স্যাটিরিক সেনের লেখা
তখন বলে সন্ধ্যাকাল। মাটি পুড়ে লাল হয়ে গ্যাছে। দূরে তাকালে মনে হয় ধোঁয়া উড়ছে। ঘোষের দোকানে বসে’ প্রায়বৃদ্ধ স্যাটিরিক সেন। দোকানের নিভু নিভু ডুমের আলোয় ওনার ভাজা ভাজা মুখখানি সিগারেটের ধোঁয়ায় কিছুটা আচ্ছন্ন। পাশে ঘোষের পো ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে সেনমহাশয়ের সামনের চৌপায়ায় নিঃশব্দে নামিয়ে রাখলো। কাগজের কাপে শব্দ হয় না। দূর আকাশে জষ্ঠি পূর্ণিমার গোলচে লালপারা চাঁদ আর সুদিন একই সঙ্গে উদয় হোলো। আজ অপ্রাকৃত গরমের জন্য বাকি আড্ডাড়ুরা ছাদে অর্ধনগ্ন হয়ে বাতাস খাচ্ছে। সুদিন স্যাটিরিকবাবুকে জাপানি বাউ করে বসলো। ঘোষের পো আরেকটা দুগ্ধজ চা নামিয়ে দিলো। সুদিন এ্যামন আঁৎকে উঠলো য্যানো চাঁদের আলোতেও ছ্যাঁকা খাচ্ছে।ঘোষের পো জিগ্গেস করলো “কী হল্যো বটে? ডর লাগল্য নাকি গ?”
সুদিন দীর্ঘশ্বাস সহ বললো “খবর দেখতে পারছি না। কতো কতো লাশ….”
স্যাটিরিকবাবু নিঃসাড়ে একটা ফ্লেক বার করে’ ঠোঁটে গুঁজে শিখাহীন লাইটার ধরালেন। ওনার তীক্ষ্ণ নাক, তেলতেলে গাল আর খোঁচাখোঁচা রক্তিমতর হয়ে গ্যালো।
সুদিন সিগারেটের আশায় কম্পমান হাত বাড়িয়ে বললো “যে এটা করেছে, সে শালা গ্যাৎচারেৎচোর একটা সাইকোপ্যাথ….”
স্যাটিরিকবাবু লাইটার এগিয়ে দিলেন।
সুদিন একটা দীর্ঘ ধোঁয়াটান দিয়ে বললো “তিনশোরও বেশী লোক মরে গ্যাছে। লাশ….শালা ভাবা যায়? আমরাও তো বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে ট্রেনে যাই….উফফফফফফফ। ভাবতেই বিচি মাথায় উঠে যাচ্ছে……”
“কী কেস ভাই? কে আবার সাইকোপ্যাথ?”
“যে শালা করমন্ডলকে লুপ লাইনে ঢুকিয়ে দিয়েছে… গরম চিমটে দিয়ে জ্যান্ত মাংস ছাড়িয়ে…..”
স্যাটিরিকবাবু পাদপূরণ করেন “কেবাব বানিয়ে খেতে হয় বুঝি?”
“আপনি শালা একটা হাপগান্ডু, ম্যানিয়াপাগল…” সুদিন আর ভাষা খুঁজে পায় না।
সেনমহাশয় সুড়ুৎ করে চায়ের ওপরে জমে থাকা সরটুকু টেনে ন্যান। “শোনো হে ছোক্রা, এখন ভারতীয় রেল রুট রিলে ইন্টারলকিং সিস্টেমে চলে। কিচু বুইলে?”
বামহস্তে জ্বলে নগ্ন বিড়ি, ডানহাতে সে চুলকায় টাক। এই অবস্থায় সুদিন প্রশ্ন করে “সেটা কী হয় সেনমহাশয়?”
“যে পয়েন্টটা বদলে গাড়িটাকে লুপ লাইনে ঢোকাতে হবে-সেটা বাস্তবে অসম্ভব”
“ক্যানে গো সাতিরিবাবু?” দ্যাখা গ্যালো ঘোষের পো’ও উৎসাহী।
সুদিন ব্যঙ্গ করে “আপনি সবজান্তা নাকি? মন্ত্রী সান্ত্রী সবাই ওখানে বসে’ আছে… আমি কক্ষণো বাপের জন্মে শুনিনি মন্ত্রী অ্যাক্সিডেন্টের জায়গায় এ্যাকটানা বস্থেকে উদ্ধার করছে….তদন্তে বলে’ দিলো….হ্যাঃ….এয়েচেন কোথাকার কোন বালের ছাল….আপনি এখানে বসে’ সব দেখতে পাচ্ছেন….সব সময় ইয়ে ভালো লাগে না”
স্যাটিরিকবাবু অবাক (বাক্যহীন অবস্থায়) সশব্দে চুমুক আর নিঃশব্দে ধোঁয়া গিলতে থাকেন।
“সাতিরিবাবু তুমিই বল্য বটে তাইলে কি হতে পারে” ঘোষের পো প্রকাশ্যে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরেক পাত্তর চা এগিয়ে দ্যায়। এটার দাম পাবে না, জেনেও।
“তাইলে আপনি এখানে বসেই জানতে পারেন যে স্টেশন মাস্টারদের কেউ এটা করে নি। যত্তসব আগজুবি, গ্যাঁজাখোর…” সুদিন গজগজ করতে থাকে।
“দ্যাখো হে প্যানেলরুমের চাবি দুজনের কাছে থাকে। যাতে যে কোনও একজন এই কাজটা না করতে পারে এবং পয়েন্টের লাইন বদলানো পুরোটা ইচ্ছে করলে খন্ডমুহূর্তেরও ছবি পাওয়া যায়”
সুদিন এবং ঘোষের পো হাঁ। “তাহলে দুজনে মিলে?….এ্যাঁ?”
“না, সেটাও সম্ভব নয়, ক্যানোনা যদি পয়েন্টের লাইন বদলানোর সময় যদি…”
“যদি কী?” যুগলের হাহাকার।
“সামনে আস্ত একটা ট্রেন তো দূরস্থান, যদি একটা পাতা অথবা ছোটো নুড়িও লুপ লাইনের জোড়ে আটকে থাকে তাহলে কেউ সিগন্যাল সবুজ করতে পারবে না। সেক্ষেত্রে স্টেশন মাস্টার ওপরোলার সঙ্গে কথা বলে’ ফর্ম T/369(3B) পূরণ করে’ পয়েন্টসম্যানকে দিয়ে ড্রাইভারকে পাঠাবেন। তারপর সেটা নিয়ে ট্রেন ঘন্টায় পনেরো কিলোমিটার গতিতে পয়েন্টসম্যানকে সঙ্গে নিয়ে পরের স্টেশন পর্যন্ত যাবে।”
“এরকম কখন কখন হতে পারে?” সুদিনের সুচিন্তিত প্রশ্ন।
“হুম হতে অবশ্যই পারে। সিগন্যালে পাওয়ার চলে গেলে, কেব্ল চুরি, ট্র্যাক সার্কিট বা এক্সটার্নাল কম্পোনেন্ট ফেইলিউর।”
“তা ত্যঁ বুজলম গ্য কিন্তুক এরকমটা কি আগে হয় নাই বটে?” ঘোষের পো সহজ মনে একটা জটিল প্রশ্ন করেই ফ্যালে।
ধূম্রজাল রচনা করতঃ স্যাটিরিকবাবু বলেন “এই বছরেই তো….মনে হচ্ছে ফেব্রুয়ারিতে, এরকম ভুল সিগন্যাল পেয়ে একটা এক্সপ্রেস মালগাড়ির পেছনে চলে যায়। কিন্তু গতি কম থাকায় সেরকম কিছু খবর তৈরি হয়নি। তখনই এই স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালের রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে কথা ওঠে… রক্ষণাবেক্ষণ….ঘোঁৎ টিকটিকির লাদি, দ্ধুস্সালা বাড়ি ফিরে হাট থেকে একটা মুর্গালড়াইয়ের কচি মোরগ এনেছি। রান্না করিগ্যা”