মেডিকেল কলেজে রাতের এমারজেন্সিতে বসে হাই তোলার নিয়ম নেই। একান্তই যদি হাই ওঠে তাহলে দুনম্বর গেটের ঠিক সামনের দোকান থেকে একটা সিগারেট আর গরম চা খেয়ে আসতে হয়। দোকানটা সারা রাত্রিই খোলা থাকে।
আজ নাইট ডিউটির প্রায় শুরু থেকেই আমার ঘন ঘন হাই উঠছিল। কতবার ব্যস্ত এমারজেন্সি ছেড়ে চা- সিগারেট খেতে যাওয়া যায়। গতকাল ২৪ ঘন্টা লেডি ডাফরিন হাসপাতালে অনকল ডিউটি ছিল। লেডি ডাফরিনের ডক্টরস রুমের বিছানায় হেব্বি ছারপোকা। একটুও ঘুম হয়নি।
এইটা আমি লক্ষ করে দেখেছি যে প্রায় সব ডক্টরস রুমের বিছানাতেই ছারপোকারা অবাধে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু সিস্টার রুমের বিছানায় ছারপোকা থাকে না। অথচ নিঃসন্দেহে আমাদের মতো চাতাল আর নিকোটিন নির্ভর ডাক্তারদের চাইতে সিস্টারদের চামড়া অনেক নরম এবং রক্তও অনেক মিষ্টি। এই নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করার প্রয়োজন আছে। আমরা যেসব রোগের নাম শোনা যায় না, সেসব জটিল ও বিরল রোগ নিয়ে পাতার পর পাতা থিসিস নামাই। ছারপোকা- ফোকাকে তুচ্ছ বস্তু বলে মনে করি।
শংকর বলল, ‘কী ঐন্দ্রিলদা, তুমিতো প্রায় ঢুলছো। যাও শৈলের দোকানে গিয়ে একটু ফুঁকে আস।’
বললাম, ‘একটু পরে যাব। খানিকক্ষণ আগেই ফুঁকে এসেছি। তুই শুয়ে নে।’
শংকর মেডিসিনের সেকেন্ড ইয়ার পিজিটি। আমি ফার্স্ট ইয়ার। শংকর পদমর্যাদায় আমার সিনিয়র, যদিও বয়েসে কম। আমি পাশ করে সরকারি চাকরি নিয়ে গ্রামে চলে গেছিলাম। ফলে এম ডি করতে গিয়ে বছর চারেক দেরি হয়ে গেছে। সেই সুযোগে আমার অনেক জুনিয়র ছেলে মেয়েই আমার থেকে এগিয়ে গেছে। দুয়েকজন তো আসিস্ট্যান্ট প্রফেসর- ট্রফেসর হয়ে গেছে।
ইন্টার্ন ছেলে দুটো কোথায় গেল কে জানে। একজনের মনে হয় কোনো আত্মীয় অসুস্থ, তাকে নিয়ে খুব ছোটাছুটি করছিলো। এখন আর আশপাশে দেখছি না। মনে হচ্ছে ইসিজির রুমে গেছে।
আবার হাই এর ধাক্কা আসছে। মাথাটা ঝুঁকিয়ে টেবিলে রাখলাম। আহ্ কী আরাম। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি । ঘুম ভাঙতেই ধড়ফড় করে সোজা হয়ে বসলাম। তারপরেই চমকে উঠলাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাশে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। যাব্বা, হাসপাতালের এমারজেন্সিতেও ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি নাকি?
স্বপ্ন নয়। রবি ঠাকুর বললেন, ‘এই যে ডাক্তারবাবু, যদি আমার সমস্যাটা সামাধান করে দেন?’
আমি আরও ঘেঁটে গেলাম। কাঁচা ঘুম ভাঙলে এমনিতেই মাথা কাজ করে না। তার উপর যদি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এসে সমস্যার কথা বলেন তাহলে মাথা আরও আউলা হয়ে যায়।
রবীন্দ্রনাথ হাসলেন। বললেন, ‘ঘাবড়ে যাবেন না। আমার নাম দুখিরাম দাস বহুরূপী। শুধু রবীন্দ্র নাথ নয়, আমি নজরুলও সাজি। এমনকি বাঘ সিংহও সাজি। হারামজাদা ফজলু কি দিয়ে দাড়ি আটকেছে কে জানে। তার পর থেকে শুধু চুলকাচ্ছে। লাল লাল চাকা চাকা দাগ হয়ে গেছে।‘
কিছুক্ষণের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ ভাইরাল হয়ে গেলেন। সিবি টপ থেকে সার্জারির ডাক্তারবাবুরা রবীন্দ্রনাথকে দেখতে এলেন। রবীন্দ্রনাথ তার কালো জোব্বার পেছনে হাত নিয়ে গম্ভীর মুখে ‘কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি’ আবৃত্তি করে শোনালেন। আজ মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেড়িয়েছে। প্রতিবছরের মতোই কয়েকটি ছেলে মেয়ে রেজাল্টে সুবিধা না করতে পেরে ঘুমের ওষুধ, অল আউটের তেল, কেরোসিন ইত্যাদি অখাদ্য ভক্ষণ করে এমারজেন্সিতে এসেছে। তারা ও তাদের বাবা মায়েরা ভিড় করে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের মুখ থেকে তাঁর লেখা কবিতা শুনছেন।
শংকর বলল, ‘বুঝলে ঐন্দ্রিলদা, আমরা এমারজেন্সিতে একটা নোটিশ টানাব “রবীন্দ্রনাথ এখানে চুলকানির চিকিৎসা করতে এসেছিলেন।”
এর মধ্যে আবার হই চই। একটি কম বয়সী ছেলেকে নিয়ে পরিবার শুদ্ধু মানুষ এসেছেন। ছেলেটি ক্যানিং হাসপাতাল থেকে রেফার হয়ে এসেছে। ছেলেটির নাকি ঘামের সাথে রক্ত বেরোচ্ছে। শংকর বলল, ‘হিমাটোহাইড্রোসিসের কথা বইয়ে পড়েছি। চোখে দেখিনি। বিরল রোগ। চলো দাদা, দুজন মিলে ভালো করে কেসটা দেখি।’
ছেলেটিকে দেখে এমনিতে অসুস্থ বলে মনে হচ্ছে না। শুধু গায়ের অনেক জায়গাতেই কালো রক্ত সরু সুতোর মতো জমে রয়েছে। তবে ছেলেটির বাড়ির লোকজনের কাজকর্ম দেখার মতো। একজন মহিলা সুর করে কাঁদছেন, ‘বাবা ইব্রহিম, তোর কী হল রে? কোন জিনে তোরে আছর করলো রে? আল্লা তোমার একেমন বিচার হে?’ আরেকজন দাড়িওয়ালা পীর টাইপের মানুষ ক্রমাগত ছেলেটির কানে আর মাথায় ফুঁ দিচ্ছেন।
রবীন্দ্রনাথ আপাতত আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দুতে নেই। তিনি স্বয়ং ছেলেটিকে হাঁ করে দেখছেন। সম্ভবত ছেলেটিকে নিয়ে তাঁর মস্তিষ্কে নতুন কোনো কবিতা জন্ম নিতে চলেছে।
শংকর করিতকর্মা ছেলে। কোত্থেকে দুটো কাচের স্লাইড আর স্ক্যালপেল নিয়ে হাজির। ইব্রাহিমের গা থেকে শুকিয়ে যাওয়া একটু রক্ত স্লাইডে চেঁচে তুলে ফেলল। তারপর বলল, ‘দাদা, আমি সেন্ট্রাল প্যাথোলজিতে যাচ্ছি। তুমি রবীন্দ্রনাথ আর ইব্রহিম লোদী দুজনকেই আটকে রেখো। পালায় না যেনো।‘
‘ইব্রাহিম লোদি কোথায়? ও তো ইব্রাহিম মণ্ডল।‘
শংকর ততোক্ষণে স্যাম্পেল পকেটে ঢুকিয়ে দৌড় লাগিয়েছে। ফিরল আধ ঘণ্টা পর। ফিরেই ছেলেটিকে এমারজেন্সির ভিতরে ডাকল। ততোক্ষণে ইন্টার্ন ছেলে দুটো চলে এসেছে।
এমারজেন্সির সিনিয়র মেডিকেল অফিসারও হাজির। সবাই এই অদ্ভুত কেসটি সম্পর্কে জানতে ইচ্ছুক। ছেলেটির সাথে সাথে সেই মহিলাও এমারজেন্সিতে ঢুকেছেন। শংকর বলল, ‘আপনি ইব্রাহিমের কে হন?’
‘আমি ওর পিসি। ওরে ইব্রাহিম রে… তোর কী হলো রে…?’
শংকর বলল, ‘এখন ভালোয় ভালোয় চুপ করুন আর আপনার কান সাবধানে রাখুন। অতো আদিখ্যেতা দেখালে ভুবনের পিসির কেস হয়ে যাবে।’
বললাম, ‘ইয়ে শংকর, ওটা ভুবনের পিসি নয়, মাসি হবে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত রয়েছেন, গুলিয়ে ফেলো না।’
শংকর পাত্তা দিল না। বলে চলল, ‘হিমাটোহাইড্রোসিস অত্যন্ত বিরল একটি রোগ। আমাদের ঘর্ম গ্রন্থির ভেতরে প্রচুর সুক্ষ রক্তজালক থাকে। অনেক সময় এই রক্তজালক ফেটে ঘর্মগ্রন্থিতে রক্তপাত হয় এবং তা ঘামের সাথে বেরিয়ে আসে। অতিরিক্ত মানসিক উত্তেজনা, রক্ত তঞ্চনের বিভিন্ন সমস্যা, মেয়েদের মাসিকের সময় এমন দেখা যেতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে এর কোনোটাই হয়নি। আচ্ছা ভুবনের মাসি, এবার কি ভুবন মাধ্যমিক দিয়েছিল?’
‘আজ্ঞে আমি ভুবনের মাসি নই, আমি ইব্রাহিমের পিসি। হ্যা, এবছর ওর মাধ্যমিক ছিল।’
‘রেজাল্ট কেমন হয়েছে? আজই তো রেজাল্ট বেড়িয়েছে।‘
‘আর রেজাল্ট ডাক্তারবাবু… ছেলেটার যা হলো। এমন রোগের কথা জন্মে শুনিনি।’
শংকর ইব্রাহিমের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোর রেজাল্টের খবর কী?’
‘আজ্ঞে ডাক্তারবাবু… রেজাল্ট হাতে পাওয়ার আগেই…’
‘চোপরাও বেয়াদপ… শংকর রীতিমতো ধমক দিল। রেজাল্ট কী হয়েছে বল। সব কটা সাবজেক্টেই ফেল করেছিস নাকি?
ইব্রাহিমের পিসি বিড়বিড় করে বললেন, ‘এ কেমন ডাক্তার? একটা অসুস্থ ছেলেকে অকারণে চোপা করছে… আল্লা এর বিচার করবে।’
ওদিকে ইব্রাহিম বলল, ‘না… মানে ইয়ে…ডাক্তারবাবু, বাংলা আর জীবন বিজ্ঞানে ফেল করি নি।’
‘এবার বল রক্তটা কিসের? পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বুঝেছি ওটা আর যাই হোক মানুষের রক্ত নয়। কিসের রক্ত মেখেছিস বল?’
‘আজ্ঞে মুরগির রক্ত।‘
‘তাহলে ব্যাপারটা যেটা দাঁড়ালো মাধ্যমিকে ফেল করে আমাদের ভুবন বাবু মুরগির রক্ত গায়ে মেখে বাড়ি ফিরলেন। আপাতত তাঁর লক্ষ সকলের নজর অন্যদিকে ফেরানো, যাতে সকলে তাকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং কেউ রেজাল্টের কথা জিজ্ঞাসা না করে। এটা আসলে একটা মানসিক ব্যাধি। নিজেকে বাঁচানোর জন্য বা নিজের গুরুত্ব বাড়ানোর জন্য রোগের আশ্রয় নেওয়া।’
আমি বললাম, ‘জানি, এই রোগের নাম মাঞ্চুরিয়ান সিনড্রোম।‘
শংকর হতাশ ভাবে বলল, ‘দাদা, মাঞ্চুরিয়ান নয় মঞ্চাউসেন সিনড্রোম। আমার সামনে বলছো বলো, চ্যাটার্জী স্যারের সামনে বললে স্যার তোমার প্রেস্টিজের একেবারে মাঞ্চুরিয়ান বানিয়ে দিতেন।‘
বললাম, ‘অনেক পড়াশুনো হলো। চল, চা আর সিগারেট খেয়ে আসি। গুরুদেব, আপনি কী ধুমপান করেন? তাহলে আমাদের সাথে চলুন।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়েই আমারা শৈলের দোকানে এলাম। রবিঠাকুর তাঁর গোঁফদাড়ি সামলে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। আর এক টানে অর্ধেক সিগারেট শেষ করছেন। শংকর বলল, ‘দাদা মাঞ্চাউসেন সিনড্রোম বাই প্রক্সি কী বলো তো?’
আমি বিড়ির ধোঁয়ায় বিষম খেলাম। শংকর দ্বিতীয় প্রশ্ন করল, ‘তুমি টুয়েঙ্কেল দ্বিভেদীর নাম শুনেছো?’
বললাম, ‘ইনি কি সিনেমা আর্টিস্ট? আমি হিন্দি সিনেমা দেখিনা।’
‘হিন্দি সিনেমার সাথে এর চৌদ্দ পুরুষের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি একটি ছোট্ট মেয়ের নাম। যে কাঁদলে চোখের জলের সাথে রক্ত বেরোতো। শরীরের নানা স্থান থেকেই আঘাত ছাড়াই রক্ত বেরিয়ে আসত। তাকে নিয়ে সারা দেশে হই চই পড়ে গেছিল। বিভিন্ন টিভি শোয়ে সে আর তাঁর মা হাজির হোতো। টিভি শোয়ে অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকতেন তান্ত্রিক, জ্যোতিষীদের সাথে দেশের নামকরা চিকিৎসকেরা। মেয়েটি প্রায় ভগবানের অবতার হয়ে উঠেছিল। ঘন্টার পর ঘন্টা সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলি এই অপবিজ্ঞানের চর্চা করত ।‘
আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, ‘তান্ত্রিকদের সাথে চিকিৎসকরা এক মঞ্চে থাকতে রাজি হতেন কেন?’
শংকর হেসে বলল, ‘এই কেনর উত্তর বড়ই জটিল। বিজ্ঞান নিয়ে পড়েও সকলে বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে ওঠে না। যাক গে যা বলছিলাম, শেষ পর্যন্ত একজন যুক্তিবাদী মানুষ সানাল ইডামারুকু ২০১০ সালে পুরো চালাকিটা ধরে ফেলেন। টুয়েঙ্কেলের মা পুরো জিনিসটাই সাজিয়েছিলেন। মেয়ের মাসিকের রক্তের সাহায্যে তিনি সকলকে ঘোল খাইয়ে ছিলেন। দুঃখের বিষয় আমাদের দেশে অপবিজ্ঞান প্রচার করার জন্য চ্যানেল গুলির বা ধর্মগুরুদের কোনো শাস্তি হয়না। আর সানাল ইডামারুকুর মতো যুক্তিবাদী মানুষকে মানুষের ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত করার জন্য দেশ ছাড়তে হয়। তিনি চার্চের কুকীর্তি ফাঁস করতে গিয়ে বর্তমানে ভারত থেকে বিতাড়িত হয়ে ফিনল্যান্ডের বাসিন্দা।‘
‘সে তো হলো। কিন্তু মাঞ্চাউসেন সিনড্রোম বাই প্রক্সি কি দাঁড়াল?’
‘মাঞ্চাউসেন সিনড্রোমের ক্ষেত্রে রোগী নিজেই অদ্ভুত অদ্ভুত রোগের গল্প বানায়। আর মাঞ্চাউসেন সিনড্রোম বাই প্রক্সির ক্ষেত্রে বাবা, মা বা পরিবারের অন্য কোনো সদস্য বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে শিশুর বা বাচ্চার মধ্যে রোগ তৈরী করে। এটা অনেক বেশি মারাত্মক। এমনকি মাঞ্চাউসেন সিনড্রোম বাই প্রক্সির ফলাফল হিসাবে শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। অনেকসময় অপরাধী শিশুদের না খাইয়ে রাখে, ক্ষতিকারক রাসায়নিক দ্রব্য দিয়ে হাত পা পুড়িয়ে দেয়, ইচ্ছাকৃত ভাবে বাচ্চাকে জীবাণু সংক্রমিত করে।’
শৈলর দোকান থেকে যখন এমারজেন্সিতে ঢুকছি তখন ভোরের কোলকাতা আড়মোড়া ভাঙতে শুরু করেছে।