সোনা একটা এনিগমা। যুগ যুগ ধরে মানুষ এর পেছনে ছুটে গেছে। কোথায় আছে সেই এলডোরাডো যেখানে মাটি খুঁড়লেই সোনা পাওয়া যায়- মানুষ জীবন অর্থ পণ করে তার পেছনে ছুটে গেছে। মৌসুমী বায়ুর গতিপ্রকৃতি ভালোভাবে যখন আরব বণিকেরা বুঝে গেল তখন ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে বাণিজ্য করা তাদের পক্ষে অনেক সহজ হয়ে গেল। আরবদের অনুসরণ করে রোমানরাও ভারতের দক্ষিণ উপকূলের সাথে বাণিজ্য শুরু করে দিল। তাদের একটাই আমদানির চাহিদা- মশলা। তার বিনিময়ে ভারতীয়রা দাবি করল সোনা। বিপুল পরিমাণে সোনার মুদ্রা রোমান ট্রেজারি থেকে ভারতে চলে আসতে শুরু হল। রোমান সেনেটররা নড়েচড়ে বসলেন। শুধু অভিজাতদের ভোজন বিলাসের জন্য এত এত সোনার অপব্যয় তারা মেনে নিতে পারলেন না। আজও দক্ষিণীদের মধ্যে যে বিপুল সোনার প্রতি মোহ তার একটা কারণ সেই সময়ের রোমান সোনার রমরমা বাজার। নীলাব্জর প্রিয় অভিনেত্রী রশ্মিকা মান্দানা আজ যে বিরাট মূল্যের সোনার জুলরি ব্যবহার করেন সেটির সোনা হয়ত এসেছে সিজারের রানি পম্পেই বা মার্কাস অরেলিয়াসের রানি ফস্টাসের গহনা থেকে। গজনীর সুলতান মামুদ যে সতেরবার ভারত বা সোমনাথের মন্দির আক্রমণ করেছিলেন তার পেছনে মূল উদ্দেশ্য যত না ইসলামের বিস্তার ছিল তার থেকে অনেক বেশি ছিল সোনার লুট। সোনার গায়ে এভাবেই লেগে থাকে রক্ত, অভিশাপ, আশীর্বাদ আর ক্ষমতার উল্লাস। মানুষ তাই যুগ যুগ ধরে সোনাকে যতই অস্বীকার করতে চেয়েছে সোনা ততই তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে।
কিন্তু আমরা প্রথমে জানার চেষ্টা করব সোনা এত মূল্যবান কেন? প্রথম কারণ এর দুর্লভতা। আমরা জানি এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি হবার সময় যখন নক্ষত্রগুলো তৈরি হচ্ছিল তাদের অভ্যন্তরে যে প্রচন্ড তাপমাত্রা তৈরি হয় সেই তাপমাত্রায় খুব অল্প সময়ের মধ্যে সোনা তৈরি হয়েছিল। সেই তাপমাত্রা যেহেতু কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা অসম্ভব তাই পৃথিবী তৈরি হবার সময় যে পরিমাণ সোনা তৈরি হয়ে গেছে নক্ষত্র বা উল্কাপিন্ড থেকে ছিটকে এসে তার বেশি তৈরি করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। সারা পৃথিবীতে এখন যত সোনা মজুত আছে সেই পরিমাণ ইস্পাত তৈরি করতে এক মিনিটেরও কম সময় লাগে। আর দ্বিতীয় কারণ অবশ্যই এর রূপ। সোনা বা গোল্ড-এর রাসায়নিক সংকেত AU বা অ্যারাম বা অরোরা। এর অর্থ ‘সাইনিং ডন’ বা ‘উজ্বল ভোর’। সোনার বিশেষত্ব হল এটি প্রায় নিষ্ক্রিয় মৌল। তাই এটি যুগে যুগে অপরিবর্তিত থাকে। কায়রোর জাদুঘরে যে ফারাওদের পরার সোনার নকল দাঁতের ব্রিজ আছে সেটির বয়স ৪৫০০ বছর। আপনি অক্লেশে তাকে নিজের দাঁত হিসেবে এখনো ব্যবহার করতে পারবেন। তাই আমি দক্ষিণী অভিনেত্রীর সোনার গয়না নিয়ে যে রসিকতা করলাম সেটি কিন্তু সত্যিই রসিকতা নয়। সোনার এই অক্ষয় রূপ একে মানুষের কাছে যুগেযুগে আরো মূল্যবান অ্যাসেট করে তুলেছে।
পৃথিবীতে যতবার আর্থিক বিপর্যয় এসেছে দেশকে, মানুষকে রক্ষা করেছে সোনা। স্প্যানিশ অভিযাত্রীরা নির্মম হাতে ইনকাদের পরাজিত করে যে বিপুল সোনা ইউরোপে নিয়ে আসে সেই সোনা দিয়ে বহু বছর স্পেন যুদ্ধের খরচ চালিয়ে গেছে। এটা মিথ্যে নয় যে ব্রিটিশদের রবরবার এক মুখ্য কারণ ভারত থেকে চুরি করে নিয়ে যাওয়া সোনা। ১৯২০ সালে সারা পৃথিবীতে বিশেষত জার্মানিতে যে বিরাট আর্থিক অবনমন বা ইকোনমিক ডিপ্রেসন দেখা দেয় যার ফলশ্রুতি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ- সেই অবক্ষয় থেকেও পৃথিবীকে রক্ষা করেছিল সোনা। হিটলার যদিও বলেছিলেন, “Gold is not necessary. I have no interest in gold. We’ll build a solid state, without an ounce of gold behind it. Anyone who sells above the set prices, let him be marched off to a concentration camp. That’s the bastion of money”.
তিনি কিন্তু কথা রাখতে পারেন নি। শুধু যে ইহুদিদের ব্যাঙ্কে রাখা বিপুল সোনাকে দখল করে তিনি যুদ্ধের খরচ চালিয়েছিলেন তাই নয় জার্মানির পতনের পরেও জার্মানি সহ সারা বিশ্বকে রক্ষা করেছিল সেই সোনা। আমেরিকায় রিয়েল এস্টেট ক্রাইসিসের জন্য ২০০৮ সালে সারা পৃথিবীতে যে ভয়ঙ্কর রিসেশন হয়েছিল তার হাত থেকে এই বিশ্বকে অনেকটাই উদ্ধার করেছিল সোনা। আজো আমাদের বাড়ির গৃহিণীরা তাদের সোনাকে আগলে রাখেন। ‘মণিহার’ সিনেমার সেই সোনাপাগল নারীর কথা মনে আছে নিশ্চই। পৈত্রিক সূত্রে যে সোনা তারা পেয়েছেন তাকে যখের ধনের মত আগলে রাখেন। কত পুরুষের ডুবে যাওয়া সংসারকে যে বাঁচিয়ে তুলেছে সেই সোনা তার কোনো ইয়ত্তা নেই। আমরা পূর্ববঙ্গের লোক। রায়টের সময় আমার ঠাকুরদা তার এক কন্যা ও সাত ছেলেকে সঙ্গে করে এদেশে এনে মাথা গোঁজার যে একটু জায়গা কিনেছিলেন সেটিও খোঁজ নিলে দেখা যাবে আমার ঠাকুমার কোনোমতে বাঁচিয়ে আনা কিছুটা সোনার গহনা।
আমার এক পিসি। আজ আর তিনি নেই। তার বিয়ের সময় পিসেমশাই ঘড়ির ব্যবসা করতেন আসামে। আসামে যখন রায়ট শুরু হয় একদিনের মাথায় তিনি তার স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে বাংলায় চলে আসেন। সঙ্গে পরনের কাপড়জামা ছাড়া কিছুই আনতে পারেন নি। তার যেটুকু সোনার গয়না ছিল পিসি বুদ্ধি করে সেগুলোকে একটা বাক্সে ভরে একটি গাছের নীচে মাটি চাপা দিয়ে আসেন। শুনেছি পরে আমার বড় জেঠু রায়ট শেষ হলে সেই সোনা উদ্ধার করে এনে পিসিকে দেন। যদিও এ আমার শোনা কথা। তবে মনে হয় মিথ্যে নয়। সেই সোনার কিছুটা দিয়েই হয়ত আমার পিসেমশাই এই রাজ্যে আবার তার ব্যবসা শুরু করেন, মেয়েদের বিয়ে দেন, জায়গা জমি কেনেন এবং এক ছেলেকে ডাক্তার করেন। সারা পৃথিবীর দিকে আমাদের তাকাবার দরকার নেই আমরা নিজেদের পরিবারের দিকে তাকালেই বুঝব সোনা কিভাবে আমাদের যুগে যুগে আর্থিক অবনমন থেকে, রায়ট যুদ্ধ লুটপাট এসবের মত বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে এসেছে। আজ আপনি বিপদে পড়ে গোছাগোছা ভারতীয় টাকা নিয়ে আমেরিকা যান কেউ আপনার টাকা নেবে না। আপনি বেশ কিছু সোনা যদি নিয়ে যেতে পারেন তৎক্ষণাৎ দাম পাবেন। সোনা এমন একটা জিনিস যার মূল্য কখনো কমে না। দেশ-কাল নির্বিশেষে এর মূল্য কখনো কমে না। তাই এটা আমাদের ফিক্সড অ্যাসেট। শেয়ার বাজার ডুবে যাবে। সরকার ব্যাঙ্ক এফ ডির, বন্ডের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হবে কিন্তু সোনা আপনাকে কখনই ডোবাবে না। যদি আপনি তাকে রক্ষা করতে পারেন।
ভাববেন না সারা পৃথিবীতে রাশিয়া, চিন, আমেরিকা, ভারতের মত দেশ বিনা কারণে এত খরচ করে সোনা সংগ্রহ ও রক্ষা করে চলেছে তাদের ট্রেজারিতে। কারণ তারা সবাই জানে, চৈব দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্রবিপ্লবে রাজদ্বারে শ্মশানে চ য তিষ্টতি স স্বর্ণ। আমি আমার সাধ্যমত ও অভিজ্ঞতামত শেয়ার বাজার নিয়ে কিছু আলোচনা করেছি। ভবিষ্যতে আরো করব। আজ সোনাকে একটা বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে লিখতে বসেছি বন্ধু নীলাব্জর গতকালের অনুরোধে। আমি ডাক্তার, ইকোনমিস্ট নই। কিছুটা বিনিয়োগ নিয়ে পড়াশোনা করি। জ্ঞান খুবই কম। আর বেন গ্রাহাম তো বলেই গেছেন, “ডক্টরস আর প্যাথেটিক ইনভেস্টর”। কারণ তারা নিজেদের সবজান্তা মনে করে। সুতরাং আপনারা আমার কথা শোনার আগে এই ‘ক্যাচ’ টাও মনে রাখবেন। সোনা নিয়ে আমিও খুব উৎসাহী। তবে গয়নার সোনা নয়। বিনিয়োগের সোনা নিয়ে। আগামি একটি কি দুটো পর্বে আমি সোনায় বিনিয়োগ নিয়ে আমার মতামতটা আপনাদের সাথে শেয়ার করব।
(চলবে)