সকাল থেকে… উঁহু সকাল না ভোররাত থেকে লাইন পড়েছে। তা পড়ুক। মানুষের হাতে টাকা আসা দরকার। বিনায়ক ব্যানার্জি বলেছে।
এই পাড়ায় যার কথা বেদবাক্য, যার বাণী ঐশ্বরিক প্রায়, যার বক্তব্য চূড়ান্ত আর দুরন্ত সেই কালোদা’ মানে কল্লোল ভৌমিক অবধি বলেছে, ‘ওরে, নোবেল কমিটি বিনায়ককে দিয়ে বলে পাঠিয়েছে, মানুষকে টাকা দিলে তবেই আমরা মানে ইয়েরা টাকা পাব।’ কালুদা এই রকম নানান কথা সাঁটে বলে। এই যেমন ‘ইয়েরা’ বলে বুঝিয়ে দিল কাদের টাকা পাবার কথা বলছে।
সে টাকা পাক লাইনের লোকেরা। এই লাইনের আর সব লাইনের লোকেরা। আমি লাইনটাইনে দাঁড়াইনি। টাকার দরকার নেই আমার, ব্যাপার তা নয়। দরকার কার নেই? আমারও আছে। যথেষ্টই আছে। কিন্তু এই লাইনে দাঁড়াবার যোগ্যতা নেই আমার।
যোগ্যতা অনেক কিছুরই নেই। টেট,নেট, গেট সব কিছুতেই আমার অযোগ্যতা প্রমাণিত। সবাই বলে ওসব কিছু না। সেট, হ্যাঁ ওই সেট করতে পারলেই পরমার্থ মিলবে। কিন্তু সেট করতে হলে ভেট দিতে হয়। সাঙ্গোপাঙ্গ সমেত কালো দা’কে, তার ওপরে থাকা সেকেন্ড টায়ারের মালো দা’কে। তারপরে জেলার সেক্রেটারি আলো দা’ কে পুজো চড়িয়ে ওদের সুপ্রিমো, প্রাক্তন সেই ‘আগুন-জ্বালো” যিনি এখন ‘বেজায়-ভালো’ হবার চেষ্টায় দিনরাত প্যাঁচ কষছেন, সেই তিনি অবধি। অত সঙ্গতি নেই আমার।
আমি কিন্তু এই লাইনে দাঁড়াতে গেলে মার খেয়ে যাব। নিতাই দা মার খেয়েছিল। লাইনে নয়। মাতৃভূমি লোকালে ভুল করে উঠে পড়ে। ক্রোমজোমাল ডিফেক্ট। ডিফেক্ট ঠিক নয় প্রবলেম। বাবার দোষে। মা তো যথাসাধ্য যা’ দেবার দিয়েইছিল। একখানা এক্স। বাবা যদি আর এক খানা এক্স দিত, আমিও লাইনে দাঁড়াতে পারতাম।
অ্যাদ্দিন বাবার দোষটাকে আশীর্বাদ ভাবতাম। দু’টো এক্স হয়ে গেলে ভ্রূণহত্যা, মুখে অ্যাসিড, গায়ে কেরোসিন, আর আলতো আদর যাকে ওই কি যেন ধর তক্তা মার পেরেক গোছের কিছু বলে, সব ছোট ঘটনাই ঘটার চান্স। সে’ সব এখনও ঘটে। প্রচুর ঘটে। কিন্তু ওই যে বেজায়-ভালো হবার চেষ্টা, তার জন্যেই কালোদা’র পার্টি এ’বার অফার দিয়েছে। ডবল এক্স হলে লাইনে দাঁড়াও। কোটার হলে হাজার। নইলে পাঁচশ’।
যাক্, যা হবার নয়, তা’ হবেও না! তবু সাত সকালে কালীরতন ইসকুলের সামনের লাইনটাকে ওই যাকে বলে মাপতে গেছিলাম। মানে ওই আমার মত বেকারের যাকে বলে চোখের সুখ। লাইনের সব কি আর বয়েস পেরোনো? বরং বেশিরভাগটাই ইয়ে।
তা’ ওই লাইনের গুঁতোগুতি দেখতে দেখতেই, হঠাৎ দেখি একটা বেদম চেনা মুখ। আহা, মনে হয় বড়লোকের মেয়ে। সাত সকালেই ঘেমে মুখটা লাল। সেই মেয়েও দেখি চেনা চেনা চোখেই আমার দিকে তাকিয়ে।
সাধারণত আমার মত চোখের-সুখ বাবুরা ভীতু হয়। আমিও তাই। কিন্তু এই চেনা মেয়েকে দেখে কথা বলে ফেললাম। আর আমার মত লঝঝর মালও ঘাবড়ে গিয়ে ডায়ালগ ওপেন করল, একেবারে মাতৃ সম্বোধনে, – হ্যাঁ, মা, তুমি এই গরীব-দুঃখীদের লাইনে?
সে’ও বেশ ওই যাকে বলে, স্মার্টই। ধরা পড়ে গেছে, কোথায় তুতলে উত্তর দেবে, তা না। ঝাঁঝিয়ে সপাটে বলল, -কেন রে বাছা? পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনায় আমার বুঝি হক নেই?
– আরে না না, তা কেন? হক তো প্রোমোটারের বউ, ডাক্তারের মেয়ে, ইংলিশ মিডিয়াম,বাংলা মিডিয়াম, নো লেখাপড়া, সবাইরই আছে। তা মাগো, তুমি পাঁচশ’ না হাজার?
– দেখি, কী দেয়। সাট্টিফিকেট তো এনিচি!
মেয়ের আঁচলঢাকা বাঁ হাতটা কেমন যেন অ্যাবনর্মাল মনে হল। ভাবলাম ফিজিক্যালি হ্যান্ডিক্যাপড নাকি? বলেও ফেললাম, – মা, তোমার ওই ভাঙা বাঁ হাতের জন্য সার্টিফিকেট থাকলে তা’ দিয়ে কাজ হবে না কিন্তু।
– তোকে অত পাকামি করতে হবে না বাছা! এই দ্যাখ্ আমার অজ্জিনাল সাট্টিফিকেট!
এক চোখ পড়ে দেখি কী সব শিডিউল লেখা। পাহাড়ি উপজাতি। বাপের নাম কৈলাশপতি। নাঃ, হাজারই পাবে মেয়ে। যদি পায়।
তো তো করে জিজ্ঞেস করলাম, – ঠিকই আছে। পেয়ে যাবে। কিন্তু বাঁ হাতটা আঁচলের আড়ালে অমন বেঢপ করে রেখেছ কেন?
আজকালকার কায়দা জানা আধুনিক মেয়ে তো। এক চোখ মটকে বলল, – আহা জানিস না যেন! ছবিতে দেখে নিস। ভাণ্ডারটা তো আমার বাঁহাতেই জড়িয়ে থাকি। সেইটে খালি করার উজ্জোগ হতেই তাই হন্যে হয়ে লাইন দিয়েছি। যে টুকু উদ্ধার করা যায়।
লাইন এগিয়ে যাচ্ছে। কথা শেষ করে এগিয়ে গেল বিসর্জন হয়ে গেছে যার, সেই নির্লজ্জ মেয়েটা।
খুব ভালো লাগলো স্যার।