★
জে বি এস হ্যালডেন সিকল সেল অ্যানিমিয়ার রোগীরা কী ভাবে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ করে তার কারণ বার করেছিলেন। তার জন্য তাঁকে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হলে ম্যালেরিয়ার কপালে চার চার খানা নোবেল হত। তা না হওয়ায় মাত্র তিনটে নোবেল প্রাইজ জুটলো ম্যালেরিয়া বেচারির।
সেই তো এক রস সাহেব পেয়েছিলেন ১৯০২ সালে, ম্যালেরিয়ার প্যারাসাইট মশার অন্ত্রে উপস্থিত থাকে আর মশাই এই রোগের বাহক সেই আবিষ্কারের দরুন। প্যারাসাইট আবিষ্কার যদিও অনেক আগের।
এর বহু বছর পরে ২০১৫ সালে চিনা মহিলা বিজ্ঞানী ইউ ইউ তু, ফ্যালসিপেরাম ম্যালেরিয়াকে জব্দ করার ওষুধ আর্টেমেসিনিন আবিষ্কার করে নোবেল প্রাইজ পেলেন।
এর মাঝে ১৯২৭ সালে ম্যালেরিয়া আর একখানা নোবেল প্রাইজ হাতিয়েছিল। ভুলেই গেছিলাম। মনে পড়াল ঐন্দ্রিলের হ্যালডেন নিয়ে লেখাটা।
আমি ব্যাপারটা জেনেছিলাম একটু তির্যক ভাবে। একটু আগের থেকে শুরু করি। চিরকালের পল্লবগ্রাহিতায় আক্রান্ত আমার একটা নেশা ছিল। কলকাতা ইউনিভার্সিটি আর প্রেসিডেন্সির সামনের ফুটে ডাঁই করে পড়ে থাকা বই উবু হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘাঁটাঘাঁটি করা। আর প্রবল ধ্বস্তাধস্তি করে তার থেকে এক আধটা অতি প্রাচীন বই কেনা। আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা যেহেতু প্রতিমুহূর্তে আপডেটেড হচ্ছে, খুব পুরোনো ডাক্তারি বইয়ের দাম স্বভাবতই কম হত।
আরও একটা কাজ করতাম সেই সময়ে। লাইব্রেরিতে সবাই পড়ছে দরকারি আধুনিক বই আর পেছনের ঘরের গাদামারা বইয়ের তলা থেকে আমি খুঁজে বার করছি একশ দেড়শ বছর আগের বই। কোনও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা নেই এশিয়ার প্রাচীনতম মেডিক্যাল কলেজের লাইব্রেরিতে। পাতা ঝুরঝুরে। ভেঙে যাচ্ছে আঙুলের সামান্যতম চাপে। আমারও সেই জ্ঞান নেই যে এই অমূল্য সম্পদের জন্য ব্যক্তিগত কোনও উদ্যোগ নেব।
সেই বইয়েই ছবি দেখেছিলাম আধুনিক স্টেথোর পূর্বপুরুষদের। লেনেক স্টেথোস্কোপ আবিষ্কার করেছেন বটে কিন্তু তার পরের পরিবর্তন সবেমাত্র অন্যরা করেছেন তারও বেশ কিছুদিন পরে।
দায়িত্বজ্ঞানহীন সেই দিনের আমি, আন্দাজ করতে পারি সেই বইগুলোর কথামাত্রও অবশিষ্ট নেই আজ।
তো সেই ফুটপাথ থেকে ঊনিশশ সাতাত্তর আটাত্তর সালে একখানা তেমনই বই কিনেছিলাম। হয়তো কোনও পুরোনো ডাক্তারবাবুর উত্তরাধিকারীরা ঘর পরিষ্কার করিয়েছেন। বিলিতি সেই বইটা ছিল মেডিসিনের। হোস্টেলে গল্পের বই পড়ার করে পড়তাম।
সেই বইয়ে কী ছিল? সালফাডায়াজিনের কথা বিশদ আশাবাদের সঙ্গে বর্ণিত হয়েছে। সদ্য আবিষ্কৃত এই ওষুধ সব রকম জীবাণু মেরে ফেলতে সিদ্ধহস্ত এই দাবীতে সোচ্চার লেখক। পাঠককে খেয়াল করাই, ফ্লেমিং সাহেবের পেনিসিলিন আসতে তখনও অনেক দেরি। তখনকার আধুনিক চিকিৎসায় অনেক রোগই ওষুধ দিয়ে অনতিক্রম্য বলে ধরা হত। টাইফয়েড, টিবি, সবই। টাইফয়েডের চিকিৎসা ছিল সেবা যত্ন পথ্য।
শোনা কথা, সে আমলে এদেশে তথাকথিত মডার্ন মেডিসিনের বদলে কবিরাজিতে টাইফয়েড সারত বেশি। কারণ আধুনিক ডাক্তার পথ্য দিতেন বার্লি আর কবিরাজের দেওয়া পথ্য ছিল গরম রসগোল্লা। টিবিতেও তাইই, সঙ্গে ছিল আর্টফিশিয়াল নিউমোথোরাক্স, আর্টিফিশিয়াল নিউমোপেরিটোনিয়াম। এখানে প্রসঙ্গত বলি, চল্লিশ বছর আগে আমাদের ইন্টার্নশিপ হাউসস্টাফশিপের সময়েও ওই ঐতিহাসিক যন্ত্র মেডিক্যাল কলেজের চেস্ট ডিপার্টমেন্টে সগৌরবে বিরাজ করত শুধু নয়, ক্বচিৎ ব্যবহারও হত। সেই তখন, যখন চেস্ট আউটডোরে মাস মিনিয়েচার এক্সরে ম্যাগনিফায়িং গ্লাসের পেছনে রেখে টিবি ডায়াগনোসিস হত। দেদার মান্টু টেস্ট। স্পুটাম এক্সামিনেশন? হ্যাঁ, তাও হত। ওষুধ বলতে, স্ট্রেপ্টোমাইসিন, আইএনএইচ আর প্যাস। কোথাও কোথাও প্যাসএর বদলে থায়োসিটাজোন। যাতে স্টিভেন জনসন সিনড্রোম নামের সাইড এফেক্ট ছড়াছড়ি।
কী কথা থেকে কোথায় চলে এলাম। প্রসঙ্গে ফিরি।
আমার কেনা সেই বইয়ে এক আশ্চর্য তথ্য পেয়ে শিহরিত হয়েছিলাম। লন্ডনের রয়াল কলেজ অফ মেডিসিন থেকে কিনতে পাওয়া যায় ম্যালেরিয়া প্যারাসাইট ইমপ্রেগনেটেড মশা। ছবি অনুযায়ী রাখা থাকে জর্দার কৌটোর মত ধাতব পাত্রে, যার একপাশে তারের জাল, যেখান দিয়ে মশা পালাতে পারবে না কিন্তু শুঁড় বাড়াতে পারবে। সেই ম্যালেরিয়াবাহী বুভুক্ষু মশককুল সমেত পাত্রের যে দিকে জাল সেটি চেপে ধরা হবে সিফিলিস রোগীর গায়ে। তাদের কামড়ে রোগীটির ম্যালেরিয়া হবে। তা হলেই কার্যসিদ্ধি। আইডিয়াটা হল তৈরি করা হু হু জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে সেরে যাবে সিফিলিস। কয়েকটা তীব্র জ্বরের এপিসোডের পরে ম্যালেরিয়াটা সারিয়ে নেওয়া যাবে কুইনাইন দিয়ে।
এই যে ম্যালেরিয়া তৈরি করে সিফিলিস সারানো এটি আবিষ্কার করেছিলেন এক সাইকিয়াট্রিস্ট।
পাইরোথেরাপি মানে শরীরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে রোগ সারানোর চেষ্টা বহু আগে থেকেই চলছিল। অস্ট্রিয়ার এক সাইকিয়াট্রিস্ট ডাঃ জুলিয়াস ওয়াগনার-জরেগ (উচ্চারণ ঠিক হল কিনা জানি না) তাঁর নিউরোসিফিলিস রোগীদের সারানোর জন্য এই পদ্ধতি ব্যবহারের চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। ব্যাপার হল নিজের ডাক্তারি কেরিয়ারের শুরুতে তাঁর একজন গভীর সাইকোসিসের রোগীর এরিসিপেলাস নামের তৎকালে প্রায় প্রাণঘাতী এক ইনফেকশনে খুব জ্বর হয়েছিল। যমে মানুষে টানাটানির পর জ্বর কমার পর সেই মেয়ের সাইকোসিস সেরে উঠলো। এই ঘটনার পর ডাক্তারবাবুর ধ্যান জ্ঞান হয়ে উঠল কী করে রোগীদের জ্বর বানিয়ে রোগ সারানো যায়। কী চেষ্টা না করেছেন তিনি! জ্বর বানানোর জন্য টিউবারকুলোসিস অ্যান্টিজেন, টাইফাস আর টাইফয়েডের ভ্যাক্সিন। সমস্ত বিফল প্রচেষ্টা চলতেই থাকল যদ্দিন না ১৯১৭র জুনে বলকান যুদ্ধের একজন আহত সৈনিক যার ম্যালেরিয়া হয়েছিল তাকে ভুল করে ডাক্তারবাবুর সাইকিয়াট্রি ওয়ার্ডে ভর্তি করা হল। প্রথমেই এই রোগীকে ম্যালেরিয়া সারানোর কুইনাইন দিলেন না তিনি। এই রকম ম্যালেরিয়ার রোগী সাইকিয়াট্রি ওয়ার্ডে পাওয়াকে তিনি ভাগ্যদেবীর আবির্ভাব ভাবলেন। সেই রোগীর রক্ত ব্যবহার করে প্রথমে তিনজন আর পরে সর্বমোট নয় জন রোগীকে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত করা হল। সব কজনেরই সেই সময়ের মারণরোগ নিউরোসিফিলিস ছিল। (ও বলতে ভুলেছি, সেই সৈনিককে পরে কুইনাইন দিয়ে সারিয়ে তোলা হল তার রক্ত ব্যবহারের পরে।) যাই হোক, ম্যালেরিয়া তৈরি করা নয় জনের মধ্যে ছয় জন সম্পূর্ণ সেরে গেল। এমন কি তিন জন, যাদের শেষ অবধি ভোগান্তি শেষে কবরে যাবার কথা, তারা নিজেদের কর্মক্ষেত্রে অবধি ফিরে গেল। এই ভাবে একটা অসুখকে আর একটা মৃত্যুসম অসুখের ঘাড়ে চাপিয়ে দ্বিতীয়টাকে সারানোর এই গল্পকথা আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ল। সেটা সন ১৯১৮। নিউরোসিফিলিস রোগীদের জন্য বানানো অ্যাসাইলামগুলোতে আছড়ে পড়ল রোগীর ঢেউ। ইউরোপ আমেরিকা সর্বত্র। সবারই এক দাবী, ম্যালেরিয়া তৈরি করে সিফিলিস সারিয়ে দাও। আর হচ্ছিলও তাই।
যদিও সেই রোগীদের পনেরো শতাংশ মারাই যাচ্ছিল ম্যালেরিয়া আর হেপাটাইটিস সমেত অন্যান্য কমপ্লিকেশনে। কিন্তু পঞ্চাশ শতাংশ সেরেও যাচ্ছিল। মনে রাখতে হবে তখন এদের একশ শতাংশই মারা যাবার কথা যদি চিকিৎসা না হত। এবং কয়েকবার তীব্র জ্বর আসার সাইকল শেষে ভাইভ্যাক্স ম্যালেরিয়া সারানোও সহজ ছিল কুইনাইন ব্যবহার করে।
এবারের নতুন চেষ্টার নাম দেওয়া হল ম্যালেরিয়োথেরাপি। মোদ্দা কথা উঁচু মাত্রার জ্বর বাধানোর জন্য ম্যালেরিয়া রোগীর রক্ত বা প্যারাসাইট ঢুকিয়ে দেওয়া হত সিফিলিস রোগীর শরীরে। মারা যেত ট্রেপোনিমা প্যালিডাম জীবাণু। এবং রোগ সেরে যেত।
এই আশ্চর্য চিকিৎসা আগুন দিয়ে আগুন নেভানোর আবিষ্কারের জন্য ১৯২৭ সালের নোবেল প্রাইজ দেওয়া হল ডাঃ জুলিয়াস ওয়াগনার-জরেগকে।
তো যে কথা বলার সেটা এবার ভয়ে ভয়ে পেশ করি?
এই জ্বর চিকিৎসা কি কাজে লাগানোর কথা ভাবা যায় করোনা দুর্যোগে?
জানি, এখনও অবধি জানা যায়নি এই ভাইরাস শরীরের তাপমাত্রা কত বাড়লে মানে কত জ্বর উঠলে মারা যেতে পারে। আগুন দিয়ে আগুনের সঙ্গে যুদ্ধ একবার সম্ভব হয়েছিল। আবারও যদি!
জানি এভিডেন্স বেসড নয়,
তবুও… তবুও… তবুও… তবুও…দিল মাঙ্গে মোর…।