কোর্ট রুমে ঘোষণা, ‘কেস নম্বর ৪৪৭’
পুলিশের ইনভেস্টিগেশন অফিসার কাঠগড়ায় উপস্থিত হল।
বিবাদী পক্ষের উকিল উঠে দাঁড়ালেন। ‘এই মামলায় ডাক্তার বাবুর বিরুদ্ধে সেকশন ৩০৪-এর ২ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। অর্থাৎ অনিচ্ছাকৃত খুনের অভিযোগ। অথচ, গত সাত বছরে পুলিশ চার্জশীট জমা করে উঠতে পারে নি।’
‘সে কি! সাত বছর! পাবলিক প্রসিকিউটর সাহেব, কিছু বলুন।’
পাবলিক প্রসিকিউটর সমীর ঘোষ মাথা নীচু করে চুপ।
কাঠগড়ার দিকে তাকিয়ে, ‘আপনিই বলুন। কেন সাত বছরেও চার্জশীট দিতে পারলেন না?’
‘এতদিন এক্সপার্ট ওপিনিয়ন পাওয়া যায় নি স্যার।’
‘কেন?’
‘ফাইল হারিয়ে গেছিল। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে গত দু’মাস আগে অফিসের আলমারি পরিষ্কার করতে গিয়ে খুঁজে পাওয়া গেছে।’
‘এত গুরুত্বপূর্ণ ফাইল হারায় কি করে ?’
‘তা তো জানি না স্যার। আমি গত দুবছর আগে চাকরিতে জয়েন করেছি। গত ছ’মাস আগে এই কেসের চার্জ পেয়েছি।’ তরুণ পুলিশ অফিসার বলল।
‘ফাইল তো বলছেন আবার পাওয়া গেছে। তো ইনভেষ্টিগেশনে কি বেরোলো?’
তখন পাবলিক প্রসিকিউটর বললেন, ‘ডাক্তারবাবুর বিরুদ্ধে কিছুই পাওয়া যায় নি স্যার।’
‘হুম্। ডাক্তারবাবু আছেন?’
পাকা চুলের মধ্যবয়স্ক ডাঃ দীপক মিত্র উঠে দাঁড়ালেন। ‘ইয়েস স্যার।’
‘বলুন, আপনার কি বক্তব্য।’
‘প্রথমতঃ বলি স্যার, আমি এখন আর ডাক্তার নই।’
‘মানে।’
‘আমি ডাক্তারী পেশা ছেড়ে দিয়েছি। সাত বছর আগে এক রোগীর অগ্ন্যাশয়ের জটিল ক্যান্সার অপারেশন করে বাদ দিতে গিয়ে দুর্ভাগ্যজনকভাবে রোগী মারা যায়। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় হাসপাতাল ভাঙচুর। আমি এবং আমার পরিবার শারীরিক আক্রমণের মুখে পড়ি। খবরের কাগজ, টিভি সব জায়গায় আমার বিরুদ্ধে বিচার সভা বসে যায়। আমি খুনী প্রতিপন্ন হয়ে গ্রেপ্তার হই। হাজতে ছিলাম তিন মাস। মেডিকেল রেজিষ্ট্রেশন বাতিল হয়ে যায় ছ’মাসের জন্য। জামিন পেয়ে বেরিয়ে দেখি, আমি বেকার। ডাক্তারী করার অনুমতি নেই। সমাজের কাছে আমি ব্রাত্য। তখন হায়দ্রাবাদে আমার এক বন্ধু আমাকে নতুন জীবন দান করে। মূলতঃ তারই উৎসাহে দুজনে সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতির ব্যবসা শুরু করি। আমি বেঁচে যাই।’
‘তারপর?’
‘বিদেশ থেকে ভালো মানের কাঁচামাল ও প্রযুক্তি এনে বিভিন্ন রকমের আধুনিক সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি তৈরী করে ব্যবসা এখন খুবই সফল। আমার সেই বন্ধুটি ইঞ্জিনিয়ার। আমরা দুজনেই ব্যবসা দেখাশুনো করি। হায়দ্রাবাদে ফ্যাক্টরি। কলকাতা, দিল্লি, হায়দ্রাবাদে অফিস।’
‘অপারেশনের যন্ত্রপাতি তৈরী করেন। নিজে আবার অপারেশন করতে ইচ্ছে করে না?’
‘না স্যার। আর নয়। এই ব্যবসায় প্রতিযোগিতা আছে। তবু ঝামেলা অনেক কম। এখন অনেক ভালো আছি। আগে আমার একটা মারুতি গাড়ি ছিল। এখন একটা মার্সিডিজ, একটা ভলভো। এশিয়া, আফ্রিকার অনেক দেশে যন্ত্রপাতি রপ্তানি করি। যন্ত্রপাতির উচ্চমানের জন্য অনেক পুরষ্কার পেয়েছি আমরা।’
‘থাকেন কোথায়?’
‘হায়দ্রাবাদে স্যার। আর পরিবার কলকাতায়।’
‘কেন?’
‘জেলখাটা ডাক্তারের সাথে কে আর থাকতে চায় স্যার!’
দু’ঘন্টা বাদে কোর্টের রায় বেরোলো। কেস বাতিল। দীপক মিত্র সব অভিযোগ থেকে মুক্ত।
সাত বছর!
রায়ের কপি নিয়ে অনেকদিন পরে মাথা উঁচু করে মিত্রসাহেব কোর্ট চত্বর থেকে বেরিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠলেন।