রোজ একাধিক রোগীর করোনার রিপোর্ট পজিটিভ আসছে। অবশ্য ডায়াগনোসিস হচ্ছে না তার চেয়ে বেশি রোগীর। যাঁদের চার পাঁচ দিনে জ্বর কমে যাচ্ছে, তাঁরা কেউই টেস্ট করাচ্ছেন না। বারবার বলা সত্ত্বেও টেস্ট করতে রাজি হচ্ছেন না। প্রধান কারণ সমাজচ্যুত হওয়ার ভয়। তাছাড়া যেসব দিন আনা দিন খাওয়া মানুষেরা লকডাউনের ফলে এতদিন বাড়ি বসে ছিলেন এবং অর্থনৈতিক ভাবে যাঁদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, তাঁরা আর কাজ কামাই করতে চাইছেন না। জ্বর গায়েই কাজে যাচ্ছেন এবং আরও অনেককে সংক্রমিত করছেন।
এসব সত্ত্বেও আমাদের এখানে মৃত্যুহার নিঃসন্দেহে কম। কয়েকটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু বাদ দিলে প্রায় সকলেই সুস্থ হয়ে উঠছেন। পরীক্ষা কম হওয়ায় এখানে কেসও অনেক কম হচ্ছে। সকল রোগীর পরীক্ষা করতে পারলে কেস নিঃসন্দেহে আরও অনেক বাড়ত এবং মৃত্যুহারও কমত।
এখন প্রশ্ন হল, কেন আমাদের এখানে করোনায় মৃত্যুহার কম? অতি বড় দেশভক্ত মানুষও দাবী করবেন না, আমাদের এখানে চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রথম বিশ্বের দেশগুলির তুলনায় ভালো। আমাদের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর নড়বড়ে অবস্থা আমরা ভালভাবেই টের পাচ্ছি।
হওয়া উচিৎ ছিল উল্টোটাই। অপুষ্টি ও অন্যান্য অনেক রোগে আক্রান্ত আমাদেরই সহজে মরে যাওয়া উচিৎ ছিল। কি রোগ নেই এখানে। ডেঙ্গু তো প্রায় বাৎসরিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। ম্যালেরিয়া, টিবি রোগী বাড়ছে হুহু করে। বর্ষার সময় হেপাটাইটিস, টাইফয়েড, পেটের রোগী ঘরে ঘরে। সেই সব রোগে মৃত্যুহার তেমন কম নয়। বরঞ্চ বাকি পৃথিবীর তুলনায় বেশির দিকে। আমাদের দেশ ডায়াবেটিসেও জগত সভায় শ্রেষ্ঠ হওয়ার দিকে ক্রমশ এগিয়ে চলেছে।
তাহলে সারা বিশ্ব কাঁপিয়ে আসা কোভিড- ১৯ ভাইরাস আমাদের এখানে তেমন সুবিধা করতে পারছে না কেন? এখানেই তো তার তাণ্ডব চালানোর কথা ছিল। ম্যালনিউট্রিশানে ভোগা, নানা রকম রোগে ভোগা, আগে থেকেই আধমরা থাকা আমাদের করোনা ভাইরাস সহজে মারতে পারছে না কেন?
ছোটবেলা থেকেই তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলিতে আমরা যেভাবে আনহাইজিনিক পরিবেশে বেড়ে উঠেছি, আনহাইজিনিক জল পান করেছি, আনহাইজিনিক খাবার খেয়েছি- তা আমাদের ইনেট ইমিউনো সিস্টেমকে নিঃসন্দেহে অনেক জোরদার করেছে। তাছাড়া হাজার গণ্ডা ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, প্যারাসাইট নিয়ে ঘর করায় কোন রোগ যে কার বিরুদ্ধে ক্রস ইমিউনিটি দিচ্ছে তাও বলা মুশকিল।
যাহোক এসব নিয়ে বিশেষজ্ঞরা পরে গবেষণা করবেন। আমি পাতি চিকিৎসক। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকের ভূমিকা পালন করি। সেনাপতি হওয়ার যোগ্যতা নেই। আমি বরঞ্চ আপনাদের একটা গল্প শোনাই।
১৯৪০ সাল। আফ্রিকার জঙ্গলে জঙ্গলে এক সাহেব ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। সেসময় অনেক শ্বেতাঙ্গ মানুষই দলবল নিয়ে আফ্রিকার জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। নির্বিচারে হত্যা করতেন সিংহ, জিরাফ, জেব্রা, বাইসন এবং আফ্রিকান উপজাতির মানুষকেও। আফ্রিকান উপজাতির মানুষরা সেসময় শ্বেতাঙ্গ মানুষদের কাছে জংলী জানোয়ারের চাইতে বেশি মর্যাদা পেত না।
কিন্তু এই সাহেব অন্যদের থেকে আলাদা। তিনি জঙ্গলের মধ্যে বিভিন্ন উপজাতি মানুষদের গ্রামে ঘুরে বেড়ান। অসুস্থদের চিকিৎসা করেন। সারিয়ে তোলেন। সাহেব ইংল্যান্ডের মানুষ। তাঁর নাম জে বি এস হ্যালডেন। নামটা খুব চেনা চেনা লাগছে, তাই না? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। এনার নামেই একটি রাস্তা আছে কোলকাতায়। যে রাস্তাটি ইস্টার্ন বাইপাসকে পার্ক সার্কাসের সাথে যোগ করেছে।
তবে হ্যালডেন সাহেবকে উপজাতির কম বয়সী ছেলে মেয়েরা যমের মতো ভয় পেত। জ্বর আসলেই তিনি মোটা একটা সিরিঞ্জ নিয়ে রক্ত নিতে আসতেন। তারপর সেই রক্ত স্লাইডে নিয়ে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের তলায় রেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কীসব দেখতেন।
হ্যালডেন সাহেব সারা জীবন ধরেই অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত গবেষণা করেছেন। কিন্তু আফ্রিকার উপজাতিদের মধ্যে তাঁর গবেষণা চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ও জেনেটিক্সের ক্ষেত্রে একটি মাইলস্টোন। তাঁর গবেষণার বিষয় বস্তু ছিল ম্যালেরিয়া নিয়ে। আফ্রিকায় তখন ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ায় প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ উপজাতির মানুষ মারা যায়। হ্যালডেন সাহেব তাঁদের মধ্যে চিকিৎসার কাজ করতে করতে এক অদ্ভুত পর্যবেক্ষণ করলেন। কিছু কিছু জনগোষ্ঠীর মানুষ ম্যালেরিয়ায় অনেক কম আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু তাঁদের মধ্যে আবার সিকেল সেল অ্যানিমিয়া বলে এক ধরণের অ্যানিমিয়ার প্রাদুর্ভাব বেশি।
সিকেল সেল অ্যানিমিয়া রোগীদের লোহিত কণিকায় অক্সিজেনের অভাব হলে তারা কাস্তে বা সিকেল আকৃতির হয়। হ্যালডেন সাহেব পর্যবেক্ষণ করলেন, যারা এই রোগের ক্যারিয়ার তাদের লোহিত কণিকা স্বাভাবিক হলেও ম্যালেরিয়ার জীবাণুর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পরে তা কাস্তের আকৃতি হয়ে যায়। এবং জীবাণু সহ লোহিত কণিকাটি পিলের মধ্যে আটকে যায় ও ধ্বংস হয়ে যায়।
এখান থেকে হ্যালডেন সাহেব ধারণা করেন হাজার হাজার বছর ধরে ম্যালেরিয়ার সাথে বসবাস করতে করতে এই সব উপজাতির মানুষদের মধ্যে সিকেল সেল অ্যানিমিয়ার জিন এসেছে। এবং এটা ডারউইনের থিয়োরি অনুযায়ী ন্যাচারাল সিলেকশন।
পরবর্তী কালে এরকম আরও অনেক রোগ পাওয়া গেছে, যা অন্য রোগকে প্রতিরোধ করে। যেমন সিস্টিক ফাইব্রোসিস রোগীদের যক্ষ্মা হয়না। কুষ্ঠ আক্রান্ত রোগীদের কখনও সোরিয়াসিস বলে একটি চর্মরোগ হয়না।
অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের আগে যখন আফ্রিকায় ইউরোপিয়ানরা কলোনি গড়ে তুলছে, তখন তাদের মধ্যে সিফিলিস মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। পেনিসিলিন আবিষ্কার হবে আরও দেড়শো বছর পরে। ইউরোপিয়ান সৈনিকরা খেয়াল করেছিল যাদের ম্যালেরিয়া হচ্ছে এবং বরাত জোরে ম্যালেরিয়ার থেকে বেঁচে ফিরছে তাদের সিফিলিস সেরে যাচ্ছে। একাধিক সৈনিকের ক্ষেত্রে এই পর্যবেক্ষণ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
এর প্রকৃত কারণ বলা মুশকিল। তবে একটা কারণ হতে পারে সিফিলিসের জীবাণু ট্রিপোনেমা প্যালিডাম বেশি উষ্ণতায় বাঁচে না। ম্যালেরিয়া জ্বরের সময় দেহের উষ্ণতা মাঝে মাঝেই ৪০ – ৪২ ডিগ্রী সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়। সেই যুগে ম্যালেরিয়ারও নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা ছিল না। ফলে জ্বর চলতো দীর্ঘদিন ধরে। শরীরের মধ্যে থাকা সিফিলিসের জীবাণু এই উচ্চ তাপমাত্রায় মারা পড়ত।
হ্যালডেন সাহেব বামপন্থায় বিশ্বাসী হওয়ায় ইংল্যান্ড ত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং শেষ জীবনে তিনি ভারতে নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। কলকাতা ও উড়িষ্যাতে তাঁর বাকি জীবন কাটান। সেসময় তাঁর কাজকর্ম নিয়ে পরে লেখা যাবে। আপাতত করোনার দিনে ফেরত আসা যাক।
মোদ্দা কথা কোন রোগ যে কোন জনগোষ্ঠীকে কিভাবে আক্রান্ত করবে তা আগে থেকে বলা মুশকিল। যেমন বলা মুশকিল এই মহামারীর শেষ কোথায়। আমাদের বোধহয় এবার করোনা ছাড়াও অন্য রোগ নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। অন্যান্য রোগের চিকিৎসা বড় বেশি অবহেলিত হচ্ছে। একজনের দু’সপ্তাহের জ্বর কমছিল না। করোনার রিপোর্ট করেই এসেছিলেন। নেগেটিভ। রক্তের স্লাইডেই ধরা পড়ল ভাইভ্যাক্স ম্যালেরিয়া। টুক টুক করে ডেঙ্গু রোগীও আসতে শুরু করেছে। ২০১৭ সালের ডেঙ্গু মহামারীর সময়ে চিকিৎসার অভিজ্ঞতা আছে। সেই মহামারীর মর্টালিটি নিঃসন্দেহে অনেক বেশি। কোমর্বিডিটি ছাড়াই অনেক কমবয়সী রোগীকে চোখের সামনে খারাপ হয়ে যেতে দেখেছি। ভগবান করুন তিন বছর আগের মতো ডেঙ্গু মহামারী না হয়। কিন্তু যদি হয়? আমরা লড়তে পারব এই পরিকাঠামো নিয়ে?