কদিন পরেই ছেলের বিয়ে। মিষ্টির অর্ডার দিতে গিয়েছিলেন বাড়ির একেবারেই সামনে ঠাকুরপুকুর বাজারে। সামান্য চাকুরীজীবী আমিনুর রহমান মাত্র এক মাস হল অবসর গ্রহণ করেছেন। এখনো পেনশনের বন্দোবস্ত হয়নি। আকস্মিক ৬ই এপ্রিল নেমে এল আঁধার।
পরিবার অর্থনৈতিক, মানসিক, সমস্ত দিক দিয়ে বিপর্যস্ত। বৃদ্ধা মা অপেক্ষায় আছেন কবে আমিন এসে তাঁকে খাইয়ে দেবে। অথচ দেখুন তথাকথিত শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত সিনেমা পরিচালক কি নিষ্ঠুর মজা করলো এদের সঙ্গে! মদ খেয়ে জাস্ট মাতাল হয়ে স্পিডে গাড়ি চালানোর মধ্যে বেশ একটা শিভালরি দেখানো যায় হয়তো। আর এই কুৎসিত আনন্দ করতে করতে আমিনুর রহমানকে চাকার তলায় পিষে ছ্যাঁচড়াতে ছেঁচডাতে মৃত্যু পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেল। আহত হলো আরো বহু মানুষ।
যন্ত্রণায় কাতর এই মানুষজন রাস্তায় যখন ছটফট করছে, তখন দোষীকে জামাই আদরে পুলিশ গাড়ি করে নিয়ে চলে গেলো। পথে পড়ে রইলো নির্দোষ, মুমূর্ষু মানুষগুলি। এলাকার মানুষ কোনক্রমে হাসপাতালে পৌঁছালো আমিনুরকে নিয়ে। আমিনুরের স্ত্রী পুলিশের হাতে পায়ে ধরেছিল তার ছেলের আব্বার কাছে একটিবার তাকে পৌঁছে দিতে। বধির পুলিশ শুনতে পায় নি।
দ্রুত এম্বুলেন্সের ব্যবস্থা হলে আমিনুর আজও তার মাকে খাইয়ে দিত বা দাঁড়িয়ে থেকে ছেলের বিয়ে দিত। তাই হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু হলো না।
অথচ মাসের পর মাস ওই অঞ্চলের রাস্তা, চলাচলের অযোগ্য। এলাকায় একজন ট্র্যাফিক পুলিশ থাকলে গাড়িটির ওখানে ঢোকারই কথা ছিল না। রাস্তা, পুলিশের ভূমিকা, সর্বোপরি মাতালের বিলাস এসব কোনোটিরই কথা ছিল না, কিন্তু হলো। আজ এই নিহত এবং আহত মানুষগুলির পাশে কে দাঁড়াবে?l
এ রাজ্যে ন্যায়বিচার এমনি পাওয়া যায় না। আদায় করতে হয়। তাই ১৭তারিখ বেহালা প্রতিবাদী মঞ্চ আর অভয়া মঞ্চ ডাক দিয়েছিল মিছিল এবং থানায় ডেপুটেশন এর। প্রবল ঝড়বৃষ্টির মধ্যে আমরা ভাবছিলাম কি করে হবে মিছিল। তারপর আমাদের মনে হলো, কত কষ্ট পেয়েছেন আমিনুর, আমরা একটু ভিজতে পারবো না?
সহনাগরিক কথাটা শুধু তো কথা নয়। ওই পরিবার যদি আমার পরিবার হতো। হ্যাঁ, আমারই পরিবার। অভয়া, আমিনুর, যোগ্য শিক্ষক– যে যেখানে বঞ্চিত, নির্যাতিত, সকলেই আমাদের পরিবার। কারণ আমরা শিরদাঁড়া আছে এমন মানুষ হতে চাই।
আমাদের দাবি, আমিনুরের হত্যাকারীকে এমন শাস্তি দেওয়া হোক যাতে আর কেউ কখনো মদ্যপ অবস্থায় এভাবে ঘাতক হয়ে ওঠার স্বপ্নও না দেখে। মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ হয় না, তবে যা পরিবারের প্রাপ্য তা পেতে হবে। আরও অনেকগুলি মানুষের কারো হাত ভেঙেছে, পা ভেঙেছে, কোমর ভেঙেছে, তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা প্রশাসনকে করতে হবে।
আমাদের পরিবারের একজন মারা গেছেন, ন্যায়বিচার আমরা ছিনিয়ে আনবোই, এই আমাদের শপথ।
“এখানে চরম দুঃখ কেটেছে সর্বনাশের খাল।
ভাঙা ঘর ফাঁকা ভিটেতে জমেছে নির্জনতার কালো।
হে মহামানব এখানে শুকনো পাতায় আগুন জ্বালো।”