“মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।”
কবি শঙ্খ ঘোষের এই অমোঘ পংক্তিও আজকাল ক্লিশে। কারণ শুধু মুখ নয়- হাত,পা, নরনারীদেহ এবং পরিবেশ- এ যুগে সব কিছুই বিজ্ঞাপনে ঢাকা পড়ে গেছে।
ঢাকা থেকে তৌহিদুর- ঠিক ঢাকা থেকে নয়, আক্ষরিক অর্থে কলকাতা বিমানবন্দর থেকে- দৌড়তে দৌড়তে এসে বকাবকি করে গেল, ‘গতবার পৈ পৈ করে বলে গেলাম আপনার নিজের ওয়েবসাইট-টা একটু ভালো করে করেন। একটু নিজের বিজ্ঞাপন দ্যান- তা কিছুই তো করেন নি দেখছি। কতগুলো রোগী পাঠানোর চেষ্টা করলাম বাংলাদেশ থেকে। সবাই বলে, বলছ তো ভালো ডাক্তার! দেখছিও বেশ ভালো অপারেশন হয়েছে। কিন্তু ইন্টারনেটে ওনাকে তো দেখাই যায় না। কিরকম কাজ করেন- কিছুই নেই।’
বললাম, ‘ওয়েবসাইট অনেক চেষ্টা করেছিলাম। ভাল হয় নি। এখন বয়স হয়ে যাচ্ছে। হাল ছেড়ে দিয়েছি।’
‘এত তাড়াতাড়ি হাল ছেড়ে দিলে হবে! কত বয়স আপনার? বুড়ো থুত্থুড়ে নাকি? ভালো করে প্রোফাইল তৈরী করেন। চেম্বারে রোগীর লাইন লেগে যাবে। দেখে শেষ করতে পারবেন না।’
‘তাহলে তো মুশকিল হয়ে যাবে। আমি হাড়ের সার্জেন। অপারেশন করতে হয়। সময় লাগে। সময়মত চেম্বারে আসতে পারি না। রোগীরা বিরক্ত হয়। আরো বাড়লে তো আমার লেখালেখি, ছবি তোলা – এসব চৌপাট হয়ে যাবে! অত দরকার নেই বাপু।’
‘দরকার নেই বললেই হবে? আমার হাঁটুতে অপারেশন করে আমাকে আবার খেলায় ফিরিয়েছেন। আমার বন্ধুদের মধ্যেও অনেক রুগী আছে। তাদের পাঠাব। আপনি শুধু ওয়েব সাইটে বিজ্ঞাপনটা ভালো ভাবে দ্যান।’
তৌহিদুর বাংলাদেশী ফুটবলার। হাঁটুর লিগামেন্ট ছিঁড়ে গিয়েছিল। সে আবার খেলতে পারছে। তাই এত উত্তেজিত।
তবে তৌহিদুরের কাহিনী এখানেই থাক।
যা বলছিলাম, বিজ্ঞাপন সর্বগ্রাসী। আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে সে আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলার চেষ্টা করছে।
আপনি ইন্টারনেটে আপনার আশেপাশে কোথায় ভালো চাইনিজ রোস্তোঁরা আছে- এটা একটু জানার চেষ্টা করলেন। ব্যস- আপনার ফেসবুকে, ইমেলে, মেসেজে, হোয়া-তে, জলে-স্থলে সর্বত্র রেস্তোরাঁর বিজ্ঞাপন আপনাকে আক্রমণ করবে। পালানোর কোনো পথ নেই।
গুগলে হাঁটু ব্যাথার সংবাদ গুলেছেন কি অমনি সোনা দিয়ে তৈরী কৃত্রিম হাঁটু রোবটের করাত দিয়ে কেটে আপনার পায়ে প্রায় বসিয়েই দেওয়া হবে। যেন ওই অপারেশনের পরেই আপনার দৌড়ে বা সাইকেল চালিয়ে অলিম্পিকে পদক জয় স্রেফ সময়ের অপেক্ষা মাত্র!
অথবা হাসি হাসি মুখে টাই আর এপ্রন পরে আপনার ফোনের স্ক্রিনে এসে কেউ বলবে, ‘আপনার ঘুম, আমার নয়। আপনার ছুটি আমার নয়।’
যেন সেই বিজ্ঞাপনের মুখ হওয়া ডাক্তারটি ৩৬৫ দিন-২৪ ঘন্টা ঘুম, খাওয়া, জলপান, হাগা, মোতা সব বাদ রেখে – আপনি কবে বুকে ব্যাথা নিয়ে মাঝরাতে হাসপাতালের এমার্জেন্সীতে পৌঁছে ওনাকে কৃতার্থ করবেন- সেই আশায় বসে আছে।
আর আপনি সেই ভরসায় সিগারেট, মদ, মাংস, পার্টি, বিদেশী গাড়ি, উর্বানায় বাড়ি, কর্পোরেট টার্গেট- এসবের পেছনে প্রাণান্তকর ছুটছেন!
তলিয়ে ভাবছেন না, দিনে পঞ্চাশটা অপারেশন করে – এমন বিজ্ঞাপন করা ডাক্তার ঘুমোয় কখন? স্নান,খাওয়া, প্রাকৃতিক কর্ম, পরিবার, প্রজনন- সে সব না হয় বাদই দিলাম।
ফ্ল্যাটের একটা বিজ্ঞাপনে ক্লিক করা মাত্র মুড়ি খেয়ে প্রভিডেন্ড ফান্ড ভেঙে লোন নেওয়া আপনাকে ভবিষ্যতে তৈরী হবে এরকম বালিগঞ্জ বা নিউটাউনের আকাশচুম্বি তিন কোটির ফ্ল্যাটের ভার্চুয়াল সুইমিং পুলে সাঁতার কাটিয়েই ছাড়বে! আপনিও স্বপ্ন দেখতে শুরু করবেন, তিনকোটির সেই পরাবাস্তব বাড়ির সাজানো শয়নকক্ষে কৃত্রিম তন্বীর পাশে শুয়ে আছেন। শুধু বাকি আছে হাজারো কর আর ঋণ জর্জরিত আপনার বেতন থেকে ইএমআই-টুকু কেটে নেওয়া।
তাই বলছি, চতুর্দিকে হাজারো বিজ্ঞাপন। কোষ্ঠকাঠিন্যে বেলের, জাপানি তেলের, বুলেট রেলের, পাত্রপাত্রীতে নম্র ছেলের।
দেখতে চান দেখুন। তবে যাচাই করে নিন।