয়ে যায়।(পঞ্চম দল)
“এরপর যাহাদের যাহাদের সর্বক্ষণ প্রস্রাব গড়িয়ে পড়তেই থাকে তাহারা নৈঋত কোণে গিয়ে খাড়া হৌন”
লোকে এতক্ষণে বুঝে গেছে দক্ষিণ পশ্চিম কোণটা নৈঋত। এদিকে বেশীরভাগ খুনখুনে (না খুনোখুনির সঙ্গে যোগাযোগ নেই) বুড়ি আর থুত্থুরে বুড়ো হাজির হলো।বয়স্কদের দিকজ্ঞান একটু বেশীই হয়। তারপর ব্রীড়াবনতা কিছু যুবতী ইতস্ততঃ করে করে ওখানে গিয়ে দাঁড়ালো।এদের সংখ্যা প্রায় অষ্টানব্বই। (ষষ্ঠ দল)
“যেনাদের ভারী জিনিস তুললে পেচ্ছাপ হয়ে যায় তাঁরা দক্ষিণ কোণে গিয়ে দাঁড়াবেন। নির্ঝঞ্ঝাটে ঘটনাটা ঘটে গেলো। (সপ্তম দল)
“যাঁদের অনেক ক্ষণ না করলে নিজের থেকে হি….
প্রস্রাব হয়ে যায় তাঁদেরকে অগ্নি কোণে দাঁড়াইতে অনুরোধ করা যাইতেছে” (অষ্টম দল)
হাতুড়েবুড়ো সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে কফি আদেশ করলেন। প্রাতরাশ এটাই এবং যত চাইবেন ততই পাবেন জাতীয় বাক্য বলা আছে। দ্বিপ্রাহরিক ভোজনেও এই কফি সম্বল কিনা ভাবতে ভাবতে বুড়ো কফি ও ধূম্র পান করতে থাকেন। স্বেচ্ছাসেবকরা গোনাগুনির কাজ করে ফেললে বুড়ো পরবর্তীতে যাবেন।
এবার আমরা আদ্যিকালের বদ্দিবুড়োর পরবর্তী কাজে মনোনিবেশ করি।
বদ্যিবুড়ো পূর্ব কোণে গিয়ে প্রথম দলের সেরিব্রাল রুগীদের আলাদা করে নিউরোমেডিসিন এবং ফিজিওথেরাপি বিভাগে পাঠালেন। তারপর অ্যাক্সিডেন্ট রুগীদের লাম্বো স্যাক্রাল মেরুদন্ডের এমআরআই এবং দুই পায়ের নার্ভ কন্ডাকশন ভেলোসিটি স্টাডি করতে পাঠালেন। এই প্রস্রাবের ধারণক্ষমতা লাম্বার স্পাইন থেকে তৈরি হয়। সুতরাং এই পরীক্ষা না করলে এদের চিকিৎসা করা দুঃসাধ্য (ধরে নিতে হবে যে এই স্বাস্থ্য শিবিরে বিনামূল্যে সবাইকার এই পরীক্ষা করার ব্যবস্থা আছে)। তারপর এনারা সবাই নিউরোসার্জারি বিভাগে যাবেন।
এরপর বদ্যিবুড়ো গেলেন দ্বিতীয় দলের কাছে,ঈশান কোণে। সেখানে প্রত্যেকের পেচ্ছাপের রুটিন পরীক্ষা করাবেন কেননা এঁদের প্রস্রাবে জ্বালা হয়। যাঁদের পেচ্ছাপে রক্ত ও পূঁজ পাওয়া যাবে তাঁরা ইউরিনারি ব্লাডারের টিউমার পরীক্ষা বা ইনফেকশন পরীক্ষা করাবেন। বাকিরা সাইকোথেরাপি করাবেন এবং প্রয়োজনে ফিজিওথেরাপি করতে হবে। যে সকল বয়স্কা মহিলার ইউরিন রিপোর্ট স্বাভাবিক আসবে তাঁরা গাইনি বিভাগে যাবেন। অনেক সময় রজোনিবৃত্তির পরে অনেকের পেচ্ছাপে জ্বালা হয়। পুরুষদের আল্ট্রাসাউন্ড বাধ্যতামূলক। প্রস্টেটের ছবি এবং বড়ো প্রস্টেট হলে প্রস্টেট ক্যানসারের পিএসএ রক্ত পরীক্ষা বাধ্যতামূলক”
এ্যাতোটা একটানা বলে বুড়োর গলা হঠাৎ খুব শুকিয়ে কাঠ। খুব বিনীতভাবে এক কাপ ফ্রি কফি যাচ্ঞা করলেন।
কাগজ কাপের কফি নিয়ে উত্তরের দিকে যাঁদের প্রস্রাবের কথা ভাবলেই হয়ে যায় তাঁদের ইউরিন পরীক্ষা করিয়ে রক্ত, পূঁজ কিছু না পেলে ফিজিওথেরাপি বিভাগে যেতে বললেন। (তৃতীয় দল)
বায়ু মানে উত্তর পশ্চিম কোণে যাঁদের ইউরিন করার পরেও মনে হয় রয়ে গেছে, তাঁদের পেটের ইউএসজি ফর রেসিডুয়াল ইউরিন এবং কিডনি ব্লাডারের ছবি করতে পাঠালেন।
যাঁদের বার বার ইউরিন বা ইউরিনারি ব্লাডারে ইনফেকশন হয় তাঁদের ব্লাডারের পেশী নষ্ট হয়ে যায় তখন কিছুতেই পুরোটা হয় না। এছাড়াও প্রস্টেট বা ইউরেথ্রাল স্ট্রিকচার (পেচ্ছাপের নালি অসুখের ফলে বন্ধ হয়ে আসে তাঁদের এটা হতে পারে। (চতুর্থ দল) পেচ্ছাপের নালিতে টিউমারও এ্যামনটা ঘটাতে পারে। এনারা প্রায় সবাই যাবেন ইউরোলজি বিভাগে। কাউকে হয়তো মেডিসিন বিভাগে যেতে হবে তবে সেটাও ইউরোলজি বিভাগ ঠিক করবে।
এরপর বৃদ্ধ গেলেন পশ্চিমে। এখানে পঞ্চম দল, এরা রাত্তিরে বিছানায় হিসু করা বাচ্চারা, হিসেবে আছে। এদের এক্স রে লাম্বার স্পাইন হবে। স্পাইনা বাইফিডা জাতীয় মেরুদন্ডের জন্মগত ত্রুটি থাকলে নিউরোসার্জারি না হলে কিছু অন্যান্য পদ্ধতির ব্যবস্থা আছে। বিদ্যুৎবাহী অ্যালার্ম বা জলপানের অভ্যাস অথবা অভিভাবকদের কিছু জিনিস বোঝানো।
নৈঋতে আছে যাঁদের সর্বক্ষণ হয়েই (ষষ্ঠ দল) যায়।মহিলাদের অনেকেরই স্বাভাবিক বাচ্চা প্রসবের পর থেকে এটা শুরু হয়। ব্লাডার এবং ভ্যাজাইনার দেওয়ালটা ছিঁড়ে যায়। তাঁদের গাইনিতে পাঠানো হলো ভেসিকো ভ্যাজাইনাল টিয়ার রিপেয়ার করতে। অনেকের পায়ুদ্বারও জন্মদ্বারের সঙ্গে জুড়ে যায়। পায়খানা, পেচ্ছাপ,মাসিক সব একই পথে বেরোতে থাকে। তাঁদেরও গাইনিতে পাঠানো হলো।
পুরুষদের আল্ট্রা সোনোগ্রাম করে, ফলাফল অনুযায়ী নিউরো, স্পাইনাল সার্জারি বা ইউরোলজি বিভাগে পাঠানো হলো।
দক্ষিণ কোণের আর অগ্নি কোণের যাঁদের ভারী জিনিস তুললে বা হাঁচলে কাশলে হয়ে যায় অথবা অনেকক্ষণ না করলে যাঁদের ইউরিন হয়ে যায়। (সপ্তম ও অষ্টম দল) এঁদের বেশীরভাগই বয়স্ক। এঁদের হয় ব্লাডার দেওয়ালের পেশী খারাপ না হলে যে নার্ভসমূহ এগুলো চালনা করে সেগুলোর গন্ডগোল। তাঁদের ইউরোলজি বিভাগে চিকিৎসা হবে কিন্তু পেটের আল্ট্রাসোনোগ্রাম করে পাঠানো হবে।
অবশ্যই ব্যতিক্রম থাকে। থাকবেই। না হলে পুরোটাই অপ্রমান হয়ে যায়। এছাড়াও কারো ইউরোফ্লোমেট্রি করতে হতে পারে। তবে আমাদের হাতুড়ের অত জ্ঞান বিদ্যে নেই। উনি দ্বিপ্রাহরিক ভোজনের সন্ধানে গন্ধ শুঁকে শুঁকে ঘুরতে লাগলেন।