কিছু কিছু মানুষ এমন থাকেন, যাঁদের সঙ্গে সহমত হতে না পারলেও সেই মতটির প্রতি অশ্রদ্ধা বা বিরক্তি প্রকাশ করা যায় না। বরং সেই মত প্রকাশের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা যুক্তিবোধ ও প্রগাঢ় মননের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতেই হয়। মনে হয়, এও শিক্ষণীয়।
আবার অনেকসময় মানুষটাও ব্যক্তিমানুষ হিসেবে এমন হন, যাঁর সঙ্গে মতান্তর হলেও সেটা মনান্তর অবধি গড়াতে পায় না।
স্থবির দাশগুপ্ত – আমার স্থবিরদা – নামের আগে ইচ্ছে করে ডাক্তার লিখলাম না, কেননা তাতে তাঁর বিস্তৃতিকে বড্ড সীমায়িত করে ফেলা হয় – সেই গোত্রের একজন ছিলেন। সেই বিরল গোত্রের মানুষদের অন্যতম ছিলেন।
তাঁর বিস্তীর্ণ কর্মকাণ্ড বিষয়ে আমার জ্ঞান অতি সামান্যই, কাজেই সে নিয়ে কিছু বলার অধিকার আমার নেই। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় তাঁর লেখালিখির সূত্রে – বা বলা ভালো, আমার লেখালিখির সুবাদেই। প্রবন্ধসাহিত্য আমি যেটুকু পড়েছি, যাকে নন-ফিকশন বলে, তা আমার পড়া প্রায় পুরোপুরিই ইংরেজিতে। সুতরাং, শুরুতে, সংবাদপত্রে ইতস্তত প্রকাশিত দু-চারখানা লেখা বাদে, আমি তাঁর নাম বা লেখা, কোনোটির সঙ্গেই সুপরিচিত ছিলাম না। সবই পরে পড়েছি। বরং তিনিই আমার লেখা পড়ে যোগাযোগ করেছিলেন। বলেছিলেন, দিনেদিনে ডাক্তাররা যেরকম কুশিক্ষিত হয়ে উঠেছে, সেখানে তোমার লেখা পড়লে মনে হয়, নাহ্, এখনও আশা আছে। আমাদের সময়টা তো চলে গেল, তোমরা রইলে। পরবর্তী কালে তুমি থেকে তুই হয়ে উঠতে পারার সৌভাগ্য হয়েছিল। আমার নিজের প্রথম বইটির ভূমিকা লেখার অনুরোধ করাতে বলেছিলেন, তোর বইয়ের ভূমিকা লিখব, এ তো আমার পক্ষে সম্মানের ব্যাপার রে! বেসিক্যালি আত্মকেন্দ্রিক যেহেতু, আজ, স্থবিরদা মারা যাওয়ার পরে, স্মৃতি বলতে শুধু এগুলোই মনে পড়ছে।
মতান্তর তো ছিলই। পদে পদেই। মডার্ন মেডিসিনের ছাত্র আমি – স্থবিরদাও, অবশ্যই – পরবর্তী কালে ক্যানসার বিশেষজ্ঞ – স্থবিরদাও তা-ই – কিন্তু পেশায় আমি অধ্যাপক-চিকিৎসকও। কাজেই, সমকালীন চিকিৎসা গবেষণার খোঁজখবর রাখাটা আমার পেশাগত কর্তব্য। সেই সুবাদে আমার অবস্থান হয়ত কোনও এক জায়গায় প্রাতিষ্ঠানিকও। স্থবিরদা সেই অর্থে, প্রতিষ্ঠান-বিরোধী। মনু কোঠারি-র ক্যানসার-বিষয়ক বইটি আমিও কিছু মন দিয়ে পড়িনি – লেখকের গভীর পড়াশোনা এবং মেধাদ্যুতি সত্ত্বেও বইয়ের মুখ্য উপপাদ্য বক্তব্য আমার কাছে অতিসরলীকরণ বলে বোধ হয়েছিল – স্থবিরদা সে বই বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন, সেই বইকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেন, যদিও পরে বলেছিলেন, বইয়ের কিছু অংশ গোলমেলে তো বটেই। তো, আধুনিক বিজ্ঞানের বাণিজ্যিকীকরণ বিষয়ে আমার মনেও প্রশ্ন কম নেই – কিন্তু গবেষণার ফল হিসেবে যা যা উঠে আসছে, তার সুফল শুধুই বাণিজ্যিক, এমনটা মানতে পারি না। মানে, গত কুড়ি-পঁচিশ বছরে ক্যানসারের যা যা নতুন চিকিৎসা বাজারে এসেছে, তার মধ্যে অনেকটাই (হয়ত অধিকাংশই) ঢক্কানিনাদের বেশি কিছু না হলেও, বেশ কিছু তো কাজেরও বটে। রাজহাঁস নাকি দুধ আর জলের মিশ্রণ থেকে দুধটুকু ছেঁকে নিতে পারে – অনেক গল্পকথার মতো এও গুজব বইকি – এমন সময়ে দাঁড়িয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতির মধ্যে থেকে বাণিজ্যিক ঢক্কানিনাদকে আলাদা করাও ততখানিই কঠিন, কিন্তু মিশ্রণে দুধ যে রয়েছে, তা অস্বীকার করার সুযোগ কোথায়! স্থবিরদা, আমার মনে হতো, অস্বীকার করতেই চাইছেন। বিশেষত, অনেক চিকিৎসার সময়, স্থবিরদা যেন পরীক্ষিতভাবে কার্যকরী ওষুধ না ব্যবহার করে পুরনো ওষুধই ব্যবহার করে চলেছেন। আধুনিক গবেষণার বাণিজ্যমুখী ধাঁচ ও তার উপর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ – মনে হতো, তার বিরোধিতা করতে গিয়ে স্থবিরদা যেন গবেষণা ও তার ফলাফল ব্যাপারটাকেই একটা মস্ত বাণিজ্যিক চক্রান্ত হিসেবে প্রত্যাখ্যান করতে চাইছেন। তো মতান্তর সেখানেই হতো। মনান্তর হয়নি, শুধু স্থবিরদার ঔদার্যের কারণেই।
আসলে স্থবিরদারা একটা সময়ের প্রতিনিধি। ঠান্ডা যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, সেই সময়ের – যেকোনও সময় পরমাণু যুদ্ধ বেধে যেতে পারে, এমন একটা সময়ের – প্রতিনিধি। অথরিটি হিসেবে যা যা তুলে ধরা হচ্ছে, তাকেই অবিশ্বাসের চোখে দেখার সময়। যেসময় ইভান ইলিচ তাঁর বই শুরুই করেন এমন বাক্য দিয়ে – “The medical establishment has become a major threat to health. The disabling impact of professional control over medicine has reached the proportions of an epidemic.”
আর আমাদের মাধ্যমিক পাস হতে না হতেই বার্লিন দেওয়াল ভেঙে গিয়েছে। কলেজ পার হতে না হতেই – বিশ্বায়ন সর্বশক্তিমান, কারণ তাহা সত্য। সবাই তো সুখী হতে চায়, সেটাই স্বাভাবিক – কিন্তু মেনে নেওয়া গিয়েছে, কেউ সুখী হয় আর কেউ হয় না – ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিজেকে ওই প্রথম দলে রেখে ফেলতে হবে, এই দৌড়ও আর অনুচিত বোধ হচ্ছে না। এমতাবস্থায় ‘এক্সপার্ট-দের প্রশ্ন না করে নিজেকেই ‘এক্সপার্ট’ করে তোলাটাই স্বপ্ন হিসেবে অনেক বেশি সমীচিন।
অতএব, এক্সপার্ট হয়ে ওঠার রাস্তায় যেতে যেতে আমাদের মনে প্রায়শই প্রশ্ন জাগে – আর স্থবিরদাদের ক্ষেত্রে, প্রশ্ন করাটাই রাস্তা – মতান্তর মতবিরোধ তো প্রত্যাশিতই। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ে, সম্ভবত, আমি অনেকাংশে ‘মঝ্ঝিম পন্থা’-র অনুসারী – আমার যেসব বন্ধু আধুনিকতার প্রবল পূজারী, তাঁরা আমাকে দস্তুরমত সন্দেহ ও বিরক্তির চোখে দেখেন – কিন্তু এই দ্বিধাগ্রস্ত ভাইটির প্রতি স্থবিরদার স্নেহের অভাব কখনোই ঘটেনি। আবার, অনেক ক্ষেত্রেই দ্বিমত হওয়া সত্ত্বেও, স্থবিরদার প্রশ্ন করে চলার ক্ষমতাকে – এবং নিজ বিশ্বাসে স্থিত থাকার ক্ষমতাকে – আমি সম্ভ্রমের চোখে দেখতাম। হিংসেও করতাম, সম্ভবত। অনিয়মিত হলেও, যোগাযোগ ছিলই। বইয়ের খবর চালাচালিও। স্থবিরদা হয়ত নর্টিন হ্যাডলারের কোনও বইয়ের প্রসঙ্গ তুললেন, আমি হয়ত খবর দিলাম গিলবার্ট ওয়েলশ-এর বইয়ের। টুকটাক আলোচনা, মূলত হোয়াটসঅ্যাপেই। আমার যেসব চিকিৎসক-বন্ধু রয়েছেন, অনেকেই দুর্দান্ত পাঠকও বটেন। কিন্তু এই গোত্রের বই পড়ার লোক আজকাল কমে আসছে। এধরনের বইয়ের খবরাখবর দেওয়ার লোক, স্থবিরদা মারা যাওয়ার পর, আমার ক্ষেত্রে আর কেউ রইলেন না। শিক্ষক দিবসের দিনটিতেই স্থবিরদার প্রয়াণ, এ কি আশ্চর্য সমাপতন নয়।
আর যে কথা বলারই অপেক্ষা রাখে না, যেখানে আমি তাঁর তর্কহীন ভক্ত – সেটা স্থবিরদার লেখালিখি। বিষয়, ভাষা, যুক্তি সাজানোর ধারা – স্থবিরদার লেখা থেকে নিত্যদিনই শিখেছি। লেখার মধ্যেই মিশে থাকত তাঁর গভীর পড়াশোনার নির্যাস। স্বাস্থ্য নিয়ে লেখালিখির ছোট্ট ফিল্ডে তো বটেই, বাংলাভাষায় বিজ্ঞান নিয়ে লেখালিখির ক্ষেত্রেও স্থবিরদার বইগুলো স্থায়ী সম্পদ হয়ে থাকবে। দুর্ভাগ্য আমাদের, সেসব বই নিয়ে আলোচনা কমই হয়। শব্দসংখ্যার জালে আবিষ্ট সংবাদপত্রের ছোট্ট কলাম পড়ে যাঁরা স্থবির দাশগুপ্তকে চিনেছেন, তাঁরা বইগুলো না পড়লে স্থবিরদার ব্যাপ্তিটার কোনও আন্দাজই পাবেন না। তো, সেই লেখালিখির দিক থেকেও স্থবিরদা আমার শিক্ষকই ছিলেন।
স্থবিরদার ভাই নিবিড়দা আমার প্রতিবেশী। এই দফার অসুস্থতার খবর নিবিড়দার কাছেই পেয়েছিলাম। ফুসফুসে সংক্রমণ, শ্বাসকষ্ট – সবাই বারবার ভর্তি হতে বলেছিলেন, স্থবিরদা শোনেননি। শুনলে হয়ত… যখন ভর্তি হলেন, তখন আইটিইউ-এ, সরাসরি। রবিবার থেকে ভেন্টিলেটরে। যে হাসপাতালে ভর্তি হলেন, সেখানকার এক পরিচিত চিকিৎসককে ফোন করলাম খবরাখবরের জন্য। অন্য বিভাগের চিকিৎসক, কিন্তু ভেতরের খবরাখবর তো পাওয়া যাবে। স্থবিরদার রাজনৈতিক বিশ্বাসের একেবারে কোণাকুণি বিপরীত প্রান্তে তাঁর অবস্থান – কিন্তু শুনেই বললেন, তুই স্থবিরদাকে কী চিনিস! তুই তো সেদিনের ছেলে রে!! স্থবিরদা ইজ আ স্টলওয়ার্ট, ইন এভরি সেন্স! শেষ দুদিনের খবর যেটুকু পেয়েছি, তাঁর কাছেই। তো, যেকথা বলছিলাম, স্থবিরদা একটা সময়ের প্রতিনিধি। সে এমন এক সময়ও, যখন সম্পূর্ণ বিপরীত মতের মানুষের প্রতিও ব্যক্তিগত শ্রদ্ধাবোধের অভাব ঘটত না।
গতকাল খবরটা যখন পেলাম, আশেপাশে তখন ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। শালগাছের পাতা জলে স্নান করে ওঠার পর কী যে অদ্ভুত এক গভীর উজ্জ্বলতার অনুভূতি জাগায়, তা যিনি দেখেননি, তাঁকে বলে বোঝানো যাবে না। সে উজ্জ্বলতা একইসঙ্গে গম্ভীর – যেন চিরন্তনের বার্তাবাহী – আবার যেন নতুন আশারও দ্যোতক।
পাশে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের বললাম, স্থবির দাশগুপ্ত মারা গেলেন। কেউই চিনতে পারল না। একজন তো বলেই ফেলল, সেটা আবার কে?
উত্তরে কিছু না বললেও হতো। একটু লঘু করেই বললাম, ওই একজন অঙ্কোলজিস্ট আর কি… এছাড়া অন্য কীভাবে স্থবিরকে সংক্ষেপে ইন্ট্রোডিউস করা যায়, ভেবে পেলাম না। ভাবার ইচ্ছেও ছিল না।
আসলে, স্থবিরদাদের সময়টা চলে গিয়েছে। সেই সময়কার ঝলমলে ক্লাবঘর এখন ঝুল পড়ে আগাছা জন্মে একেবারে পরিত্যক্তের চেহারা নিয়েছে। পরিত্যক্ত, কিন্তু বিপজ্জনক। আমরা দুচারজন, স্রেফ আগ্রহবশত, পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ওদিকে দেখতে দেখতে যাই। দেখি, একটা একটা করে জানালা বন্ধ হয়ে আসছে। গতকাল যেমন…
গতকাল খবরটা পাওয়ার সময় পাশে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের বলতেই পারতাম, চেনো না? না চিনলে ক্ষতিটা তোমাদেরই। স্থবিরদার এমনিতেও কিছু যেত আসত না, এখন তো আরও…
নাহ্, কিছু বললাম না। এসব কথা বলার সময়ও, হয়ত, চলে গিয়েছে। আর তাছাড়া, বলতে ইচ্ছেও করছিল না।
অসম্ভব ভালো লাগলো এই স্মৃতিচারণ ও শ্রদ্ধাজ্ঞাপন।ব্যক্তিগত ভাবে আমি স্থবির দাশগুপ্তর একজন গুণগ্রাহী।তাঁর লেখা, তাঁর বক্তৃতা,অনুবাদ সবের ভক্ত।তবে আ মরাও তো সংখ্যালঘু।তার উপর অতি সাধারণ।দিন দিন আরো কমে আসছে আমাদের মত নগণ্য কিন্তু অন্য ধারার ভাবনার মানুষের সংখ্যাটা। ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে স্থবির দাশগুপ্ত কে চেনাতে পারবেন ডাক্তার বিষাণ বসুর মতো ব্যক্তিত্ব