সেই তখনকার ছবি, যখন হাসপাতালেই সারাদিন আমাদের ঘরদোর, খাওয়া দাওয়া, ঝগড়া ঝাঁটি, সুখ দুঃখ। সরকারি হাসপাতাল খুব গরীবের সংসার তো! একটা ভোঁতা বাতিল সার্জিক্যাল নাইফ ছিল ড্রয়ারে– তাই দিয়ে জন্মদিনের কেক কাটা, মুড়ির সঙ্গে পেঁয়াজও।
রুটিন কাজ-কম্ম তো আছেই। আমি আর বেবীদি বহুবছরের কলিগ, বন্ধু। এমনই দুজনের গল্প জমত যে একবার গাড়ী চালাতে চালাতে– দিলাম আনমনে ইলেকট্রিসিটি পোলে এক বেদম ধাক্কা–বেচারা বেবীদি নাকের হাড় ভেঙে অনেক ভুগেছিলেন। মোটেই আনাড়ি ড্রাইভার নই কিন্তু– তিরিশ বছরে শুধু ওই একবারই।
অনেক নির্দোষ দুষ্টুমির শরিক দুজন। ছোটখাট বিদ্রোহ আর বৈপ্লবিক কাজেরও।
আমার স্কিন ওপিডির ঘরেই– লেপ্রোসি ক্লিনিক চলত। এই পেশেন্টদের সঙ্গে আমাদের গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে যেত সারাজীবনের জন্য। অসুখ সেরে গেলেও কিছু সমস্যা হতে পারে– সুতরাং নিত্য আসা যাওয়া। আমরা ওদের সবার নাড়িনক্ষত্র জানতাম। লতার ডান পায়ে আলসার, অজিতের বাঁ হাতের কড়ে আঙুল অসুখে বেঁকে গেছে, ভিখুর বউ ওকে মারে– সব মুখস্থ। সুকনার বর ওকে ছেড়ে দিয়েছে তাকে ডেকে ধমকানো, সুধারাণীর ছেলেবৌ কুষ্ঠ হয়েছে বলে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছে, ভিক্ষা করে বেড়ায়– ওই এলাকার স্বাস্থ্যকর্মী দিদিকে খবর পাঠিয়ে ডাকো ছেলে বৌকে– বকুনি দিয়ে বল- একটা মাসোহারা অন্ততঃ দাও বাপু মাকে নইলে তোমার চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে কিন্তু। এসবও যেন আমাদের বেয়ন্ড টেক্সট ডিউটির মতো হয়ে গিয়েছিল।
এরকম একটা মেয়ে আসত দেখাতে। অনেক দেরিতে হাসপাতালে এসেছিল। অলরেডি তখন তার দুটো হাতের আঙ্গুলই একদম বেঁকে মুড়ে গিয়েছে। থাবার মতো– claw hand deformity. একটা চোখও পাকাপাকি নষ্ট হয়ে গেছে corneal ulcer এর কারণে। এক বছর চিকিত্সায় রোগ তো সারবেই। কিন্তু ওই হাত তো সোজা হবার নয়। বরং অসারতার জন্য ঘা হতে হতে ক্রমশ খারাপতর। বুড়ো বাবা আসত সঙ্গে। এত দেরী করে আনলে কেন, এখন এত ভালো ওষুধ আছে এসব বললেই– প্রতিবার কপাল চাপড়ে বলত– ক্যা করেগা গরীব আদমি। মা নেই, ভাইবোন নেই, আমি মরে গেলে কে দেখবে মেয়েকে– আবার ডুকরে কান্না। এরপর অনেক দিন দেখা নেই। বেশ কিছু দিন পর মেয়েটা এল– একা। বাবা মারা গেছেন। হাতের ঘা আরো বেড়েছে, রেশন দোকানে ঝাড়ু দেবার কাজ করে পেট চালাচ্ছে। একটা compensatory mechanism-এ ওর হাতের অন্য পেশীগুলো বেশী কেজো হয়ে গেছে– নিজের কাজকর্ম চালিয়ে নিতে পারে। এরপর যা হয় আর কি– কান্না আর সান্ত্বনা পর্ব। এবার মেয়েটা সিরিয়াসলি ভেঙে পড়ল– দিদি আমার জন্য কোনো আশ্রমের ব্যবস্থা করে দাও। একা ঘরে থাকি– বস্তিতে শেয়াল কুকুর পেছনে লেগে থাকে– একদিনও নিশ্চিন্তে রাতে ঘুমোতে পারি না। শহুরে শিক্ষিত ‘সিঙ্গল লেডি’ আর বস্তির কপর্দকশূন্য অক্ষরজ্ঞানহীন ‘একা মেয়ে’-র অনেক তফাত। আমরা বললাম–বিয়ে করবি?
ও ভাবল– চরম নিষ্ঠুর মস্করা। অভিমানে বেশ কিছু সময় চুপ করে থাকল। এমন ভাবে তাকিয়ে থাকল যে– আমাদের কাছে মন খুলে কথা বলে ঠিকই– তাই বলে ওকে নিয়ে ঠাট্টা করার অধিকার কিন্তু দেয়নি! কুচকুচে কালো- একটা চোখ নষ্ট– চুল ওঠা –হাত বাঁকা এক প্রাক্তন লেপ্রোসি পেশেন্টকে কেউ বিয়ে করবে?
আমরা বললাম– শোন, তুই রাজি থাকলে আমরা চেষ্টা করব। তারপর তুই নিজেও সব দেখেশুনে নিবি। তবে বরও কিন্তু প্রাক্তন লেপ্রোসি পেশেন্টই হবে, স্বভাব চরিত্তির ভালো– পা বাঁকাও হতে পারে–চলবে? মেয়েটা বিশ্বাস করতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বলল– হ্যাঁঅ্যাঅ্যা। তারপর আবার অবিশ্বাসী লাজুক হেসে বলল– যাঃ তোমরা ঠাট্টা করছ!
আমি আর বেবীদি চোখে চোখে কথা সেরে নিলাম।
বললাম– যা- বাড়ি যা। রাতে ভালো করে দোর এঁটে ঘুমোস।
কিছুদিন আগে এসেছিল ওরা। প্রায়ই আসে। সেই একই রোগ সেরে যাওয়া লেপ্রোসি পেশেন্ট। সেই আর একজনের কথা আমাদের মাথায় ঘুরছিল। লেপ্রোসিতে দুটো পা-ই অকেজো হয়ে গেছে। ডাক্তারি ভাষায় foot drop, সঙ্গে পায়ে অসাড়তা জনিত ঘা। স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা অসম্ভব। বাড়িতে যা হয় আর কি– ন্যারেট করতে গেলে মেলোড্রামা। দাদারা বাড়িতে থাকতে দেয় না। বুড়ি মা সেই ছেলেকে নিয়ে কুঁড়ে বেঁধে থাকে। টেন পর্যন্ত পড়েছিল ছেলে– বস্তির নীচু ক্লাসের বাচ্চাদের বাড়িতে টিউশন পড়ায়। মায়ের মন– রোজই বলে, ছেলেটা আমার হাঁটতে পারেনা, আমি মরলে ছেলেটাকে কে দেখবে, ছেলেটা যে না খেয়ে মরবে গো।
খবর পাঠানো হল সেই ছেলে আর মাকে। বেবীদি কড়া গলায় বললেন– দেখো বাপু– কালো বলে, চোখ নষ্ট বলে, হাত বাঁকা বলে কখনো মনে কষ্ট দেবে না তো? মন থেকে রাজি আছো তো?
মা ছেলে কোরাসে– হ্যাঁঅ্যাঅ্যা–
ব্যস– তারপর মিয়া বিবি রাজী তো বুলাও ব্যান্ডপার্টি।
বর হাঁটতে পারেনা কিন্তু বসে বসে কুটনো কুটে দেয়, বউ দোকান বাজার করে রাঁধে বাড়ে। শাশুড়ি বলে–নিঁখুত হাতের বউরাও কেউ এমন যত্নে ভাত বেড়ে দেয়নি গো কোনোদিন। পরে, সুস্থ সবল নাতির দৌরাত্ম্যির গল্পও বুড়ি এসে শোনাত, ফোকলা দাঁত বের করে।
এর পরে– বর বউ-এর অকেজো হাত আর পা-ও আমরা অনেকটা ভালো করার ব্যবস্থা করে দিতে পেরেছিলাম reconstructive surgery -র মাধ্যমে। এই বিরাট কাজ, সম্ভব হয়েছিল যাঁর জন্য- পশ্চিমবঙ্গে– বিনামূল্যে কুষ্ঠরোগীদের অঙ্গ বিকৃতি পুনর্নির্মাণের অপারেশন প্রথম চালু করেছিলেন যিনি, আমাদের শ্রদ্ধেয় স্যর, পরম সুহৃদও বটে — ডাঃ অনিরুদ্ধ কর! তাঁর কথাও কাজ আলাদা ভাবে বলতে হবে একদিন। আপাতত ডা অনিরুদ্ধ করকে প্রণাম জানাই আর সোনামণি রায়কে জানাই ভালোবাসা।
এটুকু নিবেদন– 30th January, National Leprosy Day-তে!!
সুন্দর অভিজ্ঞতা