একটি জৈবিক কেচ্ছা লিখবো। কেচ্ছা কাহিনী লেখার জন্য অবশ্য যে ধরনের ভাষার দখল দরকার সেটি আমার নেই। ভরসা – নিজের ভাষায় সোজাসাপ্টা লেখা। আরো বড় কথা – কেচ্ছা আবার আমার নিজেকে নিয়েই! কতকটা হয়তো মানুষকে নিয়েও!
সব মানুষই জীবনে কখনো না কখনো খানিকটা দার্শনিক হয়ে ওঠে। তখন গভীর বোধোদয় হয়। তখন সামাজিক বা আধ্যাত্মিক চিন্তা চেতনা বদলে যায়। কখনো কখনো অবশ্য এতে গাঁজা, ভাং, ইত্যাদির এফেক্টও থাকে।
একজন আমাকে বলেছিলেন- এইরকম সময়ে নাকি এমন অবস্থাও হয় যে- ছাগল আর রবীন্দ্রনাথ গুলিয়ে যেতে পারে!!! ভাগ্যিস- আমার সেটা হয় না।
আমার আবার কোনদিনই অতটা গম্ভীর ভাব আসে না। গত দুদিন ধরে তাও জানি না কেন খানিকটা সময় ভেবেছি- আমি কি করছি? কেন করছি? কি আমার সাফল্য বা ব্যর্থতা? কি কি করতে পারতাম?
তার খানিক পর ই নিজেকে কয়েকটা গাল দিয়েছি। কয়েক পেগ গিলেছি। নেশা হয়নি।
অবশেষে বুঝেছি- আমি যা দেখি বা দেখতে চাই- সব সময়ই দেখতে পাই!
আলাদা করে দার্শনিক হবার ভান করার দরকার নেই। মানসিক শান্তির জন্য আধ্যাত্মিক গুরু খোঁজারও দরকার নেই। আমি যা করছি, সেটা খুউউব সামান্য কাজ। সেটা করছি – কারণ আমার পেটে খিদে পায়। সকালে টয়লেটে যেতে হয়।
আমার সাফল্য- আমি আমার কাজ করার ইচ্ছে হারিয়ে ফেলি না।
আমার ব্যর্থতা- আমি এখনো আঘাত পাই, এবং গলা ছেড়ে কাঁদি।
কি কি করতে পারতাম? – জানি না। তবে স্কুল শিক্ষক হতে পারতাম- এই বিশ্বাস ক্লাস নাইনে যেমন ছিল আজো আছে। অন্য কিছু হতে পারতাম- এই ভাবনা ভেবে সময় নষ্ট করি না।
আশেপাশের নোট ভোট জোট ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে আমার মতামত কোন কাজে লাগবে না বলেই- ও পথে যাচ্ছি না। আরো ভয় আছে- কখন কোন দল আবার প্রার্থী লিস্টে নাম তুলে দেবে কে জানে! প্রার্থীর যা আকাল পড়েছে!
আমি বাবা কেউটে গোখরো- কোনোটাই নই। নিতান্তই শব্দ ও শব্দার্থ বেচে খাই।
এই যে দেখুন, এখুনি ভুল ভাবলেন! শব্দ বেচে খাই বলতেই আবার ভাবলেন ভুলভাল লেখালেখি বিক্রি করে বুদ্ধিজীবী হয়ে গেছি!
ওসব কিছুই না। শব্দ বেচে খাই বটে, তবে এ শব্দ না কাগজে ছাপা হয়, না কানে শোনা যায়!গ্যাঁজাবো না। আমি যে শব্দ বেচে খাই- সেটি মানুষের শ্রবণশক্তির যে রেঞ্জ আছে, তার বাইরে!
ভাগ্যিস। মানে- আল্ট্রাসাউন্ড! মানে, যে শব্দ বেচে খাই, সেটি আমিও শুনতে পাই না!
না, এতে আবার অলৌকিক কিছু খুঁজবেন না যেন, এ শব্দ কানে না শুনলে কি হবে, এ শব্দ যে আছে, এ শব্দ যে সব কিছুকেই দৃশ্যমান করে তোলে, সেই দৃশ্যমান ছবি তুলে বিক্রি করাই আমার কাজ। হ্যাঁ, আমি বিক্রি করি সেই ছবি। পেটের দায়ে।
বলা যায়- টয়লেটের কাছে আজন্ম যে ধারদেনা করে রেখেছি- প্রতিদিন সুদে আসলে সেটি শোধ করার জন্যই এই শব্দ বিক্রির কাজ করি। গর্বিত হবার জন্য নয়।
প্রতিদিন সকালে একবার করে টয়লেটে গিয়ে সেই শব্দজাত ছবি বিক্রির কষ্টার্জিত উপার্জন কমোডে ফ্ল্যাশ টিপে দিয়ে ফের দোকান খুলে শব্দ ও শব্দার্থ মানে ছবি বিক্রি করতে লেগে পড়ি।
এই ফাঁকে বলে রাখি- বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময় আমার কাজ করার জন্য যে দশ ফুট বাই দশ ফুট রুম ছিল- আমরা তার নাম রেখেছিলাম – কমলা স্টুডিও!
সার্থক এই নামকরণ!
বলে রাখা ভালো, ডাক্তার, অতএব ‘মানুষের জন্য কাজ করি’- এই বাক্যবন্ধটি সযত্নে এড়িয়ে যাবারও কারণ আছে।
কেউ দুম করে চাটার্ড বিমানে তুলে নিলে আমার একলা বউয়ের কি হবে- এই দুঃশ্চিন্তা আছে!
নো মোর ন্যাকামি। বলেই ফেলি- আমি স্রেফ এমডি ডিগ্রীধারী রেডিওলজিস্ট। গালভরা ডিগ্রী নিয়েও আদতে একটি অপদার্থ। রেডিওলজি নিয়ে নিজের জ্ঞানের কথা ভুলেও প্রকাশ্যে আনবো না- বলাৎকার হয়ে যাবার ভয়ে।
দুঃখের কথা- রেডিওলজির কয়েকটি মডালিটির মধ্যে এখন বেশিরভাগ সময় কাটে এই শব্দ নিয়ে।
মানে আল্ট্রাসাউন্ড নিয়ে। শব্দ আমাকে বেচতেই হয়।
আমার ফেস ভ্যালু নেই, ডায়ালগের ভ্যালু নেই, স্লোগানের ভ্যালু নেই, পতাকার ভ্যালু নেই- অতএব শব্দই ভরসা।
ভরসা এটাই- শোনা যায় না বলে- এ শব্দ নিয়ে কারো মাথাব্যাথা নেই তেমন। এ শব্দে প্রেমিকা রেগে যায় না, আহ্লাদে গদগদ হয় না, কিস টিস কিস্যু দেয় না! তাই, কান পেতে লাভ নেই!
এ শব্দে কারো ঘুম ভাঙ্গে না, ভোট পাওয়া যায় না, দল বদলের লাভ পাওয়া যায় না, সাম্প্রদায়িক অসাম্প্রদায়িক বিভাজন হয় না, দাঙ্গা লাগে না!
দৈববাণী কখনো শুনিনি। সে কি এই শব্দের মতোই? জানি না। তবে আমার মাঝে মাঝে মনে হয়- এ শব্দ কোন সৃষ্টিকর্তা অব্দি শুনতে পায় না!
মানুষই যখন শুনতে পায় না, তখন মানুষের সৃষ্টি করা কেউ এ শব্দ যে শোনে না, সেটি বলাই যায়।
মন্দির মসজিদ গির্জা প্যাগোডা- কোথাও এ শব্দ পাওয়া যায় না! গীতা কোরান বাইবেল ত্রিপিটক গ্রন্থসাহেব কোন কিছুই এ শব্দে লেখা হয়নি!
একটা আজব ব্যাপার বলি- আমি এই শব্দের যে রূপ ব্যবহার করি, সেটিকে বলা যায় শব্দছুরি! মানে এ শব্দ যে যন্ত্র থেকে যেভাবে বেরোয় সেটির তুলনা চলে একমাত্র ধারালো ছুরির সঙ্গে।
হ্যাঁ ছুরি। আমি সেই ছুরি দিয়ে নির্দ্বিধায় কেটে চলি মানুষের শরীর। পা থেকে শুরু করে মাথা অব্দি! না, কিচ্ছু বাদ দিই না!
লজ্জাটজ্জা অনেক আগেই টয়লেটে ফ্ল্যাশ করে দিয়েছি। আমি কেটে চলি গর্ভবতী মা আর অনাগত সন্তানের নরম তুলতুলে শরীর। একসাথে।
মাঝে মাঝে মনে হয়- পৃথিবীর কাঁদা গায়ে না মাখা একমাত্র অনাগত সন্তানই হাত পা ছুঁড়ে এই কসাইগিরির প্রতিবাদ করে। বাকিরা চুপচাপ থাকে যেমন বলি।
আমি হেসে ফেলি। মনে মনে বলি- একবার বাইরে আয়। দেখবি তোর এই হাত পা কেউ না কেউ ঠিক বেঁধে দেবে ! বলা যায় না- হয়তো তুইও একদিন আমার মতো কসাইই হবি! বা কাটা পড়বি।
আমি পরের পর মানুষের শরীর কেটে চলি।
অসংখ্য মানুষ লাইন দিয়ে থাকে তবুও। আমার সকাল দুপুর বিকেল সন্ধ্যা কেটে যায় কেটে কেটে।
আমি রাতে ঘুমের মধ্যেও নাকি এই একই কাজ করি- এটা আমার হিংসুটে বউয়ের দাবি।
আমি কাটা অংশের ছবি তুলে রাখি যত্ন করে!
পেপারে ছেপে দিই সেই ছবি হ্যাঁ টাকার বিনিময়ে!
আমি হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ শিখ, ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র, পুরোহিত মৌলবী পাদ্রী, আস্তিক নাস্তিক,
বাঙালি অবাঙালি, ধনী গরীব, মুচি মেথর, ফর্সা কালো, সুন্দর অসুন্দর, সিপিএম তৃণমূল বিজেপি কংগ্রেস নির্দল, সব পেশা নেশার মানুষের শরীর কেটেছি অবলীলায়।
আমি কাটতে কাটতে দেখেছি- স্লাইস ধরে ধরে দেখেছি নিখুঁত ভাবে – সব এক! মগজে এক, ফুসফুসে এক, হৃদয়ে এক, রক্তে মাংসে নালীতে হাড়ে স্নায়ুতে- সব এক! দেখেছি- যখন আমার শব্দছুরি ফালাফালা করে দিয়েছে- মানুষের পেট খাদ্যনালী, লিভার, কিডনি, যৌনাঙ্গ। দেখেছি- শালা রা সব এক! সব শালার জৈবিক কেচ্ছা এক- আমার মতো!! সব ব্যাটা বেটির পেটে বোঝাই খাবার, গ্যাস, প্রস্রাব আর গু অব্দি এক রকম দেখতে!!
এঁদের অসুখ এক রকম! এঁদের দুঃখ কষ্ট এক রকম! এঁদের হাসিমুখ এক রকম!
এক শালারও শরীরের কোথাও মন্দির মসজিদ গির্জা প্যাগোডা, জাত পাত ধর্ম বর্ণ, ফর্সা কালো, সিপিএম তৃণমূল বিজেপি কংগ্রেস, মুচি মেথর সাফাই কর্মী- কিছু নেই!!
না, কিচ্ছু নেই!!
নিজেকে প্রশ্ন করি- কিচ্ছু থাকার কথা ছিল কি??
কখনো অন্য কিছু ছিল কি?? কোনদিন অন্য কিছু থাকবে কি??
না! সম্ভব নয়!
বলে রাখি- এর আগে আমি আসল ছুরি কাঁচি দিয়ে সত্যি সত্যি মানুষের শরীরও কেটেছি!
অ্যানাটমি পড়াতাম।
কিছু আলাদা ছিল না!!
অবাক হই- যখন দেখি এই মানুষগুলোই আমার কমলা স্টুডিও ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গিয়ে সব দলে দলে ভাগ হয়ে যায়!!
সত্যি বলছি- এই একটি আমার ব্যর্থতা হয়তো। এসব দেখে আমি আঘাত পাই। আমি কাঁদি। ফের নিজেকে বোঝাই- এঁরাও হয়তো আমার মতোই পেটের ভাত জোগাড়ের জন্য আর টয়লেটের ধার শোধ করার জন্য এক একটি জৈবিক কেচ্ছার শিকার!
সেই কেচ্ছার নাম কি জীবন? কে জানে!
এই শব্দ বিক্রি করতে করতে আরো কয়েকটা জিনিস শিখেছি। মানুষকে যত পারো কাটো, রক্ত ঝরিও না। মানুষকে কাটো- ছবি তোলো- বিক্রি করো- কোথাও তবু জাত পাত ধর্ম বর্ণ লিখে রেখো না!
মানুষকে কাটো- তারপর বলো- তোমার শব্দছুরি শরীরের কি কি খারাপ বা ভালো জিনিস দেখতে পেয়েছে! মানুষকে কাটো- তারপর বলে দাও- আপনার শরীরে বাসা বেঁধেছে অসুখ। তাড়াতাড়ি দূর করার চেষ্টা করো।
আমি দেখেছি- জাত পাত ধর্ম বর্ণ দল মত পথ নির্বিশেষে মানুষের শরীরে এই শব্দ যেখানে আটকে যায়, ফিরে আসে আমার কাছে- সেটাই সাদা। আর যেখানে না আটকে বেরিয়ে যায়, যে শব্দ আমার কাছে ফিরে আসে না- সেটি কালো। না, আর কোন রং ঢং নেই!
তা বলে কি কোথাও ভুল করে না আমার ছুরি? কোথাও অসহায় হয়ে পড়ে না??
পড়ে। এ ছুরি শক্ত হাড়ে আটকালে আমি বুঝতে পারি। সমস্যা হয় না। কিন্ত একমাত্র অসহায় হয়ে পড়ি তখন, যখন এ ছুরি পেরোতে পারে না- হাওয়া তথা গ্যাসের ভেতর দিয়ে!!
আমি শিখেছি- এই হাওয়া মানে গ্যাসই মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বড় ব্যবধান তৈরি করে! কি সামাজিক, কি অর্থনৈতিক, কি রাজনৈতিক কি সাংসারিক জীবনে- এই গ্যাস বা হাওয়াই একমাত্র শত্রু। আমার। সব মানুষের। সব সমাজের। সব দেশের।
সব কেচ্ছার পেছনে কোন না কোন হাওয়াবাজির গল্প। এই জৈবিক কেচ্ছার শিকার হয়ে আমার জীবন চলছে। হয়তো আপনারও।
দার্শনিক হতে গেলে- হাওয়াবাজিটা শুধুমাত্র টয়লেটে করতে হবে- এটাও বুঝতে পারছি।
মানুষ বুঝবে কি??