স্বল্প প্রাককথন
পার্থ চট্টোপাধ্যায় তাঁর “ইতিহাসের উত্তরাধিকার” (নিম্নবর্গের ইতিহাস, সম্পাঃ গৌতম ভদ্র ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়, আনন্দ, ১৯৯৮, পৃঃ ১২১-১৬০) প্রবন্ধে বলছেন – “সেকুলার ইতিহাস চর্চার সংকট এইখানেই – আজকের রাষ্ট্রনীতির সঙ্গে জাতীয়তার ইতিহাসের সামঞ্জস্য আনা। সংকট এইজন্য যে জাতীয়তার যে ইতিহাস গত শতাব্দী থেকে লেখা হয়ে এসেছে, তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে রয়েছে এমন সব কাহিনী, ধারণা, ব্যাখ্যা যা আজকের উগ্রহিন্দু প্রচারের প্রধান উপাদান।” ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারের রাজাবলী (১৮০৮) দিয়ে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের আলোচনা শুরু। রাজাবলী কার্যত পৌরাণিক উপাদান সমৃদ্ধ হিন্দু বিবরণ বললেও অত্যুক্তি করা হয়না। এই বইটি নিয়ে উইলিয়াম ওয়ার্ড (শ্রীরামপুরের বিখ্যাত ত্রয়ী কেরি-মার্শমম্যান-ওয়ার্ডের একজন) তাঁর A View of the History, Literautre, and Mythology, of The Hindoos: Including a minute Description of their Manners and Customs, and Translations from their Principal Works গ্রন্থের (শ্রীরামপুর থেকে ১৮১৮ সালে প্রকাশিত) ২য় সংস্করণ-এ বলছেন – “The work compiled by Mrityoonjŭyů , a bramhŭn , and published in the year 1808, and from which the above history, beginning from the kúlee yoogi, has been principally drawn, describes the effects of the Músůlman power, when it became predominant, on the different Hindoo kingdoms in Hindoost’hanŭ; most of which were subdued by it.” (পৃঃ ২৬) ইউরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত এবং আলোকপ্রাপ্ত ওয়ার্ডেরও নজরে এসেছে রাজাবলী-র ইতিহাসের ঢং-এ পৌরাণিক চরিত্র এবং প্রধানত হিন্দু-মুসলমান সংঘাতের কাহিনী বলা। পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলছেন – “বঙ্কিমের যুগে এসে পৌরাণিক আর ঐতিহাসিক কালের মধ্যে যে তফাৎ করা হবে, পৌরাণিক বিবরণের থেকে ইতিহাসের মালমসলা বের করার পদ্ধতি নিয়ে যে আলোচনা হবে, মৃত্যুঞ্জয়ের চিন্তায় তা আভাসটুকুও নেই।” মৃত্যুঞ্জয়ের মতো যারা ইতিহাস রচনা করেছেন তারা একটি কাজই মনোযোগ দিয়ে করেছেন – হিন্দু গরিমায় উজ্জ্বল একটি ঐতিহাসিক স্মৃতি গড়ে নেওয়া। আবার বিপরীতদিকে, মুসলমান রচয়িতা যারা তাদের কাছে মক্কা এবং মহম্মদের গরিমা কীর্তন প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এরকম যে ইতিহাস লেখার একটি জাতীয়তাবাদী তথা হিন্দু ইতিহাস লেখার উদ্যোগ শুরু হল সেখানে, পার্থ প্রশ্ন করছেন, “তাহলে হিন্দু নয় অথচ ভারতের অধিবাসী, এমন জনগোষ্ঠীর স্থান কোথায়?” তারিণীচরণ চট্টোপাধ্যায়ের লেখা জনপ্রিয় ভারতবর্ষের ইতিহাস (১৮৫৮ থেকে ১৮৭৮ সালের মধ্যে ১৮টি সংস্করণ হয়েছিল) আলোচনা করতে গিয়ে বলছেন – “রাষ্ট্র সার্বভৌমত্বের আধুনিক চিহ্ন রামচন্দ্রের হাতে পত্পত্ করে উড়ছে, এ-ছবি একশো বছর আগের ইংরেজি-শিক্ষিত বাঙালি ব্রাহ্মণের কল্পনায় সহজেই এসে গিয়েছিল।” জাতীয়তাবাদীর কাছে প্রাচীন ভারত হয়ে উঠল তার ক্লাসিকাল আদর্শ। ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকেই জাতীয়তাবাদী চেতনায় ইতিহাস রচনার সাথেই সংপৃক্ত হয়ে আছে সাম্প্রদায়িক বোধের বিকাশ।
পার্থ তাঁর পর্যবেক্ষণে জানাচ্ছেন – “বস্তুত জাতীয়তার অর্থ হিন্দু জাতীয়তা, এই ধারণাটিকে কোনও প্রাক-আধুনিক ধর্মীয় মতাদর্শের বলে ভাবলে মারাত্মক ভুল করা হবে। ধারণাটি সম্পূর্ণ আধুনিক। আধুনিক অর্থেই তা যুক্তিবাদী; অযৌক্তিক আচার-ব্যবহার কুসংস্কার বিরোধী। আধুনিক অর্থেই তা রাষ্ট্রকেন্দ্রিক; রাষ্ট্রের অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে কট্টরপন্থী এবং সমাজনীতি নির্ণয় ও সংস্কারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে বিশ্বাসী।” (পৃঃ ১৫৩)
এরকম এক প্রেক্ষিতে ভারতে জাতীয়তাবাদের ঊষালগ্ন আত্মপ্রকাশ করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে আমাদের প্রথম আলোচ্য চিকিৎসক-বিজ্ঞানসাধক মহেন্দ্রলাল দত্তের শিক্ষাঙ্গন ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজের অন্যতম লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রের অনুগত সুশীল, বাধ্য, শৃঙ্খলাপরায়ণ এবং রাষ্ট্রের নির্দেশ পালনের উপযোগী ‘নাগরিক’ তৈরি করা। জাতীয়তাবাদের প্রাথমিক অবস্থান ছিল কখনো একে অস্বীকার করে, কখনো একে মান্যতা দিয়ে এক দোলাচলের মধ্যে। উপনিবেশিক রাষ্ট্রে উপনিবেশ-কে অতিক্রম করে স্বাধীন বিজ্ঞান সাধনার অগ্রদূত হচ্ছেন মহেন্দ্রলাল সরকার।
প্রসঙ্গত, বাংলায় জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের (১৯০৫-১৯১০) পূর্ণ বিকাশের আগে এক সলতে পাকানোর বেশ লম্বা ইতিহাস আছে। স্মরণ করুন, ১৮৫৭-র সিপাহীদের মহাবিদ্রোহের স্মৃতি তখনো শিক্ষিত সমাজের একাংশের মাঝে ফিকে হয়ে যায়নি। এই বিদ্রোহকালে বাঙালি সমাজের নিরন্ন, খেটে খাওয়া বেশিরভাগ মানুষই ছিলেন বিষয়টি সম্পর্কে উদাসীন। “কিন্তু ইংরেজের অনুগ্রহপুষ্ট বাংলার জমিদার, ধনী ব্যবসায়ী, চাকুরিজীবী এবং শিক্ষিত সমাজের একটা অংশ ব্যস্ত হয়ে উঠলেন সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশে। এইকালের বাঙালি পত্রিকা-সম্পাদকরা হয় ছিলেন ধনী জমিদার অথবা কোনও-না-কোনভাবে ইংরেজের ওপর নির্ভরশীল।” সংবাদ প্রভাকর-এর সম্পাদক ইংরেজরা দিল্লি পুনরুদ্ধার করলে সহর্ষে তিনি লেখেন –
“ভারতের প্রিয় পুত্র হিন্দু সমুদয়
মুক্ত মুখে বল সবে ব্রিটিশের জয়।” (স্বপন বসু, ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী – ১৮৫৭-র বিদ্রোহঃ সমকালীন বাংলা ও বাঙালি, ২০০৭, পৃঃ ৫১)
আবার এর বিপরীত চিত্র এবং ব্যাখ্যাও শিক্ষিত সমাজের মধ্য থেকে তৈরি হচ্ছিল। বিদ্রোহ শুরু হবার অল্পদিনের মধ্যে হরিশচন্দ্র মুখার্জির হিন্দু পেট্রিয়ট ‘দি কান্ট্রি অ্যান্ড দ্য গবর্ণমেন্ট’ নামে একটি লেখায় বলা হয় – “এটি আর সৈন্যবাহিনীর বিদ্রোহমাত্র নয়, পরিণত হয়েছে এক গণ অভ্যুত্থানে। বাংলার সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক এই অভ্যুত্থানের একটি বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ার মতো। শুরু থেকেই বিদ্রোহীরা দেশবাসীর সহানুভূতিপুষ্ট। দেশবাসী তাঁদের একটি মহৎ জাতীয় উদ্দ্যেশ্যে নিবেদিতপ্রাণ শহিদ বলে মনে করেন।” (পূর্বোক্ত, পৃঃ ৫৬) এখানে উল্লেখযোগ্য, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএ সিলেবাসে ১৯০৬ সালের আগে বাংলার কোন “compulsory paper” ছিলনা। (সুমিত সরকার, The Swadeshi Movement in Bengal 1903-1908, পৃঃ ১৫১)
যেসমস্ত স্বাধীন চিন্তকদের ওপরে (১৯০৫-১৯১০-এর জাতীয়য়তাবাদী আন্দোলনের আগে) জাতীয়তাবাদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে তাঁদের মধ্যে মহেন্দ্রলাল সরকার (২ নভেম্বর, ১৮৩৩ – ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯০৪) অগ্রগণ্য।
(মহেন্দ্রলাল সরকার এবং IACS-এর আদি বিল্ডিং)
আমরা প্রায় সবাই জানি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় এমডি হচ্ছেন মহেন্দ্রলাল। প্রথম এমডি ছিলেন চন্দ্রকুমার দে। মেডিক্যাল কলেজ থেকে ১৮৬০ সালে মেডিসিন, সার্জারি এবং মিডওয়াইফারি সর্বোচ্চ অনার্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েট হন। ১৮৬৩ সালে বিশেষ কৃতিত্বের সঙ্গে এমডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপরে Bengal Branch of British Medical Association-এ যোগ দেন। অল্পদিনের জন্য তিনি এ সংগঠনের সম্পাদকও হয়েছিলেন। সেসময়ে তিনি ঘোরতর হোমিওপ্যাথি বিরোধী ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি হোমিওপ্যাথিচর্চায় বিশ্বাস করতে শুরু করেন। সহ-সভাপতি হিসেবে ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৮৬৭ সালে তিনি বার্ষিক মিটিংয়ে “On the supposed uncertainty in medical science, and on the relationship between diseases and their remedial agents” শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করেন (পরে এই শিরোনামেই পুস্তক হিসেবে এটি প্রকাশিত হয়) – আধুনিক মেডিসিনের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা এবং হোমিওপ্যাথির প্রসঙ্গ নিয়ে। এর পরিণতিতে তাঁকে ব্রিটিশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন থেকে বিতাড়িত করা হয়। এই বইয়ের উৎসর্গপত্রে তিনি লিখেছিলেন – “To The Medical College of Calcutta – An Institution, Which Has Done, More Than Any Other under British Rule, in Diffusing the Blessings of Western Science in India, This Humble Attempt at Catholicism in Medicine, is Inscribed, as A Slight Tribute of Gratitude, by the Author”।
১৮৭৬ সালে মহেন্দ্রলাল প্রতিষ্ঠা করেন ভারতের প্রথম স্বাধীন বিজ্ঞান সাধনা ও গবেষণার প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অফ সায়ান্স (IACS)। অতি ঘটনাবহুল এর জন্ম, বৃদ্ধি ও বিকাশের ইতিহাস। আমি এ নিয়ে বিশদ আলোচনা থেকে বিরত থাকছি বর্তমান আলোচনার জন্য যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক নয় বলে।
IACS-এর গোড়ার যুগে একটি মূল্যবান বক্তব্য রেখেছিলেন মহেন্দ্রলাল – বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যৌগপদ্যে গড়ে ওঠা সভ্যতা এবং এরকম সভ্যতার মাঝে বাস করা চিন্তাহীন নিষ্কর্মা মানুষকে নিয়ে তাঁর ধারণা – “Nay, it is not right that we should continue to be not only the idle spectators of the wonders of science, but remain the unproductive recipients of the comforts daily heaped upon us as it were by its practical achievements. This last fact renders it imperative upon us all that we should be workers ourselves and help the onward march of humanity. We are so constituted that we must either go forward, or be driven backward, we cannot remain stationary. These is an immense difference between the civilized man and the man happening to live in civilized times; between the man of science and the man whom accident has placed in the era of science … The very fact of being born at this stage of the world’s history is indeed in itself a privilege, but with such privilege, to remain as ignorant as the man of the stone period, is not a matter of unspeakable shame, but an awful irresponsibility. To whom much has been given, of him much shall be required.” (Mahendralal Sircar, “On the Necessity of National Support to an Institution for the Cultivation of Science,” in Collected Works of Mahendralal Sircar, Eugene Lafont and the Science Movement (1860-1910), ed. Arun Kumar Biswas (Kolkata: The Asiatic Society, 2003), 73-74)
এখানে আমরা মহেন্দ্রলালের করা বিভাজনটি খেয়াল করি। তিনি “সিভিলাইজড ম্যান” এবং “সিভিলাইজড টাইম”-এ জন্মানো মানুষের মাঝে প্রভেদ করছেন। প্রকৃত অর্থে তিনি বোঝাতে চাইছেন বিজ্ঞানের বিস্ময়কর অগ্রগতির সাথে যুক্ত মানুষ এবং ঘটনাচক্রে এরকম সময়ে জন্মেছে বলে “সিভিলাইজড” মানুষ – এ দুটিকে এক নিঃশ্বাসে বলা যাবেনা। তাঁর কথায় বলা যায়, যদি এরকম সময়ে জন্মেও কেউ স্বাধীনভাবে মৌলিক চিন্তাভাবনা না করে তাহলে তাকে প্রস্তর যুগের মানুষ বলা যায়। শুধু তাই নয়, এ কাজ না করা একধরনের অকথিত ঘৃণার জন্ম দেয়, এ কাজ একটি ভয়াবহ দায়িত্বজ্ঞানহীনতা। হয়তো কথাগুলো কঠোর। কিন্তু রূঢ় সত্যি, আজ একুশ শতকের ভারতবর্ষে এবং পৃথিবীতে।
এর আগে উত্তরপাড়া হিতকরী সভার “লিটারারি ব্র্যাঞ্চের” মিটিং-এ (১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৮৭২) মহেন্দ্রলাল “On the desirability of a national institution for the cultivation of the sciences” শীর্ষক একটি দীর্ঘ বক্তব্য পাঠ করেন। এটি পরে আলাদা প্রবন্ধ হিসেবে (সাথে আরও অনেকের বক্তব্য ও মিনিটস সমেত) ৪৮ পৃষ্ঠার প্রবন্ধ হিসেবে ছাপা হয় (Indian Journal of History of Science, vol. 29, Supplement, 1994, pp. S1-48)।
এই অভিভাষণের প্রায় সূচনাতেই তিনি বলেন – “How is it that we can scarcely name a single individual who may be said to be pursuing with steadiness any branch of science? How is it that the Medical College of Calcutta, which has been in existence for nearly half a century, and within whose walls some of the noblest of the physical sciences are practically and experimentally taught, has not yet turned out a single student who has even thought of cultivating any of these sciences for which such ample foundation has been laid during his term in the College?” (পূর্বোক্ত, পৃঃ S-2)
১৯০৩ সালে প্রকাশিত ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় এবং অমৃতলাল সরকার সংকলিত ভারতবর্ষীয় বিজ্ঞান সভা – ইহার সংখেপবৃত্তান্ত ও অভাব পুস্তকের ভূমিকায় সংকলকরা জানান – “আমাদের দেশে যাহাতে বিজ্ঞান শাস্ত্রের আলোচনা হয়, সেই সম্বন্ধে ১৮৬৯ খৃষ্টাব্দে অর্থাৎ তেত্রিশ বৎসর পূর্বে, চিকিৎসা বিষয়ে একখানি মাসিক পত্রে (ক্যালকাটা জার্নাল অফ মেডিসিন), ডাক্তার মহেন্দ্র লাল সরকার একখানি প্রবন্ধ লিখিয়াছিলেন। ভারতবর্ষীয় বিজ্ঞান সভার ইহাই প্রথম সূচনা।”
এই পুস্তক থেকে জানা যায়, ১৯০২ সালে IACS-এর ২৪তম বার্ষিক সভায় মহেন্দ্রলাল এক বিজ্ঞানীকে উদ্ধৃত করে বলেন যে একজন রবার্ট কখ অথবা একজন লুই পাস্তুরকে ১,০০০,০০০ টাকায় কিনলেও সেটা সস্তা হবে। আমেরিকাতে প্রতি ১,৫০০ মানুষের মধ্যে ১ জন ছাত্র আছে, ব্রিটেনে যা প্রতি ২,০০০-এ ১ জন। জার্মানিতে যেখানে ২২টি ইউনিভার্সিটির জন্য বছরে ৭৫৩,০০০ পাউন্ড এবং ফ্রান্সে ১৬টি ইউনভার্সিটির জন্য বছরে ৭৪০,০০০ পাউন্ড খরচ করা হয়, সেখানে গ্রেট ব্রিটেন এবং আয়ারল্যান্ড ইউনিভার্সিটিগুলোর জন্য বছরে ১৩৫,৩৩৯ পাউন্ড খরচ করেই সন্তুষ্ট থাকে। উপনিবেশিক বিজ্ঞানের বিকাশের সংকট বোঝাতে এই তথ্যই যথেষ্ট।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য তথ্য হল – মহেন্দ্রলাল ২৩তম বার্ষিক সাধারণ সভায় সভাপতির ভাষণে জানান যে IACS-এ ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি ছাড়াও জুলজি এবং ফিজিওলজি পড়ানো হচ্ছে। এবং ছাত্ররা ওখানে এই বিষয়গুলো পড়ে বিএসসি বসতে পারছে। যেহেতু কলকাতার (এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের তো বটেই) কলেজগুলোতে সায়ান্স ল্যাবরেটরি যথেষ্ট উন্নত নয়।
আজ থেকে প্রায় ১২৫ বছর আগে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানের সমতুল্য পঠনপাঠন IACS-এ সুরু করেছিলেন মহেন্দ্রলাল। এমনই ছিল তাঁর স্বাধীন বিজ্ঞান সাধনার লক্ষ্যে নিবেদিত সমগ্র জীবন ও প্রয়াস।
কাদম্বিনী গাঙ্গুলি (১৮৬১-১৯২৩)
তারিখটা ছিল ৩ অক্টোবর। সাল ১৯২৩। একজন চিকিৎসক তাঁর প্রাত্যহিক নিয়মে একজন রোগী দেখে দুপুরে বাড়িতে ফিরলেন। তিনি নিজেও উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিলেন। শরীরে অস্বস্তি হচ্ছিল। নিজে ভালো বোধ করছিলেন না। সন্ধেবেলায় প্রয়াত হলেন। সেরকম কোন চিকিৎসাই হলনা। কিংবা বলা ভালো চিকিৎসার হাতিয়ারই বিশেষ ছিলনা তখন উচ্চ রক্তচাপের জন্য। মারা গেলেন শুধু কলকাতা, বাংলা বা ভারত নয়, সমগ্র দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার প্রথম মহিলা যিনি চিকিৎসাবৃত্তিকে জীবনের ধর্ম, জীবনের সাধনা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি কাদম্বিনী গাঙ্গুলী। জন্মের সাল তারিখ জানা যায় ১৮ জুলাই, ১৮৬১। যদিও সংসদ বাঙ্গালী চরিতাভিধান অনুযায়ী জন্মের তারিখ ৮ মে – একেবারেই রবীন্দ্রনাথের সমবয়সী। তাঁর জীবন নিয়ে কথা বলার সুবাদেই এসে পড়বে তাঁর সময়কালে চিকিৎসার চালচিত্র, সামাজিক-ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং নারী হিসেবে সমাজের যে বিশেষ ভার ও সংঘাত বহন করতে হয়েছে সেসবের কথা। ১৫০ বছর উজিয়ে এসে আমাদের নতুন করে ফিরে দেখতে হবে সেসমস্ত দিনগুলি। হয়তো বা আমাদের মনে একবারের জন্য উঁকিও দিয়ে যেতে পারে যে আমরা এই মহীরুহ বা টাইটানদের তুলনায় কতটা গুল্মজাতীয় বা বামন।
(কাদম্বিনী গাঙ্গুলী – উইকিপিডিয়া থেকে সংগৃহীত)
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে মহিলা ছাত্রদের ভর্তি করা নিয়ে চিন্তাভাবনা ১৮৭৬ সাল থেকে শুরু হয়। সে সময়ের বাংলার লেফটন্যান্ট গভর্নর স্যার রিচার্ড টেম্পল এ বিষয়ে উৎসাহী ছিলেন। ১৮৮১-তে প্রধানত ভর্তি হতে উৎসাহী ছাত্রীদের অভিভাবকদের চাপে এডুকেশন ডিপার্টমেন্ট মেডিক্যাল কলেজের কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয় “discussing the question of accepting an inferior admission qualification for lady students.” (Centenary Volume, 1935, p.46) এই দলিলের ভাষ্য অনুযায়ী সম্ভবত ১৮৮৪ সালে প্রথম মহিলা হিসেবে কাদম্বিনী গাঙ্গুলি অ্যাডমিশন নেন (বা বলা ভালো অ্যাডমিশনের অধিকার পান)। উল্লেখ করা দরকার যেহেতু অক্সফোর্ড এবং কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে মহিলাদের প্রবেশাধিকার ছিলনা সেজন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ মহিলাদের ভর্তির ব্যাপারে গররাজি ছিল। কাদম্বিনী এর আগে ১৮৮০ সালে First Arts (FA) পরীক্ষা পাশ করেন। ১৮৮২-তে কাদম্বিনী এবং চন্দ্রমুখী বসু যুগ্মভাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভারতের প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট হিসেবে উত্তীর্ণ হন।
মেডিক্যাল কলেজের ক্লাসেও পুরুষ ছাত্রদের তরফে কটূক্তি সহ্য করতে হয়েছে কাদম্বিনীকে। এবং বিশেষ করে একজন শিক্ষকের (ডঃ আর সি চন্দ্র) নিতান্ত ব্যক্তিগতভাবে কাদম্বিনীর বিরুদ্ধে বিরূপতার কারণে (এর প্রধান কারণ ছিল এই ভদ্রলোক প্রবল নারীশিক্ষা বিরোধী ছিলেন) মেটেরিয়া মেডিকা এবং কম্প্যারেটিভ অ্যানাটমির পরীক্ষায় কাদম্বিনী অকৃতকার্য হন মাত্র এক নম্বরের জন্য। ফলে তাঁর পক্ষে এমবি ডিগ্রি অর্জন করা হলনা। কিন্তু সেসময় পর্যন্ত কলেজের প্রিন্সিপালের বিশেষ ক্ষমতা ছিল পাশ করানোর। ইউনিভার্সিটি তৈরি হলেও এই বিশেষ ধারাটি তখনও বাতিল করা হয়নি। সে ক্ষমতার বলে তৎকালীন প্রিন্সিপাল ডঃ জে এম কোটস কাদম্বিনীকে GBMC (Graduate of Bengal Medical College) ডিগ্রি দেন। ১৮৮৬ সালে আরেক বীর নারী আনন্দবাই যোশীর সাথে (যদিও আনন্দবাই আমেরিকার পেনসিলভ্যানিয়া মেডিক্যাল স্কুল থেকে পাশ করেন) প্রথম ভারতীয় নারী হিসেবে মেডিক্যাল গ্র্যাজুয়েট হলেন। সরকারের তরফে মহিলা ছাত্রদের জন্য মাসিক ২০ টাকা স্কলারশিপের ব্যবস্থা করা হয়। স্কলারশিপের “retrospective effect” হিসেবে কাদম্বিনী ১৮৮৩-র জুলাই মাস থেকে তাঁর প্রাপ্য স্কলারশিপের সুবিধে পান (অঞ্জনা চট্টোপাধ্যায়, উইমেন সায়ান্টিস্টস ইন ইন্ডিয়াঃ লাইভস, স্ট্রাগলস অ্যান্ড অ্যাচিভমেন্ট, ২০১৮, পৃঃ ১৪১) এরপরে একক একজন মহিলা হিসেবে পাড়ি দেন ইংল্যান্ডে ১৮৯২ সালে।
এখানে উল্লেখ করা দরকার, কাদম্বিনী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ব্রাহ্মসমাজের একজন সক্রিয় নেতা তথা কর্মী এবং নারীমুক্তির প্রশ্নে সোচ্চার ও সামাজিক/শ্রমিক আন্দোলনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত দ্বারকানাথ গাঙ্গুলির সাথে। তাদের বিবাহের ফসল ৫ জন সন্তান। দ্বারকানাথ বিপত্নীক ছিলেন। তাঁর প্রথম পক্ষের সন্তানের সংখ্যা ৩ জন। মোট ৮ জন সন্তানকে মানুষ করেছেন কাদম্বিনী। সংসার সামলেছেন, কলকাতায় রীতিমতো প্র্যাকটিস করেছেন, সামাজিক সংস্কার আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়েছেন, এমনকি রাজনৈতিক কাজেও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। ২১ শতকেও এর তুলনা মেলা ভার। আমরা এঁদেরকে স্বীকৃতি জানাতে না পারলে, অন্তরের শ্রদ্ধাটুকু নিবেদন করতে না পারলে আমরা মানুষ হিসেবে বামন থেকে বামনতর হয়ে থাকবো। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় তাঁর এক কন্যা জ্যোতির্ময়ী পরে রাজনীতিতে যুক্ত হন এবং পুত্র প্রভাসচন্দ্র সাংবাদিকতায় যান।
যাহোক, ১৮৯৩ সালের ২৩ মার্চ তিনি ইংল্যান্ডে পৌঁছন। ১৩ এপ্রিল, ১৮৯৩-এ তিনি “Triple Diploma” কোর্সের জন্য ফর্ম পূরণ করে জমা দেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএ এবং মেডিক্যাল কলেজের GBMC ডিগ্রি থাকার জন্য নিতান্ত স্বল্প সময়ে পরীক্ষায় বসার যোগ্যতা অর্জন করেন। অবশ্য তার আগে তাঁকে রয়্যাল কলেজ অফ ফিজিসিয়ানস এবং রয়্যাল কলেজ অফ সার্জনস-এ ক্লাস করতে হয়। অবশেষে ১৮৯৩ সালের জুলাই মাসে এডিনবার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কটিশ কলেজ থেকে “Triple Diplomas” – LRCP (Licentiate of the Royal College of Physicians), LRCS (Licentiate of the Royal College of Surgeons, University of Glasgow) এবং LFPS (Licentiate of the Faculty of Physicians and Surgeons, University of Dublin) – ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। ফিরে আসেন দেশে। সেবছর মোট ১৪ জন Triple Diplomas পায়। তিনি ছিলেন একমাত্র মহিলা (বি কে সেন, “ফিমেল গ্র্যাজুয়েট অফ ব্রিটিশ এম্পায়া্র – কাদম্বিনী গাঙ্গুলি”, সায়ান্স রিপোর্টার, জুলাই, ২০১৪)। ঐতিহাসিক ডেভিড কফ সঙ্গতভাবেই মন্তব্য করেছেন – “becoming the first fully qualified woman physician in India. Mrs. Ganguly’s case was hardly typical even among the more emancipated Brahmo and Christian women in contemporary Bengali society.” (David Kopf, The Brahmo Samaj and the Shaping of the Modern Indian Mind, 2015, p. 125) একই সাথে প্রসূতিবিদ্যা এবং শিশুরোগের বিষয়ে কাদম্বিনী বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
ইংল্যান্ডে যাবার আগে ১৮৮৮ সালে তিনি ‘লেডি ডাফরিন উইমেন’স হসপিটাল’-এ চিকিৎসক হিসবে যোগ দেন। সেসময় তাঁর মাসিক মাইনে ছিল ৩০০ টাকা (বর্তমান মূল্যে প্রায় ৪৫০,০০০ টাকার সমান)। এর সাথে জড়িয়ে একটি ছোট ইতিহাস আছে। ভারতীয় মহিলাদের চিকিৎসার দুরবস্থার কথা মাদ্রাজের চিকিৎসক মেরি শারলিয়েব এবং অন্যান্যদের কাছে শুনে রাণী ভিক্টোরিয়া তৎকালীন ভাইসরয়ের স্ত্রী লেডি ডাফরিনকে বলেন মহিলাদের চিকিৎসা ও প্রশিক্ষণের জন্য একটি ফান্ড তৈরি করতে। সালটা ছিল ১৮৮৫। সরকারের তরফে কিছু অর্থ সাহায্যও করা হয়। কিন্তু প্রধান অর্থ সাহায্য আসে এদেশের ধনী পার্শি সম্প্রদায়ের কাছ থেকে, ধনী বাঙ্গালীরাও এতে কিছু পরিমাণে অংশগ্রহণ করে। এই ফান্ডের নাম হয় ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়শন ফর সাপ্লায়িং ফিমেল এইড টু দ্য ফিমেল অফ ইন্ডিয়া (সংক্ষেপে ডাফরিন ফান্ড)। (ডেভিড আর্নল্ড, কলোনাইজিং দ্য বডি, পৃঃ ২৬২-২৬৩) এই ফান্ডের টাকায় কলকাতায় লেডি ডাফরিন উইমেন’স হসপিটাল তৈরি হয়। এবং নারী চিকিৎসকেরা কিছু পরিমাণে প্রশাসকের ভূমিকাও পালন করছিলেন। নারীদের জন্য চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটি physical-social space তৈরি হল। এ ঘটনা ঐতিহাসিক। এর আগে ভারতে কখনো ঘটেনি। আর্নল্ড মন্তব্য করছেন – “It was possible for women doctors to “colonize” this social and professional space precisely because it was largely inaccessible to male physicians, and though the latter were (as the editorials in the Indian Medical Gazette attest) initially hostile to the development, there seems to have been a more ready acceptance than in Britain at the time that women had a distinctive role to perform.” (আর্নল্ড, কলোনাইজিং দ্য বডি, পৃঃ ২৬১)
উল্লেখযোগ্য, ১ ডিসেম্বর, ১৮৮৭, বিখ্যাত ফ্লোরেন্স নাইটেংগেল শারলিয়েবকে (মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজ থেকে ১৮৭৮ সালে পাস করা ভারতের প্রথম ইংরেজ এলমএস ডাক্তার) একটি চিঠিতে লিখলেন – “I am so stupid I cannot find my memorandum of the name of that Hindu lady [Ganguly] who will graduate at Calcutta next spring as a qualified medical woman and whom her cousin, a friend of mine, Mrs. Manmohun Ghose, of Calcutta, asked me to mention to Lady Dufferin. But I shall find the memorandum and then by your kind leave ask you.”
এরপরে ২০ ফেব্রুয়ারি, ১৮৮৮, নাইটেংগেল শারলিয়েবকে আবার লিখলেন – “Do you know or could you tell me anything about this lady Mrs. Ganguly, or give me any advice?… asked me to recommend Mrs. Ganguly, if she is successful, to Lady Dufferin, for any post about the female wards in Calcutta. Mrs. Ganguly is, I believe, a young woman of high caste and cultivation and it would be a great encouragement to the Hindu ladies to embrace medicine if she were appointed. The Hindu lady’s name is Mrs. Kadambini Ganguly still studying in the Medical College at Calcutta; [she] has already passed what is called the first licentiate of medicine and surgery examinations and is to go up for the final examination March next. (This young lady, Mrs. Ganguly, married! After she had made up her mind to become a doctor! And has had one; if not two children since. But she was only absent thirteen days for her lying-in! And did not miss, I believe, a single lecture!!) (Florence Nightingale on Social Change in India, ed. Gerard Valle, 2007, pp. 763, 764)
একজন গর্ভবতী নারী তাঁর পূর্ণ গর্ভাবস্থায় সন্তান প্রসবের আগে মাত্র ১৩ দিন কলেজের ক্লাস বাদ দিয়েছেন বা বলা ভালো ক্লাসে আসা সম্ভব ছিলনা। বাকি সময়টা আর সবার মতো নিয়মিত ক্লাস করে গেছেন – এ ঘটনা আরেক মহাদেশের ও ভিন্ন সংস্কৃতির নাইটিংগেলকে বিস্মিত এবং চমৎকৃত করেছে। ১৫০ বছর পরেও আমাদের বিস্মিত ও মুগ্ধ করে – কি অদম্য ইচ্ছা শক্তি ও মনের জোর থাকলে এটা করা সম্ভব! বর্তমান সময়েও এমনটা ভাবা দুষ্কর।
অথচ লেডি ডাফরিন হাসপাতালে ইংরেজ চিকিৎসকদের সমতুল্য মর্যাদা তিনি পাননি। সেখানেও উপনিবেশ কালের এবং নারী হবার যন্ত্রণা তাঁকে বহন করতে হয়েছে। একদিকে ইংরেজদের সাথে সমান মর্যাদা পাবার জেদ, অন্যদিকে স্বাধীন নারী হিসেবে তাঁর চিকিৎসক সত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করার দুর্মর দৃঢ়তা তাঁকে বোধ করি ভিন্ন মাত্রার শক্তি জুগিয়েছে। তাঁর জীবনের দুটো ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করা যায়।
কলকাতার এক সম্পন্ন বাড়িতে এক প্রসূতির সফলভাবে প্রসব করানোর পরে কাদম্বিনী এবং তাঁর সহকারীকে বারান্দায় যেখানে বাড়ির কাজের লোকের খাবার দেওয়া হ্য় সেখানে খেতে দেওয়া হয়েছিল এবং নিজেদের বাসন ধুয়ে রাখতে হয়েছিল। এমন অভিজ্ঞতাও তাঁকে সঞ্চয় করতে হয়েছে। সেসময়ের সমাজে একজন মহিলা চিকিৎসককে একজন ধাই-এর উন্নত সংস্করণের অতিরিক্ত কিছু ভাবার মানসিক জগৎ জন্ম নেয়নি। তাঁর পেশাগত জীবনে রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল একজন পুরুষ চিকিৎসক একজন নারীর পেটে টিউমার হয়েছে বলে ডায়াগনোসিস করেন। কিন্তু কাদম্বিনীর ডায়াগনোসিস ছিল মেয়েটি গর্ভবতী এবং তিনি পরবর্তীতে সফলভাবে সন্তান প্রসব করান। ১৮৯৫-৯৬ সালে তিনি নেপালের রাজমাতার ব্যক্তিগত চিকিৎসকের দায়িত্ব পান। (বি কে সেন, প্রাগুক্ত)
১৮৮৭ সালে কাদম্বিনী যখন মেডিক্যাল কলেজ থেকে স্নাতক হচ্ছেন সেবছরেই তাঁর স্বামী দ্বারকানাথ গাঙ্গুলির লেখা “Slave Trade of Assam” ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে কে কে মিত্র সম্পাদিত জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্র সঞ্জিবনী-তে। দ্বারকানাথ আক্ষরিক অর্থে একজন অ্যাক্টিভিস্ট ছিলেন। আসামের বিভিন্ন অঞ্চলে পায়ে হেঁটে ঘুরে শ্রমিকদের অবর্ণনীয় অবস্থা এবং নিদারুণ শোষণ প্রত্যক্ষ করেন। পরে সহযোগী হিসেবে পান বিপিনচন্দ্র পালকে। কংগ্রেসের অধিবেশনে আসামের শ্রমিকদের অবস্থা উত্থাপনও করেছিলেন। সাফল্য আসেনি। কংগ্রেসের সর্বভারতীয় নেতৃত্ব একে প্রাদেশিক বিষয় বলে এড়িয়ে যান। ফলে যা হবার তাই হল। দ্বারকানাথদের উদ্যম সর্বভারতীয় স্তরে এসে অর্থহীন হয়ে গেল। (নির্মল সিনহা, ফ্রিডম মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল ১৮১৮-১৯০৪, ১৯৬৮, পৃঃ ৪১৫-১৬)
১৮৮৯ সালে বম্বেতে কংগ্রেসের পঞ্চম জাতীয় সম্মেলনে স্বর্ণকুমারী দেবী, পণ্ডিতা রমাবাই, কাদম্বিনী সহ মোট ৬ জন মহিলা প্রতিনিধিকে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন দ্বারকানাথ এবং তাঁর সহযোগীরা। কংগ্রেসের অধিবেশনে সেটাই হল প্রথম মহিলা প্রতিনিধিত্ব। বোম্বে অধিবেশনের পরের বছর ১৮৯০-এ কলকাতায় কংগ্রেসের জাতীয় সম্মেলনে কাদম্বিনী ইংরেজিতে বক্তব্য রাখেন। ১০ জানুয়ারি, ১৯১০, সঞ্জীবনী পত্রিকায় প্রতিবেদনে বলা হল – “The last Congress saw more than a hundred native ladies. And not only did native ladies attend the Congress, but one of them, Mrs. Kadambini Ganguly, B.A., even addressed the assembly. How delighted was it to see one of India’s daughters addressing such an assembly in English!” (নির্মল সিনহা, ফ্রিডম মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল ১৮১৮-১৯০৪, ১৯৬৮, পৃঃ ৫৫৬-৫৭)
ইংরেজিতে তাঁর সুললিত বক্তব্য সম্মেলনের প্রতিনিধিদের মাঝে আলোড়ন (stir) তৈরি করে। এখানে আমরা খেয়াল করবো নিশ্চয়ই যে কলকাতা সম্মেলনে ১০০ জনের বেশি মহিলা প্রতিনিধিত্ব থাকা। অথচ একবছর আগে সংখ্যাটা ছিল ৬। এক নতুন জাতীয়তাবাদী জাগরণের উন্মেষকাল তখন।
১৯০৬ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে মহিলাদের সম্মেলন সংগঠিত করেন কাদম্বিনী। ১৯০৮-এ ট্রান্সভালে গান্ধির নেতৃত্বে যে আন্দোলন চলছিল তাকে সমর্থন করে কলকাতায় মিটিং সংগঠিত করেন। ১৯১৪ সালে গান্ধির সম্মানে আয়োজিত সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সভাতে সভাপতিত্ব করেন কাদম্বিনী। আসামের শ্রমিকদের দুরবস্থা মোচনের জন্য দ্বারকানাথ যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন সে উদ্যোগের সহগামী ছিলেন তিনি। ১৯২২ সালে কবি কামিনী রায়ের সাথে বিহার এবং উড়িষ্যায় যান কয়লা খনিতে শ্রমিকদের অবস্থা সরেজমিনে দেখার জন্য। (বি কে সেন, প্রাগুক্ত)
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে নারী ছাত্রীদের ভর্তি না করার যে প্রথা চালু ছিল ১৯১৫ সালে কাদম্বিনী প্রকাশ্যে সে প্রথাকে আক্রমণ করেন। কেন নারীরা ডাক্তারি শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে এ প্রশ্ন স্পষ্ট ভাষায় উচ্চারণ করেন। (চন্দ্রানী সাধ্য, “ওয়ান অফ দ্য পায়োনিয়ারস ইন ওয়েস্টার্ন মেডিসিন – ডঃ কাদম্বিনী গাঙ্গুলি”, Aegafum Journal, 2020, p. 965) মনে রাখতে হবে, এর আগে কংগ্রেসের সম্মেলনে তাঁর ভাষণ এবং কয়লা খনির শ্রমিকদের সাথে সরকারি কমিটির সদস্য হিসেবে যুক্ত হবার সুবাদে তাঁর বক্তব্যের সামাজিক গুরুত্ব ও ওজন ছিল। ১৯১৫-র পরে নারীদের মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র হিসেবে ভর্তি হবার ব্যাপারে একেবারেই কোন বিধিনিষেধ রইলনা বলা চলে।
ভাগ্যিস কাদম্বিনী নির্ভয়া বা হাথরাসের ঘটনা দেখে জাননি। হয়তো বিমূঢ় হয়ে যেতেন এটা স্বাধীন ভারতের ঘটনা ভেবে। তিনি তো উপনিবেশ কালের নারী। স্বাধীন ভারতের জন্য এমন বার্তা রেখে যাবার কথা ঘোর দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেননি নিশ্চয়ই!
শম্ভুনাথ দে (১ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৫ – ১৫ এপ্রিল, ১৯৮৫)
একজন আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতনামা ইনফর্মেশন সায়েন্টিস্ট ইউজিন গারফিল্ড তাঁর “Mapping Cholera Research and the Impact of Sambhu Nath De of Calcutta” গবেষণাপত্রে (Current Comments, Number 14, April 1986) জানিয়েছিলেন – “De and colleagues also published highly cited pioneering studies on V. cholerae action on the intestinal membrane. The 1953 paper “An experimental study of the mechanism of action of Vibrio cholerae on the intestinal mucous membrane” is De’s most-cited paper, cited 340 times since its publication. De passed away just before we wrote to ask him for a Citation Classic@ commentary.”
রবার্ট কখ যেখানে থেমেছিলেন (কলেরার জীবাণুর আবিষ্কার) সেখান থেকে শম্ভুনাথ দে-র যাত্রা শুরু – তার পরবর্তী ধাপে এগিয়েছেন তিনি। ১৯৫৩ সালের অক্টোবর সংখ্যায় Journal of Pathology and Bacteriology-তে প্রকাশিত তাঁর পেপার “An experimental study of the mechanism of action of V. cholerae on the intestinal mucous membrane”-এ দেখালেন যে জীবাণুর শরীর থেকে নিঃসৃত এক্সোটক্সিন কলেরা রোগীর ডায়ারিয়ার কারণ। তাঁর এই গবেষণাপত্রে তিনি বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন কিভাবে খরগোশের ওপরে পরীক্ষা করেছিলেন – “Rabbits weighing 1200-1500 g. were not allowed food or water for twenty-four hours. With aseptic precautions and local procaine anaesthesia, a midline incision about two inches long was then made just below the middle of the abdomen, which was opened by cutting through the muscles and peritoneum. A segment of small intestine taken midway between its upper and lower ends was isolated with two silk ligatures; blood vessels were carefully avoided.”
তাঁর এই পদ্ধতি পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক গবেষণার জগতে একটি গৃহীত পদ্ধতি হয়েছে। তিনি সম্ভবত এক্ষেত্রে পথিকৃৎ। এই পেপারে তাঁর সিদ্ধান্ত ছিল – “These results suggest that Vibrio cholerae alters the permeability of intestinal capillaries to proteins.”
অনেক পরে ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ-এ (ফেব্রুয়ারি, ২০১১) রবার্ট হলের পেপার (“A De in the life of cholera”, Indian Journal of Medical Research, 2011, 133 (2): 146-152) দেখিয়েছে – “fundamental misconception in cholera pathogenesis was swept away when S.N. De used ligated loops of rabbit ileum to demonstrate lumenal fluid accumulation in the presence of Vibrio cholerae culture filtrates … The discovery was not so much ahead of its time as desperately awaited, but still De’s new model of pathogenesis had surprisingly little immediate impact. After a lag period of several years it was accepted, and a fresh generation of investigators boosted cholera from scientific obscurity to paradigm status.”
৩০ মে, ১৯৫৯-এ নেচার-এ তাঁর “Enterotoxicity of Bacteria-free Culture-filtrate of Vibrio cholerae” প্রকাশিত হয়। WHO-র বুলেটিনে (Bull World Health Organ 2010; 88: 237–240) ক্ল্যাসিক পেপার (“From endotoxin to exotoxin: De’s rich legacy to cholera”) হিসেবে তাঁর কাজ গৃহীত হয়। এই পেপারের পরিচিতি হিসেবে বলা হয় – “Between 1951 and 1959, Sambhu Nath De made crucial discoveries on the pathogenesis of cholera that changed the course of our understanding of the disease”। যদিও নোবেল প্রাইজ তাঁর কাছে অধরাই থাকে।
রেজোনেন্স জার্নাল-এ প্রকাশিত অন্য একটি প্রবন্ধে (“Life and Work of Sambhu Nath De”, অক্টোবর, ২০১২) দু’জন গবেষক দেখিয়েছেন – “De began his studies on the remarkable pathological changes in the kidneys in cholera cases which showed renal shunt mechanism in operation – a feature of many other toxic conditions. He published a number of papers on this topic between 1950 and 1955.”
ক্যালকাটা মেডিক্যাল ক্লাবে Dr. B. C. Roy Memorial Oration-এ (“Cholera Exotoxin – a delayed discovery”, মুদ্রিতাকারে অপ্রকাশিত) তিনি বলেছিলেন – “Vibrio cholera has now been promoted to the rank of few exotoxin producing bacteria. However, diphtheria exotoxin was discovered within four years of the discovery of the bacillus, tetanus exotoxin within six years and botulism toxin at the same time as the organism. It has taken seventy five years for cholera exotoxin to be discovered in 1959 after the organism was discovered by Robert Koch in 1884…” (A. Sen and J. K. Sarkar, “Life and Work of Sambhunath De”, Resonance (Oct. 2012): 943-954)
নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী জোশুয়া লেডারবার্গ শম্ভুনাথের নাম নোবেল কমিটিতে সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু প্রত্যাখ্যাত হয়। লেডারবার্গ শম্ভুনাথের উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে দেখেছিলেন “iconoclastic creativity, experimental skill, and observational mastery” হিসেবে।
১৯৮৩ সালে প্রকাশিত (২০১৮ সালে পুনঃপ্রকাশিত) W. E. van Heyningen এবং John R. Seal-এর লেখা সুবিখ্যাত গ্রন্থ CHOLERA: The American Scientific Experience, 1947-1980–তে শম্ভুনাথ সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছে – “in 1959, S. N. De of Calcutta very clearly demonstrated the existence in cholera culture filtrates of an exotoxin that mimicked the symptom of cholera that was responsible for all the ill effects of the disease, namely, the outpouring of fluid into the gut. In other words, cholera, like diphtheria and tetanus, was an exotoxinosis. But the significance of De’s discovery was not immediately grasped, and his historical paper went unnoticed for some years, even, apparently, in the PSCRL (Patient Security Category Review List).” (পৃঃ ১৬৯)
৩১ মে, ১৯৭৭ সালে W. E. van Heyningen (তিনি তখন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার উইল্যাম ডান স্কুল অফ প্যাথোলজির রিডার) শম্ভুনাথকে একটি চিঠি লেখেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন – (১) “I think your work of tremendous significance and most serious researchers on cholera throughout the world acknowledge this.”, (২) “It is a great honour for me to be in correspondence with you.”
কিন্তু ততদিনে শম্ভুনাথের জীবন-তিয়াষার ফল্গুধারা শুকিয়ে গেছে। তিনি এই চিঠির উত্তরে লিখলেন – “আমি আপনার নামের সাথে বিলক্ষণ পরিচিত এবং আপনার টক্সিনের ওপরে পেপারগুলো অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে পড়েছি। কিন্তু আমি এখন একটি মুদির দোকান চালাচ্ছি (grocery shop) – অর্থাৎ আমার বাড়িতে একটি ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোস্টিক ল্যাবরেটরি চালাচ্ছি। অন্তত এটুকু আমার স্বান্তনা যে ১৯৭৩ সালে চাকরি থেকে অবসর নেবার পরে আমার বিস্তৃত গবেষণার বিষয় থেকে ফলিত চেহারায় মানুষের জন্য কোন কাজে লাগতে পারছি।” হৃদয়াভ্যন্তরের সমস্ত যন্ত্রণা এ কথাগুলোর মাঝে ঝরে পড়ছে। ২০১৮ সালে এমএসএস মুর্তি তাঁকে নিয়ে বই লিখেছেন – Sambhu Nath De: the Discovery of Cholera Toxin।
১৯৯০ সালে কারেন্ট সায়ান্স পত্রিকার একটি পুরো সংখ্যা (৫ জুলাই, ১৯৯০) উৎসর্গ করা হল তাঁর স্মরণে এবং স্মৃতিকথায়, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের দিকগুলোকে নিয়ে আলোচনা করে।
২০১১ সালে ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ-এর সম্পাদকয়ীতে (“Dr Sambhu Nath De: unsung hero”, Indian J Med Res 133, February 2011, pp 127) বলা হয় – “De’s discovery of cholera toxin introduced a new paradigm in research on cholera. A recent search done on November 19, 2009 in the PubMed database using the keyword “cholera toxin” yielded a phenomenal 11,168 publications that the work of De spawned. De’s work on cholera toxin has impinged into diverse areas such as cellular physiology, biochemistry and immunology.”
১৯৫৯ সালে তাঁর নোবেল প্রাইজ পাওয়ার যোগ্য আবিষ্কারের বহুদিন পরে আন্তর্জাতিক জগতে তিনি অবশেষে স্বীকৃতি পান। ১৯৭৮ সালে নোবেল সিম্পোসিয়ামে বিশেষ লেকচার দেবার জন্য আমন্ত্রিত হন তিনি। পরম যন্ত্রণা নিয়ে সে লেকচারে তিনি বলেছিলেন – “১৯৬০-এর দশকের গোড়া থেকে আমি মৃত অবস্থায় ছিলাম। Nobel Symposium Committee আমাকে আবার কবর থেকে খুঁড়ে তুলেছে এবং আপনাদের সান্নিধ্যে এই দু’দিন কাটানোর ফলে আমি অনুভব করছি যে আমি আবার জীবনে ফিরে আসছি।”
Very much honest write up
আমি আগেও বলেছি আবার বলছি এমন তথ্য বহুল লেখা ইতিহাসবিদদের পক্ষেই সম্ভব । ডাক্তার জয়ন্ত ভট্টাচার্য মহাশয় যদি ইতিহাসবিদ হতেন তবে ততোধিক সুনাম অর্জন করতেন এ বিষয়ে দ্বিমত নেই ।
অসাধারণ লেখা। সমকালীন ভারতের চিকিৎসা শাস্ত্র ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্পর্কে অতি মূল্যবান লেখা।
তুমি যে অসাধারণ জ্ঞানের অধিকারী
Darun lekha,pore khub valo laglo.