দ্বিতীয় বিশ্ব মহাযুদ্ধে জার্মানি সহ অক্ষশক্তির পরাজয়ের পিছনে অনেক কারণ ছিল। তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল ইংল্যান্ডের Bletchley Park-এর একদল কোড ব্রেকারের অবদান। এঁরা কেউ ছিলেন বিজ্ঞানী, কেউ অঙ্কের জিনিয়াস, কারুর প্রতিভা আবার ছিল ক্রস ওয়ার্ড পাজল বা শব্দ ছক সমাধানে। এঁরা সবাই মিলে জার্মান কোড বানানোর মেশিন এনিগমা-র কোড ব্রেক করার পাল্টা মেশিন বানিয়ে ফেলেছিলেন। আমাদের আজকের কাহিনীর নায়ক ছিলেন তাঁদেরই অন্যতম একজন। নাম অ্যলান টুরিং।
ক্রিপ্টো-এনালিস্টের পাশাপাশি উনি ছিলেন বিজ্ঞানী, অঙ্ক শাস্ত্রবিদ, দার্শনিক, আধুনিক কম্পিউটার এর অন্যতম জনক। যুদ্ধ জয়ে ওই অবদানের জন্য কেমব্রিজ ও প্রিন্সটনের এই প্রাক্তন মেধাবী ছাত্রটির কপালে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান সহ আন্তর্জাতিক খ্যাতির এর পাশাপাশি বদনাম জুটে ছিল।
নিজের সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন নিয়ে অল্প বয়সে টুরিং একটু বিভ্রান্ত ছিলেন। সুদর্শন চেহারার জন্য মেয়ে বন্ধুরাও আকৃষ্ট হত। সেই কোড ভাঙ্গার দিনগুলোতে ১৯৪১ সালে টুরিং তাঁর সহযোগী ক্রিপ্টো-এনালিস্ট জোয়ান ক্লার্ককে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়ে ফেলেন। পরে নিজের সেক্সুয়ালিটি সম্পর্কে সচেতন হয়ে সেই প্রস্তাব তুলে নেন, জোয়ানকে সব খুলে বলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দুজনে এর পরেও সারাজীবন ভালো বন্ধু হিসেবে কাটিয়েছেন। এর প্রায় বছর দশেক বাদে টুরিং-এর যৌনতার দিকটি সর্বসমক্ষে আসে। একটি চুরির ঘটনয় সাক্ষ্যদানকে ঘিরে টুরিং-এর সেই সময়ের সঙ্গী আর্নল্ড মারে ও টুরিং পুলিশের জেরার মুখে পড়েন এবং টুরিং তখন স্বীকার করতে বাধ্য হন আর্নল্ড এর সাথে তার সম্পর্কের প্রকৃত রূপ।
এর পরের ইতিহাসটা বেদনাদায়ক। সেই সময়ের ইংল্যান্ডের আইন অনুযায়ী পুলিশ দুই বন্ধুকে অভিযুক্ত করে আদালতে তোলে। দু জনেই নিজেদের “দোষ” স্বীকার করে নেন। মারে শর্ত সাপেক্ষে ছাড়া পান। টুরিং-এর ক্ষেত্রে আদেশ হয়, তাঁকে কেমিক্যাল ক্যাস্ট্রেশন করাতে হবে। ডাই ইথাইল স্টীলবোস্ত্রেরল নামের হরমোন ইনজেকশন নিতে বাধ্য করা হয়।
১৯৫৪ সালে নিজের বিয়াল্লিশতম জন্মদিনের চোদ্দদিন আগে টুরিং মারা যান। তাঁর মৃতদেহের পাশে পাওয়া যায় সায়ানাইড বিষ মেশানো আপেল। করোনার রায় দেয় টুরিং আত্মহত্যা করেন (টুরিং এর মা মানতে চান নি এই রায়)।
.২০০৯ সালে এক সমকামী সম্প্রদায় (LGBtQ) দের গণআন্দোলনের ফলে সে সময়ের ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন তাদের কাছে ক্ষমা চান সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন এর ফলে তাদের ওপরে ঘটে যাওয়া নানান অন্যায় অবিচার হেনস্থার জন্য। রানী এলিজাবেথ এর পরে টুরিংকে তাঁর তথাকথিত অপরাধের জন্য মরণোত্তর ক্ষমা প্রদান করেন 2013 সালে। সমকামিতার অভিযোগে এযাবৎ কাল অভিযুক্ত শাস্তিপ্রাপ্ত সবাইকে একই সাথে ক্ষমা করা হয় ওই আইন বলে যা অ্যলান টুরিং আইন নামে পরিচিত।
আমাদের দেশে ২০১৮ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি বললেন “আমাদের ক্ষমা চাওয়া উচিত” উনি আরো বললেন “Members of LGBT community members and their family members are owed an apology from society for being denied equal rights over the years,”। এত বছর লেগে গেল ঘোষণা করতে যে সমকামিতা কোনও অপরাধ নয়।
মাত্র এক চল্লিশ বছর বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়া সেই অসম্ভব প্রতিভাবান বিজ্ঞানী, যাঁকে অনেকেই আধুনিক কম্পিউটারের জনক বলে মেনে চলেন সেই টুরিং এর আজ জন্মদিন। সমস্ত হোমোফোবিয়া ত্যাগ করে আজ শপথ নেয়া যাক যে আজ থেকে ভারতে মানুষে মানুষে ভালোবাসা, সে যেমনই হোক না কেন, তাকে আমরা অপরাধ হিসেবে ভাববো না, উদ্ভট বলে ভাববো না, মানসিক রোগ বলে ভাববো না, ঘেন্না করবো না। কোনো টুরিংকে আর যেন সায়ানাইড মেশানো আপেলে কামড় দিতে না হয় কোনোদিন। ঘেন্নার থেকে ভালোবাসার শক্তি অনেক, অনেক বেশি।
“কারা যেন ভালোবেসে
আলো জ্বেলে ছিল
সূর্যের আলো তাই নিভে গিয়েছিল।”
২৩শে জুন, ২০২৩