“সারাদিন মিছে কেটে গেল;
সারারাত বড্ডো খারাপ
নিরাশায় ব্যর্থতায় কাটবে; জীবন
দিনরাত দিনগত পাপ
ক্ষয় করবার মতো ব্যবহার শুধু।”
হ্যাঁ– জীবন এখন দিনরাত দিনগত পাপ ক্ষয় করার জন্যই যেন অবশিষ্ট আছে!
করোনার ভয়ে দুই মাসের বেশি সময় ইতিমধ্যে অতিক্রান্ত! সারা পৃথিবী জুড়েই চলেছে বিভিন্ন ফেজের এই বন্দীদশা। তারপরও করোনা মোকাবিলায় কি কি লাভ লোকসান, ঠিক ভুল হয়েছে; অর্থনীতি সমাজনীতি রাজনীতির কোন কোন দিক পরিবর্তন হয়েছে– সে সব গভীর গবেষণার বিষয়। সে আমার কম্মো নয়!
আপাতদৃষ্টিতে দেখে যেটা গোদা বাংলায় বলা যায়– করোনা এখন যেন এক রসিক নাগর হয়ে গেছে! আমাদের অবস্থা দেখে সে যেন দাঁত বের করে বলছে– ‘সেই যদি নথ খসালি, তবে কেন লোক হাসালি!’
কিন্ত করোনা যতই হাসুক, আপনি আমি কি সত্যিই মন খুলে হাসতে পারছি এখন? আমরা সুখী আছি তো? না, নেই!
আমাদের ধনে মানে প্রাণে মারার বন্দোবস্ত পাকা করতেই যেন এই করোনা র আবির্ভাব! আর আমরা কি করছি? কি করছি সেই শুরু থেকে?
কি করেছি কি করিনি– সেই নিয়ে লিখতে বসা এই গল্পে আরেকটি গল্প গুঁজে দিই! একজন বিখ্যাত সুইস-আমেরিকান মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, নাম তাঁর Elisabeth Kubler-Ross ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত তাঁর একটি বই On death and dying-এ একটি মডেল খাড়া করলেন! কি নিয়ে? নাম শুনলেই বোঝা যায়– মৃত্যু এবং মৃত্যুপথযাত্রী রোগীর মানসিক অবস্থা নিয়ে।
মৃত্যুকে যদি ধরে নিই সবচেয়ে বড় বিষাদের কারণ, তাহলে আসন্ন মৃত্যুচিন্তাজনিত বিষাদকে আমরা কিভাবে ক্রমপর্যায়ে বরণ করি (করতে বাধ্য হই সবাই!), সেই নিয়ে এক রক্তমাংসহীন মডেল!
বিষয়টি সহজ করে বাংলায় বললে দাঁড়ায়– মৃত্যুর আগে ধাপে ধাপে বিষাদ বরণ!
বোঝা যায়– এই বিষয়টি আর পাঁচটা সাধারণ অনুভূতির সাথে মেশানো খুব কঠিন। যদিও এই মডেলের সাবজেক্ট ছিল মৃত্যু পথযাত্রী রোগী, কিন্ত শুধুই কি তাতে সীমাবদ্ধ থাকে এই মডেল? অন্য কোন রকম বিষাদকে কি প্রায় একই রকম ভাবে আমরা বরণ করি না?
মানুষ সুস্থ হলে– নেয়ে খেয়ে ঘুমিয়ে ফের জেগে ওঠার মধ্যে যে জৈবিক স্বাভাবিকতা আছে, তাতে আমাদের যে প্রতিক্রিয়া অহরহ দেয়া নেয়া চলে, সেগুলো মৃত্যু বা সমতুল্য অন্য কোন বিষাদ দেখলেই ব্যর্থ হতে শুরু করে। সেখানে চলে আসে আপাতদৃষ্টিতে অস্বাভাবিক কতগুলো প্রতিক্রিয়া। যদিও মানব মনের কাছে কিছুই অস্বাভাবিক নয়! আমরা এখনো অনেক কিছুই জানি না তার!
যদিও স্বয়ং Kubler-Ross পরবর্তী কালে দেখেছিলেন– তাঁর মডেল অনুযায়ী সব ধাপই আসে বটে, কিন্তু সেটা এক একজনের ক্ষেত্রে এক এক রকম। ঠিক অঙ্কের যোগ বিয়োগ মেনে সময়ের সাথে সাথে তার অগ্রগতি একই মাপকাঠিতে মাপা যায় ন। সেই কারণে কেউ কেউ এটির সমালোচনা করেছেন, বাতিল করেছেন, কেউ কেউ এটি মেনে ও নিয়েছেন।
দেখা যাক, কি সেই মডেল?
তিনি বিষাদ বরণকে দেখালেন পাঁচটি স্টেজে …
১. Denial বাংলায় অস্বীকার;
২. Anger বা রাগ ;
৩. Bargaining বা দরকষাকষি;
৪. Depression বা হতোদ্যম এবং সবশেষে
৫. Acceptance বা মেনে নেওয়া।
এবার আসুন, শেষ দু’মাসের বেশি সময় ধরে যে অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সারা পৃথিবী, করোনা নামক যে অদৃশ্য জীবাণু প্রচুর মানুষের কাছে যে দুর্বিষহ জীবন এনে দিয়েছে, পৃথিবীর অন্য দেশকে আগেই দেখে, জেনে শুনেও কিছু করতে না পারার ফলে আজ ভারতে যখন প্রতিদিন বেড়ে চলেছে রোগীর সংখ্যা এবং তাকে নিয়ন্ত্রণ করার পলিসিতে ব্যর্থতা– তার ফলে যে মানসিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, সেখানেও এখন শুধুই বিষাদ বা grief !
সংক্ষেপে পাঁচটি স্টেজের মধ্য দিয়ে কিভাবে আমরা সবাই (হ্যাঁ,সবাই মানে সবাই!) এই সময়টা পেরিয়ে গেছি বা যাচ্ছি এখনো–
সেটা দেখা যাক।
১. অস্বীকার পর্ব: আমরা প্রথমে মানতেই চাইনি করোনা বলে কিছু আছে। অন্য দেশে যখন সেটা মহামারী, আমরা কিন্ত সোজা ব্যাটে বাউন্ডারির বাইরে উড়িয়ে দিয়েছি!! ডাক্তার বিজ্ঞানীরা যা যা বলেছেন, তার কোনটাই মেনে চলিনি। অস্বীকার করার জন্য আজব আজব যুক্তির অবতারণা ও করেছি!
কিন্ত ‘আমরা সবাই’ ইন্টারনেট বা অন্যান্য খবর দেখে জানতাম বুঝতাম, করোনা আসবেই! চীনে কি অবস্থা চলছিল, ইতালিতে লাশের পাহাড় জমছিল, তারপর আমেরিকা ও অন্যান্য দেশে … আমরা কি জানতাম না?? সব জানতাম, বুঝতামও !!
কি হলো?
বিশেষতঃ যাঁরা করোনা উপদ্রুত দেশ থেকে ফিরলেন, তাঁরা তখন পালাতে চাইলেন! অস্বীকার করতে শুরু করলেন যে তাঁরা বিদেশ থেকে এসেছে্ন!! হ্যাঁ, এই সময়ে কিন্ত ইনফেকটেড নয় এমন পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরানোর দাবী বা প্রয়োজনীয়তাও অস্বীকার করেছি আমরা!
অস্বীকার করেছি– পদক্ষেপ নিতে। বলা ভালো– এক একজন ব্যক্তি মানুষও কিন্ত এই সময় denial mode-এই ছিলাম আমরা!! ভেবে দেখুন, করোনা আসবে কি না– এই প্রশ্নে আমরা জেনে বুঝে ‘না’ বলেছি বা বিভিন্ন থিওরি (যেমন, ইন্ডিয়া গরমের দেশ, এখানে ইমিউনিটি বেশি ইত্যাদি) এনেছি।
২. রাগ পর্ব: দেখা গেল, অস্বীকার করে শুধু ব্যাপার টা মিটলো না। লকডাউন ঘোষণা করতেই হলো। কিন্তু সেই সাথে সাথে রেগেমেগে চলতে থাকলো প্রশ্ন: আমার কেন হবে? আমি তো আর বিদেশ থেকে ফিরিনি!!
যত্তসব ফালতু বিষয় নিয়ে মাথাব্যথা! তখন দাঙ্গা ছেড়ে ভাঙ্গা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে আমরা দেখলাম, না এসব রাগ দেখিয়ে লাভ নেই! অতঃপর শুরু হলো – ব্লেম গেম!
হ্যাঁ, দোষীও পাওয়া গেল!
কে কে কোথা থেকে এসেছে, কেন জানায়নি, ও নার্স বা চিকিৎসক– অতএব করোনা ছড়ানোর জন্য দায়ী– ইত্যাদি কু-রঙ্গ পরিবেশিত হতে থাকলো!
লাভ হলো না। লকডাউন ধাপে ধাপে বাড়লো। আমাদের মধ্যে চুঁইয়ে চুঁইয়ে জমতে থাকলো মৃত্যুজনিত ভয়, তাই পাল্টে যেতে থাকলো বিষাদ বরণে!
৩. দরকষাকষি পর্ব: এটা কি রকম? আমরা এদিক ওদিক থেকে অসংখ্য খবর পেতে শুরু করলাম। কেউ সৃষ্টিকর্তার উপর ভরসা রাখলাম, কেউ নানারকম অবৈজ্ঞানিক মহৌষধিতে! প্রতিদিন হরেক রকম খবর এলো — এই বুঝি প্রতিষেধক তৈরি হয়ে আসবে। কেউ কেউ ভাবলো– মৃত্যু আসে আসুক, তার আগে একটুখানি ফেস্টিভ্যাল করে নিলে মন্দ হয় না!
ব্যবসায়িক দিকগুলো যদি ভেবে দেখা যায়, তাহলে দেখা যাবে দরকষাকষি হয়েছে আরো অনেক কিছু নিয়ে!
ট্রাম্পের কথাই ধরুন! হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন নিয়ে ওনার রিঅ্যাকশন ভাবুন! আমাদের দেশে ভেন্টিলেটর নিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা বা রোগীর সংখ্যা কমানোর চেষ্টার কথা ভাবুন!
বাকিরা আশার আলো দেখতে শুরু করলাম এক আমূল পরিবর্তিত জীবন যাপনে অভ্যস্ত হবার মধ্য দিয়ে! থালা বাসন মেজে রান্না করে ফেসবুকের দেয়ালে দুনিয়ার যতসব ফালতু খবর পেশ করে, আলতু ফালতু বিষয় নিয়ে ঝগড়া করে আমরা খানিকটা পাল্টে যেতে চাইলাম।
আমরা আশার আলো খুঁজতে পাড়ার মোড়ে বাঁশ দিয়ে আটকে দিলাম। একই সাথে তার নিচ দিয়ে গলতে শুরু করলাম!
কিন্ত করোনাও তার ভয়ে জমা বিষাদ থেকে মুক্তি পেলাম না! সে বিষাদ যেন বাড়তে থাকলো এক্সপোনেন্সিয়াল হারে! আমাদের কন্টেইনমেন্ট জোন ভেদ করে!!
৪. হতোদ্যম: এই দশায় এসে আমরা দেখলাম, আমরা যা যা করছি, সবেতেই বিষাদের ছায়া! রান্নাঘর ভালো লাগে না, কোন কাজ করতে ইচ্ছে করে না, কাটাকাটি মারামারি ঝগড়া ভালো লাগে না! লকডাউন চলছে তো চলছেই, টেস্ট করা হচ্ছে যতটা তাতেও রোগীর সংখ্যা বাড়ছেই, অর্থনীতি ধ্বসে যাচ্ছে দেখে, কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে দেখেও আমাদের আর কিছুই করার নেই! রাজা মন্ত্রী থেকে শুরু করে সবাই হাল ছাড়তে শুরু করলাম আমরা। ঘরে থাকুন– এইটুকু সান্ত্বনা বাণী ছাড়া আমাদের কারো কিছু পাওয়া হলো না। করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকলো।
সরকারি তরফে দেখা গেল সব অমানুষিক কাজকর্– যেগুলো আসলে চরম হতাশারই বহিঃপ্রকাশ!
বিষাদগ্রস্ত পরিযায়ী শ্রমিকরা দিনের পর দিন ঘরে বন্ধ থেকে যখন আর পারলো না তারা বেরোতে শুরু করলো পথে। আমরা হতাশ হয়ে – বাড়িতেই একলা সময় কাটাতে চাইলাম। কোন কিছুতেই মন বসাতে পারলাম না।
৫. এইসব স্টেজ পেরিয়ে এসে আমরা দেখলাম– মৃত্যুভয় বাড়ছে। বাড়িতে বন্দী থাকলাম, তবু এখানে ওখানে রোগী বাড়ছেই। পরিযায়ী শ্রমিকরা মেনে নিল– জীবন যায় যাক, করোনা থাকে থাকুক, পথে অনাহারে অর্ধাহারে মৃত্যু হয় হোক, শেষবারের মতো চেষ্টা করে দেখি ঘরে পৌঁছানো যায় কিনা! গর্ভবতী মা হাঁটতে শুরু করলো হাজার মাইল, গাড়িচাপা পড়লো কতজন, স্টেশনে শুয়ে মরে গেল এক মা– ছোট্ট ছেলেটি তাঁকে টেনে তুলতে চাইলো– এসব ঘটনা অসংখ্য ঘটলো। আমরা আরো বিষাদে ডুবতে থাকলাম। সবাই!
সরকারের তরফে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে গেল আরো একটা ভয়ঙ্কর বার্তা– মেনে নাও! আর কিছুই করা সম্ভব নয়। করোনা এসেছে, করোনা থাকবে। একে নিয়েই ঘর করো, পাশবালিশ বানিয়ে জড়িয়ে ধরো, একসাথে ঘুমাও! খুলতে শুরু করলো একে একে সব কিছু। আমরা এখন লকডাউনের সাড়ে বারোটা বাজিয়ে দিয়েছি।
কখন? হ্যাঁ, যখন রোগী সংখ্যায় আমরা উঠে এসেছি নয় নম্বরে! যখন আমরা নিশ্চিত জানি যে– আমাদের মত দেশে এক নম্বরে পৌঁছে যাওয়াটা আর শুধু মাত্র কয়েকটি দিনের অপেক্ষা! যখন আমরা দেখছি– লাখে লাখে মানুষকে ঘর পাঠানো হচ্ছে, অথচ তাদের মধ্যে অনেকেই করোনায় আক্রান্ত। সরকার এখন মেনে নিচ্ছে যে– এদের তো ঘরে ফেরাতেই হবে!
সরকার কি এই বিষয়টা জানতো না?
আমি সেই রাজনৈতিক প্রশ্নে যাবো না। এটা আসলে হঠাৎ করে দেশের অর্থনীতি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যে ধ্বস নেমেছে, তার ফলে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে যে বিষাদের ছায়া (বিষাদই বলবো; কারণ যোগ্যতার প্রশ্ন রাজনৈতিক, আমি সেটা বুঝি না, তাই ও পথে যাবো না। হ্যাঁ ব্যতিক্রম নিয়েও কিছু বলবো না!) নেমে এসেছে, তাঁদের আর কিছুই করার নেই বলে– এই মেনে নেওয়ার ডিসিশনগুলো তাঁরাও মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন! কি শাসক কি বিরোধী– কারো কাছে সঠিক পথের সন্ধান নেই!
(দয়া করে এই নিয়ে রাজনৈতিক তর্ক করে লাভ নেই! যদ্দুর দেখা গেছে, কেউ পুরোপুরি সঠিক পথ দেখাতে পারেননি, নানা রকম দোষারোপ পর্ব চলেছে নিয়ম মেনে। যাঁর ইচ্ছে আছে, চালাতে থাকুন।)
আমাদেরও আর মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। কাল মরতে পারি– এই বিষাদ বরণ করে নিয়েই বেরিয়ে পড়ছি পথে। যে ধর্মীয় সমাবেশ নিয়ে এতো কাণ্ড হলো, এখন দেখছি সরকার সেই দরজা খুলে দিল!
হয়তো আমরাও এরপর গিয়ে ভিড় জমাবো সেখানে। আমরাই রাস্তাঘাটে শুরু করবো জমায়েত।
কি যে হবে দেশটার, কি যে হবে মানুষের– কোন পথ নেই বলে, এই প্রশ্নগুলোও আসলে শেষবারের মতো মেনে নেওয়া!
ডাক্তার নার্স ও অন্যান্য জরুরী পরিষেবার সাথে যাঁরা জড়িত, তাঁদের অতিমারীর সাথে ঘর করতে হবে– এই বাধ্যবাধকতা প্রথম থেকেই রয়েছে। আইন তাকে মান্যতা ও দিয়েছে। তবুও তাঁরা কি এই স্টেজগুলো ফিল করেননি?
করেছেন। হ্যাঁ, মানতেই হবে তাঁদের এইসব দুঃখ কষ্ট সবদিন এভাবেই মেনে নিতে হয়। তাঁরা কতকটা অভ্যাসের দাস হয়ে পড়েন ক্রমশঃ
আমরাও অতএব মেনে নিলাম। আত্মীয় স্বজন প্রতিদিন যখন ফোন করে বলেন– কেন যেতে হবে, কেন রোগী দেখতে হবে, না গেলে কি খেতে পাবে না– এইসব প্রশ্নের জবাবে আমাদের শরীরে চেপে বসে কাফনের মত সাদা পিপিই।
শরীর ঢেকে যায় … বিষাদ চাপা পড়ে কি??
হ্যাঁ, বলে রাখা ভালো– আমরা যাঁরা এইসব ক্ষেত্রে আছি, তাঁরা অনেক তাড়াতাড়ি অভ্যস্ত হয়ে যাই। কতকটা নির্দয়ও হয়ে যাই। কতকটা ভান করতেও জানি বলে– বিষাদ এসে গিলে ফেলতে পারে না সহজেই।
এবার কোন কোন জায়গায়, কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এই স্টেজ মেনে হয়তো সবকিছু ঘটেনি, বা যতটা হবার কথা ততটা হয়নি, কিন্ত মোটের উপর ঘটেছে বা ঘটছে। এই মডেলের সীমাবদ্ধতা ছিল বা আছে, হয়তো সব ক্ষেত্রে এটা সঠিক ভাবে ডেমনেস্ট্রেশন করা যায়নি, কিন্ত তবুও কি অস্বীকার করা যাবে যে– করোনা অতিমারী শুরুর পর থেকে আমরা এই স্টেজগুলো পেরিয়ে যাইনি??
যাইহোক, এই পর্যন্ত এসে গল্প শেষ করবো।
************
না, এই লেখা পড়ে এটা যেন ভেবে নেবেন না– এখানেই সব শেষ!
এখন যেন কবির কথায়– ‘এক একটা দুপুরে এক একটা পরিপূর্ণ জীবন অতিবাহিত হয়ে যায় যেন’ …তবু এই দশা থেকে মুক্তি আসবে অবশ্যই! আসতেই হবে!
ভাবতে হবে– এই বিষাদ বরণ করার মধ্যে যতই থিওরিটিক্যাল কচকচানি থাকুক, তা নিয়েই, তাকে পেরিয়ে গিয়েই, এরপরও আমাদের বেঁচে যেতে হবে!
মাথায় রাখতে হবে– করোনা সবাইকে যেমন মারবে না, তেমনি সবাই মিলে ভাগাভাগি করে করোনাকে ফুসফুসে ঢুকিয়ে নেব, এটা কোন কাজের কথা নয়!
আমাদের বেঁচে যেতে হবে আরো আসন্ন আরো অসংখ্য মারণ অসুখ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে যুদ্ধ করে।
শিখতে হবে– সাধারণ জীবন যাপন। পথ খুঁজে নিতে হবে আমাদের। হাত ধরতে হবে বিজ্ঞানের। মেনে চলতে হবে সাধারণ কিছু নিয়ম কানুন।
এতো কিছুর পরও মানুষ কোনদিন মৃত্যুকে শেষ বলে মেনে নিয়ে দল বেঁধে সব মরে যায়নি। তার অফুরান প্রাণশক্তি তাকে ফের জাগিয়ে তুলেছে। তার মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা তাকে দিয়েছে শ্রেষ্ঠ জীবের তকমা।
তার হৃদয়ে রয়েছে প্রেম ভালোবাসা বন্ধুত্ব, অন্যের পাশে দাঁড়ানোর মত সুখ– যা তাকে টেনে তুলবেই এই বিষাদগ্রস্ত অন্ধকার খাদ থেকে।
হাত ধরো বন্ধু … হাত ধরো।
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এই বিষাদ বরণ করতে শেখা, তার থেকে বেরিয়ে এসে জীবনের গান গাইতে পারা– এই তো আমাদের কাজ। খুব সহজ হয়, যদি আমরা হুজুগে না মেতে বাস্তবকে মেনে নিয়ে নিজেদের শুধরে নিতে পারি।
জীবনানন্দ দাশের কবিতা দিয়েই শেষ করবো–
‘মাটি-পৃথিবীর টানে মানবজন্মের ঘরে কখন এসেছি,
না এলেই ভালো হ’তো অনুভব ক’রে;
এসে যে গভীরতর লাভ হ’লো সে-সব বুঝেছি
শিশির শরীর ছুঁয়ে সমুজ্জ্বল ভোরে;
দেখেছি যা হ’লো হবে মানুষের যা হবার নয়—
শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়।’