৫/৪/২০২২
মেঘের দেশে আজই শেষ দিন। সকাল সাড়ে ন’টার মধ্যে ভারত সেবাশ্রমে থাকার ঘর ছেড়ে দিতে হবে। আরশির খুব মন খারাপ। বারবার জিজ্ঞেস করছে, শিলংয়ের বাড়িতে আমাদের আর থাকতে দেবে না? আমরাও দু-তিন দিনে শহরটাকে ভালোবেসে ফেলেছি। আবার কবে সবার সাথে দেখা হবে, কে জানে? খুনসুটি করে ঋতায়ণকে খ্যাপানোটা সবথেকে বেশি মিস করব। এইতো তিনদিন আগেই ঢাউস ব্যাগগুলো খুলে প্রতিদিনের ব্যবহার্য জিনিসপত্র টেবিলে পরপর সাজিয়ে রাখছিলাম। হইহই রইরই করে তিনটে দিন কেটে গেল। আজ আবার সবকিছু পরপর গুছিয়ে ফেলতে হচ্ছে। কাল থেকে আবার যে যার কাজের জায়গায়। আবার সেই একঘেয়ে থোড়-বড়ি-খাড়া। অবশ্য প্রতিদিন হাঁসফাঁস করা কাজের চাপটা থাকে বলেই ছুটির একটা আলাদা মানে হয়। অখণ্ড অবসর নিশ্চিতভাবেই আরও অনেক বেশী অসহনীয় হয়ে উঠতো। ভারত সেবাশ্রমের উঠোনে বসে শেষবার একটা গ্রুপ ফটো তোলা হ’ল। এই ছবিগুলোই থাকবে ভবিষ্যতের জন্য। সব ভালো একদিন শেষ হয়ে যায়। ‘নক্ষত্রেরও মরে যেতে হয়’।
আজকের দিনটার জন্য আলাদাভাবে অফিস থেকে গাড়ি বুক করা হয়নি। রফিকদাকে বলে রেখেছিলাম শিলং ও আশেপাশের আর কিছু জায়গা ঘুরিয়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। বিকেল চারটেয় শিলং থেকে ফিরতি বিমান। আজ ডন বস্কো মিউজিয়ামটা দেখবো। সমগ্র উত্তর পূর্ব ভারতের বৃহত্তম মিউজিয়াম। আদিম জনজাতি-জীবনকে তুলে ধরা হয়েছে এমন মিউজিয়াম ধরলে এটি এশিয়ার মধ্যে বৃহত্তম। ২০১০ সালে এর উদ্বোধন হয়। শিলং এসেও অনেকেই এই মিউজিয়াম না দেখেই ফিরে যান। কোনও একটি জায়গা ঘুরতে এসে সেখানকার ইতিহাস, ভূগোল, সংস্কৃতি খানিকটা না জানলে ঘুরতে আসার আসল মজাটাই মাটি। সোওয়া দশটায় রফিকদা গাড়ি নিয়ে হাজির। প্রাতরাশ সেরে গাড়িতে উঠলাম। আজ বড় ব্যাগ গুলো সব গাড়ির ছাদে বাঁধা হলো। ওগুলোয় এখন আর হাত দেওয়া হবে না। সরাসরি বিমানে উঠে যাবে। সবারই কথাবার্তায় আলগা বিষন্নতার ছাপ। নিজেদের মধ্যে সেই পরিচিত পেছনে লাগা, হাসিঠাট্টাগুলো নেই। সবই কেমন যেন নির্জীব। অথচ শিলং তার মোহময়ী রূপ নিয়ে আজও হাজির। রাস্তার অনেকগুলো চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ডন বস্কো মিউজিয়াম পৌঁছোলাম। এখানে প্রতিটি জায়গাই পরিচ্ছন্ন, ছিমছাম। টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকলাম। কোথা থেকে শুরু করে কীভাবে মিউজিয়াম দেখতে হবে সেটা গাইড ভালো করে বুঝিয়ে দিলেন। সাততলা মিউজিয়ামের প্রতি তলাতেই শৌচাগার আছে। প্রতিটি তলা শামুকের খোলের মতো ঘুরতে ঘুরতে উপরে উঠে গেছে। বিদ্যুৎ বাঁচানোর জন্য এমন স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা রাখা হয়েছে যাতে ঘরে কেউ না থাকলে কিছুক্ষণ বাদে এমনিতেই আলো বন্ধ হয়ে যায়। উত্তর-পূর্ব ভারতের স্থানীয় মানুষদের জীবনযাত্রা, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, চাষবাস, অস্ত্রশস্ত্র, ধর্মচর্চা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে অসংখ্য ছবি, মূর্তি ইত্যাদি নিপুণ দক্ষতায় সাজানো হয়েছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ইতিহাস, ভূগোল জানার জন্যও অসংখ্য আয়োজন। সাততলায় প্রোজেকশন পর্দায় উত্তর-পূর্ব ভারত ভ্রমণ বিষয়ক ‘থিম সং’ ও ছোট্ট তিন-চার মিনিটের ভিডিও দেখানো হয়। সবচেয়ে আকর্ষণীয় জিনিসটা হচ্ছে সাত তলার উপর দিয়ে স্কাইওয়াক। ছাদের চারদিকে রেলিং দিয়ে ঘেরা জায়গায় গোল করে ঘোরার ব্যবস্থা আছে। পুরো শিলং শহরটা এখান থেকে দেখা যায়। পাহাড়ের কোল বরাবর ছিমছাম সব বাড়ি। চার্চের উঁচু মাথাগুলো দেখা যাচ্ছে। আজ আকাশে একটুও মেঘ নেই। সকালের রোদে চারদিক ঝলমল করছে। শিলং-সুন্দরী দয়াপরবশ হয়ে শেষবার নিজেকে দেখার সুযোগ করে দিচ্ছে যেন। নিচের ফ্লোরে চা-কফি খাওয়ার জায়গা আছে। কাচের জানালায় চোখ রেখে শিলং শহরকে দেখতে দেখতে কফিতে চুমুক দেওয়ার এই সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া হতে দেওয়া যায় না।
মিউজিয়াম দেখা শেষ করে নিচে নেমে এলাম। তারপরই দুঃসংবাদটা এলো। খারাপ আবহাওয়ার জন্য শিলং থেকে বিমান ছাড়তে দেরি হবে। বাতিলও হয়ে যেতে পারে। তার বদলে গুয়াহাটি থেকে বিমান ধরার একটা সুযোগ দেওয়া হ’ল। তাড়াতাড়ি সবাই আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম গুয়াহাটি যাওয়াই ভালো। শিলংয়ের আশেপাশের কিছু জায়গা ঘোরার ইচ্ছে ছিল। সে সব চিন্তা আপাতত বাতিল। বেড়ানোর আয়েশ ছেড়ে চটপট দুপুরের খাওয়া শেষ করতে হ’ল। গুয়াহাটি যাওয়ার গাড়ির জন্য সবাই মিলে পরপর ফোন করা শুরু করলাম। গাড়ি বুক করার অফিস থেকে আট জনের একসাথে যাওয়ার মতো কোন গাড়ি ব্যবস্থা করা গেল না। শেষে রফিকদা’ই একে তাকে ফোন করে ব্যবস্থা করে দিলো। যাওয়ার আগে রবি ঠাকুরের শিলংয়ের বাড়ি দেখতে ভুল করিনি। পাশেই মেঘালয়ের বিধানসভা ভবন। সামনে অনেকটা পাইন, ফারের ছায়ায় ঢাকা রাস্তা। সর্বত্রই নির্জনতার অলঙ্কার।
গাড়ি বদল করা হ’ল। ব্যাগগুলো নতুন গাড়িতে বাঁধা হ’ল। গুয়াহাটি এখান থেকে ১১৪ কিলোমিটার। হাতে বেশি সময় নেই। সন্ধ্যে সাতটা পনেরোয় বিমান। শিলং ছেড়ে যাচ্ছি। আবার কবে আসবো কিংবা আদৌ আসতে পারবো কিনা জানি না। ছবির মতো রাজপথ পেছনে সরে যাচ্ছে। শিলং থেকে গুয়াহাটি যাওয়ার রাস্তাটাও অকল্পনীয় সুন্দর। পাহাড়ি উপত্যকার নাম না জানা ফুল, পাইন-ফারের আলিঙ্গন, স্যাঁতসেঁতে পাথরে ফার্নের আলপনা। এ সুন্দরের দিকে শুধু নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকতে হয়। অনামিকা ছুঁয়ে বলতে হয় “For God’s sake hold your tongue and let me love”
আসাম যত এগিয়ে আসছিল বন-জঙ্গলের প্রকৃতি একটু বদলাচ্ছিল। এখানকার গাছপালা অনেকটা আমাদের গ্রাম বাংলার মতই। কুকুরগুলোর মধ্যে অনেকটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। মেঘালয়ের কুকুর খুব লোমশ। রাস্তা যত আসামের দিকে এগোতে লাগলো কুকুরের লোম কমতে শুরু করলো। গুয়াহাটির কাছাকাছি এসে দেখলাম কুকুরগুলোর চেহারা একদম আমাদের এখানকার মতোই। চারদিকের পরিবেশটাও অনেকটা একই রকম। আসামের সাথে বাংলার বর্নমালার মিলের কথা আগেই জানতাম। পরিচিত ধুলো, ধোঁওয়া, গাড়ির জ্যাম অনেকটা ফিরে এলো। গাড়ি বারবার আটকে যাচ্ছিল। আমি আর রিপন বারবার ঘড়ি দেখছি। মাঝে ভয় হচ্ছিল বিমান না হাতছাড়া হয়ে যায়। যাইহোক শেষমেশ সেরকম কোনো অসুবিধে হ’ল না। নির্ধারিত সময়ের খানিকটা আগেই পৌঁছে গেলাম।
এবার বাকি ব্যাপারটা একইরকম যান্ত্রিক। বিভিন্ন রকম চেকিং, আধার কার্ড দেখানো-টেখানো সব শেষ করে বিমানে উঠলাম। ফেরার বিমান বেশ বড়। অনেক মানুষের বসার জায়গা। লম্বা লম্বা ডানা। অনেকেই আমাদের মতোই শিলং থেকে এখানে এসেছেন। বিমান কোলকাতার দিকে উড়লো। এবার আর ওজনের অতটা পরিবর্তন হ’ল না। ঝাঁকুনিও খুব কম।
ঘন্টাখানেক বাদেই আলোকমালায় সজ্জিত কল্লোলিনী চোখে পড়লো। বিমান মাটি ছুঁল। একইরকম ভাবে ব্যাগ-ট্যাগ সংগ্রহ করে নিলাম। আবার সবাইকে আলাদা আলাদা জায়গায় যেতে হবে। গাড়িতে ফিরছি। বেশ বুঝতে পারছি মেঘ-পাহাড়ের দেশ বহুদিন আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখবে। গাড়ির হর্ন আর পরিচিত ভিড়ভাট্টায় বারবার তাল কেটে যাচ্ছে। তবু মনের গতি রোখে, সাধ্য কার? আজও জানালায় মেঘের আবেশ।