? ব্লাড ডোনার ক্রেডিট কার্ড (BDCC) – একটি সমস্যা।
কিছু ব্লাড ব্যাঙ্ক, রক্তদান করার পর আপনার রক্ত যদি ব্লাড ব্যাঙ্কে গৃহীত হয় (কিছু ক্ষেত্রে রক্তের গুণমান নির্দিষ্ট মাত্রার থেকে কম হলে সেটি সংরক্ষণ করা যায় না), তাহলে তারা আপনাকে একটি BDCC দিয়ে থাকে যেখানে সেই রক্তদাতার নাম, তিনি কোন রক্তদান শিবিরে কবে কোন ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্তদান করেছেন এইসব লেখা থাকে। এটা ব্যবহার করতে গেলে রক্তদাতা এবং সংশ্লিষ্ট ব্লাডব্যাঙ্কের অধিকর্তার স্বাক্ষরটিও লাগে। রক্তের প্রক্রিয়াকরণ মোটামুটি দুই-তিন দিনে হয়ে যাওয়ায়, রক্তদানের তিন-চার দিন পরেই সাধারণত এটি দেওয়া হয়। প্রতি ইউনিট রক্ত কেনার সময় এই রকম একটি কার্ড ব্যবহার করে আপনি মোটামুটি সাতশত থেকে হাজার টাকার ছাড় পেতে পারেন (এটি বিভিন্ন ব্লাড ব্যাঙ্কে বিভিন্ন)।
১) বহু ক্ষেত্রেই অভিযোগ আসে যে রক্তদাতার প্রাপ্য এই কার্ড অনেক সময়ে তাদের না দিয়ে বিশেষ কিছু ব্যক্তি বা সংগঠনের কাছে জমা থেকেই যায় এবং পরে প্রয়োজন হলে এই কার্ড তাদের কাছ থেকে পাঁচশো-ছয়শো টাকার বিনিময়ে কিনে নিতে হয় (যেটা পুরোপুরি বেআইনি)।
এইজন্যই এই BDCC-টি সরাসরি রক্তদাতাকেই দেওয়া উচিৎ।
২) এছাড়া আরো অভিযোগ আসে যে, একজন রক্তদাতা তার নিজের BDCC-টি কোনো দুঃস্থ রোগীর জন্য দান করলে সেক্ষেত্রে তার কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার উচিৎ হলেও সেটা না করে অনেক ক্ষেত্রেই সেই কার্ড কোনো সংগঠন বা কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান সেটি নিজস্ব সুনামের জন্য ব্যবহার করে।
৩) আর, স্বেচ্ছা রক্তদাতার (Voluntary non-remunerated blood donor) এর সংজ্ঞা NBTC এভাবে জানায় – “A person who gives blood, plasma or other blood components of his/her own free will and receives no payment for it, either in the form of cash or in-kind which could be considered a substitute for money.” অর্থাৎ কোনো অর্থ বা এমন কোনো দ্রব্য যেটাকে অর্থের সমতুল্য বস্তু হিসেবে ধরা যেতে পারে, সেটি না নিয়েই যিনি রক্ত, রক্তরস বা রক্তের অন্যান্য উপাদানগুলি স্বেচ্ছায় দান করেন।
কাজেই রক্তদান যদি ছাড় পাওয়ার জন্য করা হয়, তাহলে সেটিকে স্বেচ্ছা রক্তদান হিসেবে গণ্য করা যায় না।
৪) এছাড়া, ধরুন কোনো ব্যক্তির কোনও রোগে আক্রান্ত হয়ে সারাজীবনের জন্য রক্তদানে অক্ষম (এবং এই রোগে আক্রান্ত হওয়াটা তার জন্য কোনও দোষের ব্যাপার নয়)। এবার, ইচ্ছা থাকলেও তিনি নিজে রক্তদান করতে না পারায় (এবং বিশেষ বিশেষ ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্তদান না করতে না পারায়) এই ছাড় তিনি পাবেন না।
কাজেই, এই ছাড়টি সকলের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হচ্ছে না।
মানবদেহের প্রাণ বজায় রাখার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো রক্ত, সেটি নিয়ে এইরকম অসাম্য যথেষ্ট অনৈতিক।
? রক্তদানের আগে ও পরে আরো কী কী বিষয়ে খেয়াল রাখা উচিৎ?
১) আগের দিন মদ্যপান করা চলবে না।
২) আগের দিনে ভালো ঘুমের প্রয়োজন।
৩) রক্তদান থেকে তার চার ঘন্টা আগে অবধি ধূমপান করা চলবে না।
৪) একবারে খালি পেটে বা ভরা পেটে রক্তদান করবেন না।
৫) কোনো রোগের ব্যাপারে কিছু লুকিয়ে রক্তদান করবেন না। কারণ আপনার দেওয়া রক্ত পরীক্ষা করে যদি তাতে গুণমানের অভাব দেখা যায় তাহলে সেটি ফেলে দিতে হবে, এবং এই পরীক্ষার জন্য হওয়া খরচগুলি দেশের আর্থিক ক্ষতি করবে যেটি পরবর্তীকালে রক্তের দাম বাড়িয়ে দেবে।
৬) রক্তদানের আগে আপনার ওজন, রক্তচাপ এবং রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ নির্দিষ্ট মাত্রায় আছে কি না অবশ্যই দেখে নেবেন।
৭) রক্তদানের আগে ২০০ থেকে ৩০০ মিলিলিটারের মতো জল পান করবেন। এবং রক্তদানের পরে আবার ১০০ থেকে ২০০ মিলিলিটারের মতো জল পান করবেন। (কারণ রক্তদানের ফলে শরীর থেকে ৩০০ থেকে ৪০০ মিলিলিটারের মতো জল রক্তরস রূপে দেহ থেকে বেরিয়ে যায়)।
৮) রক্তদানের পরে আধঘন্টা বিশ্রাম করবেন। তারপরে সাধারণ কাজকর্ম যথারীতি করতে পারবেন।
অনেকেই অভিযোগ করেন যে বহুক্ষেত্রে এইসব নিয়ম না মানার ফলে রক্তদাতারা শারীরিক অসুস্থতা বোধ করেন, এমনকি অজ্ঞানও হয়ে যান। কাজেই নিজের শারীরিক সুরক্ষা তথা রক্তসুরক্ষার সাথে কোনোরকম আপস করবেন না।
? রক্তদানের পরে সেটি দেহে আবার তৈরী হতে কত সময় লাগে?
১) অণুচক্রিকার (Platelets) সংখ্যা আগের মত হতে এক থেকে দুই দিন লাগে।
২) লোহিত রক্ত কণিকার (RBC) সংখ্যা আগের মত হতে দুই থেকে থেকে তিন দিন লাগে।
৩) রক্তরসের পরিমাণ সেদিনই স্বাভাবিক হয়ে গেলেও দেহে প্রোটিনের পরিমাণ স্বাভাবিক হতে এক সপ্তাহ সময় লাগে।
৪) দেহে লোহার পরিমাণ স্বাভাবিক হতে আট থেকে বারো সপ্তাহ সময় লাগে, রজঃক্ষরণের জন্য মেয়েদের ক্ষেত্রে এটি বারো থেকে ষোল সপ্তাহ হয়ে দাঁড়ায়।
? রক্তদান না করলে কী সমস্যা হবে?
অন্যান্য জিনিসের মতোই রক্তও অর্থনীতির চাহিদা ও সরবরাহের নিয়ম মেনে চলে। রক্তদান যত বাড়তে থাকবে, রক্ত সংরক্ষণের খরচ তত কমতে থাকবে এবং তার সাথে তার দামও কমবে। উল্টোদিকে, রক্তদান যত কমতে থাকবে, রক্ত সংরক্ষণের খরচ তত বাড়তে থাকবে এবং তার সাথে তার দামও বেড়ে যাবে। এছাড়া কালোবাজারি তো আছেই।
যেমন, অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে যে নেগেটিভ (Rh-D নেগেটিভ গ্রুপের মানুষ যেমন AB- বা O- ইত্যাদি) গ্রুপের মানুষেরা রক্তদান শিবিরে রক্ত দিতে চান না, এবং তাঁদের মনে হয় যে হঠাৎ প্রয়োজন হলে তাহলে তাঁরা রক্ত দেবেন, নাহলে রক্তদান শিবিরে রক্ত দিলে সেই রক্ত ব্যবহার না হয়ে নষ্ট হয়ে যাবে।
কিন্তু তাঁদের বোঝা উচিৎ যে তাঁরা নিয়মিত রক্ত দিলে এই হঠাৎ প্রয়োজনের পরিস্থিতি কখনোই তৈরী হবে না অর্থাৎ ব্লাড ব্যাঙ্কে নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত থাকলে রোগীর আত্মীয়দের সেই রক্ত কখনোই খুঁজতে যাওয়ার কথা নয়।
একই ভাবে আপনারা যদি বন্ধুদের নিয়ে নিয়মিত ব্যবধানে সারা বছর ধরে রক্তদান করেন তাহলে ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্তের অভাব থাকার কথাই নয়। কারণ, বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে এই ধারণা পাওয়া গেছে যে ভারতবর্ষের যতজন মানুষ রক্তদানে সক্ষম তার ২০% বা পাঁচভাগের একভাগ মানুষ রক্তদান করলেই রক্তের চাহিদা মেটানো সহজেই সম্ভব।
কাজেই সুস্থ থাকলে সমস্ত নিয়ম মেনেই প্রতি দুই বছরে কমপক্ষে পাঁচ বার রক্তদানের চেষ্টা করুন।
এই রচনায় ডা ঋতম চক্রবর্তীর সহায়তা নেওয়া হয়েছে।
(চলবে)
বেশ ভালো তথ্য সমৃদ্ধ লেখা।অনেক অজানা জিনিস জানা গেলো।