আজকের গল্পটার চারজন নায়ক আছেন। তার মধ্যে দু জন কবি, একজন আবার নোবেল পুরষ্কার পাওয়া, একজন বিশ্ব খ্যাত চিত্রকর , আরেকজন হলেন এক ডাক্তার। গল্পটা বলতে একটু দেরি হয়ে গেল। এক কবির জন্মদিন গেছে কয়েকদিন আগেই, ১২ই জুলাই। সে দিন বলতে পারলে ভালো হতো, সময়ের অভাবে লিখতে না পারার জন্য সুধী পাঠক মার্জনা করবেন।
গল্পের প্রথম নায়ক এক কবি, গল্পটা শুরুর আগেই মারা গেছেন। গল্পের শুরুটা ১৯৩৯ সালের চৌঠা আগস্ট তারিখে। ইউনিপেগ বলে একটা ছোট্ট জাহাজ ফ্রান্সের পইলাক বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে চিলির (বা চিলে) ভ্যালপেরাইজো বন্দরের উদ্দেশ্যে। এই যাত্রা শুরুর মূল কারিগর চিলির বছর ছত্রিশের এক কবি যিনি সম্ভবত স্প্যানিশ ভাষায় সর্বকালের সেরা কবি, নাম পাবলো নেরুদা।
সময়টা উত্তাল। একটানা গৃহযুদ্ধের পরে ইন্টারন্যাশনাল বিগ্রেড পরাজিত, বিজয়ী ফ্যাসিস্ট একনায়ক ফ্র্যানকো দখল করে নিয়েছেন গোটা দেশটা। মরিয়া প্রজাতন্ত্রীরা দলে দলে দেশ ছাড়ছেন। তাঁদের একটা বড় অংশ ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টির সাহায্যে পিরেনিজ পর্বত টপকে ফ্রান্সে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
চিলির কনসাল হিসেবে স্প্যানিশ রিপাবলিকে কাজ করার সুবাদে নেরুদা খুব লাভ থেকে ফ্যাসিস্টদের কার্যকলাপ দেখেছিলেন। স্বাধীনতা ও সংস্কৃতির ওপর এই আক্রমণ তাঁর মনকে গভীর ভাবে বিচলিত করেছিল। বিশেষত যাঁর হাত ধরে স্পেন তথা ইউরোপের শিল্পী সাহিত্যিকদের সাথে নেরুদার যোগাযোগ শুরু সেই তরুণ স্প্যানিশ কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা যখন ১৯৩৬ সালে ফ্যাসিস্টদের হাতে খুন হয়ে যান, তারপর থেকে নেরুদার দৃষ্টিভঙ্গিতে বড় পরিবর্তন আছে, আসে তাঁর কাব্য রচনার শৈলীতে। বামপন্থী নেরুদা হয়ে ওঠেন পুরোপুরি কমিউনিজমের সমর্থক।
ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা
ফ্রান্সে পালিয়ে আসা এইসব স্প্যানিশ শরণার্থীদের জন্য নিজের দেশ চিলি হবে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আশ্রয় স্থল এই চিন্তা থেকে নেরুদা তার দেশের রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করেন তাঁকে ফ্রান্সে কনসাল হিসেবে নিয়োগ করার জন্য এবং ওই গৃহহীন প্রজাতন্ত্রীদের চিলিতে জায়গা দেওয়ার জন্য। আগুরী কেরদা প্রথম অনুরোধটা রাখলেও দ্বিতীয়টার ক্ষেত্রে টালা বাহানা করেন। তাঁকে খুব বেশি দোষ দেয়া যায় না। চিলির বিরোধী দক্ষিণপন্থী দল গলো এই আশ্রয় দেয়া দিয়ে তীব্র বিরোধিতা করে। শেষমেষ রাষ্ট্রপতি রাজি হয়ে যান।
নেরুদার সামনে তখন আর এক চ্যালেঞ্জ। দু চারজন করে শরণার্থী পাঠানোর বদলে উনি চেষ্টা করতে থাকেন যদি একসাথে অনেক জনকে পাঠানো যায়। একমাত্র উপায় হল জাহাজ। যাত্রীবাহী জাহাজ ভাড়া করা প্রায় অসম্ভব। তখন নজরে আসে এই উইনিপেগ। ছোট জাহাজ, আদতে মালবাহী। তাকে এবার যাত্রীবাহী বানিয়ে তুলতে হবে। থাকার শোয়ার জায়গা, ল্যাভেটারি, ছোট ডিসপেনসারি মায় ছোটখাটো নার্সারি।
অর্থের প্রয়োজন। পাগলের মতো চেষ্টা করতে লাগলেন নেরুদা। ইউরোপ থেকে ল্যাটিন আমেরিকা, সমস্ত চেনাজানা মানুষজনের কাছে হাত পারলেন। নিরাশ করেন নি কেউ এই বিশ্বখ্যাত কবিকে। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন পাবলো পিকাসোও।
পাবলো পিকাসো
টাকা যোগাড় হল। জাহাজের খোল নলচে পাল্টে ফেলা হল। যাত্রা শুরু করলো উইনিপেগ। যাত্রী কমবেশি ২০০০ শরণার্থী। শিন্ডলার লিস্টের শিন্ডলার বাঁচিয়ে ছিলেন প্রায় বারোশ মানুষকে।
কতগুলি অসীম সাহসী মানুষ যারা বুক চিতিয়ে নিজের দেশে ফ্যাসিস্টদের মোকাবিলা করেছিল তারা অতল সাগরের বুকে মোচার খোলার মতো পুঁচকি জাহাজে চড়ে পাড়ি দিল হাজার মাইল। অচেনা অদেখা দেশ। কেবল ভাষাটা এক।
কপর্দক শূন্য ওই মানুষগুলোকে সাদর অভ্যর্থনা করার জন্য জাহাজঘাটে প্রেসিডেন্ট কেরদা পাঠিয়েছিলেন তাঁর মন্ত্রিসভার তরুণ স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে, যাঁর নাম ডাক্তার সালভাদর আয়েন্দে। শরণার্থীদের প্রথম পা চিলির মাটিতে পড়ার আগেই তাদের সমস্ত ক্লান্তি সমস্ত আশঙ্কা হাওয়ায় উড়ে গেল। আয়েন্দের নেতৃত্বে জয়ধ্বনি দেয়া সমবেত জনতা গলা ছেড়ে গাইছে স্প্যানিশ প্রতিরোধের সেই সব চেনা গান।
ডাক্তার সালভাদর আয়েন্দে
নেরুদা জীবনে বহু অবিস্মরণীয় কবিতা রচনা করে গেছেন। কিন্তু তাঁর নিজের ভাষায়, “ধোঁয়া ছেড়ে ফ্রান্সের বন্দর থেকে বেরিয়ে যাওয়া উইনিপেগ-এর দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল, এটাই আমার জীবনে রচিত শ্রেষ্ট কবিতা।” লোহা লক্কর, কয়লা দিয়ে তৈরি কবিতার রচয়িতা নেরুদা আমাদের শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন একজন কমিউনিস্টের কাছে প্রলেতারি আন্তর্জাতিকতার মানেটা কি।
কবিতা কি তাই ?
কবিতা কি শুধু তাই ?
মনের খেয়ালে কাগজে-কলমে
শব্দ সাজাই ?
কবিতা কি শুধু রম্য-রচনা
ফুল পাখি আর চাঁদের জোছোনা
প্রিয়ার সঙ্গে জল-তরঙ্গ
নৌকো ভাসাই ?
কবিতা কি শুধু “ওমর খয়াম”
অথবা বিরহী যক্ষের নাম
প্রেমের অনলে একাকিনী জ্বলে
“বিরহিনী রাই” ?
কবিতা বন্দী চার-দেওয়ালে
তোমার আমার চোখের আড়ালে
কবিতাকে আনো রাজপথে আজ
মিছিলে চাই॥
সেলাম, কবি, তোমাকে সেলাম।