যুবকটির বয়স আমার থেকে বছর পাঁচেক কম। দেখে আরো কম মনে হচ্ছে। বেশ জমকালো চেহারা। হাতের গুলি টুলি দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায় নিয়মিত বারবেল ডাম্বেল না ভাঁজলে ও জিনিস হয়না।
আমি খুপরিজীবি পেটুক চিকিৎসক। ভোর ভোর ডবল ডিমের অমলেট আর তিন পিস মাখন লাগানো পাঁউরুটি খেয়ে রোগী দেখা শুরু করি। চেম্বারের ফাঁকে ফোঁকরে রসগোল্লা বা নলিনী না খেলে ক্যালরির অভাব বোধ করি।
ব্যায়াম করা লোকজন দেখলে বেশ হিংসা হয়। আহা, আমারও যদি এমন বাইসেপ-ট্রাইসেপ থাকতো!! অনেকবার ইচ্ছে হয়েছে একটু জিমে গিয়ে যন্ত্রপাতি নাড়াচাড়া করি। ঘাম ঝড়াই।
কিন্তু সেসবে অনেক হ্যাপা। যেরকম ডায়েট করতে হবে, তাতে ডিপ্রেশনে কাজকর্ম মাথায় উঠবে। এমনিতেই লকডাউনের সৌজন্যে ডিপ্রেশন প্রায় মহামারীতে পরিণত হয়েছে। রোগীর সংখ্যা আরেকজন বাড়ানো রীতিমতো সামাজিক অপরাধ।
যুবকটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ভাই, কি হয়েছে?’
‘হয়েছে তো মুখের ভেতর। মাস্কটা খুলতে হবে… খুলবো?’
যুবকটি মাস্ক খুললেন। হাঁ করলেন। আমি টর্চ জ্বেলে উঁকি মারলাম। মুখের ভেতর এক ধারে সাদা ঘা। সন্দেহজনক… অত্যন্ত সন্দেহজনক।
বললাম, ‘কী করে হলো? আপনি তো অত্যন্ত স্বাস্থ্য সচেতন। ধূমপান করেন নাকি?’
‘না না। বিড়ি সিগারেট খেলে দম কমে যায়। শরীর ভেঙে যায়। ওসব আমাদের লাইনে একেবারে নিষিদ্ধ।’
‘তাহলে?’
যুবকটি কাঁচুমাচু মুখ করে বললেন, ‘ওই একটু খৈনী মুখের ভেতর রেখে দিতাম। ওতে নাকি দমের সমস্যা হয় না। হার্টেরও ক্ষতি হয় না। ঘা টা হয়েছে মাস দুয়েক। দোকান থেকে কিনে মলম লাগিয়েছি। অনেক ভিটামিন ট্যাবলেট খেয়েছি। কিছুতেই কমছে না।’
আর ভিটামিন! বললাম, ‘এতোদিন ধরে ঘা রয়েছে, এবারে একটা বায়োপসি করা উচিৎ। আর একজন নাক কান গলার ডাক্তারবাবুকে দেখানো উচিৎ।’
ব্যায়ামবীরের দুচোখ ভরা জল। বললেন, ‘বায়োপসি মানেই তো ক্যান্সার। আমার ছোট্ট একটা মেয়ে আছে। স্ত্রী কিছু করে না। আমার যদি কিছু হয়ে যায়…’
এসময় বড্ড অসহায় লাগে। মিনমিন করে বলার চেষ্টা করি, ‘আপনি এখনই খারাপটা ভাবছেন কেন?’
‘ডাক্তারবাবু, আপনি একবার চেষ্টা করে দেখুন না। যদি দামী ভিটামিন টিটামিন লিখে দেন।’
আমি ঘাড় নাড়লাম, ‘কমবে না। কমার হলে এতদিনে কমে যেতো। ভিটামিন না খেলেও কমতো।’
মুখগহ্বরের আলসারটির বায়োপসি এবং হিস্টোপ্যাথলজিকাল পরীক্ষা লিখে যুবকটিকে বিদায় করলাম। একজন মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ ভদ্রলোক খুপরিতে ঢুকলেন। বললেন, ‘ডাক্তার ভৌমিক, আমাদের কোম্পানির অমুক ভিটামিনের অনেক স্টক জমে রয়েছে। যদি একটু লিখে দেন। এতে আছে ভিটামিন সি, ডি আর জিংক।’
আবার ভিটামিন ট্যাবলেট! তাও এরকম আজব কম্বিনেশনে! করোনার সৌজন্যে বেশ কিছু আজব আজব চিকিৎসা পদ্ধতির সাথে পরিচিত হয়েছি। তাই কিছুতেই বিচলিত হই না।
ভদ্রলোক বলে চলেছেন, ‘এটা কোভিড রোগীদের জন্য একেবারে আদর্শ কম্বিনেশন।’
বললাম, ‘কোভিড রোগী তো একেবারেই কমে এসেছে।’
ভদ্রলোক বললেন, ‘কোভিড ছাড়াও আপনি ইমিউনো বুস্টার হিসেবে যে কোনো জ্বরের রোগীকে দিতে পারেন। তাছাড়া ডায়াবেটিস, হার্ট ডিজিজ, আর্থ্রাইটিস এইসব ক্রনিক অসুখের রোগীদেরও দিতে পারেন।’
বাপরে, এ ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা অত্যন্ত খারাপ। ক্রনিক অসুখে এইসব লিখলে রোগীরা আসল ওষুধপত্র বন্ধ করে ভিটামিন ট্যাবলেটই মহানন্দে খান।
ভদ্রলোক বলেই চলেছেন, ‘তাছাড়া এক মাসের ওষুধের সাথে কোম্পানি একটি এন ৯৫ মাস্ক দিচ্ছে একেবারে বিনামূল্যে।’
কী দিনকাল পড়েছে। ওষুধের সাথেও ফ্রি এর গাজর। মহামারীর শেষে টিকে গেলে হয়তো দেখবো এক বাক্স প্যারাসিটামলের সাথে একটা থার্মোমিটার ফ্রি।
মহামারীর সময়ে ওষুধ কোম্পানিগুলো ভিটামিনের ভালোই ব্যবসা করেছে। যাঁদের সাধ্য আছে, তাঁরা দেদার ভিটামিন খেয়েছেন। সাথে গরম জল, পাতিলেবু, রসুন, মধু, এলাচ, দারচিনি ইত্যাদিও খেয়েছেন। এখনো খেয়ে চলেছেন। এটাও এক রকমের নেশা। সুস্থ থাকার নেশা। তবে আদৌ স্বাস্থ্যকর নেশা নয়।